সিজোফ্রেনিক রাখালবালিকায় কবিতার নতুন নন্দন

রিসতিয়াক আহেমদ

কবি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। কেননা, কবির বিপ্লব ভাষার সাথে। প্রতিনিয়ত তিনি সংগ্রাম করে যান শব্দের প্রচলিত অর্থের সাথে। বাক্যের প্রচলিত বিন্যাসের সাথে। তিনি ভাষার প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙ্গেচুরে নতুন ভাষা সৃষ্টি করেন। তাই শব্দ অক্ষর এক থাকলেও পাঠক হৃদয়ে কবি সৃষ্টি করেন ভিন্ন আবেদন। সৃষ্টি হয় নতুন উপমা, নতুন প্রতীক, নতুন ব্যঞ্জনা।

কবি মাহফুজ আল-হোসেন তাঁর ‘সিজেফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ’ কাব্যগ্রন্থে শব্দের প্রচলিত অর্থকে নতুন বিন্যাসে পাঠকহৃদয়ে ভিন্ন আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছেন। আর তাই ‘আমি ও সে’ কবিতায় কবিতা হয়ে ওঠে কবির প্রেমিকা। কাব্যলক্ষ্মীর অভিমানে তিনি হন কাতর। চলে খুনসুটি। আর ‘হায় কবিতা’য় বলেন- ‘হায় কবিতা- তুমি কি আজীবনের এক মস্ত ভুল/ নাকি এক ভোরের সৌরভ বিলানো শিউলি ফুল’।

রবীন্দ্রনাথের গীতলতাকে গ্রহণ করেও জীবনানন্দ যেখানে স্বতন্ত্র। মাহফুজ আল-হোসেনের ‘আটাশ বছর ধরে একটা আটপৌরে সুতি শাড়ি পরে’ তেমনি ব্যতিক্রম সংযোজন। কবি প্রেমিকাকে একটি স্থির বয়সে অবলোকন করতে থাকেন। বলেন- অথচ ঘর মোছার কাজে বহু ব্যবহারে/ জীর্ণবিশীর্ণ বিবর্ণ ছেঁড়া ন্যাকড়া হয়ে/ মহার্ঘ শাড়িটি অ্যাদ্দিনে হয়তো ফেলেই দিয়েছো।’ কবিতাটিকে আপাত প্রেমের কবিতা মনে হলেও আরও গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করা যায় ‘বনলতা সেন’-এর মতো এখানে রয়েছে মানবসমাজের ইতিহাস। গ্রামের শহুরে হওয়ার ইতিহাস। মধ্যবিত্ত সাধারণ জীবনের ইতিহাস।

প্রতিনিয়ত কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিকগণ জীবনানন্দকে বিনির্মাণ করে চলেছেন নিজেদের সৃষ্টিশীলতায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন’ কবিতার শিরোনাম জীবনানন্দ থেকে গ্রহণ করা সত্ত্বেও এখানে জীবনানন্দকে বিনির্মাণ করা হয়নি। বরং জীবনানন্দ থেকে বহুদূর সরে গেছে। এখানে দুই পৃথিবীর রঙ যে মায়া নদীতে এসে মিশে একাকার সেখানে কবি ভাষা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন এক ভাষাতীত জগৎ।

কবিকে বেহিসাবি হলে হয় না। একজন প্রকৌশলীর মতোই তাকে সব হিসাব কষে সৃষ্টি করতে হয় নতুন ভাষা। আর এই হিসাব করেই কবি ‘বেহিসাবি উৎপ্রেক্ষার/ অত্যাশ্চর্য স্বপ্নসৌধ চূড়ায় উঠে’। করেন দেহ ছেড়ে ‘দেহাতীত কবিতাস্নান’।

রাজনীতি চলে সবখানে। এমনকি ভাষার পাণ্ডিত্যে। যখন সে পাণ্ডিত্য কর্তৃত্ববাদী। কিন্তু কবি কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাসী নন। কবি অবলীলায় গ্রহণ করেন সকল শব্দকে। আর তাই কবির ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দগুলো আর আরবের থাকে না। কিংবা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের। তিনি শুধু শব্দটুকু ব্যবহার করেন। অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় আবহমান বাংলা। ‘জবাব-এ খোদাবন্দ’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

‘মুসার মতো চেয়ো না গো দিদার

সুরমা হয়ে যাবে এক নিমেষেই

সাক্ষী ঐ জাবালে তুর

তোমার নিঃসঙ্গতা ঘুচাতে

সৃজন করেছি আমি কুল মাখলুকাত’

কবি কখনো দলভুক্ত রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। কিন্তু তিনি প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এবং তা অতীত ও বর্তমানে।

‘হাত পা চোখ সব বাঁধা চৌদ্দই ডিসেম্বরে

জলমগ্ন রায়েরবাজারের চিরমগ্নতায়

... ... ...

রবী-লালনের চারণভূমিতে নির্বাক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে

জনকের আক্রান্ত ভাষ্কর্য- খুবলে খাওয়া প্রস্তরিত মুখমণ্ডল

আর স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে ডাক দেয়া বিধ্বস্ত হাত’

কবির সংগ্রাম যেহতু প্রচলিত অর্থকে ভেঙ্গে দেয়া। তাই শীতের প্রচলিত প্রতিকল্প মৃত্যু নিয়ে তাঁর প্রশ্ন। জীবন অভিজ্ঞতাহীন জাদুবস্তবতায় তাঁর প্রশ্ন। প্রেমহীন, ব্যক্তিত্বহীন ভালোবাসায় তাঁর প্রশ্ন।

বাস্তুসংস্থানের মতো আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি ব্যবসা। সেখানে আবেগও একটি পণ্য? অন্ত্যজ শ্রেণির সংগ্রাম, প্রেম, ভালোবাসাকে পুঁজি করে আমরা কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের স্বনামখ্যাত তৈরি করি। পৃথিবীর এই বিশাল ইহজাগতিক রঙ্গমঞ্চে করি অভিনয়। আর এই সিস্টেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কবি বলেন-

‘টুপটাপ শিশির-বৃষ্টিতে প্রায় জবুথবু অশীতিপর আয়েশা বেওয়া

অগ্নিমান্দ্য খালি পেটে গনগনে আগুন তাপাচ্ছে সারারাত মহানন্দে

তার মানচিত্র-সদৃশ কোঁকড়ানো চামড়ার ওই অগ্নিভ উদ্ভাসিত অবয়ব

হয়তো আগামী দিনের প্রেরণা হতে চলেছে

কোনো উদীয়মান আলোকচিত্রীর পরম আরাধ্য শিল্পসুকৃতির।’

আপাত স্বাভাবিক অবস্থার ভেতর কবি খুঁজে পান প্রকৃত অস্বাভাবিকতাকে। বর্তমানের অস্বস্তি, অস্থিরতার ভেতর দিয়ে তিনি দেখতে পান সময়ের চিরাচরিত প্রবাহমানকে। আর তাই তাঁর লেখা নির্দিষ্ট সময়ের স্লোগানে রূপান্তর হয় না। সৃষ্টি হয় ক্লাসিক শিল্প। করোনা মহামারীর উপলব্ধি করোনায় সীমাবদ্ধ নয়। উঠে আসে চিরায়ত মারীর ইতিহাস। সম্পর্কের ভাঁজের ইতিহাস। প্রিয়জন হারানোর ইতিহাস। পরস্পর বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস। কবির ভেতর হাহাকার- আর কতো!

কবির প্রেম নয় কোনো সাধারণ। কবির প্রেমিকা কোনো সাধারণ নারী নয়। তিনি সাধারণ নারীকে নিয়ে যান অসাধারণলোকে। প্রেমিকা হয়ে যান একটি আদর্শ, একটি দর্শন, একটি বিশ্বাস, একটি স্বপ্ন। তিনি ‘সুহাসিনীর অলোকস্পর্শী শুভদৃষ্টি’-তে খুঁজে পান সকল সমাধান।

কবি কল্পলোকের বিশালতায় ঘর থেকে বের হয়ে বিশ্বভ্রমণে যান। মানবসভ্যতার সকল ইতিহাসে পরিভ্রমণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘সুলোচনা- ছোট ছোট লোকমায় তোমার দেয়া দুঃখের মহার্ঘ / সঞ্চয়গুলোই আমাকে প্রতিনিয়ত / বেজোস, বাফেট গেটসের চাইতেও ঐশ্বর্যশালী করে চলেছে;’

কবি মাহফুজ আল-হোসেনের এই ‘সিজেফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ’ কাব্যগ্রন্থে দুটো অংশ দেখা যায়। দ্বিতীয় অংশে রয়েছ ‘সিজোফ্রেনিক পদাবলি’ নামের সিরিজে ২৬টি কবিতা। যেখানে সিজেফ্রেনিক কবিতা লেখা সত্ত্বেও তিনি সিজোফ্রেনিক সাহিত্যের প্রচলনকেই ভেঙ্গে দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন একটি নতুন ধারা। এমনিতেই সিজোফ্রেনিক সাহিত্য বাংলাসাহিত্যে বিরল। তার উপর নতুন সংযোজন। তাই কবিতাগুলো গ্রহণের জন্য পাঠকের সময়ের প্রয়োজন। কবিতাগুলো আপাত পাঠে মনে হতেই পারে স্ববিরোধ কিংবা পাগলের প্রলাপ। কিন্তু গভীর পাঠে দেখা যায় এর বহুমাত্রিকতা। একটি ভাবের উপরেই একাধিক দিক থেকে ফোকাস করা হয়েছে। এবং তাদের ভেতর বিচ্ছিন্নতা নয়, রয়েছে একটি সুগভীর দৃঢ় সম্পর্ক। ইউরোপের সৃষ্ট সিজোফ্রেনিক ফরমেটেই কবি মাহফুজ আল-হোসেন যেন সিজোফ্রেনিক কবিতা লিখে একটি ওভার ট্রাম্প করলেন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন ইউরোপীয় সাহিত্যকে। নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে এটি একটি নতুন সংযোজন। কয়েকটি সিজোফ্রেনিক পদাবলি উল্লেখ করা আবশ্যকীয়।

১. রবির সভায় ইন্দ্রের আগমন

নাথও শেষাবধি ঠাকুর ঘরে

একটু দেখিই না

কলা খায় কি-না

(সিজোফ্রেনিক পদাবলি: তিন)

২. রূপসী বাংলায় কতোটা জীবন

আর কতটাই বা আনন্দ

তা বোঝার জন্য

ট্রামের নিচে চাপা পড়াটা ভীষণ জরুরি

(সিজোফ্রেনিক পদাবলি: চার)

৩. মনে হয় একটু বেশিই ধরেছ

আচ্ছা ধরে নাও সব দারিদ্র্যই একরঙা ছিট কাপড়ের থান

ছিটগ্রস্ত হলেও হিসেব কিন্তু ঠিকঠাক

আর দেখার কিই বা দরকার- হিসেবকে কখন আর কেনইবা কষছে

যে কষে কষুক কিন্তু কষা মাংসের কোনটা উপরি আর কোনটাইবা কাঠামো

আরে বোকা উপরিই তো এখন সব কাঠামোকে ঢেকেঢুকে রাখছে

খদ্দেরের জন্য যখন বেশরম- তবে কেন এতো ঢাক ঢাক গুড় গুড়

এক মুট গুড়ের মধ্যে এক চিমটে লবণ দিলেই কিন্তু সব গোমর ফাঁস

অসুবিধা কোথায় ফাঁসকৃত প্রশ্ন যতই হোক জটিল

কিংবা পরীক্ষা না দিলেও তো নিশ্চিত পাস

(সিজোফ্রেনিক পদাবলি: বিশ)

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

সিজোফ্রেনিক রাখালবালিকায় কবিতার নতুন নন্দন

রিসতিয়াক আহেমদ

image

কবি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী। কেননা, কবির বিপ্লব ভাষার সাথে। প্রতিনিয়ত তিনি সংগ্রাম করে যান শব্দের প্রচলিত অর্থের সাথে। বাক্যের প্রচলিত বিন্যাসের সাথে। তিনি ভাষার প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙ্গেচুরে নতুন ভাষা সৃষ্টি করেন। তাই শব্দ অক্ষর এক থাকলেও পাঠক হৃদয়ে কবি সৃষ্টি করেন ভিন্ন আবেদন। সৃষ্টি হয় নতুন উপমা, নতুন প্রতীক, নতুন ব্যঞ্জনা।

কবি মাহফুজ আল-হোসেন তাঁর ‘সিজেফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ’ কাব্যগ্রন্থে শব্দের প্রচলিত অর্থকে নতুন বিন্যাসে পাঠকহৃদয়ে ভিন্ন আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছেন। আর তাই ‘আমি ও সে’ কবিতায় কবিতা হয়ে ওঠে কবির প্রেমিকা। কাব্যলক্ষ্মীর অভিমানে তিনি হন কাতর। চলে খুনসুটি। আর ‘হায় কবিতা’য় বলেন- ‘হায় কবিতা- তুমি কি আজীবনের এক মস্ত ভুল/ নাকি এক ভোরের সৌরভ বিলানো শিউলি ফুল’।

রবীন্দ্রনাথের গীতলতাকে গ্রহণ করেও জীবনানন্দ যেখানে স্বতন্ত্র। মাহফুজ আল-হোসেনের ‘আটাশ বছর ধরে একটা আটপৌরে সুতি শাড়ি পরে’ তেমনি ব্যতিক্রম সংযোজন। কবি প্রেমিকাকে একটি স্থির বয়সে অবলোকন করতে থাকেন। বলেন- অথচ ঘর মোছার কাজে বহু ব্যবহারে/ জীর্ণবিশীর্ণ বিবর্ণ ছেঁড়া ন্যাকড়া হয়ে/ মহার্ঘ শাড়িটি অ্যাদ্দিনে হয়তো ফেলেই দিয়েছো।’ কবিতাটিকে আপাত প্রেমের কবিতা মনে হলেও আরও গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করা যায় ‘বনলতা সেন’-এর মতো এখানে রয়েছে মানবসমাজের ইতিহাস। গ্রামের শহুরে হওয়ার ইতিহাস। মধ্যবিত্ত সাধারণ জীবনের ইতিহাস।

প্রতিনিয়ত কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিকগণ জীবনানন্দকে বিনির্মাণ করে চলেছেন নিজেদের সৃষ্টিশীলতায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন’ কবিতার শিরোনাম জীবনানন্দ থেকে গ্রহণ করা সত্ত্বেও এখানে জীবনানন্দকে বিনির্মাণ করা হয়নি। বরং জীবনানন্দ থেকে বহুদূর সরে গেছে। এখানে দুই পৃথিবীর রঙ যে মায়া নদীতে এসে মিশে একাকার সেখানে কবি ভাষা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন এক ভাষাতীত জগৎ।

কবিকে বেহিসাবি হলে হয় না। একজন প্রকৌশলীর মতোই তাকে সব হিসাব কষে সৃষ্টি করতে হয় নতুন ভাষা। আর এই হিসাব করেই কবি ‘বেহিসাবি উৎপ্রেক্ষার/ অত্যাশ্চর্য স্বপ্নসৌধ চূড়ায় উঠে’। করেন দেহ ছেড়ে ‘দেহাতীত কবিতাস্নান’।

রাজনীতি চলে সবখানে। এমনকি ভাষার পাণ্ডিত্যে। যখন সে পাণ্ডিত্য কর্তৃত্ববাদী। কিন্তু কবি কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাসী নন। কবি অবলীলায় গ্রহণ করেন সকল শব্দকে। আর তাই কবির ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দগুলো আর আরবের থাকে না। কিংবা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের। তিনি শুধু শব্দটুকু ব্যবহার করেন। অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় আবহমান বাংলা। ‘জবাব-এ খোদাবন্দ’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

‘মুসার মতো চেয়ো না গো দিদার

সুরমা হয়ে যাবে এক নিমেষেই

সাক্ষী ঐ জাবালে তুর

তোমার নিঃসঙ্গতা ঘুচাতে

সৃজন করেছি আমি কুল মাখলুকাত’

কবি কখনো দলভুক্ত রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন। কিন্তু তিনি প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এবং তা অতীত ও বর্তমানে।

‘হাত পা চোখ সব বাঁধা চৌদ্দই ডিসেম্বরে

জলমগ্ন রায়েরবাজারের চিরমগ্নতায়

... ... ...

রবী-লালনের চারণভূমিতে নির্বাক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে

জনকের আক্রান্ত ভাষ্কর্য- খুবলে খাওয়া প্রস্তরিত মুখমণ্ডল

আর স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে ডাক দেয়া বিধ্বস্ত হাত’

কবির সংগ্রাম যেহতু প্রচলিত অর্থকে ভেঙ্গে দেয়া। তাই শীতের প্রচলিত প্রতিকল্প মৃত্যু নিয়ে তাঁর প্রশ্ন। জীবন অভিজ্ঞতাহীন জাদুবস্তবতায় তাঁর প্রশ্ন। প্রেমহীন, ব্যক্তিত্বহীন ভালোবাসায় তাঁর প্রশ্ন।

বাস্তুসংস্থানের মতো আমরা প্রতিনিয়ত করে চলেছি ব্যবসা। সেখানে আবেগও একটি পণ্য? অন্ত্যজ শ্রেণির সংগ্রাম, প্রেম, ভালোবাসাকে পুঁজি করে আমরা কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের স্বনামখ্যাত তৈরি করি। পৃথিবীর এই বিশাল ইহজাগতিক রঙ্গমঞ্চে করি অভিনয়। আর এই সিস্টেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কবি বলেন-

‘টুপটাপ শিশির-বৃষ্টিতে প্রায় জবুথবু অশীতিপর আয়েশা বেওয়া

অগ্নিমান্দ্য খালি পেটে গনগনে আগুন তাপাচ্ছে সারারাত মহানন্দে

তার মানচিত্র-সদৃশ কোঁকড়ানো চামড়ার ওই অগ্নিভ উদ্ভাসিত অবয়ব

হয়তো আগামী দিনের প্রেরণা হতে চলেছে

কোনো উদীয়মান আলোকচিত্রীর পরম আরাধ্য শিল্পসুকৃতির।’

আপাত স্বাভাবিক অবস্থার ভেতর কবি খুঁজে পান প্রকৃত অস্বাভাবিকতাকে। বর্তমানের অস্বস্তি, অস্থিরতার ভেতর দিয়ে তিনি দেখতে পান সময়ের চিরাচরিত প্রবাহমানকে। আর তাই তাঁর লেখা নির্দিষ্ট সময়ের স্লোগানে রূপান্তর হয় না। সৃষ্টি হয় ক্লাসিক শিল্প। করোনা মহামারীর উপলব্ধি করোনায় সীমাবদ্ধ নয়। উঠে আসে চিরায়ত মারীর ইতিহাস। সম্পর্কের ভাঁজের ইতিহাস। প্রিয়জন হারানোর ইতিহাস। পরস্পর বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস। কবির ভেতর হাহাকার- আর কতো!

কবির প্রেম নয় কোনো সাধারণ। কবির প্রেমিকা কোনো সাধারণ নারী নয়। তিনি সাধারণ নারীকে নিয়ে যান অসাধারণলোকে। প্রেমিকা হয়ে যান একটি আদর্শ, একটি দর্শন, একটি বিশ্বাস, একটি স্বপ্ন। তিনি ‘সুহাসিনীর অলোকস্পর্শী শুভদৃষ্টি’-তে খুঁজে পান সকল সমাধান।

কবি কল্পলোকের বিশালতায় ঘর থেকে বের হয়ে বিশ্বভ্রমণে যান। মানবসভ্যতার সকল ইতিহাসে পরিভ্রমণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘সুলোচনা- ছোট ছোট লোকমায় তোমার দেয়া দুঃখের মহার্ঘ / সঞ্চয়গুলোই আমাকে প্রতিনিয়ত / বেজোস, বাফেট গেটসের চাইতেও ঐশ্বর্যশালী করে চলেছে;’

কবি মাহফুজ আল-হোসেনের এই ‘সিজেফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ’ কাব্যগ্রন্থে দুটো অংশ দেখা যায়। দ্বিতীয় অংশে রয়েছ ‘সিজোফ্রেনিক পদাবলি’ নামের সিরিজে ২৬টি কবিতা। যেখানে সিজেফ্রেনিক কবিতা লেখা সত্ত্বেও তিনি সিজোফ্রেনিক সাহিত্যের প্রচলনকেই ভেঙ্গে দিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন একটি নতুন ধারা। এমনিতেই সিজোফ্রেনিক সাহিত্য বাংলাসাহিত্যে বিরল। তার উপর নতুন সংযোজন। তাই কবিতাগুলো গ্রহণের জন্য পাঠকের সময়ের প্রয়োজন। কবিতাগুলো আপাত পাঠে মনে হতেই পারে স্ববিরোধ কিংবা পাগলের প্রলাপ। কিন্তু গভীর পাঠে দেখা যায় এর বহুমাত্রিকতা। একটি ভাবের উপরেই একাধিক দিক থেকে ফোকাস করা হয়েছে। এবং তাদের ভেতর বিচ্ছিন্নতা নয়, রয়েছে একটি সুগভীর দৃঢ় সম্পর্ক। ইউরোপের সৃষ্ট সিজোফ্রেনিক ফরমেটেই কবি মাহফুজ আল-হোসেন যেন সিজোফ্রেনিক কবিতা লিখে একটি ওভার ট্রাম্প করলেন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন ইউরোপীয় সাহিত্যকে। নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে এটি একটি নতুন সংযোজন। কয়েকটি সিজোফ্রেনিক পদাবলি উল্লেখ করা আবশ্যকীয়।

১. রবির সভায় ইন্দ্রের আগমন

নাথও শেষাবধি ঠাকুর ঘরে

একটু দেখিই না

কলা খায় কি-না

(সিজোফ্রেনিক পদাবলি: তিন)

২. রূপসী বাংলায় কতোটা জীবন

আর কতটাই বা আনন্দ

তা বোঝার জন্য

ট্রামের নিচে চাপা পড়াটা ভীষণ জরুরি

(সিজোফ্রেনিক পদাবলি: চার)

৩. মনে হয় একটু বেশিই ধরেছ

আচ্ছা ধরে নাও সব দারিদ্র্যই একরঙা ছিট কাপড়ের থান

ছিটগ্রস্ত হলেও হিসেব কিন্তু ঠিকঠাক

আর দেখার কিই বা দরকার- হিসেবকে কখন আর কেনইবা কষছে

যে কষে কষুক কিন্তু কষা মাংসের কোনটা উপরি আর কোনটাইবা কাঠামো

আরে বোকা উপরিই তো এখন সব কাঠামোকে ঢেকেঢুকে রাখছে

খদ্দেরের জন্য যখন বেশরম- তবে কেন এতো ঢাক ঢাক গুড় গুড়

এক মুট গুড়ের মধ্যে এক চিমটে লবণ দিলেই কিন্তু সব গোমর ফাঁস

অসুবিধা কোথায় ফাঁসকৃত প্রশ্ন যতই হোক জটিল

কিংবা পরীক্ষা না দিলেও তো নিশ্চিত পাস

(সিজোফ্রেনিক পদাবলি: বিশ)