জীবনযাত্রার ব্যয়, সাধারণের নাভিশ্বাস

জীবনযাত্রার ব্যয় যে বাড়ছে তা সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবই বলছে। সেই হিসাবে, গত বছরের মার্চে ২৭৭ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যেত, এই বছরের মার্চে সেই পরিমাণ পণ্য ও সেবা নিতে ব্যয় করতে হয়েছে ২৯২ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে একই পণ্য ও সেবা কিনতে ১৫ টাকা বেশি খরচ করতে হয়েছে। শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

ওই সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। গত বছরের মার্চে ৩০১ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ কিনতে এই বছরের মার্চে ব্যয় হয়েছে ৩১৮ টাকা। আলোচ্য সময়ে এতে বেশি ব্যয় হয়েছে ১৭ টাকা। শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

আবার পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্যই বলছে করোনার মধ্যে ব্যয় বাড়লেও সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং এই সংকটে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। আবার অনেকের বেতন গেছে কমে ।

আর এই পরিস্থিতিতে বড় বিপাকে পড়েছেন বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী রাজীব হাসান। যখন জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে তখন এই করোনার মধ্যে তার বেতন কমেছে ২৯ শতাংশ।

স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তান, রাজীবের চার জনের সংসার। করোনার আগে তিনি বেতন পেতেন ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া ও ৩ হাজার টাকা বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য বিল দিতেন। বাকি টাকায় খাবার এবং বাচ্চাদের পড়াশোনা। কোন সঞ্চয়ের সুযোগ ছিল না, তবে কোনমতে কেটে যেতো দিন।

এরপর করোনার আঘাতে তার বেতন কমে হলো ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু এখন খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। বাকি টাকা ঋণ করে চলছেন। তার বেতন আর বাড়বে কিনা, আর বাড়লেও কবে? জানেন না রাজীব। এখন খরচ কমানোর জন্য কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন। নয়তো পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে মেসে উঠবেন।

এর মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। আর ডিজেলের দাম, বাস ভাড়া বাড়ায় আরও বিপাকে রাজীব। কিভাবে দিন চালাবেন, তা বুঝতে পারছেন না। বলছেন- সংসার চালাতে এখন নাভিশ্বাস তার। সংবাদ-এর সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তার কণ্ঠে ছিল হতাশা, ক্ষোভ।

‘আমি কি বলবো তা বুঝতে পারছি না। কয়েক মাস ধরে ঋণ করছি। সেই ঋণের টাকায় সংসার চলছে; আর কতো? বেতন বাড়েনি এক টাকাও, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। আমরা খাব কি? সরকার ঘোষণা দিক যে, আমরা না খেয়ে মারা যাই, সেটাই ভালো হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৪০ লাখ। করোনার কারণে গত বছর চাকরি হারিয়েছেন ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সংখ্যায় বললে সেটি দাঁড়ায় ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ জন। হিসাবটি গত বছরের।

অনেক বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেরও করোনার মধ্যে কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। বিলস এবং আরও কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে ‘লেবার রিসোর্স অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার’ বলছে, করোনাকালে দেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দেশে দরিদ্রের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে।

এছাড়া করোনায় আয় কমে যাওয়ার কথা বলছে, ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক জরিপ। সেখানে বলা হয়েছে, করোনায় ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩৪ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। আর অনেককেই ঋণ করে সংসার চালাতে হয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় কমে গেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।

করোনা সংক্রমণের আগের দাম এবং গত শুক্রবারের নিত্যপণ্যের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের আগে অর্থাৎ ফেব্রয়ারিতে প্রায় সবগুলো নিত্যপণ্যের দাম বর্তমানের চেয়ে কম ছিল।

করোনার আগে মোটা চালের (পাইজাম) গড় দাম ছিল প্রতিকেজি ৪০ টাকা। গত দেড় বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকায়, শতাংশ হারে যা প্রায় ২৫ শতাংশ। প্রতিকেজি মশুর ডালের (দেশি) দাম করোনার আগে ছিল ১০০ টাকা। এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকা, শতাংশ হারে যা ১০ শতাংশ।

এভাবে ভোজ্য তেলের দামও বেড়েছে আকাশ ছোঁয়া। করোনার আগে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। অর্থাৎ তেলের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এটি বেড়েছে প্রায় ৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।

অন্যান্য নিত্যপণ্যের মধ্যে মুরগি, পেঁয়াজ, চিনির দামও অনেক বেড়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ টাকায়, শতাংশ হারে হয় ৫০ শতাংশ। চিনির দামও বেড়েছে প্রতিকেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত।

লাবনী আখতার, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলছিলেন ‘একটা হাফ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল কিনলাম ৮২ টাকা দিয়ে। একই বোতল আগে কিনতাম ৫০ টাকায়। মিনিকেট চাল কিনলাম ৬০ টাকা কেজি। আগে কিনেছিলাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। আমার বেতন খুব বেশি না। প্রতিদিনই যদি দাম বাড়ে, তাহলে কিভাবে চলবো?’

খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের মার্চে ২৪৬ টাকায় যে পরিমাণ খাবারের বাইরে অন্যান্য পণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ পণ্য কিনতে এ বছরের মার্চে ব্যয় করতে হয়েছে ২৫৯ টাকা। বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ১৩ টাকা।

এছাড়া গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবায় ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবায় ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে।

আর এ দফায় ডিজেলের দাম বাড়িয়ে বাস ভাড়া বাড়ানোয় এই ব্যয় আরও বেড়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরও কঠোর করার আহ্বান জানান। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সবাই চাই, অন্তত দুটো ডাল-ভাত খেয়ে যেন জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু দিন দিন যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে ডাল-ভাতও খাওয়া যাবে না। দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।’

এদিকে মুরগির দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড হয়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। অথচ আগে ছিল সেটি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। অর্থাৎ শতাংশ হারে বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। গরুর মাংশের দাম বেড়েছে ২০ টাকা। বর্তমানে প্রতিকেজি গরুর মাংশ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। ডিমও দাম বৃদ্ধির তালিকায় যোগ দিয়েছে। প্রতি ডজন ডিমের (লাল) দাম ৩০ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। শতাংশ হারে বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

তাছাড়া বর্তমানে প্রায় ৬ থেকে ৮টি সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার উপরে। অথচ এসব সবজি আগে পাওয়া যেত ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে।

সম্প্রতি বেড়েছে এলপি গ্যাস, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। এসব জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে আরেক দফা বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম।

করোনার আগে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা। গত পরশু তা বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ৮০ টাকা। বেড়েছে ২৩ শতাংশ। ১২ কেজির এলপি গ্যাসের দাম ছিল ১১০০ টাকা। কয়েক দফায় বেড়ে সেটি হয়েছে ১৩১৩ টাকা, যা প্রায় ২০ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে নিত্যপণের দামের যে পরিস্থিতি তাতে সরকার যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে শক্ত হাতে দমন করতে না পারে, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তবে সব পণ্যের দাম যে সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে, এমনটা নয়। অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারেও বেড়েছে। সেটা বাড়া স্বাভাবিক। অর্থনীতির একটা নিয়ম হলো, সাপ্লাই কমলে দাম বেড়ে যায়।

‘এখন এই সমস্যা দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমটি হলো, যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে, সেসব পণ্য সরকারকে বিক্রি করতে হবে ভোক্তাদের কাছে। আর দ্বিতীয় সমাধান হলো, যখন সংকট দেখা দেবে তখন পণ্য আমদানি করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, সবজির দাম বেড়েছে, কিন্তু সবজি আমরা বাইরে থেকে আমদানি করি না। আবার আমদানি করতে গেলে দেখা যাবে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম কমিয়ে দিল। তখন যারা আমদানি করলো, তারা বিপদে পড়বে। এমন নানামুখী সংকটে রয়েছে দেশের বাজার ব্যবস্থা।’

এসব সমস্যা থেকে বের হতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

জীবনযাত্রার ব্যয়, সাধারণের নাভিশ্বাস

রেজাউল করিম

image

জীবনযাত্রার ব্যয় যে বাড়ছে তা সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবই বলছে। সেই হিসাবে, গত বছরের মার্চে ২৭৭ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যেত, এই বছরের মার্চে সেই পরিমাণ পণ্য ও সেবা নিতে ব্যয় করতে হয়েছে ২৯২ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে একই পণ্য ও সেবা কিনতে ১৫ টাকা বেশি খরচ করতে হয়েছে। শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

ওই সময়ের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। গত বছরের মার্চে ৩০১ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ কিনতে এই বছরের মার্চে ব্যয় হয়েছে ৩১৮ টাকা। আলোচ্য সময়ে এতে বেশি ব্যয় হয়েছে ১৭ টাকা। শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

আবার পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্যই বলছে করোনার মধ্যে ব্যয় বাড়লেও সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং এই সংকটে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। আবার অনেকের বেতন গেছে কমে ।

আর এই পরিস্থিতিতে বড় বিপাকে পড়েছেন বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী রাজীব হাসান। যখন জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে তখন এই করোনার মধ্যে তার বেতন কমেছে ২৯ শতাংশ।

স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তান, রাজীবের চার জনের সংসার। করোনার আগে তিনি বেতন পেতেন ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া ও ৩ হাজার টাকা বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য বিল দিতেন। বাকি টাকায় খাবার এবং বাচ্চাদের পড়াশোনা। কোন সঞ্চয়ের সুযোগ ছিল না, তবে কোনমতে কেটে যেতো দিন।

এরপর করোনার আঘাতে তার বেতন কমে হলো ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু এখন খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। বাকি টাকা ঋণ করে চলছেন। তার বেতন আর বাড়বে কিনা, আর বাড়লেও কবে? জানেন না রাজীব। এখন খরচ কমানোর জন্য কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন। নয়তো পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে মেসে উঠবেন।

এর মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়েছে। আর ডিজেলের দাম, বাস ভাড়া বাড়ায় আরও বিপাকে রাজীব। কিভাবে দিন চালাবেন, তা বুঝতে পারছেন না। বলছেন- সংসার চালাতে এখন নাভিশ্বাস তার। সংবাদ-এর সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তার কণ্ঠে ছিল হতাশা, ক্ষোভ।

‘আমি কি বলবো তা বুঝতে পারছি না। কয়েক মাস ধরে ঋণ করছি। সেই ঋণের টাকায় সংসার চলছে; আর কতো? বেতন বাড়েনি এক টাকাও, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। আমরা খাব কি? সরকার ঘোষণা দিক যে, আমরা না খেয়ে মারা যাই, সেটাই ভালো হবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মোট শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৪০ লাখ। করোনার কারণে গত বছর চাকরি হারিয়েছেন ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সংখ্যায় বললে সেটি দাঁড়ায় ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ জন। হিসাবটি গত বছরের।

অনেক বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেরও করোনার মধ্যে কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। বিলস এবং আরও কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে ‘লেবার রিসোর্স অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার’ বলছে, করোনাকালে দেশে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। দেশে দরিদ্রের সংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে।

এছাড়া করোনায় আয় কমে যাওয়ার কথা বলছে, ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক জরিপ। সেখানে বলা হয়েছে, করোনায় ৭৭ শতাংশ পরিবারে গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩৪ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। আর অনেককেই ঋণ করে সংসার চালাতে হয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের জরিপে বলা হয়েছে, করোনার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয় কমে গেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।

করোনা সংক্রমণের আগের দাম এবং গত শুক্রবারের নিত্যপণ্যের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের আগে অর্থাৎ ফেব্রয়ারিতে প্রায় সবগুলো নিত্যপণ্যের দাম বর্তমানের চেয়ে কম ছিল।

করোনার আগে মোটা চালের (পাইজাম) গড় দাম ছিল প্রতিকেজি ৪০ টাকা। গত দেড় বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকায়, শতাংশ হারে যা প্রায় ২৫ শতাংশ। প্রতিকেজি মশুর ডালের (দেশি) দাম করোনার আগে ছিল ১০০ টাকা। এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকা, শতাংশ হারে যা ১০ শতাংশ।

এভাবে ভোজ্য তেলের দামও বেড়েছে আকাশ ছোঁয়া। করোনার আগে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। অর্থাৎ তেলের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এটি বেড়েছে প্রায় ৮৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।

অন্যান্য নিত্যপণ্যের মধ্যে মুরগি, পেঁয়াজ, চিনির দামও অনেক বেড়েছে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ টাকায়, শতাংশ হারে হয় ৫০ শতাংশ। চিনির দামও বেড়েছে প্রতিকেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত।

লাবনী আখতার, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলছিলেন ‘একটা হাফ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল কিনলাম ৮২ টাকা দিয়ে। একই বোতল আগে কিনতাম ৫০ টাকায়। মিনিকেট চাল কিনলাম ৬০ টাকা কেজি। আগে কিনেছিলাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। আমার বেতন খুব বেশি না। প্রতিদিনই যদি দাম বাড়ে, তাহলে কিভাবে চলবো?’

খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে। বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের মার্চে ২৪৬ টাকায় যে পরিমাণ খাবারের বাইরে অন্যান্য পণ্য পাওয়া যেত, একই পরিমাণ পণ্য কিনতে এ বছরের মার্চে ব্যয় করতে হয়েছে ২৫৯ টাকা। বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ১৩ টাকা।

এছাড়া গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবায় ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবায় ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে।

আর এ দফায় ডিজেলের দাম বাড়িয়ে বাস ভাড়া বাড়ানোয় এই ব্যয় আরও বেড়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরও কঠোর করার আহ্বান জানান। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সবাই চাই, অন্তত দুটো ডাল-ভাত খেয়ে যেন জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু দিন দিন যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে ডাল-ভাতও খাওয়া যাবে না। দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।’

এদিকে মুরগির দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড হয়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা। অথচ আগে ছিল সেটি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। অর্থাৎ শতাংশ হারে বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। গরুর মাংশের দাম বেড়েছে ২০ টাকা। বর্তমানে প্রতিকেজি গরুর মাংশ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। ডিমও দাম বৃদ্ধির তালিকায় যোগ দিয়েছে। প্রতি ডজন ডিমের (লাল) দাম ৩০ টাকা বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। শতাংশ হারে বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

তাছাড়া বর্তমানে প্রায় ৬ থেকে ৮টি সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার উপরে। অথচ এসব সবজি আগে পাওয়া যেত ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজিতে।

সম্প্রতি বেড়েছে এলপি গ্যাস, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম। এসব জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে আরেক দফা বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম।

করোনার আগে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ছিল ৬৫ টাকা। গত পরশু তা বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ৮০ টাকা। বেড়েছে ২৩ শতাংশ। ১২ কেজির এলপি গ্যাসের দাম ছিল ১১০০ টাকা। কয়েক দফায় বেড়ে সেটি হয়েছে ১৩১৩ টাকা, যা প্রায় ২০ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বর্তমানে নিত্যপণের দামের যে পরিস্থিতি তাতে সরকার যদি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে শক্ত হাতে দমন করতে না পারে, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তবে সব পণ্যের দাম যে সিন্ডিকেটের কারণে বেড়েছে, এমনটা নয়। অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারেও বেড়েছে। সেটা বাড়া স্বাভাবিক। অর্থনীতির একটা নিয়ম হলো, সাপ্লাই কমলে দাম বেড়ে যায়।

‘এখন এই সমস্যা দুইভাবে সমাধান করা যায়। প্রথমটি হলো, যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে, সেসব পণ্য সরকারকে বিক্রি করতে হবে ভোক্তাদের কাছে। আর দ্বিতীয় সমাধান হলো, যখন সংকট দেখা দেবে তখন পণ্য আমদানি করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, সবজির দাম বেড়েছে, কিন্তু সবজি আমরা বাইরে থেকে আমদানি করি না। আবার আমদানি করতে গেলে দেখা যাবে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম কমিয়ে দিল। তখন যারা আমদানি করলো, তারা বিপদে পড়বে। এমন নানামুখী সংকটে রয়েছে দেশের বাজার ব্যবস্থা।’

এসব সমস্যা থেকে বের হতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।