কর্মদিবসে দুর্ভোগ চরমে

টানা তিন দিনের গণপরিবহন ধর্মঘটের কর্মজীবীসহ চলাচলকারী মানুষের দুর্ভোগ গতকালও ছিল চরমে। জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘটের তৃতীয় দিন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় অফিসগামী মানুষের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে মিরপুর ১০ গোলচত্বরে গিজ গিজ করছিল অফিসগামী মানুষের ভিড়। রিকশা, সিএনজি, শেয়ার বাইক, মাইক্রোবাস চালকরা যাত্রী ডাকছেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে অপেক্ষমান যাত্রীরা ছুটে যাচ্ছেন। অতিরিক্ত ভাড়া শুনে অনেকেই পিছনে চলে আসছেন আবার অনেকেই চেপে বসছেন। এরই মধ্যে ভাড়া নিয়ে চলছে বাক-বিত-া। সকাল ৮টা গড়িয়ে সাড়ে নয়টায় মতিঝিল যাওয়ার জন্য বিআরটিসির একটা দোতলা বাস এসে থামলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অপেক্ষমান দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। এরই মধ্যে অনেক কষ্টে বাসে উঠেন একজন নারী যাত্রী। নারী সিটে পুরুষদের বসে থাকতে দেখে সিট ছেড়ে দিতে বললে লেগে যায় তর্ক। প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে উঠেছেন জানিয়ে একজন পুরুষ যাত্রী বলেন ‘আপনারা এই সমস্যার মধ্যে বেরিয়েছেন কেন?’

বাইক শেয়ারিং এ যারা বাইক চালান, তারা অ্যাপ বন্ধ করে চুক্তিতে বাইক চালাচ্ছেন। রিকশার মতো করে দাম দর করছেন। আর সড়কে রিকশার দৌরাত্ম ছিল অস্বাভাবিক। মিরপুর ১১ থেকে মিরপুর ১০-এ যাওয়ার জন্য দুই নারী রিকশা ভাড়া করছিলেন। নির্বিকারভাবে যাবে না বলে হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দেন ওই রিকশাওয়ালা।

‘পরিবহন ধর্মঘটে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নারীরা’ জানিয়ে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জান্নাতুল রীমা বলেন, ‘অফিসে যাবো না এ কথা বলা যায় না। কারণ সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তা বা কলিগরা বলে এ জন্যই মেয়েদের কাজে নিতে চাই না। মেয়েরা সব সময় অজুহাত খোঁজে। অথচ একজন নারীকে কতোটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না। এ জন্য যতো সমস্যাই হোক অফিসে যেতে চাই। কেউ যেন আমার জন্য সব নারীকে ভুল বুঝতে না পারে।’

মাহবুব হোসেন। টেইলার মাস্টার। কোমরে ব্যথা নিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। মিরপুর থেকে আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালে যাবেন বলে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন যাবেন না। প্রথমে সিএনজিতে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, সিএনজি বেশি ভাড়া চাচ্ছে ভেবে রিকশা ঠিক করতে গিয়ে দেখেন প্রায় একইরকম ভাড়া। সিএনজি ভাড়া ৩শ আর রিকশা ভাড়া ২৫০ টাকা। যেখানে বাসে করে যেতে ভাড়া লাগতো সর্বোচ্চ ১৫ টাকা। এমন অবস্থায় মাহবুব সংবাদকে বলেন, ‘গাড়ি খোলার পর ডাক্তার দেখাব। এরা সব ডাকাত। মানুষের বিপদে এমন সুযোগ নেয়?’

ধর্মঘটের তিনদিন বাইক শেয়ার করে প্রতিদিনই প্রায় তিন হাজার টাকা আয় করেছেন বাইক চালক রিয়াদুল আলম। রিয়াদুল খুব খুশি মনে সংবাদকে বলেন, ‘বাইক চালাই অনেকদিন, কিন্তু শেয়ারে চালাচ্ছি মাত্র কয়েকদিন হলো।’ ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটু বেশি নিচ্ছি। কিন্তু এরই মধ্যে তেলের দাম বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো এই তিনদিন যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি।’

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে কিছু বিআরটিসির বাস চলাচল করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল কম। তবে সিএনজি, রিকশা, লেগুনার ছিল অবাধ বিচরণ। বাস না চলায় কর্মজীবী মানুষের অফিসে যাওয়ার সুযোগে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নেয় রিকশা, সিএনজি ও মোটরসাইকেল। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই গন্তব্যে যেতে হয় তাদের। কাউকে কাউকে নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ভ্যান, কাভার্ডভ্যানে চড়েও কর্মস্থলের দিকে যেতে দেখা গেছে।

এদিকে ভাড়া সমন্বয় না করেই হঠাৎ জ্বালানির দাম বাড়ানো আর পরিবহন মালিকদের গাফিলতির কারণেই এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের, যারা প্রতিদিন বাস, টেম্পুতে করে অফিস করেন। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটা ফ্যাশন হাউসে কাজ করেন মো. রাব্বি। শেওড়াপাড়া থেকে প্রতিদিন শাহবাগে আসেন বাসে করে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘শুধু কি তেলের দাম বাড়তাছে, এর সঙ্গে দেখবেন কাল থাইকা চাল ডাল তেল সাবানেরও দাম বাইড়া যাইবো। এহন কন আমগোর বেতন কি বাড়বো?’

পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে অসুস্থ জেসমিন আক্তার (৩৩) রোগের পরীক্ষা করাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টা শাহ্বাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর বিআরটিসির একটি বাস পেলেন। যাত্রীদের সঙ্গে পাড়াপাড়ি করে উঠতে হল বাসে।

সংবাদকে রাস্তায় দুর্ভোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সকাল এগারটায় বাসা থেকে বের হয়ে যাত্রাবাড়ীতে এসে কোন সিএনজি বা রিকশায় চড়তে পারলাম না অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে। রিকশাওয়ালা যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান ভাড়া চাইল ১০০ টাকা। রোদের তাপের মধ্যে অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা বিআরটিসি বাস পেয়ে গাদাগাদি করে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে গুলিস্তান গেলাম। এরপর আবার গুলিস্তান প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর আরেকটি বিআরটিসি বাসে বেশি ভাড়া দিয়ে শাহবাগ হাসপাতালে গেলাম।

রোগী জেসমিন জানান, গত শনিবার ডাক্তার দেখানোর জন্য অনেক কষ্ট করে ভেঙে ভেঙে দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় এসেছি ৭০০ টাকা খরচ করে। এমনিতে আর্থিক ভাবে অনেক কষ্টে আছি।

রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড়ে অসুস্থ শিশু কোলে লাভলী আক্তার নামে ভুক্তভোগী জানান, বাস মহাজনগো কোন দয়া মায়া নাই! কেরানীগঞ্জ হাসনাবাদ এলাকা থেকে অনেক কষ্ট করে বেশি ভাড়া দিয়ে দয়াগঞ্জ মোড়ে এসেছি। এখন ওয়ারী এলাকায় একটি ক্লিনিকে যেতে হবে আমার এ অসুস্থ বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ৪০০ টাকা ডাক্তারের ভিজিট দিতে হবে। যদি, রাস্তায় বাস, লেগুনা থাকলে সহজে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে গিয়ে অল্প খরচে সরকারি ডাক্তার দেখাতে পারতাম ও বিনামূল্যে ওষুধও পেতাম।

এভাবে গতকাল পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের বিপরীতে অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের পায়ে হেঁটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে দেখা গেছে। ভুক্তভোগীদের এক শিশু রোগীর মা জানান, ঢামেক বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে আমার বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছি। চাইছিলাম রিকশায় যাব। কিন্তু রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইছে ৮০ টাকা। তাই হাঁটতেছি। রোদের মধ্যে ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে।

নোমান নামে আরেক রোগীর স্বজন জানান, ঢাকা মেডিকেল থেকে আমার বাবার লাশ ডেমরার কোনাপাড়ায় নিতে রাস্তায় অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটের সংকট দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ১৫০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। আবার সেখান থেকে আরেক রোগীবাহী গাড়ি চাঁদপুর যেতে ৬০০০ টাকা ভাড়া লেগেছে। গত শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে আব্বা হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হলে পরিবহনহীন রাস্তায় অনেক কষ্ট করে রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আসতে হয়েছে।

চাচাতো বোনের মৃত্যুর খবর শুনে বের হন মিতা বেগম। সঙ্গে ছেলে ও স্বামী মো. সুমন। রাজধানীর মিরপুর থেকে পুরান ঢাকা যাবেন। কিন্তু সড়কে নেমে দেখেন বাস নেই। তাই ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা প্রায় দেড় ঘণ্টা।

মিতা বেগম বলেন, ‘বোন মারা গেছে তাই রাস্তায় বের হইছি, এখন গাড়ি পাই না। গুলিস্তান যেতে পারলেও হতো, বাকি পথ হাইটা যাইতাম।’ গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে।

গতকাল পরিবহন ধর্মঘটের তৃতীয় দিন রাজধানী ঢাকার সড়কে হাসপাতালগামী রোগীদের নিয়ে অনেক স্বজনরা বিপাকে পড়েছিলেন। সিএনজি, রিকশা আর ভাড়ায় চালিত হোন্ডার চালকরা যে যেভাবে পেড়েছে রাস্তায় মানুষকে জিম্মি করে গলাকাটা ভাড়া নিয়েছে।

সোমবার, ০৮ নভেম্বর ২০২১ , ২৩ কার্তিক ১৪২৮ ৩১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

কর্মদিবসে দুর্ভোগ চরমে

জাহিদা পারভেজ ছন্দা/খন্দকার জাফর আহমদ

image

ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণার পরপরই সদরঘাটে লঞ্চের টিকিট কাউন্টারে হুমড়ি খেয়ে পড়েন অপেক্ষমান যাত্রীরা। যদিও ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে -সংবাদ

টানা তিন দিনের গণপরিবহন ধর্মঘটের কর্মজীবীসহ চলাচলকারী মানুষের দুর্ভোগ গতকালও ছিল চরমে। জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘটের তৃতীয় দিন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় অফিসগামী মানুষের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে মিরপুর ১০ গোলচত্বরে গিজ গিজ করছিল অফিসগামী মানুষের ভিড়। রিকশা, সিএনজি, শেয়ার বাইক, মাইক্রোবাস চালকরা যাত্রী ডাকছেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে অপেক্ষমান যাত্রীরা ছুটে যাচ্ছেন। অতিরিক্ত ভাড়া শুনে অনেকেই পিছনে চলে আসছেন আবার অনেকেই চেপে বসছেন। এরই মধ্যে ভাড়া নিয়ে চলছে বাক-বিত-া। সকাল ৮টা গড়িয়ে সাড়ে নয়টায় মতিঝিল যাওয়ার জন্য বিআরটিসির একটা দোতলা বাস এসে থামলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অপেক্ষমান দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। এরই মধ্যে অনেক কষ্টে বাসে উঠেন একজন নারী যাত্রী। নারী সিটে পুরুষদের বসে থাকতে দেখে সিট ছেড়ে দিতে বললে লেগে যায় তর্ক। প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে উঠেছেন জানিয়ে একজন পুরুষ যাত্রী বলেন ‘আপনারা এই সমস্যার মধ্যে বেরিয়েছেন কেন?’

বাইক শেয়ারিং এ যারা বাইক চালান, তারা অ্যাপ বন্ধ করে চুক্তিতে বাইক চালাচ্ছেন। রিকশার মতো করে দাম দর করছেন। আর সড়কে রিকশার দৌরাত্ম ছিল অস্বাভাবিক। মিরপুর ১১ থেকে মিরপুর ১০-এ যাওয়ার জন্য দুই নারী রিকশা ভাড়া করছিলেন। নির্বিকারভাবে যাবে না বলে হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দেন ওই রিকশাওয়ালা।

‘পরিবহন ধর্মঘটে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নারীরা’ জানিয়ে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জান্নাতুল রীমা বলেন, ‘অফিসে যাবো না এ কথা বলা যায় না। কারণ সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তা বা কলিগরা বলে এ জন্যই মেয়েদের কাজে নিতে চাই না। মেয়েরা সব সময় অজুহাত খোঁজে। অথচ একজন নারীকে কতোটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না। এ জন্য যতো সমস্যাই হোক অফিসে যেতে চাই। কেউ যেন আমার জন্য সব নারীকে ভুল বুঝতে না পারে।’

মাহবুব হোসেন। টেইলার মাস্টার। কোমরে ব্যথা নিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। মিরপুর থেকে আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালে যাবেন বলে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নিলেন যাবেন না। প্রথমে সিএনজিতে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, সিএনজি বেশি ভাড়া চাচ্ছে ভেবে রিকশা ঠিক করতে গিয়ে দেখেন প্রায় একইরকম ভাড়া। সিএনজি ভাড়া ৩শ আর রিকশা ভাড়া ২৫০ টাকা। যেখানে বাসে করে যেতে ভাড়া লাগতো সর্বোচ্চ ১৫ টাকা। এমন অবস্থায় মাহবুব সংবাদকে বলেন, ‘গাড়ি খোলার পর ডাক্তার দেখাব। এরা সব ডাকাত। মানুষের বিপদে এমন সুযোগ নেয়?’

ধর্মঘটের তিনদিন বাইক শেয়ার করে প্রতিদিনই প্রায় তিন হাজার টাকা আয় করেছেন বাইক চালক রিয়াদুল আলম। রিয়াদুল খুব খুশি মনে সংবাদকে বলেন, ‘বাইক চালাই অনেকদিন, কিন্তু শেয়ারে চালাচ্ছি মাত্র কয়েকদিন হলো।’ ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটু বেশি নিচ্ছি। কিন্তু এরই মধ্যে তেলের দাম বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো এই তিনদিন যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি।’

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে কিছু বিআরটিসির বাস চলাচল করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল কম। তবে সিএনজি, রিকশা, লেগুনার ছিল অবাধ বিচরণ। বাস না চলায় কর্মজীবী মানুষের অফিসে যাওয়ার সুযোগে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নেয় রিকশা, সিএনজি ও মোটরসাইকেল। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই গন্তব্যে যেতে হয় তাদের। কাউকে কাউকে নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি নিয়ে ভ্যান, কাভার্ডভ্যানে চড়েও কর্মস্থলের দিকে যেতে দেখা গেছে।

এদিকে ভাড়া সমন্বয় না করেই হঠাৎ জ্বালানির দাম বাড়ানো আর পরিবহন মালিকদের গাফিলতির কারণেই এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের, যারা প্রতিদিন বাস, টেম্পুতে করে অফিস করেন। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটা ফ্যাশন হাউসে কাজ করেন মো. রাব্বি। শেওড়াপাড়া থেকে প্রতিদিন শাহবাগে আসেন বাসে করে। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘শুধু কি তেলের দাম বাড়তাছে, এর সঙ্গে দেখবেন কাল থাইকা চাল ডাল তেল সাবানেরও দাম বাইড়া যাইবো। এহন কন আমগোর বেতন কি বাড়বো?’

পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে অসুস্থ জেসমিন আক্তার (৩৩) রোগের পরীক্ষা করাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টা শাহ্বাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর বিআরটিসির একটি বাস পেলেন। যাত্রীদের সঙ্গে পাড়াপাড়ি করে উঠতে হল বাসে।

সংবাদকে রাস্তায় দুর্ভোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সকাল এগারটায় বাসা থেকে বের হয়ে যাত্রাবাড়ীতে এসে কোন সিএনজি বা রিকশায় চড়তে পারলাম না অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে। রিকশাওয়ালা যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান ভাড়া চাইল ১০০ টাকা। রোদের তাপের মধ্যে অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা বিআরটিসি বাস পেয়ে গাদাগাদি করে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে গুলিস্তান গেলাম। এরপর আবার গুলিস্তান প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর আরেকটি বিআরটিসি বাসে বেশি ভাড়া দিয়ে শাহবাগ হাসপাতালে গেলাম।

রোগী জেসমিন জানান, গত শনিবার ডাক্তার দেখানোর জন্য অনেক কষ্ট করে ভেঙে ভেঙে দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় এসেছি ৭০০ টাকা খরচ করে। এমনিতে আর্থিক ভাবে অনেক কষ্টে আছি।

রাজধানীর দয়াগঞ্জ মোড়ে অসুস্থ শিশু কোলে লাভলী আক্তার নামে ভুক্তভোগী জানান, বাস মহাজনগো কোন দয়া মায়া নাই! কেরানীগঞ্জ হাসনাবাদ এলাকা থেকে অনেক কষ্ট করে বেশি ভাড়া দিয়ে দয়াগঞ্জ মোড়ে এসেছি। এখন ওয়ারী এলাকায় একটি ক্লিনিকে যেতে হবে আমার এ অসুস্থ বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ৪০০ টাকা ডাক্তারের ভিজিট দিতে হবে। যদি, রাস্তায় বাস, লেগুনা থাকলে সহজে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে গিয়ে অল্প খরচে সরকারি ডাক্তার দেখাতে পারতাম ও বিনামূল্যে ওষুধও পেতাম।

এভাবে গতকাল পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের বিপরীতে অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের পায়ে হেঁটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে দেখা গেছে। ভুক্তভোগীদের এক শিশু রোগীর মা জানান, ঢামেক বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাতে আমার বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছি। চাইছিলাম রিকশায় যাব। কিন্তু রিকশাওয়ালা ভাড়া চাইছে ৮০ টাকা। তাই হাঁটতেছি। রোদের মধ্যে ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে।

নোমান নামে আরেক রোগীর স্বজন জানান, ঢাকা মেডিকেল থেকে আমার বাবার লাশ ডেমরার কোনাপাড়ায় নিতে রাস্তায় অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটের সংকট দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ১৫০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। আবার সেখান থেকে আরেক রোগীবাহী গাড়ি চাঁদপুর যেতে ৬০০০ টাকা ভাড়া লেগেছে। গত শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে আব্বা হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হলে পরিবহনহীন রাস্তায় অনেক কষ্ট করে রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আসতে হয়েছে।

চাচাতো বোনের মৃত্যুর খবর শুনে বের হন মিতা বেগম। সঙ্গে ছেলে ও স্বামী মো. সুমন। রাজধানীর মিরপুর থেকে পুরান ঢাকা যাবেন। কিন্তু সড়কে নেমে দেখেন বাস নেই। তাই ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা প্রায় দেড় ঘণ্টা।

মিতা বেগম বলেন, ‘বোন মারা গেছে তাই রাস্তায় বের হইছি, এখন গাড়ি পাই না। গুলিস্তান যেতে পারলেও হতো, বাকি পথ হাইটা যাইতাম।’ গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে।

গতকাল পরিবহন ধর্মঘটের তৃতীয় দিন রাজধানী ঢাকার সড়কে হাসপাতালগামী রোগীদের নিয়ে অনেক স্বজনরা বিপাকে পড়েছিলেন। সিএনজি, রিকশা আর ভাড়ায় চালিত হোন্ডার চালকরা যে যেভাবে পেড়েছে রাস্তায় মানুষকে জিম্মি করে গলাকাটা ভাড়া নিয়েছে।