মতিউর রহমান
আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয় এবং আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একইরকম কারণে বার বার ঘটতে থাকে, যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না, ফলে সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকে না, হয়ে উঠে ব্যবস্থাপনাগত বা কাঠামোগত অবহেলার ফল। বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যেসব দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ আহত ও নিহত হচ্ছেন সেসব ঘটনাকে এখন আর নিছক দুর্ঘটনা বলা যায় না। এগুলো ব্যবস্থাপনা বা অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা। অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সেটাও অবহেলাজনিত মৃত্যু হিসেবে ধরে নেয়া যায়। সুতরাং এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা ও এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এমন কোনো দিন নেই সড়ক দুর্ঘটনায় কারও না কারও মৃত্যু হচ্ছে, পঙ্গুত্ববরণ করছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, আহত ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ যেন আরেক মহামারি রূপে আবির্ভূত হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে দেশে করোনা মহামারিকালীন যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে; সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তার চেয়েও বেশি। সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বাস্তবে এই সংখ্যা হয়ত আরও বেশি।
প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে হাজারো মানুষের মুখের হাসি মলিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, পরিসংখ্যান ও আর্থিক ক্ষতি যাই হোক না কেন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যে সব পরিবারে কোন সদস্যের মৃত্যু হয় তার বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনের ব্যথা-বেদনার দুঃখ-কষ্টের পরিমাপ কী আমরা করতে পারি। আমরা কী কোন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুজনিত দুঃখ-বেদনার মূল্য দিতে পারি। কোনভাবেই মূল্য দেয়া সম্ভব নয়। এ রকম হাজার হাজার পরিবার এদেশে আছে যাদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে বা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। জাতীয় অর্থনীতির জন্যও যা ক্ষতিকর। সুতরাং এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিকার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও করণীয় নিয়ে নিয়ে প্রতিদিনই দেশে ও বিদেশে গবেষণা, আলোচনা, সমালোচনা, সভা- সেমিনার হচ্ছে। টেলিভিশন ও পত্রিকায় প্রতিবেদন ও কলাম প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারিভাবে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়েছে; নীতিমালাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কি ধরনের যানবাহন আমাদের দেশে উপযোগী বা চলাচল করবে সে সম্পর্কিত কোন নীতিমালা আছে বলে আমাদের জানা নেই। ফলে বিভিন্ন ধরনের গণপরিহন আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়েছে, যা কোন উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। শ্যালো ইঞ্জিনযুক্ত নসিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরযুক্ত রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা থেকে শুরু করে সিএনজি, ইজিবাইক, লেগুনা, এগুলো কোন টেকসই ও কার্যকর পরিবহনের মধ্যে পড়ে না। এগুলো যোগাযোগের নিকৃষ্ট পরিবহন। একইভাবে, রিকশাও কোন কার্যকর যানবাহন নয়। কোন সভ্য ও উন্নত দেশে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জীবিকা নির্বাহের জন্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে যা দেখতে দৃষ্টিকটু ও অশোভন। এক সময় হয়ত এর প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখন এর বিকল্প পরিবহন গড়ে তোলার সময় হয়েছে। রিকশাকে আমাদের জাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়েছে। রিকশার কারণে ঢাকা শহর জঞ্জালের শহরে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির ক্রয়ে আরও কড়াকড়ি আরোপের সময় হয়েছে। মোটরসাইকেলের ব্যবহারও কমাতে হবে।
এই সব পরিবহনের পক্ষে অনেকেই যুক্তি দেখান যে, এটি গ্রাম ও শহুরে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। যেমন, হাটে বাজারে পণ্য পরিবহন, অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া, কর্মস্থলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া ও আসা, প্রতিবন্ধী ও নি¤œ আয়ের মানুষদের সহজ যাতায়াতে সহায়তা, ইত্যাদি। এই সব যানবাহন পরিবেশ বান্ধব বলেও অনেকে মনে করেন। সর্বোপরি, এই সব যানবাহন চালু হওয়ায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সাধারণ পরিবহনের মতোই এটি ভূমিকা রাখছে।
তবে অধিকাংশই মনে করেন, এসব পরিবহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। অনেক সময় এইসব যানবাহন কোনো নিয়মনীতি না মানায় যানযটের সৃষ্টি হয়। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগও বাড়ে। যেসব জায়গায় যানযট হওয়ার কথা না সেসব জায়গায়ও যানযট তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে ঘটে দুর্ঘটনা। অনেকে আহত হন, পঙ্গুত্ববরণ করেন। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোতে এগুলোর চলাচল নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা না মেনে চলার কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেকের প্রাণহানির কারণ হয়। এসব পরিবহনের অধিকাংশ চালকই প্রশিক্ষিত নন। ফলে তারা যান চলাচলের নিয়মকানুন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন এবং নিয়মকানুন না মেনে চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় পড়েন ও অন্য যানবাহনের জন্য দুর্ঘটনার কারণ হন। অনেকে বলেন এসব যানবাহনে যে কর্মসংস্থান হয়েছে তা নিকৃষ্ট কর্মসংস্থান। সরকারের উচিত তাদের জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। অনেকের মতে, এসব যানবাহন খাতে ব্যক্তিগত ও এনজিওদের বিনিয়োগ রয়েছে। তবে এসব বিনিয়োগ কোন উৎপাদনশীল বিনিয়োগ নয় বলে তারা মনে করেন।
তবে পক্ষে বা বিপক্ষে যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন এসব যানবাহন কোন টেকসই যানবাহন নয়। এ কথা সত্য যে, গত এক দশকে দেশে গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক ধরনের যানবাহনের প্রচলন হয়েছে। এসব যানবাহনে অনেকেরই কর্মসংস্থান হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতেও এসব পরিবহনের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তা সত্ত্বেও এসব পরিবহনের কারণে সড়কে বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে একই সড়কে, একইসঙ্গে, একই সময়ে যত প্রকার যানবাহন চলাচল করে তা উন্নত কোন দেশে চলে বলে আমাদের জানা নেই। এখানে একই রাস্তায়, একই সঙ্গে, একই সময়ে বাস, ট্রাক, লরি, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ক্যাভার্ডভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি, অটোরিকশা, শ্যালো ইঞ্জিনযুক্ত তিন চাকার নসিমন, করিমন, ভটভটি, রিকশা, মোটরসাইকেল, ট্রাক্টর, ইজিবাইকসহ হরেক রকমের যানবাহন চলাচল করে। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি রড, সিমেন্ট, বালু, গরু, বাঁশ, কাঠ ও আর্বজনাবাহী যানবাহনও একই সঙ্গে চলে। গ্রামের রাস্তায় এগুলো একটু কম হলেও শহর এলাকায় অনেক বেশি। সুতরাং সড়ক ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এ বিষয়ে আশু নজর দেয়ার সময় হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে মনে হয় আমরা এখনও সেই আদিম অবস্থায় রয়ে গেছি। সুতরাং নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মতো গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য বলেই মনে হয়। কারণ আমাদের হাতে সময় আছে আর মাত্র ২০ বছর। এই বিশ বছরে সবার জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে সব উন্নয়নই ম্লান হয়ে যাবে।
বলা হয়ে থাকে কোন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এছাড়াও, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। সুতরাং উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা ও কাজ এখনই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়ার সময় এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিবেন বলে আশা করা যায়। অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমানো সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না কোন বাবা-মায়ের, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনের বুকফাটা আর্তনাদ ও হাহাকার থামানো। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না হলে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া কষ্টসাধ্য হবে। সুতরাং, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা]
রবিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২১ , ২২ কার্তিক ১৪২৮ ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩
মতিউর রহমান
আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয় এবং আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একইরকম কারণে বার বার ঘটতে থাকে, যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না, ফলে সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকে না, হয়ে উঠে ব্যবস্থাপনাগত বা কাঠামোগত অবহেলার ফল। বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যেসব দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষ আহত ও নিহত হচ্ছেন সেসব ঘটনাকে এখন আর নিছক দুর্ঘটনা বলা যায় না। এগুলো ব্যবস্থাপনা বা অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা। অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সেটাও অবহেলাজনিত মৃত্যু হিসেবে ধরে নেয়া যায়। সুতরাং এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা ও এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এমন কোনো দিন নেই সড়ক দুর্ঘটনায় কারও না কারও মৃত্যু হচ্ছে, পঙ্গুত্ববরণ করছে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, আহত ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ যেন আরেক মহামারি রূপে আবির্ভূত হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে দেশে করোনা মহামারিকালীন যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে; সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তার চেয়েও বেশি। সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বাস্তবে এই সংখ্যা হয়ত আরও বেশি।
প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে হাজারো মানুষের মুখের হাসি মলিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, পরিসংখ্যান ও আর্থিক ক্ষতি যাই হোক না কেন সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যে সব পরিবারে কোন সদস্যের মৃত্যু হয় তার বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনের ব্যথা-বেদনার দুঃখ-কষ্টের পরিমাপ কী আমরা করতে পারি। আমরা কী কোন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুজনিত দুঃখ-বেদনার মূল্য দিতে পারি। কোনভাবেই মূল্য দেয়া সম্ভব নয়। এ রকম হাজার হাজার পরিবার এদেশে আছে যাদের পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে বা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছে। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। জাতীয় অর্থনীতির জন্যও যা ক্ষতিকর। সুতরাং এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিকার, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও করণীয় নিয়ে নিয়ে প্রতিদিনই দেশে ও বিদেশে গবেষণা, আলোচনা, সমালোচনা, সভা- সেমিনার হচ্ছে। টেলিভিশন ও পত্রিকায় প্রতিবেদন ও কলাম প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারিভাবে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়েছে; নীতিমালাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু কি ধরনের যানবাহন আমাদের দেশে উপযোগী বা চলাচল করবে সে সম্পর্কিত কোন নীতিমালা আছে বলে আমাদের জানা নেই। ফলে বিভিন্ন ধরনের গণপরিহন আমাদের দেশে আবির্ভূত হয়েছে, যা কোন উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। শ্যালো ইঞ্জিনযুক্ত নসিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরযুক্ত রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা থেকে শুরু করে সিএনজি, ইজিবাইক, লেগুনা, এগুলো কোন টেকসই ও কার্যকর পরিবহনের মধ্যে পড়ে না। এগুলো যোগাযোগের নিকৃষ্ট পরিবহন। একইভাবে, রিকশাও কোন কার্যকর যানবাহন নয়। কোন সভ্য ও উন্নত দেশে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জীবিকা নির্বাহের জন্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে যা দেখতে দৃষ্টিকটু ও অশোভন। এক সময় হয়ত এর প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখন এর বিকল্প পরিবহন গড়ে তোলার সময় হয়েছে। রিকশাকে আমাদের জাদুঘরে পাঠানোর সময় হয়েছে। রিকশার কারণে ঢাকা শহর জঞ্জালের শহরে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির ক্রয়ে আরও কড়াকড়ি আরোপের সময় হয়েছে। মোটরসাইকেলের ব্যবহারও কমাতে হবে।
এই সব পরিবহনের পক্ষে অনেকেই যুক্তি দেখান যে, এটি গ্রাম ও শহুরে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। যেমন, হাটে বাজারে পণ্য পরিবহন, অসুস্থ হলে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে যাওয়া, কর্মস্থলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া ও আসা, প্রতিবন্ধী ও নি¤œ আয়ের মানুষদের সহজ যাতায়াতে সহায়তা, ইত্যাদি। এই সব যানবাহন পরিবেশ বান্ধব বলেও অনেকে মনে করেন। সর্বোপরি, এই সব যানবাহন চালু হওয়ায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সাধারণ পরিবহনের মতোই এটি ভূমিকা রাখছে।
তবে অধিকাংশই মনে করেন, এসব পরিবহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। অনেক সময় এইসব যানবাহন কোনো নিয়মনীতি না মানায় যানযটের সৃষ্টি হয়। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগও বাড়ে। যেসব জায়গায় যানযট হওয়ার কথা না সেসব জায়গায়ও যানযট তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে ঘটে দুর্ঘটনা। অনেকে আহত হন, পঙ্গুত্ববরণ করেন। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোতে এগুলোর চলাচল নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা না মেনে চলার কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেকের প্রাণহানির কারণ হয়। এসব পরিবহনের অধিকাংশ চালকই প্রশিক্ষিত নন। ফলে তারা যান চলাচলের নিয়মকানুন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকেন এবং নিয়মকানুন না মেনে চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় পড়েন ও অন্য যানবাহনের জন্য দুর্ঘটনার কারণ হন। অনেকে বলেন এসব যানবাহনে যে কর্মসংস্থান হয়েছে তা নিকৃষ্ট কর্মসংস্থান। সরকারের উচিত তাদের জন্য শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। অনেকের মতে, এসব যানবাহন খাতে ব্যক্তিগত ও এনজিওদের বিনিয়োগ রয়েছে। তবে এসব বিনিয়োগ কোন উৎপাদনশীল বিনিয়োগ নয় বলে তারা মনে করেন।
তবে পক্ষে বা বিপক্ষে যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন এসব যানবাহন কোন টেকসই যানবাহন নয়। এ কথা সত্য যে, গত এক দশকে দেশে গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক ধরনের যানবাহনের প্রচলন হয়েছে। এসব যানবাহনে অনেকেরই কর্মসংস্থান হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতেও এসব পরিবহনের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তা সত্ত্বেও এসব পরিবহনের কারণে সড়কে বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশে একই সড়কে, একইসঙ্গে, একই সময়ে যত প্রকার যানবাহন চলাচল করে তা উন্নত কোন দেশে চলে বলে আমাদের জানা নেই। এখানে একই রাস্তায়, একই সঙ্গে, একই সময়ে বাস, ট্রাক, লরি, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ক্যাভার্ডভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি, অটোরিকশা, শ্যালো ইঞ্জিনযুক্ত তিন চাকার নসিমন, করিমন, ভটভটি, রিকশা, মোটরসাইকেল, ট্রাক্টর, ইজিবাইকসহ হরেক রকমের যানবাহন চলাচল করে। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি রড, সিমেন্ট, বালু, গরু, বাঁশ, কাঠ ও আর্বজনাবাহী যানবাহনও একই সঙ্গে চলে। গ্রামের রাস্তায় এগুলো একটু কম হলেও শহর এলাকায় অনেক বেশি। সুতরাং সড়ক ও মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এ বিষয়ে আশু নজর দেয়ার সময় হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে মনে হয় আমরা এখনও সেই আদিম অবস্থায় রয়ে গেছি। সুতরাং নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের মতো গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য বলেই মনে হয়। কারণ আমাদের হাতে সময় আছে আর মাত্র ২০ বছর। এই বিশ বছরে সবার জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে সব উন্নয়নই ম্লান হয়ে যাবে।
বলা হয়ে থাকে কোন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এছাড়াও, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। সুতরাং উন্নত দেশের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনা ও কাজ এখনই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ নজর দেয়ার সময় এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়। সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিবেন বলে আশা করা যায়। অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব কমানো সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না কোন বাবা-মায়ের, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনের বুকফাটা আর্তনাদ ও হাহাকার থামানো। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না হলে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া কষ্টসাধ্য হবে। সুতরাং, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা]