শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে সারাদেশে এক নিয়ম, যশোরে ভিন্ন!

যশোরের তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সারাদেশে এক নিয়মে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ হলেও শুধুমাত্র যশোরের তিনটি স্কুলে তা মানা হয়নি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কৃষিশিক্ষা শিক্ষকদের ‘সিনিয়রিটি’ দেয়ায় অন্য শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে ‘বঞ্চিত’ শিক্ষকরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে জানা যায়, যশোরের তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়- যশোর জিলা স্কুল, যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মণিরামপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট ৫ জন কৃষিশিক্ষা শিক্ষক রয়েছেন। ‘নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে’ এই পাঁচজনকে জ্যেষ্ঠতা দেয়ায় ২২ জন শিক্ষকের প্রতি ‘অন্যায়’ করা হয়েছে বলে অভিযোগকারীদের দাবি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১৯৯৫ সালে ৩৭৮ জন কৃষিশিক্ষা বিষয়ক শিক্ষককে নিয়োগ হয়। টেকনিক্যাল শিক্ষক হিসেবে তারা ১৪তম বেতন স্কেলে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। আর সরকারি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণ ১০ম বেতন গ্রেডে যোগদান করে থাকেন। কৃষিশিক্ষার এই ৩৭৮ জন শিক্ষককে ২০০৪ সালের ১৪ জুন ১৪তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। ৯৫ সালে যোগদান করলেও ২০০৪ সালে ১০ম গ্রেড পাওয়ায় কৃষি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে পরবর্তীতে জটিলতা দেখা দেয়।

এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ ‘জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সংক্রান্ত’ এক অনুশাসন জারি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৪-০৬-২০০৪ খ্রি. তারিখের ৬৫৯ নং স্মারকের অফিস আদেশে ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি)-এর বেতন স্কেল ১৪নং গ্রেডে উন্নীত করা হয়, যা ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখ হতে কার্যকর করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখের ১০ম গ্রেডভুক্ত সহকারী শিক্ষক-সহকারী শিক্ষিকাদের নিচে উল্লিখিত ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি)-এর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি)-এর জ্যেষ্ঠতা ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখ হতে গণনা করা হবে।’

ওই অনুশাসনের আলোকে ১৬ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একটি অফিস আদেশ জারি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি প্রদানের লক্ষ্যে ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখের পূর্বে ১০ম গ্রেডভুক্ত সহকারী শিক্ষক-সহকারী শিক্ষিকাদের নিচে উল্লিখিত ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি) এর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা হালনাগাদ করে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

কৃষি শিক্ষকগণ ১৯৯৫ সাল থেকে জ্যেষ্ঠতা দাবি করে ওই অনুশাসনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত তাদের সেই মামলা খারিজ করে দেন। এরপর তারা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

বঞ্চিত শিক্ষকদের অভিযোগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই অনুশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশের পর সারাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সে অনুযায়ী কৃষিশিক্ষা শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে দেন। শুধুমাত্র যশোরের তিনটি সরকারি বিদ্যালয় ওই নির্দেশনা মানেনি। যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ১৩ জন শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কৃষি’র দুই শিক্ষককে সিনিয়রিটি প্রদান করা হয়ছে। যশোর জিলা স্কুলে ৮ জন শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দু’জন শিক্ষককে সিনিয়রিটি প্রদান করা হয়েছে। আর মণিরামপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে কৃষি শিক্ষককে সিনিয়রিটি দিয়ে একজন শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

যশোর জিলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান জানান, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের অফিস অর্ডার হয়েছে; গেজেট হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেটি’র লঙ্ঘন হচ্ছে। কাগজপত্র দেখলে যে কেউ সেটি বুঝতে পারবেন। কিন্তু কেন হচ্ছে এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না।

যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক কাজী শায়লা নার্গীস শাওন জানান, কৃষিশিক্ষকগণ ৯৫ সালে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। তারা সহকারী শিক্ষক হয়েছেন ২০০৪ সালে। আমরা সহকারী শিক্ষক হিসেবেই ২০০২ সালে যোগদান করেছি। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির গেজেটেও আমাদের সিনিয়রিটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্কুলে এটি মানা হচ্ছে না।

যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আরেক সিনিয়র শিক্ষক মো. শফিউদ্দিন জানান, স্কুল থেকে যখন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরে কোন কাগজপত্র প্রেরণ করা হচ্ছে তখন আমাদের সিনিয়র দেখানো হচ্ছে। কিন্তু স্কুলের নোটিস, হাজিরা খাতাসহ অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় কাগজপত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কৃষিশিক্ষা শিক্ষকদের সিনিয়রিটি দেয়া হচ্ছে। যশোরেই শুধু এই সমস্যা বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করেও সুরাহা হয়নি।

যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষিশিক্ষার সিনিয়র শিক্ষক গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, কৃষি শিক্ষকগণ ১৯৯৫ সালে যোগদান করেছেন। মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক ভুলের কারণে তাদের সহকারী শিক্ষক পদায়ন নিয়ে জটিলতা হয়েছে। ২০০৪ সালে মন্ত্রণালয় সেটি সংশোধন করেছে। কিন্তু এরপর মন্ত্রণালয় নতুন নির্দেশনা দেয়ায় এর বিরুদ্ধে আমরা আদালতে গিয়েছি। উচ্চ আদালত সেটি খারিজ করে দিলেও পরবর্তীতে আপিলের পর্যায়ে রয়েছে। আর রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ আছে, ওই ক্রমিক নম্বর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে প্রযোজ্য হবে না।

এ প্রসঙ্গে যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) লায়লা শিরীন সুলতানা বলেন, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছি। নির্দেশনা এলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে যে সিনিয়রিটি অনুযায়ী চলছিল তাই বহাল আছে। তিনি দাবি করেন, শুধু সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ই নয়; অনেক স্কুলেই সিনিয়রিটি নিয়ে এই সমস্যা আছে।

যশোর জিলা স্কুল ও যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, জ্যেষ্ঠতা নিয়ে বিরোধে যদি স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হয়, তাহলে প্রশাসন হস্তক্ষেপ করবে। সিনিয়রিটি নিয়ে সমস্যা থাকলে অভিযোগের ভিত্তিতে সেটি অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় নিরসন করবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুশাসন অনুযায়ী পরিষ্কার যে কৃষি শিক্ষকগণ ২০০৪ সালের ২২ মে থেকে জ্যেষ্ঠতা পাবেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে কৃষিশিক্ষকগণ আদালতে গেলেও তাদের মামলা খারিজ হয়ে গেছে। ফলে এ নিয়ে নতুন করে আদেশ দেয়ার কিছু নেই। যে স্কুলে এই জ্যেষ্ঠতা বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অদক্ষতা। তিনি অন্য শিক্ষকদের প্রতি অন্যায় আচরণ করছেন। যশোর ছাড়া সারাদেশের অন্যকোথাও জ্যেষ্ঠতা নিয়ে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ঢাকার সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, জ্যেষ্ঠতা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা রয়েছে। মাওশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পিএসসি জ্যেষ্ঠতার এই বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে। একই নিয়ম বহাল রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অফিস আদেশও দিয়েছে। ফলে ওই বিধি মেনেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করতে হবে। যদি আদালত বা মন্ত্রণালয় অন্যকোন আদেশ জারি করে তাহলে এই বিধি পরিবর্তিত হতে পারে; তার আগে এটি লঙ্ঘনের সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাওশি) দপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক এ এস এম আবদুল খালেক বলেন, জ্যেষ্ঠতা নিয়ে কোন কোন স্কুলে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এটির নিরসন করা হবে।

আরও খবর
ফরাসি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
ঢাকায় শুরু প্রযুক্তি খাতের বিশ্ব সম্মেলন ‘ডব্লিউসিআইটি ২০২১’
পাসপোর্ট আবেদনকারীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে টাকা নিচ্ছিল প্রতারক চক্র
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাক-সিএনজি সংঘর্ষ নিহত ৫
১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি মন্ত্রণালয় ও পিবিআই
প্রশ্নফাঁসে জড়িত ৫ জন গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামে দুর্নীতি মামলায় পুলিশের এসআই কারাগারে
হয়রানির প্রতিবাদে দেশ-বিদেশে জনমত গঠনের সিদ্ধান্ত বিএনপির
ভর্তি পরীক্ষার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল
নূর হোসেন দিবস পালিত
গুচ্ছ ভর্তি ফি বাতিলসহ ৩ দফা দাবি ছাত্র সংগঠনের

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

তিন সরকারি স্কুলে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ

শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে সারাদেশে এক নিয়ম, যশোরে ভিন্ন!

যশোর অফিস

যশোরের তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সারাদেশে এক নিয়মে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ হলেও শুধুমাত্র যশোরের তিনটি স্কুলে তা মানা হয়নি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কৃষিশিক্ষা শিক্ষকদের ‘সিনিয়রিটি’ দেয়ায় অন্য শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে ‘বঞ্চিত’ শিক্ষকরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে জানা যায়, যশোরের তিনটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়- যশোর জিলা স্কুল, যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও মণিরামপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট ৫ জন কৃষিশিক্ষা শিক্ষক রয়েছেন। ‘নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে’ এই পাঁচজনকে জ্যেষ্ঠতা দেয়ায় ২২ জন শিক্ষকের প্রতি ‘অন্যায়’ করা হয়েছে বলে অভিযোগকারীদের দাবি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১৯৯৫ সালে ৩৭৮ জন কৃষিশিক্ষা বিষয়ক শিক্ষককে নিয়োগ হয়। টেকনিক্যাল শিক্ষক হিসেবে তারা ১৪তম বেতন স্কেলে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। আর সরকারি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকগণ ১০ম বেতন গ্রেডে যোগদান করে থাকেন। কৃষিশিক্ষার এই ৩৭৮ জন শিক্ষককে ২০০৪ সালের ১৪ জুন ১৪তম গ্রেড থেকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। ৯৫ সালে যোগদান করলেও ২০০৪ সালে ১০ম গ্রেড পাওয়ায় কৃষি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে পরবর্তীতে জটিলতা দেখা দেয়।

এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ ‘জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ সংক্রান্ত’ এক অনুশাসন জারি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৪-০৬-২০০৪ খ্রি. তারিখের ৬৫৯ নং স্মারকের অফিস আদেশে ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি)-এর বেতন স্কেল ১৪নং গ্রেডে উন্নীত করা হয়, যা ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখ হতে কার্যকর করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখের ১০ম গ্রেডভুক্ত সহকারী শিক্ষক-সহকারী শিক্ষিকাদের নিচে উল্লিখিত ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি)-এর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি)-এর জ্যেষ্ঠতা ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখ হতে গণনা করা হবে।’

ওই অনুশাসনের আলোকে ১৬ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও একটি অফিস আদেশ জারি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি প্রদানের লক্ষ্যে ২২-০৫-২০০৪ খ্রি. তারিখের পূর্বে ১০ম গ্রেডভুক্ত সহকারী শিক্ষক-সহকারী শিক্ষিকাদের নিচে উল্লিখিত ৩৭৮ জন সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা (কৃষি) এর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা হালনাগাদ করে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

কৃষি শিক্ষকগণ ১৯৯৫ সাল থেকে জ্যেষ্ঠতা দাবি করে ওই অনুশাসনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু আদালত তাদের সেই মামলা খারিজ করে দেন। এরপর তারা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

বঞ্চিত শিক্ষকদের অভিযোগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই অনুশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশের পর সারাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সে অনুযায়ী কৃষিশিক্ষা শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে দেন। শুধুমাত্র যশোরের তিনটি সরকারি বিদ্যালয় ওই নির্দেশনা মানেনি। যশোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ১৩ জন শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কৃষি’র দুই শিক্ষককে সিনিয়রিটি প্রদান করা হয়ছে। যশোর জিলা স্কুলে ৮ জন শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে দু’জন শিক্ষককে সিনিয়রিটি প্রদান করা হয়েছে। আর মণিরামপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে কৃষি শিক্ষককে সিনিয়রিটি দিয়ে একজন শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

যশোর জিলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান জানান, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের অফিস অর্ডার হয়েছে; গেজেট হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেটি’র লঙ্ঘন হচ্ছে। কাগজপত্র দেখলে যে কেউ সেটি বুঝতে পারবেন। কিন্তু কেন হচ্ছে এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না।

যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক কাজী শায়লা নার্গীস শাওন জানান, কৃষিশিক্ষকগণ ৯৫ সালে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। তারা সহকারী শিক্ষক হয়েছেন ২০০৪ সালে। আমরা সহকারী শিক্ষক হিসেবেই ২০০২ সালে যোগদান করেছি। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির গেজেটেও আমাদের সিনিয়রিটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্কুলে এটি মানা হচ্ছে না।

যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আরেক সিনিয়র শিক্ষক মো. শফিউদ্দিন জানান, স্কুল থেকে যখন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরে কোন কাগজপত্র প্রেরণ করা হচ্ছে তখন আমাদের সিনিয়র দেখানো হচ্ছে। কিন্তু স্কুলের নোটিস, হাজিরা খাতাসহ অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় কাগজপত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে কৃষিশিক্ষা শিক্ষকদের সিনিয়রিটি দেয়া হচ্ছে। যশোরেই শুধু এই সমস্যা বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করেও সুরাহা হয়নি।

যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষিশিক্ষার সিনিয়র শিক্ষক গোলাম মোস্তফা দাবি করেন, কৃষি শিক্ষকগণ ১৯৯৫ সালে যোগদান করেছেন। মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক ভুলের কারণে তাদের সহকারী শিক্ষক পদায়ন নিয়ে জটিলতা হয়েছে। ২০০৪ সালে মন্ত্রণালয় সেটি সংশোধন করেছে। কিন্তু এরপর মন্ত্রণালয় নতুন নির্দেশনা দেয়ায় এর বিরুদ্ধে আমরা আদালতে গিয়েছি। উচ্চ আদালত সেটি খারিজ করে দিলেও পরবর্তীতে আপিলের পর্যায়ে রয়েছে। আর রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ আছে, ওই ক্রমিক নম্বর জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে প্রযোজ্য হবে না।

এ প্রসঙ্গে যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) লায়লা শিরীন সুলতানা বলেন, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছি। নির্দেশনা এলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে যে সিনিয়রিটি অনুযায়ী চলছিল তাই বহাল আছে। তিনি দাবি করেন, শুধু সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ই নয়; অনেক স্কুলেই সিনিয়রিটি নিয়ে এই সমস্যা আছে।

যশোর জিলা স্কুল ও যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান বলেন, জ্যেষ্ঠতা নিয়ে বিরোধে যদি স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হয়, তাহলে প্রশাসন হস্তক্ষেপ করবে। সিনিয়রিটি নিয়ে সমস্যা থাকলে অভিযোগের ভিত্তিতে সেটি অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় নিরসন করবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুশাসন অনুযায়ী পরিষ্কার যে কৃষি শিক্ষকগণ ২০০৪ সালের ২২ মে থেকে জ্যেষ্ঠতা পাবেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে কৃষিশিক্ষকগণ আদালতে গেলেও তাদের মামলা খারিজ হয়ে গেছে। ফলে এ নিয়ে নতুন করে আদেশ দেয়ার কিছু নেই। যে স্কুলে এই জ্যেষ্ঠতা বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অদক্ষতা। তিনি অন্য শিক্ষকদের প্রতি অন্যায় আচরণ করছেন। যশোর ছাড়া সারাদেশের অন্যকোথাও জ্যেষ্ঠতা নিয়ে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ঢাকার সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, জ্যেষ্ঠতা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা রয়েছে। মাওশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পিএসসি জ্যেষ্ঠতার এই বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে। একই নিয়ম বহাল রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অফিস আদেশও দিয়েছে। ফলে ওই বিধি মেনেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করতে হবে। যদি আদালত বা মন্ত্রণালয় অন্যকোন আদেশ জারি করে তাহলে এই বিধি পরিবর্তিত হতে পারে; তার আগে এটি লঙ্ঘনের সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাওশি) দপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালক এ এস এম আবদুল খালেক বলেন, জ্যেষ্ঠতা নিয়ে কোন কোন স্কুলে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এটির নিরসন করা হবে।