বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরে বন

উপকূল এলাকায় যেসব চর জেগেছে তাতে গাছ লাগাবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বেশ আগে। কর্মকর্তারা বলছেন, এখন চরগুলোতে সবুজের সমারোহ। পুরো এলাকাজুড়ে গাছগাছালি আর লতা-গুল্মের কুঁড়ি। গাছে-গাছে পাখি, কলতানে মুখরিত পুরো এলাকা।

ভোলার চরফ্যাশনসহ উপকূলীয় চরের নতুন বনাঞ্চলগুলোতে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। এসব চরাঞ্চলে বনায়নের ফলে ভূমির ক্ষয় কমে গিয়ে নতুন ভূখ- যুক্ত হচ্ছে দেশের সঙ্গে, বলছেন কর্মকর্তারা।

‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরসহ উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন’ এই প্রকল্পের অধীনেই চলছে এই কাজ।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে উপকূলীয় গ্রিন বেল্ট তৈরি হচ্ছে। ফলে উপকূলীয় এলাকা নিরাপদ থাকার পাশাপাশি ভূমিও বাড়ছে। গ্রিন বেল্টের মাধ্যমে উপকূল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। অন্যদিকে বনায়নের ফলে সেডিমেন্ট জমা হতে হতে এক সময় মাটি উঁচু হবে। এসব স্থানে জোয়ারের পানি উঠবে না এবং সবুজ ঘাস জন্ম নেবে। ফলে স্থায়ী ভূমিতে রূপ নেবে উপকূলে জেগে ওঠা চর।

প্রকল্প অফিস সূত্র বলছে, উপকূলীয় নয়টি জেলায় বনায়ন করার ফলে দেশের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত চার বছরে ১৯ হাজার ৩৯৫ হেক্টর বা ১৯৩.৯৫ বর্গকিলোমিটার ভূমি যুক্ত হয়েছে। প্রকল্প সংশিষ্টদের আশা, ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্ত হবে আরও ৫ হাজার ৬০৫ হেক্টর বা ৫৬.০৫ বর্গকিলোমিটার। ফলে, চলতি বছরের শেষের দিকে দেশের স্থলভাগের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হবে ২৫ হাজার হেক্টর জমি।

২০১৮ সালের শুরুতে বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা নতুন চরে বনায়নের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে চর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত এবং স্থায়ীকরণ, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে সবুজ বেষ্টনী তৈরি, কার্বন মজুদ বৃদ্ধি, আবাসস্থল এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে বলে জানানো হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। প্রকল্প অফিস সূত্র জানায়, দেশের ৯টি জেলার ৬৭টি উপজেলায় ৬টি বনবিভাগের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলাগুলো হচ্ছে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার।

বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরসহ উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হারুন অর রশীদ জানান, বর্তমানে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী এবং গলাচিপায়, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়, ভোলার চরফ্যাশন এবং মনপুরা, নোয়াখালীর হাতিয়া, চট্টগ্রামের সন্দীপ এলাকার বঙ্গোপসাগরে জেগে উঠা চরে কাজ চলছে। এছাড়াও পিরোজপুর এবং কক্সবাজার এলাকায় সড়কের পাশে বনায়ন এবং বসতবাড়িতে বনায়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যা ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে।

তিনি আরও জানান, দেশের মধ্যে যে ৫৭টি আন্তঃদেশীয় নদী রয়েছে তার মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে। বাকি তিনটি এসেছে মায়ানমার থেকে। এসব নদী দিয়ে প্রতিবছর ১.৪ বিলিয়ন মেট্রিকটন মাটি বা পলি উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় জমে নতুন চরের সৃষ্টি করে। যার আয়তন প্রায় ৭-৮ হাজার হেক্টর বা ৭০-৮০ বর্গ কিলোমিটার। এসব চর টিকিয়ে রাখতে হলে সামাজিক বনায়নের মতো করে চর বনায়ন ও সংরক্ষণের জন্য বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। এজন্য সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলে সবুজ বেষ্টনী করার কাজ করছে। চরগুলোতে সবুজায়নের ফলে তা দেশের ভূখ-ের সঙ্গে যোগ হচ্ছে।

কর্মকর্তারা আশা করছেন এই বনাঞ্চল বঙ্গোপসাগর দিয়ে আসা ‘বুলবুল’ এর মত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের স্থলভাগে প্রবেশ করতে বাধা দিবে। উপকূল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে।

ইতোমধ্যে চরে ২৫,০০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান তৈরি, ১০০০ সিডলিং কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান তৈরি এবং ৪০ হাজার বসতবাড়ির আঙিনায় বনায়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

চর ফ্যাশনের রেঞ্জ অফিসার চন্দ্র শেখর দাস সংবাদকে বলেন, ‘চর ফ্যাশনে ৮৯৫ হেক্টর জমিতে গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। এসব বনে বিভিন্ন দেশীয় পাখি ছাড়াও শীতকালে বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি পাখির আগমণ ঘটে। চলতি বছর আরও ২০০ হেক্টর জমিতে চারা লাগানো হবে।’

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের বুকে প্রাকৃতিকভাবেই বিশাল বিশাল চর জেগেছে। গড়ে উঠেছে মাইলের পর মাইল ভূখ-। বেশ কয়েকটি চরভূমি এরইমধ্যে স্থায়ী ভূখ-ে পরিণত হয়েছে। সেসব স্থানে জনবসতিও গড়ে উঠেছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সংবাদকে বলেন, দক্ষিণে জেগে ওঠা এসব চর দেশের আয়তন বাড়াচ্ছে। চরগুলোকে ধরে রাখতে ও বসবাসের উপযোগী করতে বনায়ন হচ্ছে।

‘আমাদের এই প্রকল্পটি একটি সফল প্রজেক্ট। আমরা চরে গাছ লাগানোর কারণে এই চরগুলো ধরে রাখতে পারছি, না হয় আমরা এই চরগুলো ধরে রাখতে পারতাম না। উপকূলে যেসব চর জাগবে সেসব চরেই আমরা বৃক্ষ লাগিয়ে দিব, না হলে এই চরগুলোকে রক্ষা করা যাবে না,’ বলেন মন্ত্রী।

রবিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২১ , ২২ কার্তিক ১৪২৮ ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরে বন

শাফিউল ইমরান

image

উপকূল এলাকায় যেসব চর জেগেছে তাতে গাছ লাগাবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বেশ আগে। কর্মকর্তারা বলছেন, এখন চরগুলোতে সবুজের সমারোহ। পুরো এলাকাজুড়ে গাছগাছালি আর লতা-গুল্মের কুঁড়ি। গাছে-গাছে পাখি, কলতানে মুখরিত পুরো এলাকা।

ভোলার চরফ্যাশনসহ উপকূলীয় চরের নতুন বনাঞ্চলগুলোতে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। এসব চরাঞ্চলে বনায়নের ফলে ভূমির ক্ষয় কমে গিয়ে নতুন ভূখ- যুক্ত হচ্ছে দেশের সঙ্গে, বলছেন কর্মকর্তারা।

‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরসহ উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন’ এই প্রকল্পের অধীনেই চলছে এই কাজ।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে উপকূলীয় গ্রিন বেল্ট তৈরি হচ্ছে। ফলে উপকূলীয় এলাকা নিরাপদ থাকার পাশাপাশি ভূমিও বাড়ছে। গ্রিন বেল্টের মাধ্যমে উপকূল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। অন্যদিকে বনায়নের ফলে সেডিমেন্ট জমা হতে হতে এক সময় মাটি উঁচু হবে। এসব স্থানে জোয়ারের পানি উঠবে না এবং সবুজ ঘাস জন্ম নেবে। ফলে স্থায়ী ভূমিতে রূপ নেবে উপকূলে জেগে ওঠা চর।

প্রকল্প অফিস সূত্র বলছে, উপকূলীয় নয়টি জেলায় বনায়ন করার ফলে দেশের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত চার বছরে ১৯ হাজার ৩৯৫ হেক্টর বা ১৯৩.৯৫ বর্গকিলোমিটার ভূমি যুক্ত হয়েছে। প্রকল্প সংশিষ্টদের আশা, ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্ত হবে আরও ৫ হাজার ৬০৫ হেক্টর বা ৫৬.০৫ বর্গকিলোমিটার। ফলে, চলতি বছরের শেষের দিকে দেশের স্থলভাগের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হবে ২৫ হাজার হেক্টর জমি।

২০১৮ সালের শুরুতে বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা নতুন চরে বনায়নের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে চর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত এবং স্থায়ীকরণ, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে সবুজ বেষ্টনী তৈরি, কার্বন মজুদ বৃদ্ধি, আবাসস্থল এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে বলে জানানো হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। প্রকল্প অফিস সূত্র জানায়, দেশের ৯টি জেলার ৬৭টি উপজেলায় ৬টি বনবিভাগের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলাগুলো হচ্ছে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার।

বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নতুন চরসহ উপকূলীয় এলাকায় বনায়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হারুন অর রশীদ জানান, বর্তমানে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী এবং গলাচিপায়, বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়, ভোলার চরফ্যাশন এবং মনপুরা, নোয়াখালীর হাতিয়া, চট্টগ্রামের সন্দীপ এলাকার বঙ্গোপসাগরে জেগে উঠা চরে কাজ চলছে। এছাড়াও পিরোজপুর এবং কক্সবাজার এলাকায় সড়কের পাশে বনায়ন এবং বসতবাড়িতে বনায়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যা ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে।

তিনি আরও জানান, দেশের মধ্যে যে ৫৭টি আন্তঃদেশীয় নদী রয়েছে তার মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে। বাকি তিনটি এসেছে মায়ানমার থেকে। এসব নদী দিয়ে প্রতিবছর ১.৪ বিলিয়ন মেট্রিকটন মাটি বা পলি উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় জমে নতুন চরের সৃষ্টি করে। যার আয়তন প্রায় ৭-৮ হাজার হেক্টর বা ৭০-৮০ বর্গ কিলোমিটার। এসব চর টিকিয়ে রাখতে হলে সামাজিক বনায়নের মতো করে চর বনায়ন ও সংরক্ষণের জন্য বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি। এজন্য সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলে সবুজ বেষ্টনী করার কাজ করছে। চরগুলোতে সবুজায়নের ফলে তা দেশের ভূখ-ের সঙ্গে যোগ হচ্ছে।

কর্মকর্তারা আশা করছেন এই বনাঞ্চল বঙ্গোপসাগর দিয়ে আসা ‘বুলবুল’ এর মত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের স্থলভাগে প্রবেশ করতে বাধা দিবে। উপকূল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে।

ইতোমধ্যে চরে ২৫,০০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান তৈরি, ১০০০ সিডলিং কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান তৈরি এবং ৪০ হাজার বসতবাড়ির আঙিনায় বনায়নের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

চর ফ্যাশনের রেঞ্জ অফিসার চন্দ্র শেখর দাস সংবাদকে বলেন, ‘চর ফ্যাশনে ৮৯৫ হেক্টর জমিতে গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। এসব বনে বিভিন্ন দেশীয় পাখি ছাড়াও শীতকালে বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি পাখির আগমণ ঘটে। চলতি বছর আরও ২০০ হেক্টর জমিতে চারা লাগানো হবে।’

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের বুকে প্রাকৃতিকভাবেই বিশাল বিশাল চর জেগেছে। গড়ে উঠেছে মাইলের পর মাইল ভূখ-। বেশ কয়েকটি চরভূমি এরইমধ্যে স্থায়ী ভূখ-ে পরিণত হয়েছে। সেসব স্থানে জনবসতিও গড়ে উঠেছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সংবাদকে বলেন, দক্ষিণে জেগে ওঠা এসব চর দেশের আয়তন বাড়াচ্ছে। চরগুলোকে ধরে রাখতে ও বসবাসের উপযোগী করতে বনায়ন হচ্ছে।

‘আমাদের এই প্রকল্পটি একটি সফল প্রজেক্ট। আমরা চরে গাছ লাগানোর কারণে এই চরগুলো ধরে রাখতে পারছি, না হয় আমরা এই চরগুলো ধরে রাখতে পারতাম না। উপকূলে যেসব চর জাগবে সেসব চরেই আমরা বৃক্ষ লাগিয়ে দিব, না হলে এই চরগুলোকে রক্ষা করা যাবে না,’ বলেন মন্ত্রী।