প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা

সন্ধ্যা রানী সাহা

চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা আর ‘শিক্ষক যোগ্যতা’ এক বিষয় নয়। শিক্ষক-যোগ্যতা কী তা জানলে একজন শিক্ষক তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে অধিকতর আন্তরিক হবেন। এ প্রত্যাশায় আমার আজকের এ নিবেদন। শিক্ষকগণ প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, শিক্ষাক্রম ও প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো মাথায় রাখবেন। পত্রপত্রিকায় সদ্য প্রকাশিত জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াকবিহাল থাকবেন। কিশোর অপরাধ, অভিভাবকদের নিম্নআয়, সরকারি চাকরির বিধি-বিধান, বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়ার/বিদ্যালয় এলাকার সার্বিক বিষয়াদি সম্পর্কে সজাগ থাকবেন। তারা উক্ত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশু-শিক্ষার্থীদের উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে উন্নয়নে অগ্রসর হবেন। কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব, overlooking এবং escapism যেন তাদের পেয়ে না বসে সে বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। করোনাকালে মাত্র চার মাসের (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) শিক্ষাবর্ষের মধ্যে নির্ধারিত শ্রেণীভিত্তিক অর্জন-উপযোগী যোগ্যতাসমূহ শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে অর্জন করাতে সচেষ্ট হবেন। বিশেষত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষকগণ বিশেষ technique এর মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ধরে শিখিয়ে পারগ (capable/advance) শিক্ষার্থীদের সমকক্ষ করতে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষকদের জীবনযাত্রা সাদামাটা এবং সহজ হলেও শিক্ষাদান কর্মটি বেশ কঠিন। কাজেই এ বিষয়ে শিক্ষকদের নতুন-নতুন কৌশল অবলম্বনে পারদর্শী হতে হবে। শ্রেণীকক্ষে তারা পারগ শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষক-জ্ঞানে পরিচালনা করতে পারেন। তাহলে শিখনফল অর্জনে দ্রুততা আসবে। শিক্ষার্থীরাও শিখতে আগ্রহী থাকবে। সময়ের সদ্ব্যবহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অত্যাবশ্যক। করোনাকাল এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তাই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সাধারণত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়ে যতটা সতর্ক করতে অভ্যস্ত নিজেদের বেলায় ততটা নয়। বিদ্যালয়ে গমণকারী সবাইকেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পরিদর্শকরা প্রথমত শিক্ষক, অতঃপর পরিদর্শক এই মানসিকতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাবেন। কাজেই তাদেরও শিক্ষকদের সমান বা তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করতে হবে। শুধু শিক্ষক নয়, বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে সহযোগিতা করার বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, বহু বিবাহ, নেশাগ্রস্ত অভিভাবক, কলহ বিবাদ, মামলা, মোকদ্দমায় জর্জরিত অভিভাবকের কারণে যেন শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সেজন্য এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে counseling করতে হবে।

শ্রেণীর মধ্যে কোন শিশু যেন কোনভাবেই মনমরা হয়ে পড়া লেখার প্রতি উদাসীন না হয়। এই করোনাকালে অনেক অভিভাবক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে আছে। তাদের আয়ের উপায় বাতলে দেয়া বা আয় বৃদ্ধিতে উৎসাহ/পরামর্শও দেবেন শিক্ষক। এজন্য অভিভাবকদের সঙ্গে ঘন ঘন ফোনে যোগাযোগ এবং অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করতে হবে। তবে তা কোনক্রমেই শ্রেণীকাজ বিঘি্নত করে নয়। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাদি সম্বন্ধে অবহিত করে তাদেরকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকবেন শিক্ষকরা। পাঠের বিষয়বস্তুর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জীবন-অভিজ্ঞতার সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবেন শিক্ষকগণ। যেমন- বীজ থেকে কীভাবে চারা গজায় তা শেখানোর জন্য বিদ্যালয়ের আঙিনায় বা শিশুর বাড়ির আঙিনায় বীজ বপন করে তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠসংশ্লিষ্ট উদ্ভাবনমূলক ও সৃজনশীল কাজ দিতে ও প্রশ্ন করতে সক্ষম হবেন শিক্ষকরা। যেমন- অভিনয় করা, গল্প-কবিতা লেখা, হাতের কাজ ইত্যাদি। বোর্ডে শিক্ষক যা কিছু লিখবেন তা স্পষ্ট অক্ষরে সঠিক পদ্ধতিতে লিখবেন। তিনি পর্যায়ক্রমে শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করবেন এবং বোর্ডে লেখার সুযোগ করে দেবেন। এতে শিক্ষার্থীর জড়তা, ভীরুতা এবং অনুপস্থিতি অনেকাংশে দূর হয়ে যাবে।

শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে সমান বুব eye contact স্থাপনে শিক্ষকরা পারদর্শী হবেন। তিনি স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথোপকথনের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন। শুদ্ধভাবে লিখে স্পষ্টভাবে মনোভাব প্রকাশ করবেন। বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন ধারণা (concept) এবং ভাববস্তু (theme) শুদ্ধভাবে ব্যক্ত করবেন। গাণিতিক সমস্যা সঠিক পদ্ধতিতে সমাধান করবেন। গাইড বই দেখে বোর্ডে লিখে গণিত মুখস্থ করানোর tendency থাকলে পরিহার করবেন। বাংলা এবং ইংরেজি বানান করে পড়া শেখাবেন। পাঠ্যবই পড়ানোর পাশাপাশি সংবাদপত্র এবং অন্যান্য পুস্তকাদি যেন শিশুরা পড়তে পারে সে বিষয়ে সহযোগিতা করবেন। তারা শিশু ও শিশুর অভিভাবক সমন্ধে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন। কখনোই বলবেন না বাড়ি থেকে পড়ে আসলে তো শিখবে কিংবা তোর দ্বারা কিছু হবে না এরকম সব বিরক্তিকর কথাবার্তা।

শিক্ষকরা অবশ্যই পাঠ পরিকল্পনা/পাঠটিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী পাঠদানে অগ্রসর হবেন। মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের দলবদ্ধ করে ভিন্ন ভিন্নভাবে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি-পূর্বক শিক্ষাদান করে শিখনফল অর্জন নিশ্চিত করবেন শিক্ষক। তারা শিশুদের আগ্রহ, উৎসাহ ও প্রেষণা সৃষ্টির কলা কৌশল জানবেন। পাঠবিষয়ক ধারণা ও দক্ষতা অর্জন সহজ করার জন্য শিক্ষক যথোপযুক্ত এবং সহজলভ্য শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের নাড়াচাড়া করতে দিয়ে অবলীলাক্রমে শিখিয়ে যাবেন। সহপাঠক্রমিক (co-curricular activities) কার্যাবলীর অনুশীলনের সুযোগ দান করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগ সৃষ্টি করে শিক্ষাদানে পারদর্শী হবেন। শিক্ষার্থীরা অন্যমনস্ক রয়েছে অথচ শিক্ষক তা avoid করে শুধু পড়াচ্ছেন আর পড়াচ্ছেন- এমনভাবে সিলেবাস শেষ করতে যাবেন না। যতটুকু শেখাবেন তা যেন শ্রেণীর সব শিশু শিখতে পারে এমন কৌশলে শেখাবেন। অবশ্যই overcrowded classroom একটি সমস্যা। শিক্ষকগণ বহুমুখী শিখন-শেখানোর কৌশল অবলম্বন করে এ সমস্যার সমাধান করবেন। তারা শিক্ষার্থীদের আসন ব্যবস্থার সর্বদা পরিবর্তন আনবেন।

সমাজে বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ করে দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বুদ্ধির বিকাশে সহায়তা করবেন। যেমন-বিশ^ বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত কৃতী শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ করে দিয়ে শিক্ষাদান করবেন। শিক্ষার্থী কতটুকু জানে আগে তা পরিমাপ করে সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে সহায়তা দানে প্রবৃত্ত হবেন শিক্ষকবৃন্দ। তারা শিক্ষার্থীদের সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করে তা ভালোভাবে বোঝার জন্য বিশ্লেষণ করতে পারদর্শী হবেন। পাঠ-সংশ্লিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি সুদৃঢ় করণের জন্য শিক্ষক উপযুক্ত অনুশীলনমূলক কাজ (শ্রেণীতে ও বাড়িতে) চিহ্নিত করে তা শিক্ষার্থীদের দিয়ে করাতে সক্ষম হবেন। বাড়ির কাজগুলো শিক্ষকরা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবেন। শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকগণ সবসময় শিশুকেন্দ্রিক ফলপ্রসূ পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন করবেন। শিশুদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকরা সঠিক কৌশলসমূহ নির্বাচন করবেন। শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতির ক্রমপুঞ্জিত রেকর্ড সংরক্ষণ করবেন এবং সময়ে সময়ে তা অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন। তাদের শ্রেণীকাজ পরিচালনা অভিভাবকদের প্রদর্শনের সুযোগদান করবেন প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি। যেন শ্রেণীতে কার সন্তান কতটা তৎপর তা অভিভাবকরা বুঝতে পারেন।

একদিনে সবাইকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব না হলে পর্যায়ক্রমে দিনে দিনে তার ব্যবস্থা রাখবেন। শিক্ষকদের শিখন-দুর্বলতা চিহ্নিত করে নিরাময়মূলক সহায়তা প্রদান করবেন ও পুনরায় মূল্যায়ন করে শিশুদের উৎসাহিত করবেন। শিশুদের সঙ্গে interact কালে শিক্ষক সদা হাসিমুখে থাকবেন। কোনো পিছুটান বা সমস্যার কারণে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করতে পারবেন না। পিছুটান কথাটা এ কারণে উল্লেখ করছি যে, আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বর্তমানে ৬০% এর অধিক মহিলা শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। সামাজিক প্রথা অনুসারে তাদেরকে সংসারের ধোয়া-মোছা, রান্নবান্না, সন্তান পালন ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করে ক্ষেত্র বিশেষে কোলের সন্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়। বিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষিকার সন্তানকে কোলে পিঠে করে রাখা, খাওয়ানো, দেখে রাখা, ইত্যাদি প্রায় সবই করে থাকে নিজের পড়ালেখা ফেলে। তাই তাদের (শিক্ষিকা) জন্য পরামর্শ হলো পরিবারকে যৌথ রাখুন। পরিবারের সদস্যদের নিজে প্রয়োজনে মানসিক এবং আর্থিকভাবে সহযোগিতা করুন। বিনিময়ে আপন সন্তানের নিরাপত্তার দায়িত্বভার তাদের ওপর ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত থাকুন। অন্যথায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে দরিদ্র, অসহায় এবং দিনমজুর মহিলা নিয়োগ করে সন্তানজনিত পিছুটান মুক্ত হয়ে বিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রাখুন। নিজের একটি সন্তানের জন্য অপরের সন্তানদের পড়ালেখার ক্ষতি কিংবা বিদ্যালয়ের কর্ম-পরিবেশ বিঘিœত করবেন না। প্রধান শিক্ষকদের এ বিষয়ে বিব্রত করবেন না।

শিক্ষকরা নিজেরাও নিজেদের পেশাগত যোগ্যতা মূল্যায়ন করবেন এবং ধারাবাহিকভাবে তার রেকর্ড সংরক্ষণ করবেন। তারা একাডেমিক আলোচনায় উৎসাহবোধ করবেন এবং স্টাফ মিটিংয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন। শ্রেণীকাজ পরিচালনার সময় ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনালাপ করবেন না। প্রশিক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করবেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে তা প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠের মানোন্নয়ন করবেন। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের তাগিদ আপনা থেকে অনুধাবন করবেন। পরামর্শ কার্যক্রমে/worksop এ আমন্ত্রিত হলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বপ্রণোদিতভাবে কাজ করবেন। উদ্ভাবনমূলক কাজে নিজেদের এবং শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত করে উন্নয়নে অংশগ্রহণ করবেন। শিখন-শেখানো কাজের মান উন্নয়নে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। উন্নত শিখন-শেখানো পদ্ধতির অনুসন্ধান করবেন এবং শ্রেণীকক্ষে তা প্রয়োগ করবেন। শিশুদের সঙ্গে ইতিবাচক, পেশাগত এবং ন্যায়সঙ্গত সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখবেন। ব্যক্তিগত ও পেশাগত গ্রহণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে শিশুদের মাঝে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। বিভিন্ন জাতিসত্তা, শ্রেণী-ধম-বর্ণ, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সমতা বজায় রাখবেন। বিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। সর্বোপরি শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবেন এবং পেশায় সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করবেন।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

সোমবার, ০৮ নভেম্বর ২০২১ , ২৩ কার্তিক ১৪২৮ ৩১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৩

প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা

সন্ধ্যা রানী সাহা

চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা আর ‘শিক্ষক যোগ্যতা’ এক বিষয় নয়। শিক্ষক-যোগ্যতা কী তা জানলে একজন শিক্ষক তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে অধিকতর আন্তরিক হবেন। এ প্রত্যাশায় আমার আজকের এ নিবেদন। শিক্ষকগণ প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, শিক্ষাক্রম ও প্রান্তিক যোগ্যতাগুলো মাথায় রাখবেন। পত্রপত্রিকায় সদ্য প্রকাশিত জাতীয়-আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াকবিহাল থাকবেন। কিশোর অপরাধ, অভিভাবকদের নিম্নআয়, সরকারি চাকরির বিধি-বিধান, বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়ার/বিদ্যালয় এলাকার সার্বিক বিষয়াদি সম্পর্কে সজাগ থাকবেন। তারা উক্ত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশু-শিক্ষার্থীদের উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে উন্নয়নে অগ্রসর হবেন। কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব, overlooking এবং escapism যেন তাদের পেয়ে না বসে সে বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। করোনাকালে মাত্র চার মাসের (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) শিক্ষাবর্ষের মধ্যে নির্ধারিত শ্রেণীভিত্তিক অর্জন-উপযোগী যোগ্যতাসমূহ শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে অর্জন করাতে সচেষ্ট হবেন। বিশেষত পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষকগণ বিশেষ technique এর মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ধরে শিখিয়ে পারগ (capable/advance) শিক্ষার্থীদের সমকক্ষ করতে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষকদের জীবনযাত্রা সাদামাটা এবং সহজ হলেও শিক্ষাদান কর্মটি বেশ কঠিন। কাজেই এ বিষয়ে শিক্ষকদের নতুন-নতুন কৌশল অবলম্বনে পারদর্শী হতে হবে। শ্রেণীকক্ষে তারা পারগ শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষক-জ্ঞানে পরিচালনা করতে পারেন। তাহলে শিখনফল অর্জনে দ্রুততা আসবে। শিক্ষার্থীরাও শিখতে আগ্রহী থাকবে। সময়ের সদ্ব্যবহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অত্যাবশ্যক। করোনাকাল এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তাই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সাধারণত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়ে যতটা সতর্ক করতে অভ্যস্ত নিজেদের বেলায় ততটা নয়। বিদ্যালয়ে গমণকারী সবাইকেই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পরিদর্শকরা প্রথমত শিক্ষক, অতঃপর পরিদর্শক এই মানসিকতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাবেন। কাজেই তাদেরও শিক্ষকদের সমান বা তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করতে হবে। শুধু শিক্ষক নয়, বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে সহযোগিতা করার বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, বহু বিবাহ, নেশাগ্রস্ত অভিভাবক, কলহ বিবাদ, মামলা, মোকদ্দমায় জর্জরিত অভিভাবকের কারণে যেন শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সেজন্য এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে counseling করতে হবে।

শ্রেণীর মধ্যে কোন শিশু যেন কোনভাবেই মনমরা হয়ে পড়া লেখার প্রতি উদাসীন না হয়। এই করোনাকালে অনেক অভিভাবক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে আছে। তাদের আয়ের উপায় বাতলে দেয়া বা আয় বৃদ্ধিতে উৎসাহ/পরামর্শও দেবেন শিক্ষক। এজন্য অভিভাবকদের সঙ্গে ঘন ঘন ফোনে যোগাযোগ এবং অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করতে হবে। তবে তা কোনক্রমেই শ্রেণীকাজ বিঘি্নত করে নয়। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধাদি সম্বন্ধে অবহিত করে তাদেরকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থাকবেন শিক্ষকরা। পাঠের বিষয়বস্তুর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জীবন-অভিজ্ঞতার সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবেন শিক্ষকগণ। যেমন- বীজ থেকে কীভাবে চারা গজায় তা শেখানোর জন্য বিদ্যালয়ের আঙিনায় বা শিশুর বাড়ির আঙিনায় বীজ বপন করে তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠসংশ্লিষ্ট উদ্ভাবনমূলক ও সৃজনশীল কাজ দিতে ও প্রশ্ন করতে সক্ষম হবেন শিক্ষকরা। যেমন- অভিনয় করা, গল্প-কবিতা লেখা, হাতের কাজ ইত্যাদি। বোর্ডে শিক্ষক যা কিছু লিখবেন তা স্পষ্ট অক্ষরে সঠিক পদ্ধতিতে লিখবেন। তিনি পর্যায়ক্রমে শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করবেন এবং বোর্ডে লেখার সুযোগ করে দেবেন। এতে শিক্ষার্থীর জড়তা, ভীরুতা এবং অনুপস্থিতি অনেকাংশে দূর হয়ে যাবে।

শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে সমান বুব eye contact স্থাপনে শিক্ষকরা পারদর্শী হবেন। তিনি স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথোপকথনের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন। শুদ্ধভাবে লিখে স্পষ্টভাবে মনোভাব প্রকাশ করবেন। বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন ধারণা (concept) এবং ভাববস্তু (theme) শুদ্ধভাবে ব্যক্ত করবেন। গাণিতিক সমস্যা সঠিক পদ্ধতিতে সমাধান করবেন। গাইড বই দেখে বোর্ডে লিখে গণিত মুখস্থ করানোর tendency থাকলে পরিহার করবেন। বাংলা এবং ইংরেজি বানান করে পড়া শেখাবেন। পাঠ্যবই পড়ানোর পাশাপাশি সংবাদপত্র এবং অন্যান্য পুস্তকাদি যেন শিশুরা পড়তে পারে সে বিষয়ে সহযোগিতা করবেন। তারা শিশু ও শিশুর অভিভাবক সমন্ধে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন। কখনোই বলবেন না বাড়ি থেকে পড়ে আসলে তো শিখবে কিংবা তোর দ্বারা কিছু হবে না এরকম সব বিরক্তিকর কথাবার্তা।

শিক্ষকরা অবশ্যই পাঠ পরিকল্পনা/পাঠটিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী পাঠদানে অগ্রসর হবেন। মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের দলবদ্ধ করে ভিন্ন ভিন্নভাবে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি-পূর্বক শিক্ষাদান করে শিখনফল অর্জন নিশ্চিত করবেন শিক্ষক। তারা শিশুদের আগ্রহ, উৎসাহ ও প্রেষণা সৃষ্টির কলা কৌশল জানবেন। পাঠবিষয়ক ধারণা ও দক্ষতা অর্জন সহজ করার জন্য শিক্ষক যথোপযুক্ত এবং সহজলভ্য শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের নাড়াচাড়া করতে দিয়ে অবলীলাক্রমে শিখিয়ে যাবেন। সহপাঠক্রমিক (co-curricular activities) কার্যাবলীর অনুশীলনের সুযোগ দান করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগ সৃষ্টি করে শিক্ষাদানে পারদর্শী হবেন। শিক্ষার্থীরা অন্যমনস্ক রয়েছে অথচ শিক্ষক তা avoid করে শুধু পড়াচ্ছেন আর পড়াচ্ছেন- এমনভাবে সিলেবাস শেষ করতে যাবেন না। যতটুকু শেখাবেন তা যেন শ্রেণীর সব শিশু শিখতে পারে এমন কৌশলে শেখাবেন। অবশ্যই overcrowded classroom একটি সমস্যা। শিক্ষকগণ বহুমুখী শিখন-শেখানোর কৌশল অবলম্বন করে এ সমস্যার সমাধান করবেন। তারা শিক্ষার্থীদের আসন ব্যবস্থার সর্বদা পরিবর্তন আনবেন।

সমাজে বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ করে দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বুদ্ধির বিকাশে সহায়তা করবেন। যেমন-বিশ^ বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত কৃতী শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপের সুযোগ করে দিয়ে শিক্ষাদান করবেন। শিক্ষার্থী কতটুকু জানে আগে তা পরিমাপ করে সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীকে সহায়তা দানে প্রবৃত্ত হবেন শিক্ষকবৃন্দ। তারা শিক্ষার্থীদের সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করে তা ভালোভাবে বোঝার জন্য বিশ্লেষণ করতে পারদর্শী হবেন। পাঠ-সংশ্লিষ্ট জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি সুদৃঢ় করণের জন্য শিক্ষক উপযুক্ত অনুশীলনমূলক কাজ (শ্রেণীতে ও বাড়িতে) চিহ্নিত করে তা শিক্ষার্থীদের দিয়ে করাতে সক্ষম হবেন। বাড়ির কাজগুলো শিক্ষকরা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবেন। শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকগণ সবসময় শিশুকেন্দ্রিক ফলপ্রসূ পদ্ধতি ও কৌশল নির্বাচন করবেন। শিশুদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকরা সঠিক কৌশলসমূহ নির্বাচন করবেন। শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতির ক্রমপুঞ্জিত রেকর্ড সংরক্ষণ করবেন এবং সময়ে সময়ে তা অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন। তাদের শ্রেণীকাজ পরিচালনা অভিভাবকদের প্রদর্শনের সুযোগদান করবেন প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি। যেন শ্রেণীতে কার সন্তান কতটা তৎপর তা অভিভাবকরা বুঝতে পারেন।

একদিনে সবাইকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব না হলে পর্যায়ক্রমে দিনে দিনে তার ব্যবস্থা রাখবেন। শিক্ষকদের শিখন-দুর্বলতা চিহ্নিত করে নিরাময়মূলক সহায়তা প্রদান করবেন ও পুনরায় মূল্যায়ন করে শিশুদের উৎসাহিত করবেন। শিশুদের সঙ্গে interact কালে শিক্ষক সদা হাসিমুখে থাকবেন। কোনো পিছুটান বা সমস্যার কারণে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করতে পারবেন না। পিছুটান কথাটা এ কারণে উল্লেখ করছি যে, আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বর্তমানে ৬০% এর অধিক মহিলা শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। সামাজিক প্রথা অনুসারে তাদেরকে সংসারের ধোয়া-মোছা, রান্নবান্না, সন্তান পালন ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করে ক্ষেত্র বিশেষে কোলের সন্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়। বিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষিকার সন্তানকে কোলে পিঠে করে রাখা, খাওয়ানো, দেখে রাখা, ইত্যাদি প্রায় সবই করে থাকে নিজের পড়ালেখা ফেলে। তাই তাদের (শিক্ষিকা) জন্য পরামর্শ হলো পরিবারকে যৌথ রাখুন। পরিবারের সদস্যদের নিজে প্রয়োজনে মানসিক এবং আর্থিকভাবে সহযোগিতা করুন। বিনিময়ে আপন সন্তানের নিরাপত্তার দায়িত্বভার তাদের ওপর ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত থাকুন। অন্যথায় উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে দরিদ্র, অসহায় এবং দিনমজুর মহিলা নিয়োগ করে সন্তানজনিত পিছুটান মুক্ত হয়ে বিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে নিয়োজিত রাখুন। নিজের একটি সন্তানের জন্য অপরের সন্তানদের পড়ালেখার ক্ষতি কিংবা বিদ্যালয়ের কর্ম-পরিবেশ বিঘিœত করবেন না। প্রধান শিক্ষকদের এ বিষয়ে বিব্রত করবেন না।

শিক্ষকরা নিজেরাও নিজেদের পেশাগত যোগ্যতা মূল্যায়ন করবেন এবং ধারাবাহিকভাবে তার রেকর্ড সংরক্ষণ করবেন। তারা একাডেমিক আলোচনায় উৎসাহবোধ করবেন এবং স্টাফ মিটিংয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন। শ্রেণীকাজ পরিচালনার সময় ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনালাপ করবেন না। প্রশিক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করবেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে তা প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠের মানোন্নয়ন করবেন। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের তাগিদ আপনা থেকে অনুধাবন করবেন। পরামর্শ কার্যক্রমে/worksop এ আমন্ত্রিত হলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বপ্রণোদিতভাবে কাজ করবেন। উদ্ভাবনমূলক কাজে নিজেদের এবং শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত করে উন্নয়নে অংশগ্রহণ করবেন। শিখন-শেখানো কাজের মান উন্নয়নে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। উন্নত শিখন-শেখানো পদ্ধতির অনুসন্ধান করবেন এবং শ্রেণীকক্ষে তা প্রয়োগ করবেন। শিশুদের সঙ্গে ইতিবাচক, পেশাগত এবং ন্যায়সঙ্গত সম্পর্ক স্থাপন ও বজায় রাখবেন। ব্যক্তিগত ও পেশাগত গ্রহণযোগ্য আচরণের মাধ্যমে শিশুদের মাঝে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। বিভিন্ন জাতিসত্তা, শ্রেণী-ধম-বর্ণ, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সমতা বজায় রাখবেন। বিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। সর্বোপরি শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবেন এবং পেশায় সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করবেন।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]