বাড়লো ভাড়া, চলছে বাস, ভাসল লঞ্চ

১৩ বছরে ভাড়া বাড়লো ৬ বার, তাও মানছে না

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়ানো হয়েছে গণপরিবহনের ভাড়া। বাস ও লঞ্চের নতুন ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকর করার কথা রয়েছে। কিন্তু ভাড়ার সরকারি এই নির্দেশনা মানে না গণপরিবহনের মালিকরা। সিটিং ও গেইটলক সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে তারা। তাই নতুন ভাড়া কার্যকরের পর কঠোর মনিটরিংয়ের পরামর্শ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের।

নতুন ভাড়ায় দূরপাল্লার বাসে ২৭ শতাংশ ও মহানগরী পর্যায়ে বাসে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বনি¤œ ভাড়া বাসে ১০ টাকা ও মিনিবাসে ৮ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। একই সঙ্গে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

গতকাল রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ’র কার্যালয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে নতুন ভাড়া প্রস্তাব করা হয়। গতকাল বিকেলে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে আজ নতুন ভাড়া কার্যকরের নির্দেশনা দেয়া হয়।

বাসে নতুন ভাড়া কার্যকর আজ থেকে

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের বাসে ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সার থেকে বেড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়িয়ে ২ টাকা ০৫ পয়সা। বাসের সর্বনি¤œ ভাড়া ৭ টাকার স্থলে ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকার স্থলে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)’র অন্তর্ভুক্ত নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ০৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে গ্যাস, অকটেন ও পেট্রোল চালিত কোন যানবাহনে ক্ষেত্রে এই নতুন ভাড়া প্রযোজ্য হবে না বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে গতকাল ঢাকার বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ বিষয়ক কমিটির সভা শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই ভাড়া কার্যকর হবে সোমবার থেকে। ভাড়ার এই নতুন হার ডিজেলচালিত বাসের জন্য প্রযোজ্য। সিএনজি চালিত বাসের ভাড়া এক পয়সাও বাড়ানো যাবে না, তাদের জন্য এই ভাড়া প্রযোজ্য নয়, আগের রেটে নেবে।’

লঞ্চে ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকর করা হবে বলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ’র কার্যালয়ে লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নতুন ভাড়া ঘোষণা করেন সংস্থার চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক।

লঞ্চ নতুন ভাড়ায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৩০ পয়সা ও ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৪০ পয়সা স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জনপ্রতি সর্বনি¤œ ভাড়া ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকর করা হবে বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়।

১৩ বছরে ৬ বার বৃদ্ধি হয় গণপরিবহন ভাড়া

২০০৮ সালের ২২ জুলাই ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে পৃথকভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। তখনই মিনিবাসের চেয়ে বাসের ভাড়া বেশি নির্ধারণ করা হয়। তখন বাসের জন্য ১ টাকা ২০ পয়সা ও মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তখনই মালিক সমিতির সম্মতিতে বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এরপর ২০১১ সালের ১৮ মে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে আবার বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তখন বাসের জন্য ১ টাকা ৫৫ পয়সা ও মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় বাস ও মিনিবাসের জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা ও ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মালিক সমিতির আপত্তি ছিল বলে বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।

এরপর ২০১১ সালে গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তখন বাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা ও মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তখনো বাস ও মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা ও ৫ টাকা অপরিবর্তিত থাকে।

২০১৫ সালে নগর পরিবহনে বাসের ভাড়া প্রতি কিলেমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। আর ২০১৬ সালে দূরপাল্লায় ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা ৪২ পয়সা। কিন্তু কোন সময়ই সরকার নির্ধারিত এই ভাড়া মানতে দেখা যায়নি গণপরিবহনে। তাই বাসের ভাড়া বৃদ্ধির পর তা কঠোর মনিটরিংয়ের পরামর্শ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের।

নির্ধারিত ভাড়া মানে না গণপরিবহন চালকরা

গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের নিয়ম মানে না কেউ। এক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। রাজধানীতে চলাচলরত লেগুনা, বাস, মিনিবাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশাসহ সব গণপরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয় ইচ্ছেমত।

একই রুটের বিভিন্ন বাস-মিনিবাস ভাড়া নেয়া হয় বিভিন্ন রকম। এসব বাস বিরতিহীন, গেইটলক, সিটিং সার্ভিস ও কাউন্টার সার্ভিসসহ নানা নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। মাঝে মধ্যে লোকাল বাসেও সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের কাছে দ্বিগুণ ও তিনগুণ ভাড়া আদায় করে বাস মালিকরা। এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি।

অথচ এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে পরিবহন মালিকদের কাছে অসহায় বিআরটিএ। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই মালিকদের চাপের কারণে বাস্তবায়ন করা যায় না বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।

জানা গেছে, সরকার গ্যাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলেই প্রতিবারই বৃদ্ধি করা হয় পরিবহন সার্ভিসের ভাড়া। তবে সরকার নির্ধারিত ভাড়া মানে না পরিবহনগুলো। ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে পরিবহন মালিকরা। দেখা যায় একই রুটে একাধিক পরিবহন বিভিন্ন ভাড়া আদায় করে। যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর এই রুটে একাধিক পরিবহন চলাচল করে। এরমধ্যে দেখা যায় যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেটের ভাড়া এক একটি পরিবহন এক এক রকম আদায় করে।

যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী ২১ নম্বর বাস (সাবেক ৮ নম্বর) বর্তমানে যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট ভাড়া নেয়া ২০ টাকা। তবে যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রুটে চলাচলকারী শিকড় পরিবহন নেয় ৩০ টাকা। একইভাবে যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিল, পুরানা পল্টন, গুলিস্তানের ভাড়া সাধারণত ৫ টাকা। কিন্তু ট্রান্স সিলভা পরিবহন নেয় ১০ টাকা, শিকড় পরিবহন নেয় ৫ টাকা, গ্রামীণ বাংলা পরিবহন নেয় ২০ টাকা। এ সব বাসগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে যাত্রীদের কাছে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এরমধ্যে বিরতিহীন, গেইটলক, সিটিং সার্ভিসসহ বিভিন্ন নামে যাত্রীদের কাছ থেকে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। তবে এসব নাম ব্যবহার করে যে সব পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ বলে বিআইটিএ’র সূত্র জানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ’র এক পরিচালক সংবাদকে বলেন, পরিবহন মালিকরা অনেক শক্তিশালী। তাই সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক নিয়মই কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারও তাদের তেমন কিছু বলে না। সরকারকে টিকিয়ে রাখছে এই পরিবহন মালিক-শ্রমিক আন্দোলন করে। পরিবহন মালিকরাই এখন দেশ চালায়। তাই রাজধানীর গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক সমিতি যা চাইবে তাই হবে বলে জানান তিনি।

বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবি যাত্রী কল্যাণ সমিতির। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার গণশুনানি ব্যাতিরেকে অবৈধ পন্থায় এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে। এই অজুহাতে বাস-ট্রাক ও লঞ্চের মালিকরা এই বর্ধিত মূল্যের কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া লুটে নেয়ার জন্য পরিবহন ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মি করে। বাস ও লঞ্চ মালিকদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে সরকার তাদের চাহিদা অনুযায়ী একচেটিয়া ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।’ সংকটাপন্ন যাত্রী সাধারণকে সঙ্গে নিয়ে বর্ধিত ভাড়া প্রতিহত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।

সোমবার, ০৮ নভেম্বর ২০২১ , ২৩ কার্তিক ১৪২৮ ৩১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

বাড়লো ভাড়া, চলছে বাস, ভাসল লঞ্চ

১৩ বছরে ভাড়া বাড়লো ৬ বার, তাও মানছে না

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়ানো হয়েছে গণপরিবহনের ভাড়া। বাস ও লঞ্চের নতুন ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকর করার কথা রয়েছে। কিন্তু ভাড়ার সরকারি এই নির্দেশনা মানে না গণপরিবহনের মালিকরা। সিটিং ও গেইটলক সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে তারা। তাই নতুন ভাড়া কার্যকরের পর কঠোর মনিটরিংয়ের পরামর্শ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের।

নতুন ভাড়ায় দূরপাল্লার বাসে ২৭ শতাংশ ও মহানগরী পর্যায়ে বাসে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বনি¤œ ভাড়া বাসে ১০ টাকা ও মিনিবাসে ৮ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। একই সঙ্গে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

গতকাল রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ’র কার্যালয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে নতুন ভাড়া প্রস্তাব করা হয়। গতকাল বিকেলে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে আজ নতুন ভাড়া কার্যকরের নির্দেশনা দেয়া হয়।

বাসে নতুন ভাড়া কার্যকর আজ থেকে

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের বাসে ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সার থেকে বেড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়িয়ে ২ টাকা ০৫ পয়সা। বাসের সর্বনি¤œ ভাড়া ৭ টাকার স্থলে ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৫ টাকার স্থলে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)’র অন্তর্ভুক্ত নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় চলাচলকারী বাস ও মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ০৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে গ্যাস, অকটেন ও পেট্রোল চালিত কোন যানবাহনে ক্ষেত্রে এই নতুন ভাড়া প্রযোজ্য হবে না বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে গতকাল ঢাকার বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ বিষয়ক কমিটির সভা শেষে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই ভাড়া কার্যকর হবে সোমবার থেকে। ভাড়ার এই নতুন হার ডিজেলচালিত বাসের জন্য প্রযোজ্য। সিএনজি চালিত বাসের ভাড়া এক পয়সাও বাড়ানো যাবে না, তাদের জন্য এই ভাড়া প্রযোজ্য নয়, আগের রেটে নেবে।’

লঞ্চে ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে যাত্রীবাহী লঞ্চের ভাড়া ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকর করা হবে বলে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ’র কার্যালয়ে লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নতুন ভাড়া ঘোষণা করেন সংস্থার চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক।

লঞ্চ নতুন ভাড়ায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার স্থলে ২ টাকা ৩০ পয়সা ও ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৪০ পয়সা স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। জনপ্রতি সর্বনি¤œ ভাড়া ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা সোমবার থেকে কার্যকর করা হবে বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়।

১৩ বছরে ৬ বার বৃদ্ধি হয় গণপরিবহন ভাড়া

২০০৮ সালের ২২ জুলাই ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে পৃথকভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। তখনই মিনিবাসের চেয়ে বাসের ভাড়া বেশি নির্ধারণ করা হয়। তখন বাসের জন্য ১ টাকা ২০ পয়সা ও মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তখনই মালিক সমিতির সম্মতিতে বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এরপর ২০১১ সালের ১৮ মে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে আবার বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তখন বাসের জন্য ১ টাকা ৫৫ পয়সা ও মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় বাস ও মিনিবাসের জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা ও ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মালিক সমিতির আপত্তি ছিল বলে বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।

এরপর ২০১১ সালে গ্যাসের দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়। তখন বাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা ও মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তখনো বাস ও মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা ও ৫ টাকা অপরিবর্তিত থাকে।

২০১৫ সালে নগর পরিবহনে বাসের ভাড়া প্রতি কিলেমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। আর ২০১৬ সালে দূরপাল্লায় ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা ৪২ পয়সা। কিন্তু কোন সময়ই সরকার নির্ধারিত এই ভাড়া মানতে দেখা যায়নি গণপরিবহনে। তাই বাসের ভাড়া বৃদ্ধির পর তা কঠোর মনিটরিংয়ের পরামর্শ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের।

নির্ধারিত ভাড়া মানে না গণপরিবহন চালকরা

গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের নিয়ম মানে না কেউ। এক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। রাজধানীতে চলাচলরত লেগুনা, বাস, মিনিবাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশাসহ সব গণপরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয় ইচ্ছেমত।

একই রুটের বিভিন্ন বাস-মিনিবাস ভাড়া নেয়া হয় বিভিন্ন রকম। এসব বাস বিরতিহীন, গেইটলক, সিটিং সার্ভিস ও কাউন্টার সার্ভিসসহ নানা নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। মাঝে মধ্যে লোকাল বাসেও সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের কাছে দ্বিগুণ ও তিনগুণ ভাড়া আদায় করে বাস মালিকরা। এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি।

অথচ এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে পরিবহন মালিকদের কাছে অসহায় বিআরটিএ। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই মালিকদের চাপের কারণে বাস্তবায়ন করা যায় না বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।

জানা গেছে, সরকার গ্যাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলেই প্রতিবারই বৃদ্ধি করা হয় পরিবহন সার্ভিসের ভাড়া। তবে সরকার নির্ধারিত ভাড়া মানে না পরিবহনগুলো। ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে পরিবহন মালিকরা। দেখা যায় একই রুটে একাধিক পরিবহন বিভিন্ন ভাড়া আদায় করে। যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর এই রুটে একাধিক পরিবহন চলাচল করে। এরমধ্যে দেখা যায় যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেটের ভাড়া এক একটি পরিবহন এক এক রকম আদায় করে।

যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী ২১ নম্বর বাস (সাবেক ৮ নম্বর) বর্তমানে যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট ভাড়া নেয়া ২০ টাকা। তবে যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রুটে চলাচলকারী শিকড় পরিবহন নেয় ৩০ টাকা। একইভাবে যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিল, পুরানা পল্টন, গুলিস্তানের ভাড়া সাধারণত ৫ টাকা। কিন্তু ট্রান্স সিলভা পরিবহন নেয় ১০ টাকা, শিকড় পরিবহন নেয় ৫ টাকা, গ্রামীণ বাংলা পরিবহন নেয় ২০ টাকা। এ সব বাসগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে যাত্রীদের কাছে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এরমধ্যে বিরতিহীন, গেইটলক, সিটিং সার্ভিসসহ বিভিন্ন নামে যাত্রীদের কাছ থেকে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। তবে এসব নাম ব্যবহার করে যে সব পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ বলে বিআইটিএ’র সূত্র জানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএ’র এক পরিচালক সংবাদকে বলেন, পরিবহন মালিকরা অনেক শক্তিশালী। তাই সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক নিয়মই কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সরকারও তাদের তেমন কিছু বলে না। সরকারকে টিকিয়ে রাখছে এই পরিবহন মালিক-শ্রমিক আন্দোলন করে। পরিবহন মালিকরাই এখন দেশ চালায়। তাই রাজধানীর গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক সমিতি যা চাইবে তাই হবে বলে জানান তিনি।

বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবি যাত্রী কল্যাণ সমিতির। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার গণশুনানি ব্যাতিরেকে অবৈধ পন্থায় এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে। এই অজুহাতে বাস-ট্রাক ও লঞ্চের মালিকরা এই বর্ধিত মূল্যের কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া লুটে নেয়ার জন্য পরিবহন ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মি করে। বাস ও লঞ্চ মালিকদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে সরকার তাদের চাহিদা অনুযায়ী একচেটিয়া ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে।’ সংকটাপন্ন যাত্রী সাধারণকে সঙ্গে নিয়ে বর্ধিত ভাড়া প্রতিহত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।