শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি

ফোরকান উদ্দিন আহমদ

আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা একটি স্বীকৃত বিষয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। যদিও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে সমাজের বহুমাত্রিক ভাবাদর্শের ওপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল অর্থ উপার্জন না ব্যক্তির চরিত্রের বিকাশ, তা এখনও অনেকের বিতর্কের বিষয়।

এটাই স্বাভাবিক, সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের মানুষ থাকার কারণে শিক্ষার অর্থ এবং সংজ্ঞায় থাকবে নানা বৈচিত্র্য। চলমান এ বিতর্কের সহজে অবসান না হলেও এটা নানাভাবে প্রমাণিত যে, শিক্ষা এবং উন্নয়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গী। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানত যে বিষয়গুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে- মানবসম্পদ, প্রকৃতিক সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। তাই শিক্ষার মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। দেশের জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করার জন্য প্রয়োজন একটি শিক্ষিত জাতি। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে দেশের সব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রথম সোপান। তাই জাতীয় অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষিত জাতি গঠনের মূল ভিত্তি।

মানুষকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মানবসম্পদের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সঠিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং যথাযথ প্রযুক্তি নির্দিষ্টকরণ ও প্রয়োগের জন্য দক্ষ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান, সৎ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদের প্রয়োজন। আর দেশের জনসম্পদকে মানবসম্পদে রূপান্তর করাতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এতই জটিল রূপ দেওয়া হয়েছে এবং এতে ক্রমাগত এত পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে যে এ সম্পর্কে কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা নিয়ে চলা দুঃসাধ্য। গ্রামে এবং শহরে অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ এখন ইংলিশ ভার্সনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এরই মধ্যে কেবল ইংলিশ ভার্সন নিয়ে নতুন অনেক প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি ইংলিশ ভার্সনের এ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রেখেছে। এর দ্বারা শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারার এই বিভাজনকে নতুন করে বেগবান করা হচ্ছে। এ-লেভেল, ও-লেভেল সরকার যে হাত দেবে তা মনে হয় না। এক শ্রেণির অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আমলা, পুঁজিপতি ও এনজিওপতির মধ্যে এখন ইংরেজির প্রতি অন্ধ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। দশ, বিশ, কী ত্রিশ বছর পরে বাংলাদেশে শিক্ষার এবং শিক্ষার মাধ্যমের অবস্থা কী দাঁড়াবে? ততদিনে আমাদের রাষ্ট্রই বা কী প্রকৃতি লাভ করবে? রাষ্ট্র কি গড়ে উঠবে? রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানকালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের স্পিরিটের ধারাবাহিকতায় এগোবার কোনোপ্রবণতা তো খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের মনে হয়, যেখানে বাংলা মাধ্যম নিকৃষ্ট, সেখানে এই ইংলিশ ভার্সন অবশ্যই নিকৃষ্টতর হচ্ছে। ইংলিশ ভার্সনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ভালো হতেই পারে না। যে অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে তাতে বাংলা মাধ্যমও নিম্নগামীই থাকবে।

এ ব্যাপারে অভিভাবকদের বিবেচনাশীল হওয়া উচিত। বাঙালি-সন্তানের প্রথম ভাষা বাংলা, দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি; যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে এ দুটো ভাষাই শিখতে হবে। তবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে রাখতে হবে কেন্দ্রীয় অবস্থানে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি দ্বারা চলমান ভাষা ও সংস্কৃতি-পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে এখন শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের বেলায় কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত বাংলাদেশ-উপযোগী করে পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের উন্নয়নে। পাঠ্যপুস্তকের বেলায় জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য।

শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। সেই পরিবর্তন বা সংস্কার হতে পারে- সাধারণ শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষা, ধর্মীয় নৈতিক বোধের শিক্ষা, ক্রিয়া ও সংস্কৃতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সিভিল ডিফেন্স।

উপরিউক্ত বিভাগের জন্য যথাযথ মানের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমন- সাধারণ শিক্ষার জন্য সাধারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ধর্মীয় মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়ার ব্যবস্থাকে নতুনরূপে ঢেলে সাজানো যেতে পারে।

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা প্রচলিত। তার সঙ্গে কারিগরি, প্রকৌশলী, ডাক্তারি, ভোকেশনাল ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। তাবে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ যুবক বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। যেখানে বাংলাদেশে তার পরিমান মাত্র ১% এর কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যে উন্নীত করা হয়েছে, তার মধ্যে কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আছে অর্থনৈতিক সংকট ও কর্মসংস্থানের অভাব। তাই আর বিলম্ব না করে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিশ্বের জাতিসমূহের উন্নয়ন ও প্রগতির ধারার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষাকে জীবনমুখী করে তোলার সময় এসেছে। জাতীয় প্রতিভার অপচয় আর অর্থনৈতিক প্রশ্ন বিবেচনায় এনে আমাদের ব্যাপারে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। এ অপরিহার্য কেবল কারিগরি শিক্ষার জন্যই। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সাধারণ সনদপত্র নয় বৃত্তিমুলক শিক্ষা লাভ করে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাহলে জাতি অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে। বাঁচবে দেশ। সার্থক হবে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা। আমরা একটি উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

শিক্ষানীতি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এর আগে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে তা নির্ধারণে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল সরকার। কিন্তু ওই শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো দীর্ঘ সময়েও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে ভাগ করে দুটি আলাদা অধিদপ্তর যথাক্রমে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর করার কথা ছিল শিক্ষানীতিতে। কিন্তু সেটি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সেক্ষেত্রেও সংকট ও টানাপোড়েন চলছে। সেটা যেভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। মান, কাঠামোগত পরিবর্তন ও আধুনিকতা সবটাকেই প্রাধ্যান্য দিয়ে একটি সমন্বিত ও অভিন্ন ধারা চালু করা এ মুহূর্তে প্রয়োজন।

শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভর্তি নীতিমালা বাস্তবায়ন, যথাসময়ে ক্লাস শুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ৬০ দিনে ফল প্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করে ঝরেপড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ মহূর্তে কারিকুলাম প্রণীত হলেও তা মানসম্মত হতে সময়ের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আপাতত হলেও একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনাকে মেনে নিয়ে ক্রমান্বয়ে তা গ্রহণ বর্জন এবং ট্রায়াল ও এরর মেথড ভিত্তিতে একটি মানসম্মত কারিকুলাম জাতিকে উপহার দেয়া সম্ভব হবে। মানসম্মত কারিকুলাম ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কাজেই দিন-রাত পরিশ্রম করে হলেও আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের এ কাজে আরো বেশি মনোযোগী এবং তৎপর হতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

শুক্রবার, ০৫ নভেম্বর ২০২১ , ২০ কার্তিক ১৪২৮ ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি

ফোরকান উদ্দিন আহমদ

আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা একটি স্বীকৃত বিষয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়া। যদিও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ভর করে সমাজের বহুমাত্রিক ভাবাদর্শের ওপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল অর্থ উপার্জন না ব্যক্তির চরিত্রের বিকাশ, তা এখনও অনেকের বিতর্কের বিষয়।

এটাই স্বাভাবিক, সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের মানুষ থাকার কারণে শিক্ষার অর্থ এবং সংজ্ঞায় থাকবে নানা বৈচিত্র্য। চলমান এ বিতর্কের সহজে অবসান না হলেও এটা নানাভাবে প্রমাণিত যে, শিক্ষা এবং উন্নয়নের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গী। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানত যে বিষয়গুলোর প্রয়োজন হয় সেগুলো হচ্ছে- মানবসম্পদ, প্রকৃতিক সম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। তাই শিক্ষার মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। দেশের জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করার জন্য প্রয়োজন একটি শিক্ষিত জাতি। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে দেশের সব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রথম সোপান। তাই জাতীয় অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষিত জাতি গঠনের মূল ভিত্তি।

মানুষকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মানবসম্পদের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সঠিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং যথাযথ প্রযুক্তি নির্দিষ্টকরণ ও প্রয়োগের জন্য দক্ষ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান, সৎ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদের প্রয়োজন। আর দেশের জনসম্পদকে মানবসম্পদে রূপান্তর করাতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এতই জটিল রূপ দেওয়া হয়েছে এবং এতে ক্রমাগত এত পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে যে এ সম্পর্কে কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা নিয়ে চলা দুঃসাধ্য। গ্রামে এবং শহরে অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ এখন ইংলিশ ভার্সনের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। এরই মধ্যে কেবল ইংলিশ ভার্সন নিয়ে নতুন অনেক প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি ইংলিশ ভার্সনের এ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রেখেছে। এর দ্বারা শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারার এই বিভাজনকে নতুন করে বেগবান করা হচ্ছে। এ-লেভেল, ও-লেভেল সরকার যে হাত দেবে তা মনে হয় না। এক শ্রেণির অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আমলা, পুঁজিপতি ও এনজিওপতির মধ্যে এখন ইংরেজির প্রতি অন্ধ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। দশ, বিশ, কী ত্রিশ বছর পরে বাংলাদেশে শিক্ষার এবং শিক্ষার মাধ্যমের অবস্থা কী দাঁড়াবে? ততদিনে আমাদের রাষ্ট্রই বা কী প্রকৃতি লাভ করবে? রাষ্ট্র কি গড়ে উঠবে? রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পাকিস্তানকালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের স্পিরিটের ধারাবাহিকতায় এগোবার কোনোপ্রবণতা তো খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের মনে হয়, যেখানে বাংলা মাধ্যম নিকৃষ্ট, সেখানে এই ইংলিশ ভার্সন অবশ্যই নিকৃষ্টতর হচ্ছে। ইংলিশ ভার্সনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ভালো হতেই পারে না। যে অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে তাতে বাংলা মাধ্যমও নিম্নগামীই থাকবে।

এ ব্যাপারে অভিভাবকদের বিবেচনাশীল হওয়া উচিত। বাঙালি-সন্তানের প্রথম ভাষা বাংলা, দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি; যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে এ দুটো ভাষাই শিখতে হবে। তবে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে রাখতে হবে কেন্দ্রীয় অবস্থানে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি দ্বারা চলমান ভাষা ও সংস্কৃতি-পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে এখন শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের বেলায় কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত বাংলাদেশ-উপযোগী করে পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের উন্নয়নে। পাঠ্যপুস্তকের বেলায় জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য।

শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো আজ সময়ের দাবি। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। সেই পরিবর্তন বা সংস্কার হতে পারে- সাধারণ শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষা, ধর্মীয় নৈতিক বোধের শিক্ষা, ক্রিয়া ও সংস্কৃতি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সিভিল ডিফেন্স।

উপরিউক্ত বিভাগের জন্য যথাযথ মানের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমন- সাধারণ শিক্ষার জন্য সাধারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষার জন্য কারিগরি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ধর্মীয় মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়ার ব্যবস্থাকে নতুনরূপে ঢেলে সাজানো যেতে পারে।

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা প্রচলিত। তার সঙ্গে কারিগরি, প্রকৌশলী, ডাক্তারি, ভোকেশনাল ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। তাবে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ যুবক বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। যেখানে বাংলাদেশে তার পরিমান মাত্র ১% এর কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যে উন্নীত করা হয়েছে, তার মধ্যে কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আছে অর্থনৈতিক সংকট ও কর্মসংস্থানের অভাব। তাই আর বিলম্ব না করে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিশ্বের জাতিসমূহের উন্নয়ন ও প্রগতির ধারার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষাকে জীবনমুখী করে তোলার সময় এসেছে। জাতীয় প্রতিভার অপচয় আর অর্থনৈতিক প্রশ্ন বিবেচনায় এনে আমাদের ব্যাপারে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। এ অপরিহার্য কেবল কারিগরি শিক্ষার জন্যই। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সাধারণ সনদপত্র নয় বৃত্তিমুলক শিক্ষা লাভ করে জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তাহলে জাতি অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে। বাঁচবে দেশ। সার্থক হবে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা। আমরা একটি উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

শিক্ষানীতি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এর আগে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে তা নির্ধারণে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল সরকার। কিন্তু ওই শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করাসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো দীর্ঘ সময়েও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে ভাগ করে দুটি আলাদা অধিদপ্তর যথাক্রমে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর করার কথা ছিল শিক্ষানীতিতে। কিন্তু সেটি হয়নি। এ পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সেক্ষেত্রেও সংকট ও টানাপোড়েন চলছে। সেটা যেভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। মান, কাঠামোগত পরিবর্তন ও আধুনিকতা সবটাকেই প্রাধ্যান্য দিয়ে একটি সমন্বিত ও অভিন্ন ধারা চালু করা এ মুহূর্তে প্রয়োজন।

শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজন্মকে আধুনিক মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা, শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্যোগ, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভর্তি নীতিমালা বাস্তবায়ন, যথাসময়ে ক্লাস শুরু, নির্দিষ্ট দিনে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ৬০ দিনে ফল প্রকাশ, সৃজনশীল পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, স্বচ্ছ গতিশীল শিক্ষা প্রশাসন গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করে ঝরেপড়া বন্ধ করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ মহূর্তে কারিকুলাম প্রণীত হলেও তা মানসম্মত হতে সময়ের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আপাতত হলেও একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনাকে মেনে নিয়ে ক্রমান্বয়ে তা গ্রহণ বর্জন এবং ট্রায়াল ও এরর মেথড ভিত্তিতে একটি মানসম্মত কারিকুলাম জাতিকে উপহার দেয়া সম্ভব হবে। মানসম্মত কারিকুলাম ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কাজেই দিন-রাত পরিশ্রম করে হলেও আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের এ কাজে আরো বেশি মনোযোগী এবং তৎপর হতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]