ধারাবাহিক রচনা : শেষ পর্ব

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

(পূর্ব প্রকাশের পর)

১৭.

আমি বিজয় দেখেছি

সেদিনের সন্ধ্যাটা কি অন্যান্য সন্ধ্যার চেয়ে অন্য রকম ছিল? ক্যামন করে বুঝব অন্যরকম ছিল? আর দশটা সন্ধ্যার মতই ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ঠাসা। আসলে কী হচ্ছে দেশে। মুক্তি বাহিনী কি পেরে উঠবে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে? পারবে বোধ হয়। ইন্ডিয়া নাকি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। স্বীকৃতি জিনিসটা কী তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বাবা বললেন ইন্ডিয়ান আর্মিরা আমাদের পক্ষে এবার নামবে। পাকিস্তানের যেমন পাঞ্জাবি সৈন্য আছে ইন্ডিয়ারও তেমনি পাঞ্জাবি সৈন্য আছে। ইন্ডিয়ান পাঞ্জাাবি সৈন্যগুলো নাকি আরো সরস। যুদ্ধে নাকি আমরা জিতে যাবো। আমরা একথা বিশ্বাস করি।

ডিসেম্বরের সূর্য আমাদের বাঁশঝাড়ের আগায় কিছুক্ষণ লটকে থেকে ডুবে গিয়েছে। খৈলাধুলা সেরে পুকুরের ঘাটলায় হাত-পা ধুয়ে গায়ে গরম একটা কিছু চাপিয়েছি। কুপি বাতিগুলো মৃদু আলো জালিয়ে আমাদের পাড়ার সকল গৃহকোণের আঁধার দূরিভূত করার একটা নিস্ফল চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন সময় পুরো গ্রাম কেঁপে উঠে গোলাগুলির আওয়াজে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। আবারো কি পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে এসেছে? কিছুই ঠাহর করতে পারি না। আবারো কি আমাদেরকে পালাতে হবে? কিন্তু শব্দগুলো এতো কাছে কেনো? আমাদের উঠোন থেকে উত্তর পুব দিকে তাকিয়ে দেখি মুক্তোছন কাকাদের উঠান থেকে গুলির আওয়াজ আর তার সাথে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। কিছু ছেলেমেয়ে হৈ হল্লা করছে। তা হলে কি পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের পাড়াতে চলে এসেছে?

‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে’। আব্বা ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে নেমে বলল। গুলি ফোটাচ্ছে মুক্তিরা। আমি আব্বার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। কথা নেই বার্তা নেই আগাম কোনো খবর নেই দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে! আমি সাহসে ভর করে একপা দুপা করে কাকাদের উঠানের দিকে পা বাড়াই। সেখানে গিয়ে দেখি আলো আঁধারিতে অনেক মানুষ। এদের মধ্যে একজনের হাতে বন্দুক। সে মনের আনন্দে গুলি করে যাচ্ছে আকাশের তারা তাক করে। নিচে একদল অর্ধ উলঙ্গ ছেলে মেয়ে মনের আনন্দে গুলির খোসা কুড়াচ্ছে। আমি ধাক্কা মেরে দুয়েকজনকে সরিয়ে গুলির খোসা কুড়াতে চেষ্টা করি। গুলি ফোটাচ্ছে আমাদের মিঠু মামা। সে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। একবার চেষ্টা করে বর্ডার থেকে ফিরে এসেছিল বলে শুনেছি। সে বন্ধুক পেলো কোথায়?

চারিদিক থেকে অবিরত গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। কান পাতা দায়।

অতঃপর আমরা বিভিন্ন বাড়িতে যাই। অবাক বিস্ময়ে কাদির চাচা, খালেদ ভাই, মিনু ভাই, শাহাবুদ্দিন ভাই জালাল ভাই এদেরকে দেখি। এদের প্রত্যেকের হাতেই অস্ত্র আর এ অস্ত্র থেকেই অবিরাম গুলি বের চ্ছে। এঁরা এতোদিন কোথায় ছিলেন?। এঁরা যুদ্ধে গিয়েছিল জানি কিন্তু এরা যে গ্রামে আছে তাতো জানতাম না। তাঁদের বন্ধুক, স্টেন গান থেকে গুলি বের হচ্ছে দেদারসে। গুলির সাথে আগুনের ফুলকি। ঝাঁকে ঝাঁকে আকাশের অজানা গস্তব্যে চলছে সে গুলি। গুলির খোসা ঝর ঝর করে মাঠিতে পড়ছে। আর আমরা মনের আনন্দে কুড়াচ্ছি সে গুলির খোসা। আমাদে মুঠো ভরে উঠে গুলির খোসাতে। আমরা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি, কে বেশি খোসা কুড়াতে পারে। মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে গুলি ফোটাতে থাকে। এত গুলি কেথায় ছিল এতোদিন আমি ভেবে পাই না। এশা নামাজের আগ পর্যন্ত থেমে থেমে চলল গুলির আওয়াজ। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে পায়ে ঘুরছি বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি। দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গিয়েছে? পাকিস্তানি বাহিনী আতœসমর্পণ করেছে। আহা! স্বাধীন দেশ। আমাদের আর কোনো ভয় নেই। আমাদেরকে আর কেউ মেরে ফেলতে পারবে না গুলি করে। আমাদেরকে আর আমাদের বাড়ি ছেড়ে রাতের আঁধারে পালাতে হবে না। আমাদের অন্য কোনো মালতি দিদিকে আর কেউ অত্যাচার করে মেরে ফেলতে পারবে না। আমরা বুক চিতিয়ে এখন থেকে রাস্তা ঘাটে চলাচল করতে পারব। আমরা আমাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে পারব।

মুক্তিযোদ্ধদের দেখতে আমাদের বড়ই ভালো লাগে। তাঁরা আমাদেরই ভাই, চাচা। আমারা সারাক্ষণ তাঁদের পিছু পিছু ঘুরি। তাদের বন্ধুকটা, স্টেনগানটা একটু নেড়েচেড়ে দেখি আমরা। ভয় লাগে, যদি গুলিটুলি বের হয়ে যায়। এরকম একটা ঘটনা যে পাশের গ্রামে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। বন্দুক চালাতে অজ্ঞ এক অতি উৎসাহী বন্দুক হাতে নিয়ে- দেই গুলি, দেই গুলি বলে এক মহিলাকে ভয় দেখাতে থাকে। মহিলাটি তাঁর ঠাট্টা সম্পর্কীয় কেউ ছিলেন নিশ্চয়ই। আনাড়ি লোকটি দেই গুলি, দেই গুলি, করতে করতে ট্রিগারে চাপ মারলে বন্দুকের নল দিয়ে গুলি বের হয়ে মহিলাটির কণ্ঠনালী ভেদ করে গুলিটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সাথে সাথেই মহিলাটি মারা যায়। আমরা খুব সতর্কতার সাথে বন্দুক আর স্টেনগান নাড়াচাড়া করি।

আমাদের চেয়ে বড়দের উৎসাহ আর উদ্দীপনা এব্যাপারে অনেক বেশি। এরা যে কোনো কারণেই হোক যুদ্ধে যেত পারেননি। বন্দুক হাতে পেয়ে তাদের হাত নিশপিশ করতে থেকে। এলোপাতাড়ি কয়েক জায়গায় এরা গুলিও চালিয়েছে কুকুর বিড়ালের ওপর। রাস্তা দিয়ে এক কুকুর হাঁটছিল। হাতের টিপ পরীক্ষা করার জন্য একজন কুকুরটিকে লক্ষ করে বন্দুক চালালো। বদ নসিব কুকুরটির। তার নিশানা ব্যর্থ হলো না। রাস্তার উপর লুটিয় পড়ল কুকুরটি। প্রচণ্ড জোরে কুকুরটি চিৎকার করছিল। আমাদের আনন্দ ধ্বনিতে কুকুরটির আর্তনাদ চাপা পড়ে যায়। কুকুরটির মালিক কে ছিল আমার মনে নেই। মালিক নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়ে ছিলেন। কিন্তু মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদ করেননি। আমরা স্বাধীন হয়ে গিয়েছি! আমরা যা খুশি করতে পারব? নিরীহ কুকুর মারতে পারব? বিড়াল মারতে পারব? ইচ্ছে করলে খেলার ছলে মানুষের দিকে বন্ধুক তাক করে ভয় দেখাতে পারব? ভুলে সে বন্ধুকের নল দিয়ে গুলি বের হয়ে মানুষ মারা গেলে আমার কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবে না?

আমাদের গ্রামে কোনো রাজাকার ছিল না। আমাদের পাশের গ্রাম ফুলপুরেও কোনো রাজাকার ছিল না। এজন্য আমরা খুব গর্ববোধ করতাম। নাসিরনগরের কয়েকটি গ্রাম ব্যতীত সব গ্রামই ছিল রাজাকার মুক্ত। থানা সদরের পাশে একটা গ্রামে ছিল কিছু রাজাকার। একদিন তাদেরকে ধরে আনা হলো। এরা অতি সাধারণ মানুষ। গরিব শ্রেণির বলেই মনে হলো। আসলে এরা কোনো রাজনৈতিক কারণে রাজাকারগিরি করতে যায়নি। সামান্য কিছু প্রাপ্তির আশায় কিংবা মুসলিম লীগের নেতাদের কথায়ই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। তাদেরকে সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কী সাজা দেয়া হলো তাদেরক? গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে এদেরকে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছিল আর তওবা পড়ানো হয়েছিল যাতে ভবষ্যিতে এরা আর দেশের বিরোধিতা না করে। আর কিছু চড় লাথিও তাদের ভাগ্যে জুটেছিল। তাদের ভাগ্য খুবই ভালো। অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে।

দেশ স্বাভাবিক হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ছাত্র, কেউ কৃষক কেউ বা চাকরজীবী। তারা এখন স্ব স্ব পেশায় ফেরত যাবেন। তাঁদের কাছে অস্ত্র রয়ে গেছে। কী হবে সে অস্ত্রের? এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র ফেরত দিতে নির্দেশ দিলেন। একটা দিন ঠিক হলো। সেদিন আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতে যাবে। আমাদের মাঝে সাজ সাজ রব। আমরাও তাঁদের সাথে যাবো। তাঁরা আমাদেরকে নেবে না। না নেয়ার কারণ হলো আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই, আর আমরা ছোট। আমাদের মন খুবই খারাপ হলো। আমরা বেজার মুখে তাদের পিছু পিছু যাই। তাঁদের মনে কিছুটা দয়ার সঞ্চার হয়। তাঁরা আমাদেরকে অস্ত্রগুলো বহন করতে দেয়। আমি খুব খুশি হই আর গৌরব বোধ করি। আমার ভাগে পড়ে একটা স্টেনগান। আমার পিঠে স্টেনগানটা কেউ একজন ঝুলিয়ে দেয়। আমি মহাবিক্রমে স্টেনগানটা পিঠে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। গৌরবে আমার পা যেনা মাঠিতে পড়ে না। যেনা আমি হাওয়ায় ভেসে উড়ে চলেছি। সেই পরম আনন্দটুকু বেশিক্ষণ আমাদের ভাগ্যে সইল না। গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আমাদেরকে অস্ত্রগুলো বহন করতে দেয়া হলো। তারপর আমাদেরকে বাড়ি ফিরতে নির্দেশ দিলেন তাঁরা। আমরা তাঁদের নির্দেশ মতো বাড়ির পথ ধরলাম। আমাদের

পিঠে তখনো যেনা ধাতব অস্ত্রগুলোর একটা ছোঁয়া লেগেছিল। সেই ছোঁয়াটুকু কি এখনো টের পাই? পাই মনে হয়। আর তখনই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়। নিজেকে আমি প্রশ্ন করি আমি কি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম? মাঝে মাঝে মনে হয় ছিলামই তো।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জনযুদ্ধ। কিছু লোক বাদে দেশের সাধারণ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল। এক অর্থে সে সময় দেশের প্রায় সব মানুষই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা সম্মুখ ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা তো আলাদাই, তাঁরা আমাদের গর্ব, জাতীয় বীর।

যুদ্ধ তো শেষ। সবকিছু আবার ঠিক মতো চালাতে হবে, চলতে হবে। অনেকদিন স্কুলে যাইনি আমরা। সম্ভবত এপ্রিল থেকেই আমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বইগুলো মাথার উপর তাকে রাখা ছিল। সেগুলি আর খোলা হয়নি। এবার স্কুলে যেত হবে। বইগুলি খুললাম। বইগুলি থেকে কীরকম একটা গন্ধ বের হচ্ছে। সোঁদা গন্ধ। চৈত্র বৈশাখ মাসে প্রথম বৃষ্টি হলে মাটি থেকে যেরকম একটা গন্ধ বের হয়ে সেরকম আর কি। আমি বইগুলিকে বুকের সাথে চেপে ধরে সেই সোঁদা গন্ধ নিতে থাকি।

আমাদের শিক্ষা জীবন থেকে এক বছর ঝরে পড়ে। আমরা কি তৃতীয় শ্রেণিতে উঠব না কি দ্বিতীয় শ্রেণিতেই থেকে যাবো এরকম একটা বিষয় চলে আসে সামনে। যাদের অভিভাবক অতিসচেতন তারা স্বয়ংক্রিয় পাস নিয়ে উপরের ক্লাসে চলে যায়। আমরা রয়ে যাই একই ক্লাসে। আমাদের অভিভাবক আর শিক্ষকদের অভিমত হলো- বিনা পড়াশোনা আর পরীক্ষা ছাড়া উপরের ক্লাসে উঠা ঠিক হবে না। পড়াশোনায় পাকাপোক্ত হয়েই উপরের ক্লাসে উঠা উচিৎ। আমি পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য ক্লাস টুতেই রয়ে যাই। অবশ্য অটোপাসের সুযোগটা খুব বেশি সংখ্যক ছাত্র কাজে লাগিয়েছিল এমনটা বলা যাবে না। সরকার আমাদের জন্য চকচকে বইয়ের ব্যবস্থা করে। আমার সাথী না সবুজ সাথী ছিল সেই বইয়ের নাম। সেই বই বুকে চেপে আমরা আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করি। আমাদের আর ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ গাইতে হয় না।

আমরা এখন গাই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। গানটা গাওয়ার সময় আমাদের চোখে কখনো কখনো পানি চলে আসত, এখনো মাঝে মধ্যে গানটা গাওয়ার সময় চোখে পানি চলে আসে। কেনো আসে? এই বাংলাকে ভালোবাসতে গিয়ে আমাদেরকে অনেক দাম দিতে হয়েছে বলে? (সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি

আহমেদ ফরিদের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার নূরপুর গ্রামে। মাতা রূপবানু, পিতা নূর উদ্দীন আহমেদ। লেখাপড়া নূরপুর লাহাজুড়া প্রাইমারি স্কুল, গোকর্ন এস ডব্লিউ হাই স্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে। পুত্র ফাইয়াজ নূর মিশু, নাফিস নূর মুগ্ধ এবং স্ত্রী ফারহানা আহমেদ শীলাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন।

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

ধারাবাহিক রচনা : শেষ পর্ব

এক অখ্যাত কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ

আহমেদ ফরিদ

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

(পূর্ব প্রকাশের পর)

১৭.

আমি বিজয় দেখেছি

সেদিনের সন্ধ্যাটা কি অন্যান্য সন্ধ্যার চেয়ে অন্য রকম ছিল? ক্যামন করে বুঝব অন্যরকম ছিল? আর দশটা সন্ধ্যার মতই ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ঠাসা। আসলে কী হচ্ছে দেশে। মুক্তি বাহিনী কি পেরে উঠবে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে? পারবে বোধ হয়। ইন্ডিয়া নাকি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। স্বীকৃতি জিনিসটা কী তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বাবা বললেন ইন্ডিয়ান আর্মিরা আমাদের পক্ষে এবার নামবে। পাকিস্তানের যেমন পাঞ্জাবি সৈন্য আছে ইন্ডিয়ারও তেমনি পাঞ্জাবি সৈন্য আছে। ইন্ডিয়ান পাঞ্জাাবি সৈন্যগুলো নাকি আরো সরস। যুদ্ধে নাকি আমরা জিতে যাবো। আমরা একথা বিশ্বাস করি।

ডিসেম্বরের সূর্য আমাদের বাঁশঝাড়ের আগায় কিছুক্ষণ লটকে থেকে ডুবে গিয়েছে। খৈলাধুলা সেরে পুকুরের ঘাটলায় হাত-পা ধুয়ে গায়ে গরম একটা কিছু চাপিয়েছি। কুপি বাতিগুলো মৃদু আলো জালিয়ে আমাদের পাড়ার সকল গৃহকোণের আঁধার দূরিভূত করার একটা নিস্ফল চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমন সময় পুরো গ্রাম কেঁপে উঠে গোলাগুলির আওয়াজে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই। আবারো কি পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে এসেছে? কিছুই ঠাহর করতে পারি না। আবারো কি আমাদেরকে পালাতে হবে? কিন্তু শব্দগুলো এতো কাছে কেনো? আমাদের উঠোন থেকে উত্তর পুব দিকে তাকিয়ে দেখি মুক্তোছন কাকাদের উঠান থেকে গুলির আওয়াজ আর তার সাথে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। কিছু ছেলেমেয়ে হৈ হল্লা করছে। তা হলে কি পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের পাড়াতে চলে এসেছে?

‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে’। আব্বা ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে নেমে বলল। গুলি ফোটাচ্ছে মুক্তিরা। আমি আব্বার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। কথা নেই বার্তা নেই আগাম কোনো খবর নেই দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে! আমি সাহসে ভর করে একপা দুপা করে কাকাদের উঠানের দিকে পা বাড়াই। সেখানে গিয়ে দেখি আলো আঁধারিতে অনেক মানুষ। এদের মধ্যে একজনের হাতে বন্দুক। সে মনের আনন্দে গুলি করে যাচ্ছে আকাশের তারা তাক করে। নিচে একদল অর্ধ উলঙ্গ ছেলে মেয়ে মনের আনন্দে গুলির খোসা কুড়াচ্ছে। আমি ধাক্কা মেরে দুয়েকজনকে সরিয়ে গুলির খোসা কুড়াতে চেষ্টা করি। গুলি ফোটাচ্ছে আমাদের মিঠু মামা। সে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। একবার চেষ্টা করে বর্ডার থেকে ফিরে এসেছিল বলে শুনেছি। সে বন্ধুক পেলো কোথায়?

চারিদিক থেকে অবিরত গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। কান পাতা দায়।

অতঃপর আমরা বিভিন্ন বাড়িতে যাই। অবাক বিস্ময়ে কাদির চাচা, খালেদ ভাই, মিনু ভাই, শাহাবুদ্দিন ভাই জালাল ভাই এদেরকে দেখি। এদের প্রত্যেকের হাতেই অস্ত্র আর এ অস্ত্র থেকেই অবিরাম গুলি বের চ্ছে। এঁরা এতোদিন কোথায় ছিলেন?। এঁরা যুদ্ধে গিয়েছিল জানি কিন্তু এরা যে গ্রামে আছে তাতো জানতাম না। তাঁদের বন্ধুক, স্টেন গান থেকে গুলি বের হচ্ছে দেদারসে। গুলির সাথে আগুনের ফুলকি। ঝাঁকে ঝাঁকে আকাশের অজানা গস্তব্যে চলছে সে গুলি। গুলির খোসা ঝর ঝর করে মাঠিতে পড়ছে। আর আমরা মনের আনন্দে কুড়াচ্ছি সে গুলির খোসা। আমাদে মুঠো ভরে উঠে গুলির খোসাতে। আমরা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি, কে বেশি খোসা কুড়াতে পারে। মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে গুলি ফোটাতে থাকে। এত গুলি কেথায় ছিল এতোদিন আমি ভেবে পাই না। এশা নামাজের আগ পর্যন্ত থেমে থেমে চলল গুলির আওয়াজ। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে পায়ে ঘুরছি বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি। দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গিয়েছে? পাকিস্তানি বাহিনী আতœসমর্পণ করেছে। আহা! স্বাধীন দেশ। আমাদের আর কোনো ভয় নেই। আমাদেরকে আর কেউ মেরে ফেলতে পারবে না গুলি করে। আমাদেরকে আর আমাদের বাড়ি ছেড়ে রাতের আঁধারে পালাতে হবে না। আমাদের অন্য কোনো মালতি দিদিকে আর কেউ অত্যাচার করে মেরে ফেলতে পারবে না। আমরা বুক চিতিয়ে এখন থেকে রাস্তা ঘাটে চলাচল করতে পারব। আমরা আমাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে পারব।

মুক্তিযোদ্ধদের দেখতে আমাদের বড়ই ভালো লাগে। তাঁরা আমাদেরই ভাই, চাচা। আমারা সারাক্ষণ তাঁদের পিছু পিছু ঘুরি। তাদের বন্ধুকটা, স্টেনগানটা একটু নেড়েচেড়ে দেখি আমরা। ভয় লাগে, যদি গুলিটুলি বের হয়ে যায়। এরকম একটা ঘটনা যে পাশের গ্রামে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। বন্দুক চালাতে অজ্ঞ এক অতি উৎসাহী বন্দুক হাতে নিয়ে- দেই গুলি, দেই গুলি বলে এক মহিলাকে ভয় দেখাতে থাকে। মহিলাটি তাঁর ঠাট্টা সম্পর্কীয় কেউ ছিলেন নিশ্চয়ই। আনাড়ি লোকটি দেই গুলি, দেই গুলি, করতে করতে ট্রিগারে চাপ মারলে বন্দুকের নল দিয়ে গুলি বের হয়ে মহিলাটির কণ্ঠনালী ভেদ করে গুলিটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সাথে সাথেই মহিলাটি মারা যায়। আমরা খুব সতর্কতার সাথে বন্দুক আর স্টেনগান নাড়াচাড়া করি।

আমাদের চেয়ে বড়দের উৎসাহ আর উদ্দীপনা এব্যাপারে অনেক বেশি। এরা যে কোনো কারণেই হোক যুদ্ধে যেত পারেননি। বন্দুক হাতে পেয়ে তাদের হাত নিশপিশ করতে থেকে। এলোপাতাড়ি কয়েক জায়গায় এরা গুলিও চালিয়েছে কুকুর বিড়ালের ওপর। রাস্তা দিয়ে এক কুকুর হাঁটছিল। হাতের টিপ পরীক্ষা করার জন্য একজন কুকুরটিকে লক্ষ করে বন্দুক চালালো। বদ নসিব কুকুরটির। তার নিশানা ব্যর্থ হলো না। রাস্তার উপর লুটিয় পড়ল কুকুরটি। প্রচণ্ড জোরে কুকুরটি চিৎকার করছিল। আমাদের আনন্দ ধ্বনিতে কুকুরটির আর্তনাদ চাপা পড়ে যায়। কুকুরটির মালিক কে ছিল আমার মনে নেই। মালিক নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়ে ছিলেন। কিন্তু মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদ করেননি। আমরা স্বাধীন হয়ে গিয়েছি! আমরা যা খুশি করতে পারব? নিরীহ কুকুর মারতে পারব? বিড়াল মারতে পারব? ইচ্ছে করলে খেলার ছলে মানুষের দিকে বন্ধুক তাক করে ভয় দেখাতে পারব? ভুলে সে বন্ধুকের নল দিয়ে গুলি বের হয়ে মানুষ মারা গেলে আমার কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবে না?

আমাদের গ্রামে কোনো রাজাকার ছিল না। আমাদের পাশের গ্রাম ফুলপুরেও কোনো রাজাকার ছিল না। এজন্য আমরা খুব গর্ববোধ করতাম। নাসিরনগরের কয়েকটি গ্রাম ব্যতীত সব গ্রামই ছিল রাজাকার মুক্ত। থানা সদরের পাশে একটা গ্রামে ছিল কিছু রাজাকার। একদিন তাদেরকে ধরে আনা হলো। এরা অতি সাধারণ মানুষ। গরিব শ্রেণির বলেই মনে হলো। আসলে এরা কোনো রাজনৈতিক কারণে রাজাকারগিরি করতে যায়নি। সামান্য কিছু প্রাপ্তির আশায় কিংবা মুসলিম লীগের নেতাদের কথায়ই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। তাদেরকে সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। কী সাজা দেয়া হলো তাদেরক? গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে এদেরকে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছিল আর তওবা পড়ানো হয়েছিল যাতে ভবষ্যিতে এরা আর দেশের বিরোধিতা না করে। আর কিছু চড় লাথিও তাদের ভাগ্যে জুটেছিল। তাদের ভাগ্য খুবই ভালো। অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে।

দেশ স্বাভাবিক হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ছাত্র, কেউ কৃষক কেউ বা চাকরজীবী। তারা এখন স্ব স্ব পেশায় ফেরত যাবেন। তাঁদের কাছে অস্ত্র রয়ে গেছে। কী হবে সে অস্ত্রের? এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র ফেরত দিতে নির্দেশ দিলেন। একটা দিন ঠিক হলো। সেদিন আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতে যাবে। আমাদের মাঝে সাজ সাজ রব। আমরাও তাঁদের সাথে যাবো। তাঁরা আমাদেরকে নেবে না। না নেয়ার কারণ হলো আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই, আর আমরা ছোট। আমাদের মন খুবই খারাপ হলো। আমরা বেজার মুখে তাদের পিছু পিছু যাই। তাঁদের মনে কিছুটা দয়ার সঞ্চার হয়। তাঁরা আমাদেরকে অস্ত্রগুলো বহন করতে দেয়। আমি খুব খুশি হই আর গৌরব বোধ করি। আমার ভাগে পড়ে একটা স্টেনগান। আমার পিঠে স্টেনগানটা কেউ একজন ঝুলিয়ে দেয়। আমি মহাবিক্রমে স্টেনগানটা পিঠে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। গৌরবে আমার পা যেনা মাঠিতে পড়ে না। যেনা আমি হাওয়ায় ভেসে উড়ে চলেছি। সেই পরম আনন্দটুকু বেশিক্ষণ আমাদের ভাগ্যে সইল না। গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আমাদেরকে অস্ত্রগুলো বহন করতে দেয়া হলো। তারপর আমাদেরকে বাড়ি ফিরতে নির্দেশ দিলেন তাঁরা। আমরা তাঁদের নির্দেশ মতো বাড়ির পথ ধরলাম। আমাদের

পিঠে তখনো যেনা ধাতব অস্ত্রগুলোর একটা ছোঁয়া লেগেছিল। সেই ছোঁয়াটুকু কি এখনো টের পাই? পাই মনে হয়। আর তখনই নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়। নিজেকে আমি প্রশ্ন করি আমি কি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম? মাঝে মাঝে মনে হয় ছিলামই তো।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জনযুদ্ধ। কিছু লোক বাদে দেশের সাধারণ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল। এক অর্থে সে সময় দেশের প্রায় সব মানুষই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। যাঁরা সম্মুখ ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা তো আলাদাই, তাঁরা আমাদের গর্ব, জাতীয় বীর।

যুদ্ধ তো শেষ। সবকিছু আবার ঠিক মতো চালাতে হবে, চলতে হবে। অনেকদিন স্কুলে যাইনি আমরা। সম্ভবত এপ্রিল থেকেই আমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বইগুলো মাথার উপর তাকে রাখা ছিল। সেগুলি আর খোলা হয়নি। এবার স্কুলে যেত হবে। বইগুলি খুললাম। বইগুলি থেকে কীরকম একটা গন্ধ বের হচ্ছে। সোঁদা গন্ধ। চৈত্র বৈশাখ মাসে প্রথম বৃষ্টি হলে মাটি থেকে যেরকম একটা গন্ধ বের হয়ে সেরকম আর কি। আমি বইগুলিকে বুকের সাথে চেপে ধরে সেই সোঁদা গন্ধ নিতে থাকি।

আমাদের শিক্ষা জীবন থেকে এক বছর ঝরে পড়ে। আমরা কি তৃতীয় শ্রেণিতে উঠব না কি দ্বিতীয় শ্রেণিতেই থেকে যাবো এরকম একটা বিষয় চলে আসে সামনে। যাদের অভিভাবক অতিসচেতন তারা স্বয়ংক্রিয় পাস নিয়ে উপরের ক্লাসে চলে যায়। আমরা রয়ে যাই একই ক্লাসে। আমাদের অভিভাবক আর শিক্ষকদের অভিমত হলো- বিনা পড়াশোনা আর পরীক্ষা ছাড়া উপরের ক্লাসে উঠা ঠিক হবে না। পড়াশোনায় পাকাপোক্ত হয়েই উপরের ক্লাসে উঠা উচিৎ। আমি পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য ক্লাস টুতেই রয়ে যাই। অবশ্য অটোপাসের সুযোগটা খুব বেশি সংখ্যক ছাত্র কাজে লাগিয়েছিল এমনটা বলা যাবে না। সরকার আমাদের জন্য চকচকে বইয়ের ব্যবস্থা করে। আমার সাথী না সবুজ সাথী ছিল সেই বইয়ের নাম। সেই বই বুকে চেপে আমরা আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করি। আমাদের আর ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ গাইতে হয় না।

আমরা এখন গাই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। গানটা গাওয়ার সময় আমাদের চোখে কখনো কখনো পানি চলে আসত, এখনো মাঝে মধ্যে গানটা গাওয়ার সময় চোখে পানি চলে আসে। কেনো আসে? এই বাংলাকে ভালোবাসতে গিয়ে আমাদেরকে অনেক দাম দিতে হয়েছে বলে? (সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি

আহমেদ ফরিদের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার নূরপুর গ্রামে। মাতা রূপবানু, পিতা নূর উদ্দীন আহমেদ। লেখাপড়া নূরপুর লাহাজুড়া প্রাইমারি স্কুল, গোকর্ন এস ডব্লিউ হাই স্কুল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে। পুত্র ফাইয়াজ নূর মিশু, নাফিস নূর মুগ্ধ এবং স্ত্রী ফারহানা আহমেদ শীলাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন।