সোয়ারীঘাটে জুতা কারখানায় আগুন, নিহত ৫

এমনিতে নুন আনতে পান্তা ফুরালেও টানাপড়েনের সংসারে লালিত স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে আগুনের লেলিহান শিখায়। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে, ক্লান্ত দেহ নিয়ে কর্মস্থলেই ঘুমাতে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য জোটেনি ভোরের আভা। মাঝরাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে প্রাণপণ চেষ্টা করেও জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন তারা।

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটে কামালবাগ এলাকায় ‘রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে জুতার কারখানায় লাগা ভয়াবহ আগুনের শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ৫টি দেহ। বেশ কয়েক বছর ধরে কারখানাটির শ্রমিক হিসেবে আশপাশের সবার কাছে চেনাজানা মুখগুলো দেখে আর চেনারও উপায় নেই। কয়লা হওয়া দেহগুলো শনাক্তে নেয়া হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ। মর্মস্পর্শী আগুনে শুধু তাদের জীবন প্রদীপ নিভে যায়নি, শেষ হয়ে গেছে পরিবার ও সন্তান নিয়ে লালিত স্বপ্নগুলোও।

কামালবাগের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫ শ্রমিকের স্বজনরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই কারখানার বিভিন্ন পদে কাজ করতেন তারা। সবার পরিবার গ্রামের বাড়িতে থাকেন। নিহতদের আয় দিয়েই চলে সংসারের চাকা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যদের হারিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে ৫টি পরিবারের ভবিষ্যত।

নিহতরা হলেন, কারখানাটির সেফ ম্যান মানিকগঞ্জের মৃত আবদুল রশিদ মিয়ার ছেলে আমিনুল মিয়া (৩৬), জুতার কাটিং মাস্টার বরিশালের মুলাদি এলাকার সিকান্দার মিয়ার ছেলে আবদুল রহমান রুবেল (৩৫), সিনিয়র জুতার কারিগর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের শহুর আলীর ছেলে শামীম মিয়া (৩৫), জুতার কারিগর চাঁদপুরের কচুয়া এলাকার শহুর আলীর ছেলে শামীম মিয়া (৩৫) ও শেরপুরের শ্রীবরদী এলাকার মৃত সাইফুল ইসলামের ছেলে কামরুল হাসান (২২)। মৃত মনিরের বোন জামাই মো. শাহজাহান বলেন, মনির ১৬ হাজার টাকা বেতনে ওই কারখানায় চাকরি করতেন। থাকতেন কারখানার একটি কক্ষে। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার কাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে যান। এরপর রাত ১টার দিকে আগুন লাগে। বের হওয়ার দরজায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকায় আর বের হতে পারেননি।

মো. শাহজাহান আরও জানান, মৃত মনিরের স্ত্রী নুরুন্নাহার দুই সন্তান মিম (৯) ও বায়েজিদকে (৪) নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। প্রতিমাসে বেতন পেয়ে বাড়িতে ১০ হাজার টাকা পাঠাতেন মনির। ওই টাকা দিয়েই চলতো সংসার ও মেয়ের লেখাপড়া। মনিরের অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন অনিশ্চিয়তার দিকে পা বাড়ালো।

মনিরের সংসার কিভাবে চলবে সেটাই এখন বড় দুঃশ্চিন্তা। একইভাবে গ্রামরে বাড়িতে মায়ের জন্য একটু জমি কেনার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে মৃত কামরুলের। শুধু মনির কিংবা কামরুল নয়, মৃত ৫ জনের পরিবারেই নেমে এসেছে অন্ধকার।

মৃত শামীমের বড় ভাই কাজল মিয়া জানান, লাশ নিতে হলে ডিএনএ টেস্ট করাতে হবে। কারণ লাশগুলো দেখে কোনটা কার সেটি বোঝার উপায় নেই। থানা পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, ডিএনএ টেস্ট করতে ২১-২৩ দিন সময় লাগবে। এখন সেই প্রতিক্ষা শুরু হলো আমাদের।

এদিকে, জুতা তৈরির কারখানাটিতে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল, প্রচুর রাবার জাতীয় কাঁচামাল, প্লাস্টিক ও ডিওপি তেল ছিল। সেখান থেকেই ঘটে আগুনের সূত্রপাত। আর সেই আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা মদিনা কাঁচাবাজারে। মূলত দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস। প্রাণে বাঁচতে ভবন থেকে লাফ দেন দুই শ্রমিক। পরে তাদের উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মৃতদের লাশও রাখা হয়েছে মিটফোর্ড মর্গে।

জুতার কারখানাটিতে গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, কামালবাগে আবাসিক এলাকা থেকে ১৫০ গজ দূরে রুমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের অবস্থান। কারখানার পাশেই ছোট একটি কাঁচাবাজার। বাজারটি মদিনা কাঁচাবাজার নামে পরিচিত। সোয়ারীঘাটের বেড়িবাঁধ সড়কের পাশেই রফিক হাজীর দোতলা কারখানাটি। কারখানাটির দ্বিতীয় তলায় ছিল রাবার ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের মজুদ। জরাজীর্ণ ভবনের নিচতলায় ঢুকতেই দেখা যায়, রাখা আছে ডিওপি তেলের অনেকগুলো ড্রাম। আগুনে যা পুড়ে গেছে। রাবার জাতীয় আঠা ও জুতা তৈরির জন্য রাখা লেদার সেখানে ছিল। আগুনে এসব পুড়ে পাকা ফ্লোর স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। প্লাস্টিক পুড়ে পুরো রুমে ও বাইরে স্তূপে পরিণত হয়েছে।

দোতলায় থাকা রাবারে পানি ছিটানোর কারণে সেটি শক্ত হয়ে প্রলেপ পড়েছে। ফলে ভেতরে পানি ঢুকছে না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মেশিন দিয়ে শক্ত প্রলেপ কেটে পানি ছিটাচ্ছেন। এছাড়া ভবনটির ২য় তলায় শ্রমিকদের থাকার জন্য করা হয়েছিল খোপ খোপ ঘর। নিহত পাঁচ শ্রমিক ওই ঘরগুলোর একটিতে ঘুমিয়ে ছিলেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা। কারখানা থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে মদিনা বাজারের ১০টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে দোকানগুলোতে থাকা কাঁচা মালামাল ও নিত্যপণ্য পুড়ে যায়।

মদিনা কাঁচাবাজারের সুপারভাইজার মো. রফিক বলেন, ১০-১২ বছর আগে রফিক হাজী এই জমি লিজ নিয়ে কারখানাটি তৈরি করেছিলেন। কারখানায় অন্তত অর্ধশত শ্রমিক দুই শিফটে কাজ করেন। রফিক হাজী চকবাজারের রহমতগঞ্জের হাজী গলি রোডে বসবাস করলেও তার গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় বার্মিজ ও স্পনসের স্যান্ডেল তৈরি করা হতো। এই জুতা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে মজুদ রাখা হতো প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যাল, রাবার ও প্লাস্টিক। রাবার একধরনের পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ। ব্যবহার করা হতো দাহ্য ডিওপি তেল। এই তেল জুতা ফিনিসিং ও মোলায়েম করতে সহায়তা করে।

কাঁচাবাজারের একটি মাংসের দোকানের মালিক রহিম জানান, রাতে তিনি দোকানেই ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে ওঠে। তখন ভয়ে দৌঁড়ে দোকান ছেড়ে রাস্তায় চলে আসি। পরে দেখি বাজারের পাশে রহিম হাজীর কারখানা আগুনে জ্বলতেছে। কারখানার বাইরে বেশ কিছু রিকশাও পুড়েছে।

এদিকে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা। এ বিষয়ে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের প্রধান পরিদর্শক মো. সাইফুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ঘটনাস্থল থেকে কেমিক্যাল সাদৃশ্য আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে। সিআইডির রাসায়নিক ল্যাবে পরীক্ষা করে তারপর বলা যাবে, এগুলো দাহ্য কোন কেমিক্যাল ছিল কিনা। চকবাজার থানার ওসি মো. আবদুল কাইউম জানান, ডিএনএ টেস্টের পর মৃতদের লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিচালক হাফুজুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণত বিভিন্ন জেলা থেকে অল্প শিক্ষিত মানুষরা পুরান ঢাকার এই জুতার কারখানায় কাজ করতে আসেন। কাজের সময় তাদের অনেকে বিড়ি-সিগারেট খান। হয়তো সিগারেট কিংবা কয়েলের আগুনেও এই ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে। এছাড়াও অন্য কোন কারণ আছে কিনা তা তদন্ত শেষে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।

শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১ , ২১ কার্তিক ১৪২৮ ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

সোয়ারীঘাটে জুতা কারখানায় আগুন, নিহত ৫

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

আগুনে স্বজনহারাদের আহজারি

এমনিতে নুন আনতে পান্তা ফুরালেও টানাপড়েনের সংসারে লালিত স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে আগুনের লেলিহান শিখায়। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে, ক্লান্ত দেহ নিয়ে কর্মস্থলেই ঘুমাতে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য জোটেনি ভোরের আভা। মাঝরাতে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে প্রাণপণ চেষ্টা করেও জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন তারা।

গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটে কামালবাগ এলাকায় ‘রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে জুতার কারখানায় লাগা ভয়াবহ আগুনের শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ৫টি দেহ। বেশ কয়েক বছর ধরে কারখানাটির শ্রমিক হিসেবে আশপাশের সবার কাছে চেনাজানা মুখগুলো দেখে আর চেনারও উপায় নেই। কয়লা হওয়া দেহগুলো শনাক্তে নেয়া হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ। মর্মস্পর্শী আগুনে শুধু তাদের জীবন প্রদীপ নিভে যায়নি, শেষ হয়ে গেছে পরিবার ও সন্তান নিয়ে লালিত স্বপ্নগুলোও।

কামালবাগের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫ শ্রমিকের স্বজনরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই কারখানার বিভিন্ন পদে কাজ করতেন তারা। সবার পরিবার গ্রামের বাড়িতে থাকেন। নিহতদের আয় দিয়েই চলে সংসারের চাকা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যদের হারিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে ৫টি পরিবারের ভবিষ্যত।

নিহতরা হলেন, কারখানাটির সেফ ম্যান মানিকগঞ্জের মৃত আবদুল রশিদ মিয়ার ছেলে আমিনুল মিয়া (৩৬), জুতার কাটিং মাস্টার বরিশালের মুলাদি এলাকার সিকান্দার মিয়ার ছেলে আবদুল রহমান রুবেল (৩৫), সিনিয়র জুতার কারিগর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের শহুর আলীর ছেলে শামীম মিয়া (৩৫), জুতার কারিগর চাঁদপুরের কচুয়া এলাকার শহুর আলীর ছেলে শামীম মিয়া (৩৫) ও শেরপুরের শ্রীবরদী এলাকার মৃত সাইফুল ইসলামের ছেলে কামরুল হাসান (২২)। মৃত মনিরের বোন জামাই মো. শাহজাহান বলেন, মনির ১৬ হাজার টাকা বেতনে ওই কারখানায় চাকরি করতেন। থাকতেন কারখানার একটি কক্ষে। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার কাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে যান। এরপর রাত ১টার দিকে আগুন লাগে। বের হওয়ার দরজায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকায় আর বের হতে পারেননি।

মো. শাহজাহান আরও জানান, মৃত মনিরের স্ত্রী নুরুন্নাহার দুই সন্তান মিম (৯) ও বায়েজিদকে (৪) নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। প্রতিমাসে বেতন পেয়ে বাড়িতে ১০ হাজার টাকা পাঠাতেন মনির। ওই টাকা দিয়েই চলতো সংসার ও মেয়ের লেখাপড়া। মনিরের অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন অনিশ্চিয়তার দিকে পা বাড়ালো।

মনিরের সংসার কিভাবে চলবে সেটাই এখন বড় দুঃশ্চিন্তা। একইভাবে গ্রামরে বাড়িতে মায়ের জন্য একটু জমি কেনার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে মৃত কামরুলের। শুধু মনির কিংবা কামরুল নয়, মৃত ৫ জনের পরিবারেই নেমে এসেছে অন্ধকার।

মৃত শামীমের বড় ভাই কাজল মিয়া জানান, লাশ নিতে হলে ডিএনএ টেস্ট করাতে হবে। কারণ লাশগুলো দেখে কোনটা কার সেটি বোঝার উপায় নেই। থানা পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, ডিএনএ টেস্ট করতে ২১-২৩ দিন সময় লাগবে। এখন সেই প্রতিক্ষা শুরু হলো আমাদের।

এদিকে, জুতা তৈরির কারখানাটিতে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল, প্রচুর রাবার জাতীয় কাঁচামাল, প্লাস্টিক ও ডিওপি তেল ছিল। সেখান থেকেই ঘটে আগুনের সূত্রপাত। আর সেই আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা মদিনা কাঁচাবাজারে। মূলত দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস। প্রাণে বাঁচতে ভবন থেকে লাফ দেন দুই শ্রমিক। পরে তাদের উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মৃতদের লাশও রাখা হয়েছে মিটফোর্ড মর্গে।

জুতার কারখানাটিতে গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, কামালবাগে আবাসিক এলাকা থেকে ১৫০ গজ দূরে রুমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের অবস্থান। কারখানার পাশেই ছোট একটি কাঁচাবাজার। বাজারটি মদিনা কাঁচাবাজার নামে পরিচিত। সোয়ারীঘাটের বেড়িবাঁধ সড়কের পাশেই রফিক হাজীর দোতলা কারখানাটি। কারখানাটির দ্বিতীয় তলায় ছিল রাবার ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের মজুদ। জরাজীর্ণ ভবনের নিচতলায় ঢুকতেই দেখা যায়, রাখা আছে ডিওপি তেলের অনেকগুলো ড্রাম। আগুনে যা পুড়ে গেছে। রাবার জাতীয় আঠা ও জুতা তৈরির জন্য রাখা লেদার সেখানে ছিল। আগুনে এসব পুড়ে পাকা ফ্লোর স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। প্লাস্টিক পুড়ে পুরো রুমে ও বাইরে স্তূপে পরিণত হয়েছে।

দোতলায় থাকা রাবারে পানি ছিটানোর কারণে সেটি শক্ত হয়ে প্রলেপ পড়েছে। ফলে ভেতরে পানি ঢুকছে না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মেশিন দিয়ে শক্ত প্রলেপ কেটে পানি ছিটাচ্ছেন। এছাড়া ভবনটির ২য় তলায় শ্রমিকদের থাকার জন্য করা হয়েছিল খোপ খোপ ঘর। নিহত পাঁচ শ্রমিক ওই ঘরগুলোর একটিতে ঘুমিয়ে ছিলেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা। কারখানা থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে মদিনা বাজারের ১০টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে দোকানগুলোতে থাকা কাঁচা মালামাল ও নিত্যপণ্য পুড়ে যায়।

মদিনা কাঁচাবাজারের সুপারভাইজার মো. রফিক বলেন, ১০-১২ বছর আগে রফিক হাজী এই জমি লিজ নিয়ে কারখানাটি তৈরি করেছিলেন। কারখানায় অন্তত অর্ধশত শ্রমিক দুই শিফটে কাজ করেন। রফিক হাজী চকবাজারের রহমতগঞ্জের হাজী গলি রোডে বসবাস করলেও তার গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় বার্মিজ ও স্পনসের স্যান্ডেল তৈরি করা হতো। এই জুতা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে মজুদ রাখা হতো প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যাল, রাবার ও প্লাস্টিক। রাবার একধরনের পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ। ব্যবহার করা হতো দাহ্য ডিওপি তেল। এই তেল জুতা ফিনিসিং ও মোলায়েম করতে সহায়তা করে।

কাঁচাবাজারের একটি মাংসের দোকানের মালিক রহিম জানান, রাতে তিনি দোকানেই ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে পুরো এলাকা আলোকিত হয়ে ওঠে। তখন ভয়ে দৌঁড়ে দোকান ছেড়ে রাস্তায় চলে আসি। পরে দেখি বাজারের পাশে রহিম হাজীর কারখানা আগুনে জ্বলতেছে। কারখানার বাইরে বেশ কিছু রিকশাও পুড়েছে।

এদিকে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা। এ বিষয়ে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের প্রধান পরিদর্শক মো. সাইফুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ঘটনাস্থল থেকে কেমিক্যাল সাদৃশ্য আলামতও সংগ্রহ করা হয়েছে। সিআইডির রাসায়নিক ল্যাবে পরীক্ষা করে তারপর বলা যাবে, এগুলো দাহ্য কোন কেমিক্যাল ছিল কিনা। চকবাজার থানার ওসি মো. আবদুল কাইউম জানান, ডিএনএ টেস্টের পর মৃতদের লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী উপপরিচালক হাফুজুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণত বিভিন্ন জেলা থেকে অল্প শিক্ষিত মানুষরা পুরান ঢাকার এই জুতার কারখানায় কাজ করতে আসেন। কাজের সময় তাদের অনেকে বিড়ি-সিগারেট খান। হয়তো সিগারেট কিংবা কয়েলের আগুনেও এই ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে। এছাড়াও অন্য কোন কারণ আছে কিনা তা তদন্ত শেষে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।