সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপির পৌষ মাসের সূচনাপর্ব

গৌতম রায়

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ধীরে ধীরে ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে একটা চরিত্রগত অদলবদল আসতে শুরু করে। রাজীব গান্ধীর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা সেই অদলবদলকে একটা অস্থির অবয়বের ভেতরে নিয়ে আসে। সেই অস্থির অবয়ব রচনায় ভারতের সেই সময়ের ডান, অতি ডান, বাম-কোনো রাজনীতিকদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হবে না। রাজীবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রশ্নে সেই সময়ে ভারতের সব স্তরের বিরোধী রাজনীতিকরা এতটাই সরব হয়েছিলেন, যাকে মোকাবিলা করতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেয়ার মতো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত রাজীব নিয়েছিলেন। ফলে আরএসএস-বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তারপর্ব অনেক উগ্রতায় পরিণত হয়েছিল খুব সহজেই। রাজীব বা কংগ্রেসের দুর্নীতির প্রশ্নে বামেদের সমান্তরাল আন্দোলনে বিজেপি ছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আরএসএস কীভাবে ইটপুজো ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সামনে তুলে আনছে যার জেরে মন্দির-মসজিদ ইস্যুটি অনেক তীব্র হয়ে উঠছে, সাম্প্রয়িকতার ঢাকে জোরদারভাবে কাঠি পড়ছে-সেই কাঠির পড়বার পরিণতি পরবর্তীতে ভারতীয় রাজনীতিতে কি হতে পারেÑএসব আগুপিছু ভাবনা তৎকালীন বামপন্থি নেতারা কতখানি ভেবেছিলেন, আজ এত বছর পরে ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায় সেই প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং তার সহযোগীদের জন্য রাজধর্মকে উপচিয়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভয়াবহকতার সাক্ষী থাকতে হয়েছে পণ্ডিত নেহরুকে। স্বাধীন দেশের প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কোনো স্তরের মানুষই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের জন্যে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকুন, রাজধর্ম পালনের প্রেক্ষিতে পণ্ডিত নেহরু সেটা কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেননি। এ পর্বে এক গভীর নির্জন পথে নেহরু ছিলেন এক নিঃসঙ্গ পথিক। সর্দার প্যাটেলের অকাল মৃত্যু না ঘটলে সে সময় কালেই হয়তো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে পরাজিত হতো নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। সমাজতন্ত্রের প্রতি নেহরুর প্রবল আগ্রহ থাকলেও ভারতে সেই সময়ে যারা সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বুক বেঁধে রাজনীতি করতেন, তাদের ভিতরেও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো হাতে গোনা একজন- দুজন বুঝেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে পণ্ডিত নেহরুর দায়বদ্ধতাকে। সেই দায়বদ্ধতা না থাকলে এতকিছুর পরে ও আজ ভারত টিকে থাকত না।

শাসনযন্ত্রের ওপর নিজের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে পিতার পদাঙ্কের সার্থক উত্তরসূরি কখনোই নেহরুকন্যা ইন্দিরাকে বলা যায় না। তবে প্রশাসনে থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বেশিরভাগ সময়ে ইন্দিরার যে অবস্থান ছিল, বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিরুবনন্তপুরমে ধর্মান্তর ঘিরে ইন্দিরা যে অবস্থান নিয়েছিলেন- তা আরএসএসের অবস্থানের থেকে বিশেষ আলাদা ছিল না।

দুর্নীতির প্রশ্নে অন্ধ রাজীব বিরোধিতা আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কতখানি শক্তি জোগাবে অবিজেপি দলগুলো কি তা সে দিন পরিমাপ করেছিল? আর রাজীব নিজেও বিরোধী রাজনীতির মোকাবিলার নামে শাহবানু মামলার রায়ের পর যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকেও প্রবল সংশয়ী করে তুলেছিল। অন্ধ ভারত বিরোধিতা অতীতে বাংলাদেশে বেআইনি ক্ষমতা দখলদারীদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাস্তটাকে প্রশস্ত করে দিয়েছিল, অনেকটা প্রায় সেভাবেই অন্ধ ভারত বিরোধিতাটাও সেই দেশের শাসক বা শাসক ঘনিষ্ঠদের সাম্প্রদায়িক পদ গ্রহণের ফলে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের পথ টাকে প্রলম্বিত করে দিয়েছিল।

দুর্নীতির প্রশ্নে রাজীবের বিরোধিতার প্রেক্ষিতে সেই সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির পরিপূর্ণ সুযোগ বিজেপি নিয়েছিল। এই জায়গাতেই একটি প্রশ্ন আমার কাছে খুব জোরালো হয়ে ওঠে, প্রশ্নটি হলো; দুর্নীতির প্রেক্ষিতে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেটি বাম-ডান-অতি ডানেরা কখনো ই যৌথভাবে করেনি, কিন্তু সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিত কে কাজে লাগিয়ে গোটা ভারতব্যাপী হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কীভাবে উগ্র করে তুলছে আরএসএস- সে সম্পর্কে কি ভিপি সিং থেকে হরকিষান সিং সুরজিৎ, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, জ্যোতি বসু, সি রাজেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত থেকে শুরু করে মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ হেগড়ে- এঁরা কেউই ওয়াকিবহাল ছিলেন না? রাজীবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিরোধী আন্দোলনের জেরে সঙ্ঘ পরিবার কীভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে গ্রামীণ ভারতে- সেই সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্যের কানাকড়ি ও কি ইএমএস, সুরজিৎ, জ্যোতিবাবু, রাজেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তদের কানে পৌঁছায়নি?

এসব রাজনৈতিক নেতারা দেশভাগ দেখেছিলেন। দেশভাগকে ত্বরান্বিত করতে হিন্দু- মুসলমান, উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির তাণ্ডব দেখেছিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে গান্ধী হত্যা দেখেছিলেন। জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে জয় প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে আরএসএসের যৌথ আন্দোলন দেখেছিলেন। সেই আন্দোলনের জেরে ভারতে তৈরি হওয়া প্রথম অকংগ্রেসী মোরারজি দেশাইয়ের সরকার দেখেছিলেন। সেই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে আরএসএসের সরকারের ভেতরে নাকগলানোর মানসিকতা দেখেছিলেন। জুলাই সংকট দেখেছিলেন। দ্বৈতসদস্যপদকে কেন্দ্র করে দেশাই সরকার ভেঙে যেতেও এরা দেখেছিলেন। সেই মানুষগুলো তো আরএসএস-বিজেপির ভয়াবহকতার সবটুকুনিই জানতেন। তবু কেন রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বফোর্স ইস্যুতে পৃথম কর্মকাণ্ড হলেও, সেই কর্মকাণ্ডে থেকেছিলেন? একই ইস্যুতে বিজেপির কর্মতৎপরতা সেই দলকে যে ভোট রাজনীতিতে পরবর্তীতে সুযোগ করে দেবে- এটা না বোঝার মতো দূরদর্শিতার অভাব তো সে সময়ের সর্বস্তরের অকংগ্রেস, অবিজেপি নেতাদের ছিল না। এর পাশাপাশি সংঘ পরিবারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও তো ওই নেতারা তখন ওয়াকিবহাল ছিলেন- এ কথা বললে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। শাসনক্ষমতার কাছাকাছি থাকার তাগিদ কি সেই সময়ের একটা বড় অংশের রাজনৈতিক নেতার নীতির প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িকতাকে ঠেকানোর প্রশ্নে, মৌলবাদকে রোখবার প্রশ্নে খানিকটা হলেও দিগভ্রান্ত করে দিয়েছিল?

জাতীয় আন্দোলনের সময়কালের নেতারা গান্ধীজী হত্যাকাণ্ডে আরএসএসের সংযোগ ঘিরে এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর, ভোল বদলে আরএসএস কীভাবে ধীরে ধীরে সমাজজীবনের গভীরে ঢুকে পড়ছে- তা দেখেছিলেন। গান্ধী হত্যাকারী সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচয় মুছে ফেলতে কীভাবে নিজেদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আরএসএস নিজেদের মেলে ধরতে শুরু করেছে, এসব প্রবীণ নেতারা তা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। সেই আরএসএসকে সঙ্গে নিয়ে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ন। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে কখনও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই আন্দোলনে আরএসএসকে সংযুক্ত করলে সংঘ পরবর্তীকালে সেই সুযোগে তাদের রাজনৈতিক আগ্রাসনকে কোন স্তরে নিয়ে যাবেÑসেটা বুঝতে না পারাটা জয়প্রকাশের অত্যন্ত অপরিণামদর্শী রাজনীতি ছিল।

একই কথা প্রযোজ্য রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিজেপির আন্দোলনের পাশাপাশি অবিজেপি, এমন কি বামদলগুলোর ও সেই সময়ের অবস্থান ঘিরে। বাম দলগুলো এখানে বক্তব্য হতেই পারে, বোফর্স ইত্যাদি দুর্নীতির প্রশ্নে তাদের সেই সময়ে নীরব থাকাটা রাজনৈতিক অপরাধ হতো। তাদের বক্তব্য হতেই পারে, একই ইস্যুতে যদি পৃথকভাবে বিজেপি আন্দোলন করে, তাহলে বামেরা কি করবে? বামেরা তো একটি সভাও কখনও যৌথভাবে বিজেপির সঙ্গে করেনি। আন্দোলনের অধিকার তো সব রাজনৈতিক দলেরই আছে।

বামেদের পাশাপাশি একই ইস্যুতে আলাদাভাবে সাম্প্রদায়িক বিজেপি আন্দোলন করলে বামেদের কিছু করার থাকে না- রাজনৈতিকভাবে এটা বাস্তব। কিন্তু বিজেপি সেই আন্দোলনের সমান্তরালভাবে সংঘ পরিবারের অজস্র শাখা সংগঠনের মাধ্যমে যে নিজেদের অস্তিত্ব বিস্তার করছে, যার জেরে লোকসভায় তাদের আসন সংখ্যা দুই থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আটের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল- এই পরিবেশ তৈরির যে ঘটনাক্রম সেগুলো কি বাম রাজনীতিকেরা ঠিকমতো জানতে পারেননি? যদি জেনে থাকতেন, তাহলে সেই জানার ভিত্তিতে রাজীবের দুর্নীতির পাশাপাশি আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সুবিধা করে দিতে সেই সময়েই কি ধরনের সামাজিক প্রযুক্তি চালাচ্ছে, তার ফলে দেশের সামাজিক বিন্যাস কীভাবে খুব দ্রুত বদলাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক অভিমুখ তীব্র হচ্ছে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং অধিকার ধীরে ধীরে বিপন্ন হচ্ছেÑ সে সম্পর্কে কি তারা তখন কোন অবস্থান নিয়েছিলেন? ভিপি সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের শেষ দিকে বিজেপি যখন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসে একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে, তখন যে সুরে বিজেপির নোংরা রাজনীতির বিরোধিতা হয়েছিল, সেই সুরে কি রাজীব জামানার শেষ দিকে, যখন বিজেপি ও বোফর্স ইস্যুতে আন্দোলন করছে, রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করবার কথা বলছে- সেই সময়ে কি বিজেপির সাম্প্রদায়িক অভিমুখ ঘিরে পরবর্তী সময়ের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছিল? নাকি অকংগ্রেসি, অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো তখন দেখে শুনে বুঝে ও আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অবস্থান ঘিরে নীরব ছিল? ইচ্ছাকৃত নয়, রাজীবকে ক্ষমতাচ্যুত করবার ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডার জন্য শীতল মনোভাব দেখাচ্ছিল?

মোরারজি দেশাই সরকারের পরিচালক জনতা পার্টির ভেতর গান্ধী হত্যাকারী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনসংঘ শামিল ছিল। আজকের বিজেপির সেদিন সংস্করণই হলো এই জনসংঘ। দেশাই সরকারের ভেতরে থাকার সুবাদে মাত্র দুই বছরের ও কম সময় ওই সরকারের অস্তিত্বের ভেতরেই প্রশাসনের শিরা উপশিরায় আরএসএস নিজেদের ছড়িয়ে দিতে অনেকখানি সক্ষম হয়েছিল। সেই সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই কিন্তু আরএসএস-পরবর্তীতে তাদের বিবর্তিত রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ভোট রাজনীতিতে অনেকখানি সফল করে তুলেছে।

নিজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধীদের আন্দোলনের মোকাবিলায় রাজীব হাঁটলেন নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে। আর সেই সুযোগ আরএসএস নিলো পরিপূর্ণভাবে। বামেরাও সেই সময়ে রাজীবকে ক্ষমতাচ্যুত করবার লক্ষ্যে এতটাই দৃঢ় সংকল্প যে, গোটা বিরোধী শিবিরের আন্দোলনকে ব্যবহার করে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কতটা শক্তিশালী করে তুলছে, ভূমিস্তরে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়িয়ে বিজেপির ভোটব্যাংক কতটা বাড়াচ্ছে-সেদিকে সজাগ-নিরপেক্ষ-নির্মোহ দৃষ্টি তখন প্রায় কোন রাজনৈতিক দলেরই নেই।

ভিপি সিংয়ের সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সুবাদে মাত্র এক দেড় বছর সময়ের ভেতরে আরএসএস তাদের হাজারটা শাখা সংগঠনকে আরও কতটা ভূমিস্তরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল- সেসব ভাবলে আজ আমাদের শিউরে উঠতে হয়। আরএসএসের এসব শাখা সংগঠনগুলোর বিস্তারের জেরে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কীভাবে শক্তিশালী হয়েছিল-এ সম্পর্কে কিন্তু প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এখন কার্যত নীরবতা পালন করে চলে। জানি না, বামদলগুলো তাদের অতীত পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ভিপি সিং সরকারের সময়ে বিজেপি ট্রেজারি বেঞ্চে বসার বিষময় ফল পরবর্তীতে আরএসএস-বিজেপির বিস্তারের ক্ষেত্রে কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল, সেই সম্পর্কে কোনো বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন কি না।

বিজেপির মতো হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল, যারা পরিচালিত হয় আরএসএসের আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, ফ্যাসিবাদী দর্শনকে সম্বল করে, সেই দলটি সরকারের অভ্যন্তরে কোনোভাবে ঢোকবার সুযোগ পেলে নিজেদের নখদন্ত বিস্তারের একটি প্রয়াসকেও ফসকে যেতে দেবে নাÑএটা কি ভিপি সিং সরকার তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যেসব রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন, তারা জানতেন না? বুঝতেন না সেই বাস্তবতাকে? নাকি শর্ট টাইম অ্যাচিভমেন্টের তাগিদে তারা আগামী ভারত কোন প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসের পথে হাঁটবে-তা ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন?

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, নয় দশকের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগেই বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির যে ভোট রাজনীতির সাফল্য, সেটির পেছনে অনেকখানিই ভূমিকা এবং অবদান ভিপি সিং সরকারকে বাইরের থেকে বিজেপির সমর্থন করবার ঘটনাটি। বিজেপির যাবতীয় কর্মকাণ্ড যে শুধু হুজুগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, তার পেছনে ভারতের চিরাচরিত বহুত্ববাদী দর্শনের একদম বিপরীত একটি দর্শন আছে, যে দর্শনে একমাত্র রাজনৈতিক হিন্দুদেরই ঠাঁই আছে, বাকি মুসলমানসহ যাবতীয় সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, কমিউনিস্ট- কারো ঠাঁই নেই- এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব না দিয়ে বিজেপিকে সেদিন ট্রেজারি বেঞ্চে বসবার সুযোগ দেয়া সে সময়ের সমস্ত অকংগ্রেস, অবিজেপি রাজনীতিকদের চরমতম ভুল।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২১ , ২১ কার্তিক ১৪২৮ ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপির পৌষ মাসের সূচনাপর্ব

গৌতম রায়

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ধীরে ধীরে ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে একটা চরিত্রগত অদলবদল আসতে শুরু করে। রাজীব গান্ধীর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা সেই অদলবদলকে একটা অস্থির অবয়বের ভেতরে নিয়ে আসে। সেই অস্থির অবয়ব রচনায় ভারতের সেই সময়ের ডান, অতি ডান, বাম-কোনো রাজনীতিকদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা ইতিহাসের প্রতি সুবিচার হবে না। রাজীবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রশ্নে সেই সময়ে ভারতের সব স্তরের বিরোধী রাজনীতিকরা এতটাই সরব হয়েছিলেন, যাকে মোকাবিলা করতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেয়ার মতো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত রাজীব নিয়েছিলেন। ফলে আরএসএস-বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তারপর্ব অনেক উগ্রতায় পরিণত হয়েছিল খুব সহজেই। রাজীব বা কংগ্রেসের দুর্নীতির প্রশ্নে বামেদের সমান্তরাল আন্দোলনে বিজেপি ছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আরএসএস কীভাবে ইটপুজো ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সামনে তুলে আনছে যার জেরে মন্দির-মসজিদ ইস্যুটি অনেক তীব্র হয়ে উঠছে, সাম্প্রয়িকতার ঢাকে জোরদারভাবে কাঠি পড়ছে-সেই কাঠির পড়বার পরিণতি পরবর্তীতে ভারতীয় রাজনীতিতে কি হতে পারেÑএসব আগুপিছু ভাবনা তৎকালীন বামপন্থি নেতারা কতখানি ভেবেছিলেন, আজ এত বছর পরে ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায় সেই প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই।

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং তার সহযোগীদের জন্য রাজধর্মকে উপচিয়ে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভয়াবহকতার সাক্ষী থাকতে হয়েছে পণ্ডিত নেহরুকে। স্বাধীন দেশের প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কোনো স্তরের মানুষই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের জন্যে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকুন, রাজধর্ম পালনের প্রেক্ষিতে পণ্ডিত নেহরু সেটা কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেননি। এ পর্বে এক গভীর নির্জন পথে নেহরু ছিলেন এক নিঃসঙ্গ পথিক। সর্দার প্যাটেলের অকাল মৃত্যু না ঘটলে সে সময় কালেই হয়তো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কাছে পরাজিত হতো নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। সমাজতন্ত্রের প্রতি নেহরুর প্রবল আগ্রহ থাকলেও ভারতে সেই সময়ে যারা সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বুক বেঁধে রাজনীতি করতেন, তাদের ভিতরেও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো হাতে গোনা একজন- দুজন বুঝেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে পণ্ডিত নেহরুর দায়বদ্ধতাকে। সেই দায়বদ্ধতা না থাকলে এতকিছুর পরে ও আজ ভারত টিকে থাকত না।

শাসনযন্ত্রের ওপর নিজের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে পিতার পদাঙ্কের সার্থক উত্তরসূরি কখনোই নেহরুকন্যা ইন্দিরাকে বলা যায় না। তবে প্রশাসনে থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বেশিরভাগ সময়ে ইন্দিরার যে অবস্থান ছিল, বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিরুবনন্তপুরমে ধর্মান্তর ঘিরে ইন্দিরা যে অবস্থান নিয়েছিলেন- তা আরএসএসের অবস্থানের থেকে বিশেষ আলাদা ছিল না।

দুর্নীতির প্রশ্নে অন্ধ রাজীব বিরোধিতা আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কতখানি শক্তি জোগাবে অবিজেপি দলগুলো কি তা সে দিন পরিমাপ করেছিল? আর রাজীব নিজেও বিরোধী রাজনীতির মোকাবিলার নামে শাহবানু মামলার রায়ের পর যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকেও প্রবল সংশয়ী করে তুলেছিল। অন্ধ ভারত বিরোধিতা অতীতে বাংলাদেশে বেআইনি ক্ষমতা দখলদারীদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাস্তটাকে প্রশস্ত করে দিয়েছিল, অনেকটা প্রায় সেভাবেই অন্ধ ভারত বিরোধিতাটাও সেই দেশের শাসক বা শাসক ঘনিষ্ঠদের সাম্প্রদায়িক পদ গ্রহণের ফলে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের পথ টাকে প্রলম্বিত করে দিয়েছিল।

দুর্নীতির প্রশ্নে রাজীবের বিরোধিতার প্রেক্ষিতে সেই সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেই পরিস্থিতির পরিপূর্ণ সুযোগ বিজেপি নিয়েছিল। এই জায়গাতেই একটি প্রশ্ন আমার কাছে খুব জোরালো হয়ে ওঠে, প্রশ্নটি হলো; দুর্নীতির প্রেক্ষিতে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেটি বাম-ডান-অতি ডানেরা কখনো ই যৌথভাবে করেনি, কিন্তু সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিত কে কাজে লাগিয়ে গোটা ভারতব্যাপী হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কীভাবে উগ্র করে তুলছে আরএসএস- সে সম্পর্কে কি ভিপি সিং থেকে হরকিষান সিং সুরজিৎ, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, জ্যোতি বসু, সি রাজেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত থেকে শুরু করে মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ হেগড়ে- এঁরা কেউই ওয়াকিবহাল ছিলেন না? রাজীবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিরোধী আন্দোলনের জেরে সঙ্ঘ পরিবার কীভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে গ্রামীণ ভারতে- সেই সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্যের কানাকড়ি ও কি ইএমএস, সুরজিৎ, জ্যোতিবাবু, রাজেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তদের কানে পৌঁছায়নি?

এসব রাজনৈতিক নেতারা দেশভাগ দেখেছিলেন। দেশভাগকে ত্বরান্বিত করতে হিন্দু- মুসলমান, উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির তাণ্ডব দেখেছিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে গান্ধী হত্যা দেখেছিলেন। জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনে জয় প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে আরএসএসের যৌথ আন্দোলন দেখেছিলেন। সেই আন্দোলনের জেরে ভারতে তৈরি হওয়া প্রথম অকংগ্রেসী মোরারজি দেশাইয়ের সরকার দেখেছিলেন। সেই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে আরএসএসের সরকারের ভেতরে নাকগলানোর মানসিকতা দেখেছিলেন। জুলাই সংকট দেখেছিলেন। দ্বৈতসদস্যপদকে কেন্দ্র করে দেশাই সরকার ভেঙে যেতেও এরা দেখেছিলেন। সেই মানুষগুলো তো আরএসএস-বিজেপির ভয়াবহকতার সবটুকুনিই জানতেন। তবু কেন রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বফোর্স ইস্যুতে পৃথম কর্মকাণ্ড হলেও, সেই কর্মকাণ্ডে থেকেছিলেন? একই ইস্যুতে বিজেপির কর্মতৎপরতা সেই দলকে যে ভোট রাজনীতিতে পরবর্তীতে সুযোগ করে দেবে- এটা না বোঝার মতো দূরদর্শিতার অভাব তো সে সময়ের সর্বস্তরের অকংগ্রেস, অবিজেপি নেতাদের ছিল না। এর পাশাপাশি সংঘ পরিবারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও তো ওই নেতারা তখন ওয়াকিবহাল ছিলেন- এ কথা বললে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। শাসনক্ষমতার কাছাকাছি থাকার তাগিদ কি সেই সময়ের একটা বড় অংশের রাজনৈতিক নেতার নীতির প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িকতাকে ঠেকানোর প্রশ্নে, মৌলবাদকে রোখবার প্রশ্নে খানিকটা হলেও দিগভ্রান্ত করে দিয়েছিল?

জাতীয় আন্দোলনের সময়কালের নেতারা গান্ধীজী হত্যাকাণ্ডে আরএসএসের সংযোগ ঘিরে এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর, ভোল বদলে আরএসএস কীভাবে ধীরে ধীরে সমাজজীবনের গভীরে ঢুকে পড়ছে- তা দেখেছিলেন। গান্ধী হত্যাকারী সংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচয় মুছে ফেলতে কীভাবে নিজেদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আরএসএস নিজেদের মেলে ধরতে শুরু করেছে, এসব প্রবীণ নেতারা তা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। সেই আরএসএসকে সঙ্গে নিয়ে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ন। জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে কখনও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই আন্দোলনে আরএসএসকে সংযুক্ত করলে সংঘ পরবর্তীকালে সেই সুযোগে তাদের রাজনৈতিক আগ্রাসনকে কোন স্তরে নিয়ে যাবেÑসেটা বুঝতে না পারাটা জয়প্রকাশের অত্যন্ত অপরিণামদর্শী রাজনীতি ছিল।

একই কথা প্রযোজ্য রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিজেপির আন্দোলনের পাশাপাশি অবিজেপি, এমন কি বামদলগুলোর ও সেই সময়ের অবস্থান ঘিরে। বাম দলগুলো এখানে বক্তব্য হতেই পারে, বোফর্স ইত্যাদি দুর্নীতির প্রশ্নে তাদের সেই সময়ে নীরব থাকাটা রাজনৈতিক অপরাধ হতো। তাদের বক্তব্য হতেই পারে, একই ইস্যুতে যদি পৃথকভাবে বিজেপি আন্দোলন করে, তাহলে বামেরা কি করবে? বামেরা তো একটি সভাও কখনও যৌথভাবে বিজেপির সঙ্গে করেনি। আন্দোলনের অধিকার তো সব রাজনৈতিক দলেরই আছে।

বামেদের পাশাপাশি একই ইস্যুতে আলাদাভাবে সাম্প্রদায়িক বিজেপি আন্দোলন করলে বামেদের কিছু করার থাকে না- রাজনৈতিকভাবে এটা বাস্তব। কিন্তু বিজেপি সেই আন্দোলনের সমান্তরালভাবে সংঘ পরিবারের অজস্র শাখা সংগঠনের মাধ্যমে যে নিজেদের অস্তিত্ব বিস্তার করছে, যার জেরে লোকসভায় তাদের আসন সংখ্যা দুই থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আটের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল- এই পরিবেশ তৈরির যে ঘটনাক্রম সেগুলো কি বাম রাজনীতিকেরা ঠিকমতো জানতে পারেননি? যদি জেনে থাকতেন, তাহলে সেই জানার ভিত্তিতে রাজীবের দুর্নীতির পাশাপাশি আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সুবিধা করে দিতে সেই সময়েই কি ধরনের সামাজিক প্রযুক্তি চালাচ্ছে, তার ফলে দেশের সামাজিক বিন্যাস কীভাবে খুব দ্রুত বদলাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক অভিমুখ তীব্র হচ্ছে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং অধিকার ধীরে ধীরে বিপন্ন হচ্ছেÑ সে সম্পর্কে কি তারা তখন কোন অবস্থান নিয়েছিলেন? ভিপি সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের শেষ দিকে বিজেপি যখন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসে একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে, তখন যে সুরে বিজেপির নোংরা রাজনীতির বিরোধিতা হয়েছিল, সেই সুরে কি রাজীব জামানার শেষ দিকে, যখন বিজেপি ও বোফর্স ইস্যুতে আন্দোলন করছে, রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করবার কথা বলছে- সেই সময়ে কি বিজেপির সাম্প্রদায়িক অভিমুখ ঘিরে পরবর্তী সময়ের মতো রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছিল? নাকি অকংগ্রেসি, অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলো তখন দেখে শুনে বুঝে ও আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অবস্থান ঘিরে নীরব ছিল? ইচ্ছাকৃত নয়, রাজীবকে ক্ষমতাচ্যুত করবার ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডার জন্য শীতল মনোভাব দেখাচ্ছিল?

মোরারজি দেশাই সরকারের পরিচালক জনতা পার্টির ভেতর গান্ধী হত্যাকারী আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনসংঘ শামিল ছিল। আজকের বিজেপির সেদিন সংস্করণই হলো এই জনসংঘ। দেশাই সরকারের ভেতরে থাকার সুবাদে মাত্র দুই বছরের ও কম সময় ওই সরকারের অস্তিত্বের ভেতরেই প্রশাসনের শিরা উপশিরায় আরএসএস নিজেদের ছড়িয়ে দিতে অনেকখানি সক্ষম হয়েছিল। সেই সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই কিন্তু আরএসএস-পরবর্তীতে তাদের বিবর্তিত রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ভোট রাজনীতিতে অনেকখানি সফল করে তুলেছে।

নিজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরোধীদের আন্দোলনের মোকাবিলায় রাজীব হাঁটলেন নরম সাম্প্রদায়িকতার পথে। আর সেই সুযোগ আরএসএস নিলো পরিপূর্ণভাবে। বামেরাও সেই সময়ে রাজীবকে ক্ষমতাচ্যুত করবার লক্ষ্যে এতটাই দৃঢ় সংকল্প যে, গোটা বিরোধী শিবিরের আন্দোলনকে ব্যবহার করে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কতটা শক্তিশালী করে তুলছে, ভূমিস্তরে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়িয়ে বিজেপির ভোটব্যাংক কতটা বাড়াচ্ছে-সেদিকে সজাগ-নিরপেক্ষ-নির্মোহ দৃষ্টি তখন প্রায় কোন রাজনৈতিক দলেরই নেই।

ভিপি সিংয়ের সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সুবাদে মাত্র এক দেড় বছর সময়ের ভেতরে আরএসএস তাদের হাজারটা শাখা সংগঠনকে আরও কতটা ভূমিস্তরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল- সেসব ভাবলে আজ আমাদের শিউরে উঠতে হয়। আরএসএসের এসব শাখা সংগঠনগুলোর বিস্তারের জেরে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কীভাবে শক্তিশালী হয়েছিল-এ সম্পর্কে কিন্তু প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এখন কার্যত নীরবতা পালন করে চলে। জানি না, বামদলগুলো তাদের অতীত পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ভিপি সিং সরকারের সময়ে বিজেপি ট্রেজারি বেঞ্চে বসার বিষময় ফল পরবর্তীতে আরএসএস-বিজেপির বিস্তারের ক্ষেত্রে কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল, সেই সম্পর্কে কোনো বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করেছেন কি না।

বিজেপির মতো হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল, যারা পরিচালিত হয় আরএসএসের আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, ফ্যাসিবাদী দর্শনকে সম্বল করে, সেই দলটি সরকারের অভ্যন্তরে কোনোভাবে ঢোকবার সুযোগ পেলে নিজেদের নখদন্ত বিস্তারের একটি প্রয়াসকেও ফসকে যেতে দেবে নাÑএটা কি ভিপি সিং সরকার তৈরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যেসব রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন, তারা জানতেন না? বুঝতেন না সেই বাস্তবতাকে? নাকি শর্ট টাইম অ্যাচিভমেন্টের তাগিদে তারা আগামী ভারত কোন প্রলয়ঙ্কর ধ্বংসের পথে হাঁটবে-তা ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন?

এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, নয় দশকের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগেই বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির যে ভোট রাজনীতির সাফল্য, সেটির পেছনে অনেকখানিই ভূমিকা এবং অবদান ভিপি সিং সরকারকে বাইরের থেকে বিজেপির সমর্থন করবার ঘটনাটি। বিজেপির যাবতীয় কর্মকাণ্ড যে শুধু হুজুগে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, তার পেছনে ভারতের চিরাচরিত বহুত্ববাদী দর্শনের একদম বিপরীত একটি দর্শন আছে, যে দর্শনে একমাত্র রাজনৈতিক হিন্দুদেরই ঠাঁই আছে, বাকি মুসলমানসহ যাবতীয় সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, কমিউনিস্ট- কারো ঠাঁই নেই- এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব না দিয়ে বিজেপিকে সেদিন ট্রেজারি বেঞ্চে বসবার সুযোগ দেয়া সে সময়ের সমস্ত অকংগ্রেস, অবিজেপি রাজনীতিকদের চরমতম ভুল।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]