কুমিল্লাকাণ্ডের আক্রোশ ত্রিপুরায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

কুমিল্লাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপের ভাঙচুর ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশে পূজামণ্ডপে সহিংসতার পর থেকে বিজেপি শাসিত আসাম ও ত্রিপুরায় গেরুয়া পরিহিত উগ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। কয়েকটি পোস্টে মসজিদ আগুনে জ্বলতেও দেখা গেছে। কিন্তু সহিংসতার সকল অভিযোগ ত্রিপুরার পুলিশ অস্বীকার করেছে। পৌর নির্বাচন অত্যাসন্ন বিধায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোটের আশায় ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বা বিরোধী দল এই সব দাঙ্গার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না। তবে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্মের নামে যারা সহিংসতা করে তারা হিন্দু নয়, ভণ্ড’।

ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রচার না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়েছে যে, ত্রিপুরায় ১৬টি মসজিদ এবং অনেকগুলো দোকান ও ঘর-বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। কিন্তু রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, পুড়ে যাওয়া কোরআন হাতে যুবককের ছবিসহ যে কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে সেগুলো নয়াদিল্লির কাঞ্চন কুঞ্জের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার, ত্রিপুরার নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি পোস্টে একটি বিশাল জনসমাবেশের ভিডিও দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় মসজিদে আগুন দেয়া, ভাঙচুর করা এবং হজরত মুহাম্মদকে (সা.) কটূক্তি করার প্রতিবাদে ত্রিপুরার মুসলমানেরা জেগে উঠেছে; প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি উত্তর প্রদেশের বাদাউনে মুসলিম নেতা হজরত আবদুল হামিদ মোহাম্মদ সালিমুল কাদরির জানাজার ভিডিও।

তাই বলে ত্রিপুরায় কিছুই হয়নি তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও তাদের পূজামণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে বিজেপির ঘনিষ্ট মিত্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিরুদ্ধে একটি মসজিদ এবং তিনটি বাড়ি ও তিনটি দোকান ভাঙচুরসহ দুটি দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২৫ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের পর ২০১৮ সনের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ত্রিপুরায় জয়লাভ করে। ত্রিপুরার ৪২ লাখ জনসংখ্যার ৯ শতাংশের মতো মুসলিম। আবার হরিয়ানায় একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুসলমানদের জনসমক্ষে খোলা জায়গায় নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য ‘জয় শ্রীরাম’ সেøাগান দিয়ে যারা নামাজে বাধা বিঘœ সৃষ্টি করছিল তাদের আটক করা হয়েছে। মুসলমানদের অভিযোগ, মসজিদ তৈরির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না বলেই তাদের খোলা জায়গায় জুমার নামাজ পড়তে হচ্ছে।

ধর্ম দিয়ে সৃষ্টিকর্তা মানুষগুলোকে সততার সঙ্গে জীবনযাপনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে, ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা শয়তানের না থাকলে পৃথিবী আরও শান্ত এবং সুশৃঙ্খল থাকত। আমি আগেও বলেছি, রাজ্য দখল বা সম্পদ লুণ্ঠন করার হানাহানিতে যত লোক মরেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মরেছে ধর্ম এবং জাতিগত বিরোধে। এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব যে সব ধর্ম স্বীকার করে তাদের অনুসারীদের মধ্যেও জীবনাচরণ ও প্রার্থনার ধরন নিয়ে খুনাখুনি হয়েছে এবং হচ্ছে। জেরুজালেমে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের উপসনালয় গড়ে উঠেছে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করার জন্য, উক্ত তিনটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থও এসেছে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে, উক্ত তিনটি ধর্মের নবীও পারস্পরিক ধর্মমতে স্বীকৃত; ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানেরা একই সৃষ্টিকর্তার উপাসক। এতদসত্ত্বেও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার জন্য নির্মিত উপাসনালয় নিয়ে এই তিন ধর্মের লোকজন খুনাখুনি করছে। ভারতবর্ষেও উপসনালয় নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। মোঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি হিন্দুদের মন্দির ভেঙে তৈরি করেছে মসজিদ, আধুনিক হিন্দুরা সেই মসজিদ ভেঙে একই জায়গায় করেছে রামমন্দির। মনে হচ্ছে, উপসনালয় গড়ার জন্য খালি জায়গা পৃথিবীতে আর নেই। শুধু প্রার্থনার ভিন্নতার জন্য এক ধর্মাবলম্বী আরেক ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করছে, সৃষ্টিকর্তার আরাধনার জন্য তৈরি প্রার্থনাগৃহ ধ্বংস করছে।

ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার ঘটনা নতুন নয়; মানুষের কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মপালন করার একটি পর্যায়ে নতুন চিন্তার কোন লোক এসে তার বিরুদ্ধাচরণ করা থেকেই ধর্মানুভূতির আঘাত শুরু হয়। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহ; কিন্তু পরবর্তীতে হযরত ঈসা (আ.) এসে নতুন কথা বলায় ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং তাদের আনন্দ, উল্লাসের মধ্যে হযরত ঈসা (আ.)-কে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়। কত নিষ্ঠুর আচরণ। ঈসা নবী তো তাঁর কথা শোনার জন্য, পরিপালনের জন্য কাউকে জোরজবরদস্তি করেননি, কারো ওপর সামান্যতম আঘাতও করেননি, তাহলে শুধু নতুন কথার জন্য তাঁকে কেন হত্যা করা হলো, তা কেমন ধর্মানুভূতি যা একজন নবীকে হত্যা করতে ইহুদিদের উদ্বুদ্ধ করেছিল? পরে আমাদের ইসলাম ধর্ম এলে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের বিচ্যুতি এবং মক্কায় মূর্তিপুজোকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। আমাদের নবীজীর নতুন কথাতেও তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে, তারা নানাভাবে নবীজীকে হত্যার চেষ্টা করে। আঘাত লাগাই যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে তো খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা নয়। এখন কারো কথা ধর্মের বিরুদ্ধে গেলে তাকে হত্যা করার জন্য কিছু লোক উন্মাদ হয়ে যায়।

ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব সরকারের আদি বাড়ি বাংলাদেশের চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার মা-বাবা ত্রিপুরা চলে যান। এরপর তারা সেখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। বিপ্লব দেব সরকারের আদি বাসস্থান কুমিল্লায় সংখ্যালঘু হিন্দুরা উগ্র কিছু মুসলমানের তাণ্ডবে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের আমলে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা ত্রিপুরা রাজ্যে উগ্র হিন্দুদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। কুমিল্লাকাণ্ডের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা দুর্ভাগ্যজনক। সব ধর্মাবলম্বীর মানুষ পৃথিবীর কোন না কোন দেশে সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হলে ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। হিন্দু, মুসলমান দুই ধর্মাবলম্বীর লোক এখন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলছে- ওই সব দেশে হিন্দু, মুসলমান উভয় শ্রেণীর লোক সংখ্যালঘু। ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বিচারে হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক খ্রিস্টানদের তুলনায় সংখ্যালঘু। তাই কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। ১৯৪৮ সনে

গভীর রাতে পরিত্যক্ত বাবরি মসজিদের মধ্যে রামলালার মূর্তি রেখে এসে যারা রামের আবির্ভাবের কথা প্রচার করেছিল তাদের চিহ্নিত করা হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে হনুমানের কোলে যে কোরআন রেখে এসেছিল তাকে ধরা হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশে ধর্মের নামে দাঙ্গা বাঁধানো লোকগুলোর বাইরের জগতের আলো-বাতাসে শান্তিতে বসবাসের অধিকার নেই; এদের স্থায়ী বসতি জেলখানার অন্ধ প্রকৌষ্ঠে হলে সরকারকে সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণসহ সার্বিক নিরাপত্তায় আলাদা ব্যবস্থা নিতে হয় না। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নাকি বলেছেন, ‘এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না; যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করে না তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে’।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী উপপরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

রবিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২১ , ২২ কার্তিক ১৪২৮ ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

কুমিল্লাকাণ্ডের আক্রোশ ত্রিপুরায়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

কুমিল্লাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপের ভাঙচুর ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশে পূজামণ্ডপে সহিংসতার পর থেকে বিজেপি শাসিত আসাম ও ত্রিপুরায় গেরুয়া পরিহিত উগ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। কয়েকটি পোস্টে মসজিদ আগুনে জ্বলতেও দেখা গেছে। কিন্তু সহিংসতার সকল অভিযোগ ত্রিপুরার পুলিশ অস্বীকার করেছে। পৌর নির্বাচন অত্যাসন্ন বিধায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোটের আশায় ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বা বিরোধী দল এই সব দাঙ্গার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না। তবে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘হিন্দু ধর্মের নামে যারা সহিংসতা করে তারা হিন্দু নয়, ভণ্ড’।

ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রচার না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়েছে যে, ত্রিপুরায় ১৬টি মসজিদ এবং অনেকগুলো দোকান ও ঘর-বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। কিন্তু রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, পুড়ে যাওয়া কোরআন হাতে যুবককের ছবিসহ যে কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে সেগুলো নয়াদিল্লির কাঞ্চন কুঞ্জের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার, ত্রিপুরার নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি পোস্টে একটি বিশাল জনসমাবেশের ভিডিও দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় মসজিদে আগুন দেয়া, ভাঙচুর করা এবং হজরত মুহাম্মদকে (সা.) কটূক্তি করার প্রতিবাদে ত্রিপুরার মুসলমানেরা জেগে উঠেছে; প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি উত্তর প্রদেশের বাদাউনে মুসলিম নেতা হজরত আবদুল হামিদ মোহাম্মদ সালিমুল কাদরির জানাজার ভিডিও।

তাই বলে ত্রিপুরায় কিছুই হয়নি তা কিন্তু নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও তাদের পূজামণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে বিজেপির ঘনিষ্ট মিত্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিরুদ্ধে একটি মসজিদ এবং তিনটি বাড়ি ও তিনটি দোকান ভাঙচুরসহ দুটি দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২৫ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের পর ২০১৮ সনের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ত্রিপুরায় জয়লাভ করে। ত্রিপুরার ৪২ লাখ জনসংখ্যার ৯ শতাংশের মতো মুসলিম। আবার হরিয়ানায় একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুসলমানদের জনসমক্ষে খোলা জায়গায় নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য ‘জয় শ্রীরাম’ সেøাগান দিয়ে যারা নামাজে বাধা বিঘœ সৃষ্টি করছিল তাদের আটক করা হয়েছে। মুসলমানদের অভিযোগ, মসজিদ তৈরির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছে না বলেই তাদের খোলা জায়গায় জুমার নামাজ পড়তে হচ্ছে।

ধর্ম দিয়ে সৃষ্টিকর্তা মানুষগুলোকে সততার সঙ্গে জীবনযাপনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে, ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা শয়তানের না থাকলে পৃথিবী আরও শান্ত এবং সুশৃঙ্খল থাকত। আমি আগেও বলেছি, রাজ্য দখল বা সম্পদ লুণ্ঠন করার হানাহানিতে যত লোক মরেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মরেছে ধর্ম এবং জাতিগত বিরোধে। এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব যে সব ধর্ম স্বীকার করে তাদের অনুসারীদের মধ্যেও জীবনাচরণ ও প্রার্থনার ধরন নিয়ে খুনাখুনি হয়েছে এবং হচ্ছে। জেরুজালেমে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের উপসনালয় গড়ে উঠেছে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করার জন্য, উক্ত তিনটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থও এসেছে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে, উক্ত তিনটি ধর্মের নবীও পারস্পরিক ধর্মমতে স্বীকৃত; ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানেরা একই সৃষ্টিকর্তার উপাসক। এতদসত্ত্বেও সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার জন্য নির্মিত উপাসনালয় নিয়ে এই তিন ধর্মের লোকজন খুনাখুনি করছে। ভারতবর্ষেও উপসনালয় নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। মোঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি হিন্দুদের মন্দির ভেঙে তৈরি করেছে মসজিদ, আধুনিক হিন্দুরা সেই মসজিদ ভেঙে একই জায়গায় করেছে রামমন্দির। মনে হচ্ছে, উপসনালয় গড়ার জন্য খালি জায়গা পৃথিবীতে আর নেই। শুধু প্রার্থনার ভিন্নতার জন্য এক ধর্মাবলম্বী আরেক ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করছে, সৃষ্টিকর্তার আরাধনার জন্য তৈরি প্রার্থনাগৃহ ধ্বংস করছে।

ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার ঘটনা নতুন নয়; মানুষের কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মপালন করার একটি পর্যায়ে নতুন চিন্তার কোন লোক এসে তার বিরুদ্ধাচরণ করা থেকেই ধর্মানুভূতির আঘাত শুরু হয়। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহ; কিন্তু পরবর্তীতে হযরত ঈসা (আ.) এসে নতুন কথা বলায় ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং তাদের আনন্দ, উল্লাসের মধ্যে হযরত ঈসা (আ.)-কে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়। কত নিষ্ঠুর আচরণ। ঈসা নবী তো তাঁর কথা শোনার জন্য, পরিপালনের জন্য কাউকে জোরজবরদস্তি করেননি, কারো ওপর সামান্যতম আঘাতও করেননি, তাহলে শুধু নতুন কথার জন্য তাঁকে কেন হত্যা করা হলো, তা কেমন ধর্মানুভূতি যা একজন নবীকে হত্যা করতে ইহুদিদের উদ্বুদ্ধ করেছিল? পরে আমাদের ইসলাম ধর্ম এলে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের বিচ্যুতি এবং মক্কায় মূর্তিপুজোকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। আমাদের নবীজীর নতুন কথাতেও তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে, তারা নানাভাবে নবীজীকে হত্যার চেষ্টা করে। আঘাত লাগাই যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে তো খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা নয়। এখন কারো কথা ধর্মের বিরুদ্ধে গেলে তাকে হত্যা করার জন্য কিছু লোক উন্মাদ হয়ে যায়।

ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব সরকারের আদি বাড়ি বাংলাদেশের চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার মা-বাবা ত্রিপুরা চলে যান। এরপর তারা সেখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। বিপ্লব দেব সরকারের আদি বাসস্থান কুমিল্লায় সংখ্যালঘু হিন্দুরা উগ্র কিছু মুসলমানের তাণ্ডবে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের আমলে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা ত্রিপুরা রাজ্যে উগ্র হিন্দুদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। কুমিল্লাকাণ্ডের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা দুর্ভাগ্যজনক। সব ধর্মাবলম্বীর মানুষ পৃথিবীর কোন না কোন দেশে সংখ্যালঘু। বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হলে ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। হিন্দু, মুসলমান দুই ধর্মাবলম্বীর লোক এখন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলছে- ওই সব দেশে হিন্দু, মুসলমান উভয় শ্রেণীর লোক সংখ্যালঘু। ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বিচারে হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক খ্রিস্টানদের তুলনায় সংখ্যালঘু। তাই কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। ১৯৪৮ সনে

গভীর রাতে পরিত্যক্ত বাবরি মসজিদের মধ্যে রামলালার মূর্তি রেখে এসে যারা রামের আবির্ভাবের কথা প্রচার করেছিল তাদের চিহ্নিত করা হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে হনুমানের কোলে যে কোরআন রেখে এসেছিল তাকে ধরা হয়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশে ধর্মের নামে দাঙ্গা বাঁধানো লোকগুলোর বাইরের জগতের আলো-বাতাসে শান্তিতে বসবাসের অধিকার নেই; এদের স্থায়ী বসতি জেলখানার অন্ধ প্রকৌষ্ঠে হলে সরকারকে সংখ্যালঘুদের ধর্মাচরণসহ সার্বিক নিরাপত্তায় আলাদা ব্যবস্থা নিতে হয় না। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নাকি বলেছেন, ‘এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না; যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করে না তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে’।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী উপপরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com