স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

মোস্তাফা জব্বার

তিন

আমি আজও অত্যন্ত স্পষ্ট করে স্মরণ করতে পারি, শেখ কামাল তার বন্ধুদের নিয়ে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাধীনতার এই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক কা-টি সম্পন্ন করার জন্য সবচেয়ে বড় সৈনিকের কাজ করেছিলেন। শেখ কামালকে এমনিতেই ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীদের চাইতে আলাদা করা যেত না। নাট্যকর্মী হিসেবেও তাকে আলাদা করা যায়নি। সামনে ‘এক নদী রক্ত’ মঞ্চস্থ করার সেই প্রেক্ষিত ও শেখ কামালের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথাও আমরা বলব।

বলা যেতে পারে একেবারে আকস্মিকভাবে শেখ কামাল ‘এক নদী রক্ত’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। নাট্য একাডেমির কথা যে শেখ কামাল জানতেন সেটিই আমি সেভাবে জানতাম না। আমরা গোটাকয়েক ছাত্রলীগ কর্মী আশকার ইবনে শাইখের ফুলার রোডের বাসাকে ঘিরে নাটকের চর্চা করতাম। মিছিল করে স্যারের বাসায় যেতাম। পোস্টার লিখতাম স্যারের বাসায় বসে। পুলিশ দাবড়ানো দিলে স্যারের বাসায় পালাতাম। শেখ কামালের সঙ্গে আমাদের নাট্য পরিবারের সম্পর্কেরও ‘এক নদী রক্ত’ মঞ্চায়নের বিবরণটি জালাল খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

এক নদী রক্ত মঞ্চায়ন নিয়ে মুহম্মদ জালাল লিখেছেন, “৬৬ সাল থেকেই দেখে আসছি ছাত্রলীগের কর্মকা-ের দুর্বলতম অংশের নাম সংস্কৃতি। সাহিত্যেও তাই। আমাদের চোখের সামনে ছাত্র ইউনিয়ন নাটক, সংগীত ইত্যাদিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাতিয়ে রাখতো। আমরা দখলে রাখতাম রাজপথ। অন্যদিকে সাত রং নাট্য গোষ্ঠী আর নাট্য একাডেমি দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু নাটক করতাম। লালন ফকির বা বিদ্রোহী পদ্মা জাতীয় নাটকের বিপরীতে অন্যরা চটকদার অনুষ্ঠান করত। আমাদের জন্য তাই এক নদী রক্তের দর্শকপ্রিয়তার বিষয়টি ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

একুশ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কর্তৃক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল। একুশ তারিখে অন্যান্য কর্মসূচিতে এ নাটকের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলাম। কাজেই ‘এক নদী রক্ত’ মঞ্চায়নের দিন ঠিক করা হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার ছ্ত্রা-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে চূড়ান্ত স্টেজ রিহার্সেল হবার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই আমরা প্রায় সবাই এসে পড়েছিলাম। শেখ কামালকে সামনে পেয়েই স্যার বললেন, “বেশ কিছু ফুল লাগবে কিন্তু।” শেখ কামাল আর দেরি না করে আমাকে বলল, “জালাল ভাই চলেন যাই।” ডালিমও কাছেই ছিল। আমরা তিনজন রমনা পার্কের নার্সারিতে গেলাম। কামাল জিপ চালিয়ে নিয়ে গেল। ফুল নিয়ে আসতেই স্যার আবার বললেন, “আমার বাসা থেকে রাইফেল আর পোশাকগুলোও আনতে হবে কিন্তু। ভুলে যেও না যেন।” ভুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া যায় না। কাজেই আবার কামালকে নিয়ে স্যারের বাসায়। শেখ কামাল জিপের পেছনের ডালা ধরে টানাটানি করে খুলতে পারছে না। আমাকে ডাকল, “জালাল ভাই আমি ফেল। আপনি একটু শক্তি প্রয়োগ করেন। মনে হয় কাজ হবে।” আসলেই কাজ হলো।

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল স্টেজ রিহার্সেল। প্রায় সবাই উপস্থিত। এ ক’দিন সবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক চেষ্টায় প্রস্তুতি ভালোই হয়েছে। প্রথম থেকে সবগুলো দৃশ্য পর্যায়ক্রমে রিহার্সেল হলো। শেষ দৃশ্যে একটি সংকট দেখা দিল। রথীন, মিহির এবং আপেল মাহমুদ-চারণবেশী এরা বন্দি হয়ে যাওয়ার পর শেষ দৃশ্যে অবতীর্ণ হওয়ার কথা অজিত রায়ের। অজিত রায় তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় গণসংগীত শিল্পী। কিন্তু কি একটা কারণে তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। দৃশ্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার গানে আবার জনতা তীব্র বিক্ষোভে জেগে উঠবে, সমবেত হবে, বন্দি চারণ (রথীন) মুক্ত হবে। স্যার চিন্তিত। আফতাব ভাই বললেন, “ও অংশ শিল্পীকে দিয়ে করান যাবে।” আফতাব ভাই আমাকে শিল্পী বলে ডাকতেন, আফতা ভাইয়ের বাবার নাম জালাল ছিলো বলে ও আমি গান গাইতাম বলে আমার এই নাম ছিল। স্যার তেমন উৎসাহ বোধ করলেন না। আফতাব ভাই আমাকে নিয়ে গ্রিন রুমে এলেন। হারমোনিয়াম ছিল। বললেন, “গান তো ঐ গানটা” গেলাম। আফতাব ভাই ফিরে এসে স্যারকে বললেন, “স্যার হবে।” কিন্তু আমার দুরুদুরু ভাবটা রয়েই গেল। স্টেজ রিহার্সেল হল না। আফতাব ভাইকে বললাম। আফতাব ভাই বললেন, “লাগবে না।”

মঞ্চায়ন : হলে হলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে লেখা পোস্টার লাগানো হয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ডাকসুর নাটক ‘এক নদী রক্ত’। রচনা : মোস্তাফা জব্বার। পরিচালনা : আফতাব উদ্দিন আহমদ।

বিকেল ৫টার মধ্যেই আমরা সবাই পৌঁছে গেলাম ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে। প্রথম দিকে যাদের মঞ্চে প্রবেশ তারা সবাই মেকআপ নিতে বসে গেল। মেকআপ বলতে তেমন কিছু না। হালকা প্রলেপ। শুধু আসলাম ভূঁইয়া (চাচা), তাওরীত হোসেন বাদল (বাস্তুহারা), রাজ্জাক (গৃহহারা), তারেক (অন্নহারা)Ñএদের মোটামুটি মেকআপ নেয়ার ছিল। এদের মেকআপ নেয়ার সময় একবার মঞ্চের পর্দার ফাঁক গলিয়ে দেখলাম মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। সামনে কয়েক সারি সুধীজন। মেয়েদের অংশ যতদূর দেখা গেল খালি নাই। এরপরেও চারদিক দিয়ে দাঁড়ান অজস্র ছাত্রছাত্রী এবং বাইরের মানুষ। এক কথায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এমনিতেই ডাকসুর নাটক। নাটকের নাম ‘এক নদী রক্ত।’ এটি তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সেøাগান। ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত, প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত’ ছিল সেøাগানটা। এতেও একটা কৌতূহল এবং আকর্ষণের কারণ রয়েছে। এছাড়া সার্বিকভাবে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটও ছিল দুর্বার আবেগের।

নাটকের প্রথম কটি দৃশ্য ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলোতে মায়ামমতায় জড়ানো পরিবারের চিত্র।

হঠাৎ শহরে ভাষা আন্দোলনের দামামা বেজে উঠল একদিন।

রক্ত ঝরলো ঢাকার রাজপথে।

অনেক সন্তান আর গ্রাম বাংলার মায়ের কোলে ফিরে এলো না।

পুঞ্জীভূত ব্যথা-বেদনা দাবানল হয়ে জ্বলে উঠলো সংগ্রামী চেতনায়।

এরপরের সব দৃশ্যই জেল-জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের।

ছাত্র-জনতার সংগ্রামী প্রত্যয় দৃঢ়তর হতে থাকে।

সংঘর্ষের পর সংঘর্ষ।

গুলির ঘায়ে রক্তের বন্যা বয়ে যায়।

বন্দি হয় চারণ, চারণেরা। একে একে।

সংগ্রাম এগিয়ে যায় তবুও।

অনেক জীবনের বিনিময়ে চারণ মুক্তি পায়। ফিরে আসে জনতার মাঝে।

পর্দা উঠে গেছে কখন জানি না। গ্রিনরুমে মেকআপ নিতে নিতেই রাজা ও রূপার কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

দেখতে দেখতে কয়েকটি দৃশ্য পার হয়ে গেল। সংগ্রাম আন্দোলনের তীব্রতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠলো মঞ্চ।

শুরু হয়ে গেল পুলিশ এবং ছাত্র জনতার মারমুখী সংঘর্ষ।

মঞ্চে মিছিল পরিচালনা করছিল শেখ কামাল। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব দিচ্ছিল। সংঘর্ষের একপর্যায়ে শেখ কামাল দৌড়ে গ্রিনরুমে এলো। হাত দিয়ে কপাল চেপে রেখেছে। গোলযোগের মধ্যে রাইফেলের আঘাতে কামালের কপাল কেটে গেছে। হাত রক্তে ভেজা। সঙ্গে সঙ্গে আতিক কামালকে ধরে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রিনরুমের বাম দিকের করিডোর দিয়ে ওকে বের করে নিয়ে গেল। তখনই ব্যান্ডেজ না করলে অসুবিধা হতে পারে। করিডোর দিয়ে কামালকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই দিককার দর্শকদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিল। তারা হয়তো ভেবে নিয়েছিল, সত্যিই গ-গোল শুরু হয়ে গেছে। “কিছু হয়নি, সামান্য একটু লেগেছে। আপনারা নটক দেখুন”Ñবলতে বলতে আতিক খুব দ্রুত কামালকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তখনো মঞ্চে দফায় দফায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলছে।

মিলিটারি মেজর গর্জে উঠলো, “কে গায়? স্তব্ধ করে দাও ঐ কণ্ঠ।”

গান গেয়ে যাওয়া চারণের মিছিলের ওপর হলো গুলি।

বন্দি হলো চারণ। যেতে যেতে বলে গেল, “আমার একার কণ্ঠ তোমরা বন্ধ করতে পার। অগণিত জনতার কণ্ঠে যে সুর রেখে গেলাম তা তোমরা কিছুতেই ধ্বংস করতে পারবে না।”

আন্দোলন এগিয়ে যায় বাঁধভাঙা জোয়ারের গতিতে। প্রতিরোধ হয় দুর্বার।

শেষ দৃশ্য। উইংসের পাশে হারমোনিয়াম কাঁধে দাঁড়িয়ে মুড আনার চেষ্টা করছি। অজিত রায়ের করার কথা ছিল। না হয়ে বরং ভালোই হয়েছে। কারণ আগের গানগুলো ছিল শুধু গেয়ে যাওয়ার। কিন্তু এ গানে বেশ কিছুটা অভিনয়ের ব্যাপার আছে। জাগ্রত জনতার মাঝে হারমোনিয়াম কাঁধে গান গাওয়ার সময় চোখে ঝরবে বিক্ষোভের আগুন।

রথীনের কণ্ঠে গান ভেসে এলো “জাগো নাগিনীরা জাগো জাগো।”

ঝড়ের গতিতে জনতার মাঝে গিয়ে পড়লাম। আমার চোখের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য লাইটম্যান খুব পারদর্শিতার সঙ্গে আলোক প্রক্ষেপণের কাজ করে যাচ্ছিল।

গান শেষে মুক্ত চারণ ফিরে এলো জনতার মাঝে।

হঠাৎ আমার পিছনে নারী কণ্ঠের সেøøাগান, “জয় বাংলা”, “জয় বাংলা বিভাগ।” তাকিয়ে দেখি মমতাজ আপা (ছাত্রলীগ কর্মী, পরবর্তীতে জাসদ নেত্রী। বছর কয়েক আগে ইন্তেকাল করেছেন)। বললাম, “জয় বাংলা” তো বুঝলাম। “জয় বাংলা বিভাগ” আবার কোনো সেøাগান?” মমতাজ আপা যা বুঝালেন তার অর্থ হলো মোস্তাফা, আমি, রথীন, রাজ্জাকুল হায়দার, সফি এবং আরও কয়েকজন বাংলা বিভাগের একই শ্রেণীর সহপাঠী এ নাটকের সঙ্গে জড়িত। আমাদের বিভাগের সিনিয়র ও জুনিয়র বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন মহসীন ভাই, কামাল হায়দার। এছাড়া মিছিলের সময় মমতাজ আপা ও রোকেয়াসহ বাংলা বিভাগের আরো অনেকেই অংশ নিয়েছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের তিন মাস ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সময়। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র জয়লাভ, একাত্তরের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ। এরপর থেকে ৬-দফাভিত্তিক আন্দোলন দুর্বার হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” উচ্চারণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের দলিল লিখে এনে দেয়ার লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়। এর ঠিক ১৩ দিন আগে মঞ্চস্থ হয় ‘এক নদী রক্ত’।

সেই একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল পরাধীন বাংলাদেশের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার বুকের রক্ত দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদবিরোধী সংগ্রামের বীজ বপন করে গিয়েছিল। বায়ান্নো থেকে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন পর্যন্ত অসংখ্য বাঙালি ছাত্র-জনতার রক্তে ভিজে সেই বায়ান্নোর শহীদদের বপন করে যাওয়া বীজ থেকে বাংলাদেশের সমান আয়তনের এক মহীরুহ জন্ম নিয়েছে। একাত্তরে এসে সেই মহীরুহ পূর্ণ ফলবতী। আরও রক্তে স্নান করিয়ে প্রতিটি পরিপক্ব ফল ঘরে তুলতে হবে। ‘এক নদী রক্ত’ নাটকটি ছিল সেই রক্ত স্নানের আবাহন, গণজাগরণের এক দুরন্ত নাটকীয় অভিব্যক্তি।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা জাতিগতভাবে ইতিহাসবিমুখ। আমাদেরকে যখন যা সামনে দেয়া হয় তাতেই মগ্ন হয়ে যাই। আমাদের অবস্থা এমন যে গতকালের ঘটনাটিও আমাদের মনে থাকে না। অনেকটা ফেসবুকের স্ট্যাটাসের মতো। যেটি সামনে থাকে সেটি নিয়েই মাতামাতি করি। এর জন্য আমরা ভাবি ২৫ মার্চ রাতে বাংলার স্বাধীনতার সূচনা হয়েছিলো। আমরা একাত্তরের ৯ মাসের যুদ্ধটাকেই শুধু মনে রাখি। এর আগের প্রেক্ষিতগুলো মোটেই আমলে নিই না। বিশেষ করে বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ তরুণের লড়াই আমরা স্মরণেই নিই না। শেখ কামালের মতো মুক্তিযোদ্ধা যে কেবল অস্ত্র নিয়েই যুদ্ধ করেননি সংস্কৃতিতে যে তার অবদান অপরিসীম সেটি কেউই মনে রাখেননি। অন্যদিকে সেই সময়ে এক নদী রক্ত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আরও একধাপ সামনে নিতে যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলো সেটিও কেউ আলোচনায় আনেন না। আমরা এখনও যারা বেঁচে আছি তাদের তো উচিত শেখ কামালদের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা। আমরা যারা ‘এক নদী রক্ত’ নিয়ে মঞ্চে ওঠেছিলাম তারা গর্ব করে বলতে পারি একাত্তরেই কেবল নয় শেখ কামাল হলেন সেই ব্যক্তি যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য মঞ্চস্থ একটি নাটকে প্রথম রক্ত দিয়েছিলেন। শেখ কামাল অমর হোক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতিটি পাতা যেন আমরা পাঠ করি। শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল তার সঙ্গে শহীদ পরিবারবর্গ, বঙ্গমাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পরম শ্রদ্ধা।

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সর্বশেষ সম্পাদনা: ৬ নভেম্বর, ২০২১।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]

মঙ্গলবার, ০৯ নভেম্বর ২০২১ , ২৪ কার্তিক ১৪২৮ ৩ রবিউস সানি ১৪৪৩

স্বাধীনতার প্রথম গণনাট্য ‘এক নদী রক্ত’ ও শেখ কামাল

মোস্তাফা জব্বার

তিন

আমি আজও অত্যন্ত স্পষ্ট করে স্মরণ করতে পারি, শেখ কামাল তার বন্ধুদের নিয়ে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাধীনতার এই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক কা-টি সম্পন্ন করার জন্য সবচেয়ে বড় সৈনিকের কাজ করেছিলেন। শেখ কামালকে এমনিতেই ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীদের চাইতে আলাদা করা যেত না। নাট্যকর্মী হিসেবেও তাকে আলাদা করা যায়নি। সামনে ‘এক নদী রক্ত’ মঞ্চস্থ করার সেই প্রেক্ষিত ও শেখ কামালের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথাও আমরা বলব।

বলা যেতে পারে একেবারে আকস্মিকভাবে শেখ কামাল ‘এক নদী রক্ত’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। নাট্য একাডেমির কথা যে শেখ কামাল জানতেন সেটিই আমি সেভাবে জানতাম না। আমরা গোটাকয়েক ছাত্রলীগ কর্মী আশকার ইবনে শাইখের ফুলার রোডের বাসাকে ঘিরে নাটকের চর্চা করতাম। মিছিল করে স্যারের বাসায় যেতাম। পোস্টার লিখতাম স্যারের বাসায় বসে। পুলিশ দাবড়ানো দিলে স্যারের বাসায় পালাতাম। শেখ কামালের সঙ্গে আমাদের নাট্য পরিবারের সম্পর্কেরও ‘এক নদী রক্ত’ মঞ্চায়নের বিবরণটি জালাল খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

এক নদী রক্ত মঞ্চায়ন নিয়ে মুহম্মদ জালাল লিখেছেন, “৬৬ সাল থেকেই দেখে আসছি ছাত্রলীগের কর্মকা-ের দুর্বলতম অংশের নাম সংস্কৃতি। সাহিত্যেও তাই। আমাদের চোখের সামনে ছাত্র ইউনিয়ন নাটক, সংগীত ইত্যাদিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাতিয়ে রাখতো। আমরা দখলে রাখতাম রাজপথ। অন্যদিকে সাত রং নাট্য গোষ্ঠী আর নাট্য একাডেমি দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু নাটক করতাম। লালন ফকির বা বিদ্রোহী পদ্মা জাতীয় নাটকের বিপরীতে অন্যরা চটকদার অনুষ্ঠান করত। আমাদের জন্য তাই এক নদী রক্তের দর্শকপ্রিয়তার বিষয়টি ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

একুশ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কর্তৃক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল। একুশ তারিখে অন্যান্য কর্মসূচিতে এ নাটকের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলাম। কাজেই ‘এক নদী রক্ত’ মঞ্চায়নের দিন ঠিক করা হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার ছ্ত্রা-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে চূড়ান্ত স্টেজ রিহার্সেল হবার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই আমরা প্রায় সবাই এসে পড়েছিলাম। শেখ কামালকে সামনে পেয়েই স্যার বললেন, “বেশ কিছু ফুল লাগবে কিন্তু।” শেখ কামাল আর দেরি না করে আমাকে বলল, “জালাল ভাই চলেন যাই।” ডালিমও কাছেই ছিল। আমরা তিনজন রমনা পার্কের নার্সারিতে গেলাম। কামাল জিপ চালিয়ে নিয়ে গেল। ফুল নিয়ে আসতেই স্যার আবার বললেন, “আমার বাসা থেকে রাইফেল আর পোশাকগুলোও আনতে হবে কিন্তু। ভুলে যেও না যেন।” ভুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া যায় না। কাজেই আবার কামালকে নিয়ে স্যারের বাসায়। শেখ কামাল জিপের পেছনের ডালা ধরে টানাটানি করে খুলতে পারছে না। আমাকে ডাকল, “জালাল ভাই আমি ফেল। আপনি একটু শক্তি প্রয়োগ করেন। মনে হয় কাজ হবে।” আসলেই কাজ হলো।

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল স্টেজ রিহার্সেল। প্রায় সবাই উপস্থিত। এ ক’দিন সবার অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক চেষ্টায় প্রস্তুতি ভালোই হয়েছে। প্রথম থেকে সবগুলো দৃশ্য পর্যায়ক্রমে রিহার্সেল হলো। শেষ দৃশ্যে একটি সংকট দেখা দিল। রথীন, মিহির এবং আপেল মাহমুদ-চারণবেশী এরা বন্দি হয়ে যাওয়ার পর শেষ দৃশ্যে অবতীর্ণ হওয়ার কথা অজিত রায়ের। অজিত রায় তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় গণসংগীত শিল্পী। কিন্তু কি একটা কারণে তিনি অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। দৃশ্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার গানে আবার জনতা তীব্র বিক্ষোভে জেগে উঠবে, সমবেত হবে, বন্দি চারণ (রথীন) মুক্ত হবে। স্যার চিন্তিত। আফতাব ভাই বললেন, “ও অংশ শিল্পীকে দিয়ে করান যাবে।” আফতাব ভাই আমাকে শিল্পী বলে ডাকতেন, আফতা ভাইয়ের বাবার নাম জালাল ছিলো বলে ও আমি গান গাইতাম বলে আমার এই নাম ছিল। স্যার তেমন উৎসাহ বোধ করলেন না। আফতাব ভাই আমাকে নিয়ে গ্রিন রুমে এলেন। হারমোনিয়াম ছিল। বললেন, “গান তো ঐ গানটা” গেলাম। আফতাব ভাই ফিরে এসে স্যারকে বললেন, “স্যার হবে।” কিন্তু আমার দুরুদুরু ভাবটা রয়েই গেল। স্টেজ রিহার্সেল হল না। আফতাব ভাইকে বললাম। আফতাব ভাই বললেন, “লাগবে না।”

মঞ্চায়ন : হলে হলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে লেখা পোস্টার লাগানো হয়েছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ডাকসুর নাটক ‘এক নদী রক্ত’। রচনা : মোস্তাফা জব্বার। পরিচালনা : আফতাব উদ্দিন আহমদ।

বিকেল ৫টার মধ্যেই আমরা সবাই পৌঁছে গেলাম ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে। প্রথম দিকে যাদের মঞ্চে প্রবেশ তারা সবাই মেকআপ নিতে বসে গেল। মেকআপ বলতে তেমন কিছু না। হালকা প্রলেপ। শুধু আসলাম ভূঁইয়া (চাচা), তাওরীত হোসেন বাদল (বাস্তুহারা), রাজ্জাক (গৃহহারা), তারেক (অন্নহারা)Ñএদের মোটামুটি মেকআপ নেয়ার ছিল। এদের মেকআপ নেয়ার সময় একবার মঞ্চের পর্দার ফাঁক গলিয়ে দেখলাম মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। সামনে কয়েক সারি সুধীজন। মেয়েদের অংশ যতদূর দেখা গেল খালি নাই। এরপরেও চারদিক দিয়ে দাঁড়ান অজস্র ছাত্রছাত্রী এবং বাইরের মানুষ। এক কথায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এমনিতেই ডাকসুর নাটক। নাটকের নাম ‘এক নদী রক্ত।’ এটি তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সেøাগান। ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত, প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত’ ছিল সেøাগানটা। এতেও একটা কৌতূহল এবং আকর্ষণের কারণ রয়েছে। এছাড়া সার্বিকভাবে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটও ছিল দুর্বার আবেগের।

নাটকের প্রথম কটি দৃশ্য ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলোতে মায়ামমতায় জড়ানো পরিবারের চিত্র।

হঠাৎ শহরে ভাষা আন্দোলনের দামামা বেজে উঠল একদিন।

রক্ত ঝরলো ঢাকার রাজপথে।

অনেক সন্তান আর গ্রাম বাংলার মায়ের কোলে ফিরে এলো না।

পুঞ্জীভূত ব্যথা-বেদনা দাবানল হয়ে জ্বলে উঠলো সংগ্রামী চেতনায়।

এরপরের সব দৃশ্যই জেল-জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের।

ছাত্র-জনতার সংগ্রামী প্রত্যয় দৃঢ়তর হতে থাকে।

সংঘর্ষের পর সংঘর্ষ।

গুলির ঘায়ে রক্তের বন্যা বয়ে যায়।

বন্দি হয় চারণ, চারণেরা। একে একে।

সংগ্রাম এগিয়ে যায় তবুও।

অনেক জীবনের বিনিময়ে চারণ মুক্তি পায়। ফিরে আসে জনতার মাঝে।

পর্দা উঠে গেছে কখন জানি না। গ্রিনরুমে মেকআপ নিতে নিতেই রাজা ও রূপার কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

দেখতে দেখতে কয়েকটি দৃশ্য পার হয়ে গেল। সংগ্রাম আন্দোলনের তীব্রতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠলো মঞ্চ।

শুরু হয়ে গেল পুলিশ এবং ছাত্র জনতার মারমুখী সংঘর্ষ।

মঞ্চে মিছিল পরিচালনা করছিল শেখ কামাল। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব দিচ্ছিল। সংঘর্ষের একপর্যায়ে শেখ কামাল দৌড়ে গ্রিনরুমে এলো। হাত দিয়ে কপাল চেপে রেখেছে। গোলযোগের মধ্যে রাইফেলের আঘাতে কামালের কপাল কেটে গেছে। হাত রক্তে ভেজা। সঙ্গে সঙ্গে আতিক কামালকে ধরে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রিনরুমের বাম দিকের করিডোর দিয়ে ওকে বের করে নিয়ে গেল। তখনই ব্যান্ডেজ না করলে অসুবিধা হতে পারে। করিডোর দিয়ে কামালকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই দিককার দর্শকদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিল। তারা হয়তো ভেবে নিয়েছিল, সত্যিই গ-গোল শুরু হয়ে গেছে। “কিছু হয়নি, সামান্য একটু লেগেছে। আপনারা নটক দেখুন”Ñবলতে বলতে আতিক খুব দ্রুত কামালকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তখনো মঞ্চে দফায় দফায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলছে।

মিলিটারি মেজর গর্জে উঠলো, “কে গায়? স্তব্ধ করে দাও ঐ কণ্ঠ।”

গান গেয়ে যাওয়া চারণের মিছিলের ওপর হলো গুলি।

বন্দি হলো চারণ। যেতে যেতে বলে গেল, “আমার একার কণ্ঠ তোমরা বন্ধ করতে পার। অগণিত জনতার কণ্ঠে যে সুর রেখে গেলাম তা তোমরা কিছুতেই ধ্বংস করতে পারবে না।”

আন্দোলন এগিয়ে যায় বাঁধভাঙা জোয়ারের গতিতে। প্রতিরোধ হয় দুর্বার।

শেষ দৃশ্য। উইংসের পাশে হারমোনিয়াম কাঁধে দাঁড়িয়ে মুড আনার চেষ্টা করছি। অজিত রায়ের করার কথা ছিল। না হয়ে বরং ভালোই হয়েছে। কারণ আগের গানগুলো ছিল শুধু গেয়ে যাওয়ার। কিন্তু এ গানে বেশ কিছুটা অভিনয়ের ব্যাপার আছে। জাগ্রত জনতার মাঝে হারমোনিয়াম কাঁধে গান গাওয়ার সময় চোখে ঝরবে বিক্ষোভের আগুন।

রথীনের কণ্ঠে গান ভেসে এলো “জাগো নাগিনীরা জাগো জাগো।”

ঝড়ের গতিতে জনতার মাঝে গিয়ে পড়লাম। আমার চোখের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য লাইটম্যান খুব পারদর্শিতার সঙ্গে আলোক প্রক্ষেপণের কাজ করে যাচ্ছিল।

গান শেষে মুক্ত চারণ ফিরে এলো জনতার মাঝে।

হঠাৎ আমার পিছনে নারী কণ্ঠের সেøøাগান, “জয় বাংলা”, “জয় বাংলা বিভাগ।” তাকিয়ে দেখি মমতাজ আপা (ছাত্রলীগ কর্মী, পরবর্তীতে জাসদ নেত্রী। বছর কয়েক আগে ইন্তেকাল করেছেন)। বললাম, “জয় বাংলা” তো বুঝলাম। “জয় বাংলা বিভাগ” আবার কোনো সেøাগান?” মমতাজ আপা যা বুঝালেন তার অর্থ হলো মোস্তাফা, আমি, রথীন, রাজ্জাকুল হায়দার, সফি এবং আরও কয়েকজন বাংলা বিভাগের একই শ্রেণীর সহপাঠী এ নাটকের সঙ্গে জড়িত। আমাদের বিভাগের সিনিয়র ও জুনিয়র বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন মহসীন ভাই, কামাল হায়দার। এছাড়া মিছিলের সময় মমতাজ আপা ও রোকেয়াসহ বাংলা বিভাগের আরো অনেকেই অংশ নিয়েছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের তিন মাস ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সময়। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র জয়লাভ, একাত্তরের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ। এরপর থেকে ৬-দফাভিত্তিক আন্দোলন দুর্বার হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় পরিণত হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” উচ্চারণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের দলিল লিখে এনে দেয়ার লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়। এর ঠিক ১৩ দিন আগে মঞ্চস্থ হয় ‘এক নদী রক্ত’।

সেই একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল পরাধীন বাংলাদেশের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার বুকের রক্ত দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদবিরোধী সংগ্রামের বীজ বপন করে গিয়েছিল। বায়ান্নো থেকে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন পর্যন্ত অসংখ্য বাঙালি ছাত্র-জনতার রক্তে ভিজে সেই বায়ান্নোর শহীদদের বপন করে যাওয়া বীজ থেকে বাংলাদেশের সমান আয়তনের এক মহীরুহ জন্ম নিয়েছে। একাত্তরে এসে সেই মহীরুহ পূর্ণ ফলবতী। আরও রক্তে স্নান করিয়ে প্রতিটি পরিপক্ব ফল ঘরে তুলতে হবে। ‘এক নদী রক্ত’ নাটকটি ছিল সেই রক্ত স্নানের আবাহন, গণজাগরণের এক দুরন্ত নাটকীয় অভিব্যক্তি।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা জাতিগতভাবে ইতিহাসবিমুখ। আমাদেরকে যখন যা সামনে দেয়া হয় তাতেই মগ্ন হয়ে যাই। আমাদের অবস্থা এমন যে গতকালের ঘটনাটিও আমাদের মনে থাকে না। অনেকটা ফেসবুকের স্ট্যাটাসের মতো। যেটি সামনে থাকে সেটি নিয়েই মাতামাতি করি। এর জন্য আমরা ভাবি ২৫ মার্চ রাতে বাংলার স্বাধীনতার সূচনা হয়েছিলো। আমরা একাত্তরের ৯ মাসের যুদ্ধটাকেই শুধু মনে রাখি। এর আগের প্রেক্ষিতগুলো মোটেই আমলে নিই না। বিশেষ করে বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ তরুণের লড়াই আমরা স্মরণেই নিই না। শেখ কামালের মতো মুক্তিযোদ্ধা যে কেবল অস্ত্র নিয়েই যুদ্ধ করেননি সংস্কৃতিতে যে তার অবদান অপরিসীম সেটি কেউই মনে রাখেননি। অন্যদিকে সেই সময়ে এক নদী রক্ত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আরও একধাপ সামনে নিতে যে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলো সেটিও কেউ আলোচনায় আনেন না। আমরা এখনও যারা বেঁচে আছি তাদের তো উচিত শেখ কামালদের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা। আমরা যারা ‘এক নদী রক্ত’ নিয়ে মঞ্চে ওঠেছিলাম তারা গর্ব করে বলতে পারি একাত্তরেই কেবল নয় শেখ কামাল হলেন সেই ব্যক্তি যিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য মঞ্চস্থ একটি নাটকে প্রথম রক্ত দিয়েছিলেন। শেখ কামাল অমর হোক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতিটি পাতা যেন আমরা পাঠ করি। শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল তার সঙ্গে শহীদ পরিবারবর্গ, বঙ্গমাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পরম শ্রদ্ধা।

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সর্বশেষ সম্পাদনা: ৬ নভেম্বর, ২০২১।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক]