১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি মন্ত্রণালয় ও পিবিআই

তবু বিভাগীয় মামলা চলমান

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পৃথক তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেনি। তবে ‘১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্প’র সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও মাউশির এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (ডিপি) চলছে। শিক্ষা প্রশাসনের এই ধরনের কর্মকা-ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের চার বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও অগ্রগতি মাত্র ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘১০ স্কুল প্রকল্পে’ দুর্নীতির অভিযোগটি বিব্রতকর। কারণ, এখানে দুর্নীতি হয়নি, টাকাও ছাড় হয়নি। প্রকল্পভুক্ত একটি স্কুলের ভূমি অধিগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল একটি প্রভাবশালী মহল। এদের কারণেই জটিলতায় পড়ে প্রকল্পটি।

‘ঢাকা শহরের সন্নিকটে ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এ হিসাবে প্রকল্পের মেয়াদ আছে মাত্র আটমাস। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ৬৭৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বর্তমানে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা বিষয়ে গত ২৮ অক্টোবর মাউশি মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

গত ৮ নভেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রকল্পের মোট ব্যয় হয়েছে ৬৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাত্র ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

১০ স্কুল প্রকল্পের পিডি ড. মীর জাহীদা নাজনীন জানিয়েছেন, প্রকল্পের ১০টি জমির মধ্যে চারটির অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, যার একটি জমি (পূর্বাচল, নারায়ণগঞ্জ) এখনও বুঝে পাওয়া যায়নি। বাকি ৬টি স্কুলের জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এছাড়া ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পের ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ নিয়েও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) সঙ্গে মাউশির দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। কারণ, ইইডির প্রস্তুত করা অবকাঠামো স্থাপনের ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’র ওপর আস্থা রাখতে পারছে না মাউশি। তারা ইইডির তৈরি ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ পিডব্লিউডির মাধ্যমে ‘ভেটিং’ (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করাতে চাচ্ছে। কিন্তু, ইইডি বলছে, তাদের ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ পরামর্শক ফার্ম বা পিডব্লিউডির মাধ্যমে ‘ভেটিং’য়ের কোন সুযোগ নেই।

প্রকল্পের আর্থিক ব্যয় ও ভূমি অধিগ্রহণ শুরুর আগেই বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ আমিনকে সভাপতি করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কিন্তু, তদন্ত কমিটি দুর্নীতির কোন প্রমাণ পায়নি। এরপরও প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. আমিরুল ইসলামকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এবং মাউশির সহকারী পরিচালক দিল আফরোজ বিনতে আছিরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় মামলা চলমান রেখেছে মন্ত্রণালয়ের একটি প্রভাবশালী পক্ষ।

গত ৩০ জুন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ‘১০ স্কুল প্রকল্পে’ কোন দুর্নীতি হয়নি। দুর্নীতির কোন সুযোগও ছিল না। ভূমি অধিগ্রহণ ও গাছ-পালা কর্তনে যদি কারও দুর্নীতির অভিপ্রায় থেকে থাকে, সে জন্য যারা প্রাক্কলন করেছেন, অর্থাৎ ডিসি অফিসের কর্মকর্তারা দায়ী।

এর আগে প্রকল্পের সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ এনে পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় মামলা করেন। গত ৩ নভেম্বর পিবিআই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে।

পিবিআই’র তদন্ত

পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলায় বাদী অভিযোগ করেছিলেন, মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অভিযুক্ত পাঁচজন কর্মকর্তা ঢাকার কাছে ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের প্রায় ৭৪৪ কোটি টাকার মধ্যে ৪৭৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল করে এবং প্রকল্পের ব্যয় ৬৭৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ১২৪ কোটি টাকা দেখিয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা একনেকে অনুমোদনের চেষ্টা করেছেন।

বাদী অভিযোগ করেন, সাবেক পিডি বাদীকে প্রকল্পে দুর্নীতিতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়ে চাপ প্রয়োগ এবং ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাদী যে ৪৭৮ কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল তৈরির কথা বলেছেন, তা আসলে বিল নয়, ব্যয়ের প্রাক্কলন। তাছাড়া রিভাইজড ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট প্রোপোজাল (আরডিপিপি) অনুমোদনের ফাইল মামলার বাদী আবদুর রাজ্জাক নিজেই অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন।

আরডিপিপি প্রস্তুত করে পিডি, মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং মাউশি মহাপরিচালক স্বাক্ষর করে তা অনুমোদনের জন্য শিক্ষাসচিব বরাবর পাঠান। কিন্তু, শিক্ষাসচিব আরডিপিপিতে স্বাক্ষর করেননি। পরবর্তীতে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় আরডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।

পিবিআইর সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগেই আরডিপিপি স্থগিত হয়ে যাওয়ায় দুর্নীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অর্থাৎ দুর্নীতি হয়নি। মাউশি অধিদপ্তরের চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য ব্যয় বাড়ানোর চেষ্টার অভিযোগেরও কোন সত্যতা পায়নি পিবিআই।

৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জমির মালিকের সঙ্গে গোপন চুক্তির অভিযোগ সম্পর্কে পিবিআই বলেছে, বাদী যে চুক্তির কপি দিয়েছেন, সেটি রেজিস্ট্রিকৃত নয়। ফলে এর আইনি ভিত্তিই নেই। বাদী আবদুর রাজ্জাক পেনাল কোডের ধারায় যে সব অভিযোগ এনেছেন তার কোনটির পক্ষেই দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পিডি ড. আমিরুল ইসলাম রাজ্জাককে দুই দফায় ২০ কোটি ও বিশ লাখ টাকা ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগের কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পায়নি পিবিআই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি মামলার বাদী, আমি এখনও রিপোর্ট পাইনি। আদালতে রিপোর্ট জমা হয়েছে, বিচারক দেখেননি, সিন (দেখা) হয়নি। অথচ এটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এই রিপোর্টে সঠিক তথ্য আসেনি। আমি এ বিষয়ে হাইকোর্টে যাব।’

প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে লালমাটিয়া কলেজের অধ্যক্ষের ব্যাখ্যা

গত ৪ নভেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘১০ স্কুল প্রকল্প নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বে থানায় অভিযোগ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের একাংশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১০ স্কুল প্রকল্প নিয়ে আবদুর রাজ্জাক যে মামলা করেছেন, সেখানে তার নাম নেই এবং ওই প্রকল্পের সঙ্গে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।

অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে অভিজ্ঞতা ভাতা নামে কোন ভাতা গ্রহণ করি না। আমাকে যতটুকু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমার পদায়নের আদেশের সঙ্গে মিল রেখেই কলেজ পরিচালনা পরিষদের সিন্ধান্তক্রমে দেয়া হচ্ছে। আমি কোন ডেভেলপার ব্যবসা বা অন্য কোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। এছাড়া কলেজটি সরকারিকরণের আগ মুহূর্তে একজন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়নি।’

লিখিত বক্তব্যে রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজ্জাক ‘বিবাহের’র তথ্য গোপান করে লালমাটিয়া কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। তার বিভাগের এক ছাত্রীকে বিয়ে করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তার লম্পট চরিত্র ফাঁস হয়ে গেলে তার বিবাহিত এ কলেজের ছাত্রী এবং তার পূর্বের স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং একপর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজ্জাককে সাময়িক বরখাস্ত করে। এছাড়া এ কলেজে চাকরি করাকালীন লালমাটিয়ার স্থানীয় লোকদের হাতে সে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয় এবং পরবর্তীতে থানা পুলিশের মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি হয়।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ। অধ্যক্ষের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার কারণেই এসব করা হচ্ছে। আমাকে কেউ লাঞ্ছিত করেনি। তারাই আমাকে বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেছে। ছাত্রজীবনে আমি বিয়ে করেছিলাম, সেই বিয়ে একদিনও টিকেনি। আইনিভাবেই এটি নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু, তারা ওই মেয়েটাকে ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।’

প্রতিবেদকের বক্তব্য

ওই প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নিজস্ব কোন মতামত ছিল না। আবদুর রাজ্জাক অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম সম্পর্কে কয়েকটি অভিযোগ করেন, যার রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

আরও খবর
ফরাসি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
ঢাকায় শুরু প্রযুক্তি খাতের বিশ্ব সম্মেলন ‘ডব্লিউসিআইটি ২০২১’
পাসপোর্ট আবেদনকারীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে টাকা নিচ্ছিল প্রতারক চক্র
শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে সারাদেশে এক নিয়ম, যশোরে ভিন্ন!
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাক-সিএনজি সংঘর্ষ নিহত ৫
প্রশ্নফাঁসে জড়িত ৫ জন গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামে দুর্নীতি মামলায় পুলিশের এসআই কারাগারে
হয়রানির প্রতিবাদে দেশ-বিদেশে জনমত গঠনের সিদ্ধান্ত বিএনপির
ভর্তি পরীক্ষার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল
নূর হোসেন দিবস পালিত
গুচ্ছ ভর্তি ফি বাতিলসহ ৩ দফা দাবি ছাত্র সংগঠনের

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি মন্ত্রণালয় ও পিবিআই

তবু বিভাগীয় মামলা চলমান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পৃথক তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেনি। তবে ‘১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্প’র সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও মাউশির এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (ডিপি) চলছে। শিক্ষা প্রশাসনের এই ধরনের কর্মকা-ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের চার বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও অগ্রগতি মাত্র ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘১০ স্কুল প্রকল্পে’ দুর্নীতির অভিযোগটি বিব্রতকর। কারণ, এখানে দুর্নীতি হয়নি, টাকাও ছাড় হয়নি। প্রকল্পভুক্ত একটি স্কুলের ভূমি অধিগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল একটি প্রভাবশালী মহল। এদের কারণেই জটিলতায় পড়ে প্রকল্পটি।

‘ঢাকা শহরের সন্নিকটে ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এ হিসাবে প্রকল্পের মেয়াদ আছে মাত্র আটমাস। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ৬৭৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীনে বর্তমানে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা বিষয়ে গত ২৮ অক্টোবর মাউশি মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

গত ৮ নভেম্বর ওই সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রকল্পের মোট ব্যয় হয়েছে ৬৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাত্র ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

১০ স্কুল প্রকল্পের পিডি ড. মীর জাহীদা নাজনীন জানিয়েছেন, প্রকল্পের ১০টি জমির মধ্যে চারটির অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, যার একটি জমি (পূর্বাচল, নারায়ণগঞ্জ) এখনও বুঝে পাওয়া যায়নি। বাকি ৬টি স্কুলের জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এছাড়া ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পের ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ নিয়েও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) সঙ্গে মাউশির দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। কারণ, ইইডির প্রস্তুত করা অবকাঠামো স্থাপনের ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’র ওপর আস্থা রাখতে পারছে না মাউশি। তারা ইইডির তৈরি ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ পিডব্লিউডির মাধ্যমে ‘ভেটিং’ (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করাতে চাচ্ছে। কিন্তু, ইইডি বলছে, তাদের ‘ড্রয়িং-ডিজাইন’ পরামর্শক ফার্ম বা পিডব্লিউডির মাধ্যমে ‘ভেটিং’য়ের কোন সুযোগ নেই।

প্রকল্পের আর্থিক ব্যয় ও ভূমি অধিগ্রহণ শুরুর আগেই বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ আমিনকে সভাপতি করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কিন্তু, তদন্ত কমিটি দুর্নীতির কোন প্রমাণ পায়নি। এরপরও প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ড. আমিরুল ইসলামকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এবং মাউশির সহকারী পরিচালক দিল আফরোজ বিনতে আছিরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় মামলা চলমান রেখেছে মন্ত্রণালয়ের একটি প্রভাবশালী পক্ষ।

গত ৩০ জুন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ‘১০ স্কুল প্রকল্পে’ কোন দুর্নীতি হয়নি। দুর্নীতির কোন সুযোগও ছিল না। ভূমি অধিগ্রহণ ও গাছ-পালা কর্তনে যদি কারও দুর্নীতির অভিপ্রায় থেকে থাকে, সে জন্য যারা প্রাক্কলন করেছেন, অর্থাৎ ডিসি অফিসের কর্মকর্তারা দায়ী।

এর আগে প্রকল্পের সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ অভিযোগ এনে পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় মামলা করেন। গত ৩ নভেম্বর পিবিআই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে।

পিবিআই’র তদন্ত

পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলায় বাদী অভিযোগ করেছিলেন, মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অভিযুক্ত পাঁচজন কর্মকর্তা ঢাকার কাছে ১০ স্কুল স্থাপন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের প্রায় ৭৪৪ কোটি টাকার মধ্যে ৪৭৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিল করে এবং প্রকল্পের ব্যয় ৬৭৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ১২৪ কোটি টাকা দেখিয়ে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা একনেকে অনুমোদনের চেষ্টা করেছেন।

বাদী অভিযোগ করেন, সাবেক পিডি বাদীকে প্রকল্পে দুর্নীতিতে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়ে চাপ প্রয়োগ এবং ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

এই অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাদী যে ৪৭৮ কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল তৈরির কথা বলেছেন, তা আসলে বিল নয়, ব্যয়ের প্রাক্কলন। তাছাড়া রিভাইজড ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট প্রোপোজাল (আরডিপিপি) অনুমোদনের ফাইল মামলার বাদী আবদুর রাজ্জাক নিজেই অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন।

আরডিপিপি প্রস্তুত করে পিডি, মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং মাউশি মহাপরিচালক স্বাক্ষর করে তা অনুমোদনের জন্য শিক্ষাসচিব বরাবর পাঠান। কিন্তু, শিক্ষাসচিব আরডিপিপিতে স্বাক্ষর করেননি। পরবর্তীতে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় আরডিপিপি অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।

পিবিআইর সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর আগেই আরডিপিপি স্থগিত হয়ে যাওয়ায় দুর্নীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অর্থাৎ দুর্নীতি হয়নি। মাউশি অধিদপ্তরের চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভূমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য ব্যয় বাড়ানোর চেষ্টার অভিযোগেরও কোন সত্যতা পায়নি পিবিআই।

৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জমির মালিকের সঙ্গে গোপন চুক্তির অভিযোগ সম্পর্কে পিবিআই বলেছে, বাদী যে চুক্তির কপি দিয়েছেন, সেটি রেজিস্ট্রিকৃত নয়। ফলে এর আইনি ভিত্তিই নেই। বাদী আবদুর রাজ্জাক পেনাল কোডের ধারায় যে সব অভিযোগ এনেছেন তার কোনটির পক্ষেই দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পিডি ড. আমিরুল ইসলাম রাজ্জাককে দুই দফায় ২০ কোটি ও বিশ লাখ টাকা ঘুষ দিতে চাওয়ার অভিযোগের কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পায়নি পিবিআই।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি মামলার বাদী, আমি এখনও রিপোর্ট পাইনি। আদালতে রিপোর্ট জমা হয়েছে, বিচারক দেখেননি, সিন (দেখা) হয়নি। অথচ এটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এই রিপোর্টে সঠিক তথ্য আসেনি। আমি এ বিষয়ে হাইকোর্টে যাব।’

প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে লালমাটিয়া কলেজের অধ্যক্ষের ব্যাখ্যা

গত ৪ নভেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘১০ স্কুল প্রকল্প নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বে থানায় অভিযোগ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের একাংশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১০ স্কুল প্রকল্প নিয়ে আবদুর রাজ্জাক যে মামলা করেছেন, সেখানে তার নাম নেই এবং ওই প্রকল্পের সঙ্গে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।

অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে অভিজ্ঞতা ভাতা নামে কোন ভাতা গ্রহণ করি না। আমাকে যতটুকু আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমার পদায়নের আদেশের সঙ্গে মিল রেখেই কলেজ পরিচালনা পরিষদের সিন্ধান্তক্রমে দেয়া হচ্ছে। আমি কোন ডেভেলপার ব্যবসা বা অন্য কোন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। এছাড়া কলেজটি সরকারিকরণের আগ মুহূর্তে একজন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়নি।’

লিখিত বক্তব্যে রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজ্জাক ‘বিবাহের’র তথ্য গোপান করে লালমাটিয়া কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। তার বিভাগের এক ছাত্রীকে বিয়ে করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তার লম্পট চরিত্র ফাঁস হয়ে গেলে তার বিবাহিত এ কলেজের ছাত্রী এবং তার পূর্বের স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং একপর্যায়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজ্জাককে সাময়িক বরখাস্ত করে। এছাড়া এ কলেজে চাকরি করাকালীন লালমাটিয়ার স্থানীয় লোকদের হাতে সে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয় এবং পরবর্তীতে থানা পুলিশের মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি হয়।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ। অধ্যক্ষের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার কারণেই এসব করা হচ্ছে। আমাকে কেউ লাঞ্ছিত করেনি। তারাই আমাকে বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেছে। ছাত্রজীবনে আমি বিয়ে করেছিলাম, সেই বিয়ে একদিনও টিকেনি। আইনিভাবেই এটি নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু, তারা ওই মেয়েটাকে ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।’

প্রতিবেদকের বক্তব্য

ওই প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নিজস্ব কোন মতামত ছিল না। আবদুর রাজ্জাক অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম সম্পর্কে কয়েকটি অভিযোগ করেন, যার রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।