৮ মানবপাচারকারী গ্রেপ্তার, স্বীকারোক্তি : সাত বছরে ৫শ’ ব্যক্তিকে দুবাই পাচার

সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র জাল করে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার করছে- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব সদস্যরা ঢাকা, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৮ মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল র‌্যাব-৩ টিকাটুলি অফিস থেকে এ সব তথ্য জানা গেছে। এ চক্র গত সাত বছরে ৫শ’র বেশি লোককে দুবাই পাচার করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা মানব পাচারের নানা কাহিনী স্বীকার করেছে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, পলাতক অন্যদের ধরতে চলছে র‌্যাবের অভিযান।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলোÑ মো. নাইম খান ওরফে লোটাস, নূরে আলম শাহরিয়ার, রিমন সরকার, গোলাম মোস্তফা সুমন, বদরুল ইসলাম, খোরশেদ আলম, মো. সোহেল ও মো. হাবিব।

গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমই কার্ড, ১টি সিপিআইইউ, ১টি প্রিন্টার, ৫১টি স্ক্যানার, ২ বক্র খালি কার্ড, ৫টি মোবাইল ফোন, ১টি চেক বই ও ৫টি নকল সিল উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাব-৩ মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা বীণা রাণী দাস জানিয়েছেন, বিদেশ যেতে চাওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগী র‌্যাব-৩ অফিসে অভিযোগ করে বলেন, একটি চক্র তাদের ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা বিএমইটি ইমিগ্রেশন কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে অস্বীকার করেন। তারা তাদের পাওনা টাকা ফেরত চান। এরপর মানব পাচারকারী চক্র নকল (জাল) বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে তাদের দেয়। তারা ওই কার্ড নিয়ে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে গেলে কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের (ভিকটিম) ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করে। এরপর তাদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করে। তখন বিদেশ যেতে ইচ্ছুকরা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। এরপর তারা যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়।

অবশেষে ভুক্তভোগীদের অভিযোগেরভিত্তিতে র‌্যাব রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ও কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় গতকাল পর্যন্ত টানা অভিযান চালিয়ে ৮ মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাবের অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত নাইম খান ওরফে লোটাস চক্রের মূল হোতা। সে দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে সে দেশে ফেরত আসে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। সে ২০১২ সালে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে দুবাই যায়। পরবর্তীতে দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাইয়ে অবস্থানকারীদের কাজের বৈধতা দেয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাইম মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ে।

সে দুবাইয়ে তার পরিচিত লোকজনের মাধ্যমে উচ্চ বেতনের লোভ দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুদ্ধ করে। এরপর বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তি রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। বিদেশ গিয়ে কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এ চক্র গত ৭ সাত বছরে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে দুবাই পাচার করেছে। মানব পাচার থেকে আয় করা অবৈধ টাকা দিয়ে দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয়। নিজে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেয়।

অভিযুক্ত নাইম জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার এক সহযোগীও রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত নুরুল আলম শাহরিয়ার বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে। শাহরিয়ার বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

বিএমইটি কার্ড জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা হাবিব এবং খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ জালিয়াতি করে মানব পাচার করছে। ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিএমইটি একটি কার্ড, আবার ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে কার্ড দেয়া হয়। এভাবে জালিয়াতি করে নকল কার্ড তৈরি করা হয়। আবার কখনও ১ হাজার থেকে ৬৫০ টাকা নিয়েছে।

এ জালিয়াতি চক্র গত ৪ বছর ধরে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে আসছে।

উল্লেখ্য এর আগেও র‌্যাব সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে নানা তথ্য দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, পলাতকদের ধরতে চলছে অভিযান।

রবিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২১ , ২২ কার্তিক ১৪২৮ ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

জালিয়াতি করে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর ঘটনায়

৮ মানবপাচারকারী গ্রেপ্তার, স্বীকারোক্তি : সাত বছরে ৫শ’ ব্যক্তিকে দুবাই পাচার

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র জাল করে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার করছে- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব সদস্যরা ঢাকা, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৮ মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল র‌্যাব-৩ টিকাটুলি অফিস থেকে এ সব তথ্য জানা গেছে। এ চক্র গত সাত বছরে ৫শ’র বেশি লোককে দুবাই পাচার করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা মানব পাচারের নানা কাহিনী স্বীকার করেছে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, পলাতক অন্যদের ধরতে চলছে র‌্যাবের অভিযান।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলোÑ মো. নাইম খান ওরফে লোটাস, নূরে আলম শাহরিয়ার, রিমন সরকার, গোলাম মোস্তফা সুমন, বদরুল ইসলাম, খোরশেদ আলম, মো. সোহেল ও মো. হাবিব।

গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমই কার্ড, ১টি সিপিআইইউ, ১টি প্রিন্টার, ৫১টি স্ক্যানার, ২ বক্র খালি কার্ড, ৫টি মোবাইল ফোন, ১টি চেক বই ও ৫টি নকল সিল উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাব-৩ মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা বীণা রাণী দাস জানিয়েছেন, বিদেশ যেতে চাওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগী র‌্যাব-৩ অফিসে অভিযোগ করে বলেন, একটি চক্র তাদের ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা বিএমইটি ইমিগ্রেশন কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে অস্বীকার করেন। তারা তাদের পাওনা টাকা ফেরত চান। এরপর মানব পাচারকারী চক্র নকল (জাল) বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে তাদের দেয়। তারা ওই কার্ড নিয়ে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে গেলে কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের (ভিকটিম) ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করে। এরপর তাদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করে। তখন বিদেশ যেতে ইচ্ছুকরা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। এরপর তারা যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়।

অবশেষে ভুক্তভোগীদের অভিযোগেরভিত্তিতে র‌্যাব রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ও কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় গতকাল পর্যন্ত টানা অভিযান চালিয়ে ৮ মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।

র‌্যাবের অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত নাইম খান ওরফে লোটাস চক্রের মূল হোতা। সে দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে সে দেশে ফেরত আসে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। সে ২০১২ সালে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে দুবাই যায়। পরবর্তীতে দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাইয়ে অবস্থানকারীদের কাজের বৈধতা দেয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নাইম মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ে।

সে দুবাইয়ে তার পরিচিত লোকজনের মাধ্যমে উচ্চ বেতনের লোভ দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুদ্ধ করে। এরপর বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তি রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। বিদেশ গিয়ে কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এ চক্র গত ৭ সাত বছরে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে দুবাই পাচার করেছে। মানব পাচার থেকে আয় করা অবৈধ টাকা দিয়ে দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয়। নিজে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেয়।

অভিযুক্ত নাইম জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার এক সহযোগীও রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত নুরুল আলম শাহরিয়ার বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে। শাহরিয়ার বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

বিএমইটি কার্ড জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা হাবিব এবং খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ জালিয়াতি করে মানব পাচার করছে। ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিএমইটি একটি কার্ড, আবার ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে কার্ড দেয়া হয়। এভাবে জালিয়াতি করে নকল কার্ড তৈরি করা হয়। আবার কখনও ১ হাজার থেকে ৬৫০ টাকা নিয়েছে।

এ জালিয়াতি চক্র গত ৪ বছর ধরে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে আসছে।

উল্লেখ্য এর আগেও র‌্যাব সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে নানা তথ্য দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মতে, পলাতকদের ধরতে চলছে অভিযান।