শেয়ারবাজারে আতঙ্ক দূর করতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

করোনা মহামারীর আঘাত সামলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মহামারীর এই কালপর্বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রয়েছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার এক অসীম সাহস ও ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য শক্তি আমাদের নতুন নয়। ইতিহাস ঘাঁটলেই তা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে করোনার আগেরকার আর্থ-সামাজিক উন্নতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। তবে এখনকার অর্থনীতির অগ্রগতিও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থার পর্যবেক্ষণে প্রতিনিয়ত উঠে আসছে। বলা হয়ে থাকে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নির্ভর করবে টিকাদান কর্মসূচির ওপর। অথচ স্বল্পসংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে আজ করোনা নিয়ন্ত্রণেই বলা চলে। কয়েক সপ্তাহ ধরে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দুই শতাংশের নিচে রয়েছে। কমেছে মৃত্যুও। করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আপাতত জনমনে প্রশমিত হয়েছে করোনা আতঙ্ক।

তবে গত ১০ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রায়শ দেখা যায় আরেক আতঙ্কের নাম। এটি শেয়ারবাজার পতনের আতঙ্ক। যার ওপর ভর করে শেয়ারবাজারে চলছে অস্থিরতা। বাংলা ভাষার এ শব্দটির সঙ্গে জাতি গত একযুগ ধরেই বেশ পরিচিত। অবস্থা আজ এমন দাঁড়িয়েছে যে, শেয়ারবাজার মানেই এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। শেয়ারবাজার ও আতঙ্ক একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে; যা বিনিয়োগকারীদের মনোজগতে শক্তপোক্তভাবে গ্রথিত। কিন্তু এটি এমন হওয়ার কথা নয়। তবে এটি কী হতে পারত? এর উত্তর সহজেই অনুমেয়।

এটা তো সবারই জানা- শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ যদি বিনিয়োগের আগে ঝুঁকি শব্দটা মাথায় থাকত, তবে আজকে তা আতঙ্কে পরিণত হতো না। এখানে ঝুঁকি আছে এটা মেনেই বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু লাভের আশায় বিনিয়োগ করলে হবে না। যে কোনো দেশে শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকাশের অনুকূল দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারের মতো একটি গুরত্বপূর্ণ মাধ্যম থেকে বিপুল পরিমাণে পুঁজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে ঠিক এর উল্টো। এখানে শেয়ারবাজারের বদলে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটি বিগত ৬৭ বছরেও শক্ত কোনো ভিতের উপর দাঁড়ায়নি। এখানে প্রতিনিয়ত চলছে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, সর্বগ্রাসী অরাজকতা, আস্থাহীনতা, আইনের শাসন অনুপস্থিতি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, অকার্যকারিতা, লুটপাট ও কারসাজির এক মহোৎসব। তাই তো দীর্ঘদিন ধরেই এক অস্থিতিশীল পরিবেশেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। এক কার্যদিবস কিছুটা উত্থান হলে এর পরের কার্যদিবসই পতন হচ্ছে। আর এ উত্থান ও পতনের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। এটি মোটেও সুষ্ঠু পরিপক্ব বাজারের লক্ষণ নয়।

কিন্তু কেন এরকম হয়? উত্তর খুঁজলে পাওয়া যায়- শেয়ারবাজার যখন টানা ঊর্ধ্বমুখী থাকে তখন সাধারণ বিনিয়োগকারী ভুলে যান সূচকের কারেকশন বা শেয়ার দরের মূল্য সংশোধন অবধারিত। আর শেয়ার দরের যখন মূল্য সংশোধন চলতে থাকে, তখন এর পালে হাওয়া দেয় অসাধু কারসাজি চক্র। ফলে কারেকশন পতনে রূপ নেয়। টানা পতন চলতে থাকায় আতঙ্ক ভর করে বিনিয়োগকারীদের মনে। কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করে এ পতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর উত্থান-পতনের এ পরিক্রমায় আবার কম দামে শেয়ার কিনে নেয় কারসাজি চক্র। এ চক্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কারসাজির ফাঁদে ফেলে, বিভিন্ন গুজবের মারপ্যাঁচে প্রলুব্দ করে প্রায়শ সর্বশান্ত করে খুব সহজেই হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। নিঃস্ব হন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে বাজারে চাঙ্গাভাব ফিরতে শুরু করে। আর মে মাসে ঈদের আগে-পরে বাজার আরও গতি পায়। লেনদেনেও দেখা যায় চাঙাভাব। এতে প্রতিদিনই বাজারে নতুন নতুন বিনিয়োগ বা অর্থ লগ্নি হয়। বিশেষ করে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে আবেদনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপের কারণেও বিপুল বিনিয়োগ আসে। লক্ষণীয় বিষয় হলো- বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাই আগ্রাসী ছিলেন। ফলে শেয়ারবাজারে প্রধান সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনে হয় নতুন নতুন রেকর্ড। রেকর্ডের এ ধারাবাহিকতায় সূচক পৌঁছায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার পয়েন্টে। গত এক বছরে সূচক বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পয়েন্ট। ছয় হাজার পয়েন্টের পরে বলা চলে সূচক প্রায় টানা বেড়েছে, ফলে স্বল্পমূলধনী অনেক কোম্পানির শেয়ার দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে, আবার কিছু শেয়ারের দর কারসাজির মাধ্যমে অল্প সময়ে এতটাই বাড়ানো হয়েছে যে, তা কোনোভাবেই ওই কোম্পানির আর্থিক ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর মধ্যে কোনো মূল্য সংশোধন হয়নি। সেখান থেকে কিছু মূল্য সংশোধন হওয়া স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক দরপতন বিনিয়োগকারীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর- এই দুই দিনে সূচক কমে ১৯১ পয়েন্ট। ফলে সূচক নেমে আসে বহু কাক্সিক্ষত ৭ হাজার পয়েন্ট মাইলফলকের নিচে এবং বেশকিছু শেয়ারের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মূল্য সংশোধন হয়। এর পেছনেই কারসাজির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই, আমাদের শেয়ারবাজার অনেকটাই গুজবনির্ভর। পৃথিবীর সব শেয়ারবাজারেই গুজব রয়েছে। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী নিজের বিশ্লেষণী জ্ঞান দিয়ে গুজবকে প্রতিহত করেন। গুজব থেকে সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কারসাজি চক্র নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বাজারে গুজব ছড়ায়। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী কখনো গুজবে কান দেন না। প্রকৃত বিনিয়োগ কখনো গুজবে হওয়া উচিত নয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ারবাজার নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ায়। তবে আশার কথা হলো- এসব ব্যক্তি ও গ্রুপকে আইনের আওতায় আনতে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ২৪ মে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। যাদের কাজ হবে শেয়ারবাজারে গুজব প্রচারকারীদের খুঁজে বের করে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা।

মূলত বিনিয়োগকারীদেরই সচেতন থাকতে হবে। বিনিয়োগকৃত কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে তথা গুজব ও প্রকৃত তথ্যের সত্যতা বিশ্লেষণের ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা হরহামেশাই তথাকথিত আইটেম খোঁজার নামে গুজবের জালে আচ্ছন্ন থাকেন। তারা বিনিয়োগে গুজবেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিনিয়োগকারীরা হাউসে বসে খোশগল্পে মেতে ওঠেন এবং কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই প্রায়শ ভুল বিনিয়োগ করেন। ফলে অনায়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হন; কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেন না। আবার গুজবের পেছনে ছোটেন। বিনিয়োগকারীরা অতীত মনে রাখেন না। বর্তমান নিয়ে সর্বদা হতাশায় ভোগেন। আর ভবিষ্যৎ তথা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে তারা অভ্যস্ত নন। এক্ষেত্রে ব্রোকার হাউসকেও সুষ্ঠু টেকসই বাজারের লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। ট্রেডারদের আরও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যারা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের নৈতিকভাবে ভালো বিনিয়োগ পরামর্শ, উৎসাহ ও সচেতন করবেন। আমাদের শেয়ারবাজার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো- এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাজার সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাব।

শেয়ারবাজারে প্রথম ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- একটি প্রশিক্ষিত বিনিয়োগ শ্রেণী গড়ে তোলা। কেননা একটি সুষ্ঠু, টেকসই ও দক্ষ শেয়ারবাজারের জন্য প্রয়োজন দক্ষ বিনিয়োগকারী, যারা নিজেদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়ে থাকবেন এবং কখনই গুজবে কান দেবেন না। বিনিয়োগকারীরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন- একটি দেশের শেয়ারবাজার টেকসই বা স্থায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর দক্ষতার ওপর। আতঙ্ক বাংলা ভাষার এ বিশেষ্য পদের শাব্দিক অর্থ হলো-ভয় বা শঙ্কা। মানুষের ভয় আসে অজ্ঞনতা থেকে। এ ভয় যখন সার্বিকভাবে জেঁকে বসে, তখন তা আতঙ্কে পরিণত হয়। বাঁচার উপায় জানতে হবে। একমাত্র জানাশোনার মাধ্যমেই অজ্ঞনতা দূর করে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে; যা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক দূর করবে।

নতুন ট্রেকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতায় লাখো বিনিয়োগকারীর দরকার নেই। একমাত্র প্রশিক্ষিত বিনিয়োগকারীরাই তাদের বিনিয়োগসুলভ আচরণ দিয়ে বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারবেন। আর অবশ্যই সামগ্রিকভাবে অগ্রগতির জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই; যা বর্তমান কমিশন নিরলসভাবে করে যাচ্ছে- এটি স্পষ্ট। প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা ও বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগসুলভ আচরণ। তা হলে বাজার হবে টেকসই, বাজারে ফিরবে আস্থা। বাংলাদেশের চলমান এ উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে দেশের শেয়ারবাজারের সম্পর্ক হবে সুসংহত।

[লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক]

শুক্রবার, ০৫ নভেম্বর ২০২১ , ২০ কার্তিক ১৪২৮ ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

শেয়ারবাজারে আতঙ্ক দূর করতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

করোনা মহামারীর আঘাত সামলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মহামারীর এই কালপর্বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রয়েছে। প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার এক অসীম সাহস ও ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য শক্তি আমাদের নতুন নয়। ইতিহাস ঘাঁটলেই তা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে করোনার আগেরকার আর্থ-সামাজিক উন্নতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। তবে এখনকার অর্থনীতির অগ্রগতিও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থার পর্যবেক্ষণে প্রতিনিয়ত উঠে আসছে। বলা হয়ে থাকে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নির্ভর করবে টিকাদান কর্মসূচির ওপর। অথচ স্বল্পসংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে আজ করোনা নিয়ন্ত্রণেই বলা চলে। কয়েক সপ্তাহ ধরে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দুই শতাংশের নিচে রয়েছে। কমেছে মৃত্যুও। করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আপাতত জনমনে প্রশমিত হয়েছে করোনা আতঙ্ক।

তবে গত ১০ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রায়শ দেখা যায় আরেক আতঙ্কের নাম। এটি শেয়ারবাজার পতনের আতঙ্ক। যার ওপর ভর করে শেয়ারবাজারে চলছে অস্থিরতা। বাংলা ভাষার এ শব্দটির সঙ্গে জাতি গত একযুগ ধরেই বেশ পরিচিত। অবস্থা আজ এমন দাঁড়িয়েছে যে, শেয়ারবাজার মানেই এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। শেয়ারবাজার ও আতঙ্ক একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে; যা বিনিয়োগকারীদের মনোজগতে শক্তপোক্তভাবে গ্রথিত। কিন্তু এটি এমন হওয়ার কথা নয়। তবে এটি কী হতে পারত? এর উত্তর সহজেই অনুমেয়।

এটা তো সবারই জানা- শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ যদি বিনিয়োগের আগে ঝুঁকি শব্দটা মাথায় থাকত, তবে আজকে তা আতঙ্কে পরিণত হতো না। এখানে ঝুঁকি আছে এটা মেনেই বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু লাভের আশায় বিনিয়োগ করলে হবে না। যে কোনো দেশে শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকাশের অনুকূল দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে শেয়ারবাজারের মতো একটি গুরত্বপূর্ণ মাধ্যম থেকে বিপুল পরিমাণে পুঁজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে ঠিক এর উল্টো। এখানে শেয়ারবাজারের বদলে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটি বিগত ৬৭ বছরেও শক্ত কোনো ভিতের উপর দাঁড়ায়নি। এখানে প্রতিনিয়ত চলছে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, সর্বগ্রাসী অরাজকতা, আস্থাহীনতা, আইনের শাসন অনুপস্থিতি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, অকার্যকারিতা, লুটপাট ও কারসাজির এক মহোৎসব। তাই তো দীর্ঘদিন ধরেই এক অস্থিতিশীল পরিবেশেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। এক কার্যদিবস কিছুটা উত্থান হলে এর পরের কার্যদিবসই পতন হচ্ছে। আর এ উত্থান ও পতনের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি। এটি মোটেও সুষ্ঠু পরিপক্ব বাজারের লক্ষণ নয়।

কিন্তু কেন এরকম হয়? উত্তর খুঁজলে পাওয়া যায়- শেয়ারবাজার যখন টানা ঊর্ধ্বমুখী থাকে তখন সাধারণ বিনিয়োগকারী ভুলে যান সূচকের কারেকশন বা শেয়ার দরের মূল্য সংশোধন অবধারিত। আর শেয়ার দরের যখন মূল্য সংশোধন চলতে থাকে, তখন এর পালে হাওয়া দেয় অসাধু কারসাজি চক্র। ফলে কারেকশন পতনে রূপ নেয়। টানা পতন চলতে থাকায় আতঙ্ক ভর করে বিনিয়োগকারীদের মনে। কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করে এ পতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর উত্থান-পতনের এ পরিক্রমায় আবার কম দামে শেয়ার কিনে নেয় কারসাজি চক্র। এ চক্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কারসাজির ফাঁদে ফেলে, বিভিন্ন গুজবের মারপ্যাঁচে প্রলুব্দ করে প্রায়শ সর্বশান্ত করে খুব সহজেই হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। নিঃস্ব হন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে বাজারে চাঙ্গাভাব ফিরতে শুরু করে। আর মে মাসে ঈদের আগে-পরে বাজার আরও গতি পায়। লেনদেনেও দেখা যায় চাঙাভাব। এতে প্রতিদিনই বাজারে নতুন নতুন বিনিয়োগ বা অর্থ লগ্নি হয়। বিশেষ করে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে আবেদনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপের কারণেও বিপুল বিনিয়োগ আসে। লক্ষণীয় বিষয় হলো- বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাই আগ্রাসী ছিলেন। ফলে শেয়ারবাজারে প্রধান সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধনে হয় নতুন নতুন রেকর্ড। রেকর্ডের এ ধারাবাহিকতায় সূচক পৌঁছায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার পয়েন্টে। গত এক বছরে সূচক বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পয়েন্ট। ছয় হাজার পয়েন্টের পরে বলা চলে সূচক প্রায় টানা বেড়েছে, ফলে স্বল্পমূলধনী অনেক কোম্পানির শেয়ার দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে, আবার কিছু শেয়ারের দর কারসাজির মাধ্যমে অল্প সময়ে এতটাই বাড়ানো হয়েছে যে, তা কোনোভাবেই ওই কোম্পানির আর্থিক ভিত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর মধ্যে কোনো মূল্য সংশোধন হয়নি। সেখান থেকে কিছু মূল্য সংশোধন হওয়া স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক দরপতন বিনিয়োগকারীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর- এই দুই দিনে সূচক কমে ১৯১ পয়েন্ট। ফলে সূচক নেমে আসে বহু কাক্সিক্ষত ৭ হাজার পয়েন্ট মাইলফলকের নিচে এবং বেশকিছু শেয়ারের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মূল্য সংশোধন হয়। এর পেছনেই কারসাজির গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। এটা অস্বীকারের উপায় নেই, আমাদের শেয়ারবাজার অনেকটাই গুজবনির্ভর। পৃথিবীর সব শেয়ারবাজারেই গুজব রয়েছে। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী নিজের বিশ্লেষণী জ্ঞান দিয়ে গুজবকে প্রতিহত করেন। গুজব থেকে সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, কারসাজি চক্র নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বাজারে গুজব ছড়ায়। একজন প্রকৃত বিনিয়োগকারী কখনো গুজবে কান দেন না। প্রকৃত বিনিয়োগ কখনো গুজবে হওয়া উচিত নয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ারবাজার নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ায়। তবে আশার কথা হলো- এসব ব্যক্তি ও গ্রুপকে আইনের আওতায় আনতে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ২৪ মে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। যাদের কাজ হবে শেয়ারবাজারে গুজব প্রচারকারীদের খুঁজে বের করে সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা।

মূলত বিনিয়োগকারীদেরই সচেতন থাকতে হবে। বিনিয়োগকৃত কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে তথা গুজব ও প্রকৃত তথ্যের সত্যতা বিশ্লেষণের ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা হরহামেশাই তথাকথিত আইটেম খোঁজার নামে গুজবের জালে আচ্ছন্ন থাকেন। তারা বিনিয়োগে গুজবেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিনিয়োগকারীরা হাউসে বসে খোশগল্পে মেতে ওঠেন এবং কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই প্রায়শ ভুল বিনিয়োগ করেন। ফলে অনায়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হন; কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেন না। আবার গুজবের পেছনে ছোটেন। বিনিয়োগকারীরা অতীত মনে রাখেন না। বর্তমান নিয়ে সর্বদা হতাশায় ভোগেন। আর ভবিষ্যৎ তথা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে তারা অভ্যস্ত নন। এক্ষেত্রে ব্রোকার হাউসকেও সুষ্ঠু টেকসই বাজারের লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। ট্রেডারদের আরও প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যারা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের নৈতিকভাবে ভালো বিনিয়োগ পরামর্শ, উৎসাহ ও সচেতন করবেন। আমাদের শেয়ারবাজার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো- এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে বাজার সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাব।

শেয়ারবাজারে প্রথম ও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- একটি প্রশিক্ষিত বিনিয়োগ শ্রেণী গড়ে তোলা। কেননা একটি সুষ্ঠু, টেকসই ও দক্ষ শেয়ারবাজারের জন্য প্রয়োজন দক্ষ বিনিয়োগকারী, যারা নিজেদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিয়ে থাকবেন এবং কখনই গুজবে কান দেবেন না। বিনিয়োগকারীরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন- একটি দেশের শেয়ারবাজার টেকসই বা স্থায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর দক্ষতার ওপর। আতঙ্ক বাংলা ভাষার এ বিশেষ্য পদের শাব্দিক অর্থ হলো-ভয় বা শঙ্কা। মানুষের ভয় আসে অজ্ঞনতা থেকে। এ ভয় যখন সার্বিকভাবে জেঁকে বসে, তখন তা আতঙ্কে পরিণত হয়। বাঁচার উপায় জানতে হবে। একমাত্র জানাশোনার মাধ্যমেই অজ্ঞনতা দূর করে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে; যা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক দূর করবে।

নতুন ট্রেকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতায় লাখো বিনিয়োগকারীর দরকার নেই। একমাত্র প্রশিক্ষিত বিনিয়োগকারীরাই তাদের বিনিয়োগসুলভ আচরণ দিয়ে বাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারবেন। আর অবশ্যই সামগ্রিকভাবে অগ্রগতির জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই; যা বর্তমান কমিশন নিরলসভাবে করে যাচ্ছে- এটি স্পষ্ট। প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা ও বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগসুলভ আচরণ। তা হলে বাজার হবে টেকসই, বাজারে ফিরবে আস্থা। বাংলাদেশের চলমান এ উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে দেশের শেয়ারবাজারের সম্পর্ক হবে সুসংহত।

[লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক]