এই প্রশ্ন করা যাবে না

মনজুরুল হক

জনসাধারণের মনে যে শঙ্কা আর সন্দেহ ছিল, তাই-ই হলো। অযোগ্য দুর্নীতিগ্রস্ত বিপিসির ‘লোকসান’ সমন্বয় করতে বিপিসি হুট করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১৫% বাড়িয়ে দিল। যদিও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো-কমানোর এক্তিয়ার একমাত্র জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের রেগুলেটরি কমিটির। বিপিসি বা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অথচ তারা রেগুলেটরি কমিটিকে না জানিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়াল। এটাই তো আইনত দ-নীয়! কে দেবে দ-? যে কোম্পানি ব্যবসা করে তার লাভ-লোকসান থাকবে, এবং তাকে তা মেনে নিতে হবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকার সময় বিপিসি যে ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে তার ভাগ কি জনগণের পকেটে এসেছে? না। তাহলে লোকসানের ভার কেন জনগণকে বইতে হবে?

বিশ্ববাজারের লাগাতার রেকর্ড কম দামের বিপরীতে তেলের দাম ততটা না কমিয়ে শেষ পাঁচ মাস বাদে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তখন দাম কমানোর দাবি উঠেছে বহুবার, কিন্তু বিপিসি বা সরকার কর্ণপাত করেনি। একপর্যায়ে বলেছে-‘আগের বছরগুলোতে বিপিসি কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে’, আর সরকারও বলেছে-‘বিপিসির লোকসান সমন্বয় হলে দাম কমানো হবে। ‘বিপিসির লাভ যখন লিটারপ্রতি ১৫-৪০ টাকা ছিল, তখন বহু সমালোচনার পর এপ্রিল ২০১৬ সালে মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছিল! এরপর ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ না পেয়ে কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা লোকসান দেখিয়ে এক ধাক্কায় ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করা হলো। সাত বছর ধরে গড়ে ২৩ শতাংশের বেশি লাভের বিপরীতে কমানো হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অথচ পাঁচ মাসের লোকসান দেখিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো কি গ্রহণযোগ্য হলো?

সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয়, তবে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট বা মূসক বাবদ আয়ও করে। লোকসানের হিসাবটা সরকার যেমন দেখায় তেমন সরল নয়। লিটারপ্রতি ডিজেলে ১১ টাকা ভ্যাটসহ অন্যান্য শুল্ক প্রায় ১৭ টাকার বেশি। এক্ষেত্রে সরকার জনগণের সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক করাদি কম করতে পারত। তাতে করে ভর্তুকি দেয়া লাগত না। কিন্তু এসব দিক বিবেচনায় আনেনি সরকার কিংবা বিপিসি।

এই প্রশ্নগুলো শনৈ শনৈ উন্নতি করা ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে করা যাবে না। করলেই মাননীয়দের ভাবমূর্তি চোট খাবে।

এরপর যেটা হলো তার সবই ‘পাতানো খেলা’! আইন উপেক্ষা করে (আইনে আছে যে কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট ডাকার ১৫ দিন আগে পোষকদের এবং সরকারকে জানাতে হবে। তারা সেসবের ধার ধারেনি। তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন মালিকপক্ষ অনৈতিকভাবে ধর্মঘট ডেকে বসল। তারা ‘সরকার আলোচনা না করে বাড়িয়েছে’ অজুহাত দেখালো। তারা যে আগাম ঘোষণা না দিয়ে ধর্মঘট ডাকল তার জবাবদিহিতা নেয়া হলো না। টানা তিন দিন ধর্মঘট করে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে, তাদের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা বাড়তি শুষে নিয়ে অবশেষে তারা ‘আমরা আমরাই তো’ দুপক্ষ আলোচনায় বসলেন, এবং মালিকপক্ষের অন্যায্য অনৈতিক দাবি মেনে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো অনুমোদন করে দিলেন। শেষে নিষ্ঠুর রসিকতার মতো বললেন-‘কেউ বেঁধে দেয়া ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’! কী সেই ‘কঠোর ব্যবস্থা’? কচু। সরকার জানেও না এই শহরে কত পার্সেন্ট বাস-মিনিবাস ডিজেলে চলে আর কত পার্সেন্ট সিএনজিতে চলে! ভাড়া বাড়ানোর কারণে এখন সিএনজিচালিত, ডিজেলচালিত সব যানবাহনই বেঁধে দেয়া ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করছে। তার কোন মনিটরিং নেই।

বাংলাদেশে এখন সরকারের ‘চোখে চোখ রেখে’ চ্যালেঞ্জ করতে পারে একটি ‘মাফিয়া গোষ্ঠী’-পরিবহন মালিক-শ্রমিক। এখন যে পেট্রোবাংলা বলছে মাসে ২০ কোটির বেশি লোকসান দিচ্ছে, সেটারও ভিত্তি নেই। দেখা যাবে সেই লোকসান হচ্ছে চুরি-ডাকাতি, সিস্টেম লস আর কর্মকর্তাদের বেশুমার ভোগ-বিলাসের কারণে। আরও একটি যুক্তি-‘ভারতে দাম বেশি, তাই ভারতে পাচার ঠেকাতে দাম বাড়ানো হয়েছে’। এটারও ভিত্তি নেই। পাচারই যদি হবে তাহলে বর্ডার গার্ডের মতো বিশাল বাহিনী রয়েছে কী করতে?

এইসব ‘মাফিয়া’ গোষ্ঠী চিকন সূতোর গিট্টু না মেরে যদি সোজাসাপ্টা বলত- “পেট্রোবাংলার লোকসান কমানোর জন্য বাহুল্য খরচ কমান। সিস্টেম লস বন্ধ করুন। দেশ তো এখন প্রায় উন্নত, তাহলে ভর্তুকি দিন, কিংবা কোনভাবেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো চলবে না।”

না। তারা তা বলবেন না। এখানে একটা বহুল প্রচলিত সূত্র আছে। মালিক সিন্ডিকেট ঈদের আগে কসাইদের মতো মাংসের দাম কেজি প্রতি ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেয়। তার পর সরকার রাগান্বিত হয়ে বলে ‘এ কিছুতেই মেনে নেয়া হবে না’। এরপর সরকার ৫০ টাকা অনুমোদন করে দেয়। কসাইরা আসলে যেটা চেয়েছিল। বিপিসি এবং পরিবহন মালিকগং ঠিক সেই কাজটি করেছে। এক ধরনের হ-য-ব-র-ল দশা সৃষ্টি করে ২৭-৩০% ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা আর ৭ টাকার বদলে ১০ টাকা ও ৭ টাকা করেছে। লঞ্চের ভাড়া ৬০% বাড়িয়ে নিয়ে ১০০% আদায় করছে। পুরো পরিবহন ব্যবস্থা এখন যে যার মতো মুনাফা তুলে নিচ্ছে। এতে করে দেশে উৎপাদিত সুঁই থেকে ট্রাক্টর পর্যন্ত উৎপাদন, পরিবহন ব্যয় বেড়ে সাধারণ জনণের চামড়া তুলে লবণ লাগানোর অবস্থায় চলে গেছে।

বিআরটিএ নির্ধারিত প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা ছিল। কেউ কি কখনও দেখেছেন, বাসে এই হারে ভাড়া নিতে? না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ঢাকার গুলিস্তান থেকে কুড়িল বিশ্বরোড ১২ কিলোমিটার। ভাড়া হয় ১.৭০ী১২ = ২০.৪০ টাকা। লক্কড়ঝক্কড় লোকাল বাসেও ভাড়া নেয়া হয় ৩০ টাকা। এসি বাসে ৬০ টাকা। এ রকম প্রত্যেকটা রুটেই দেড়গুণ ভাড়া নেয়া হয়। এবার ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামহিম ‘কত্তিপক্ক’ ৫০ পয়সা ভাড়া বাড়িয়ে নিতে বলেছে। মানে ২ টাকা ২০ পয়সা প্রতি কিলো। এরপর থেকেই থেকেই দেখা যাচ্ছে কোন বাস, পিকআপ, অটো সিএনজিচালিত নয়! সবই যেন ডিজেলে চলে! এমনকি বাইক নিএনজি অটোরিকশা ও বাইক রাইডারও ভাড়া বাড়িয়ে দেবে, কারণ হিসাবে বলবে-সবকিছুর দাম বেড়েছে। ইতোমধ্যে এককাপ চায়ের দামও বেড়েছে ওই একই অজুহাতে।

দেশের মোট জ্বালানির ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৩২ শতাংশ হচ্ছে তরল জ্বালানি। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশেহারা, তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে তখন জ্বালানির দাম বাড়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, কারণ, মূল্য বৃদ্ধির নতুন এক বিভীষিকাময় চক্র শুরু হয়েছে এতে। অথচ জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় একটা হারে বাড়ানোর সুযোগ ছিল। মহামারীর মন্দা অর্থনীতিকে সচল করতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নিয়ে বাজারে বাড়তি মুদ্রাপ্রবাহ করা হয়েছে, বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। সেক্ষেত্রে জ্বালানির দাম ৫ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির যুক্তি নেই।

ইতোমধ্যে ২৩ শতাংশের মতো অসহনীয় হারে দাম বাড়ানোয় জনজীবনে অসহনীয় চাপ শুরু হয়ে গেছে। পত্রিকায় শিরোনাম উঠেছে, ‘দামে দিশেহারা ক্রেতা’, ‘এখন সংসার চালানোই দায়’, ‘সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ’, ‘সবকিছুর দাম নাগালের বাইরে’! করোনার পর মানুষের আয়ের ক্রয়ক্ষমতা আরেক দফা কমে গেছে। দেশে এখন অলিখিত প্রায় দেড় কোটি মানুষ সরাসরি করোনায় বেকার কিংবা আধা বেকার। এ অবস্থায় সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধার কষ্টও শুরু হয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে যখন সরকারের কর্তব্য ছিল ভর্তুকি দিয়ে হলেও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করা, সেখানে জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের দাম সহনীয় হারে না বাড়িয়ে ‘অতি উচ্চহারে’র বাড়ানো অযৌক্তিক এবং অবশ্যই গণবিরোধী।

‘বাংলাদেশের প্রকৃত মালিক জনগণ’ সংবিধানের এই বাক্যটি এখন অসার প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকৃত মালিক তারাই যারা অনৈতিক অবৈধ ক্ষমতাবলে জনগণকে জিম্মি করে অনৈতকি অবৈধ সুবিধা আদায় করতে পারে। এই অনৈতিক অবৈধ সুবিধা কোন কোন গোষ্ঠী এবং শ্রেণী আদায় করে, করছে এবং করবেও সেটা সবাই জানে। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারছে না। করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত মানুষের পিঠ-পেট একাকার হয়ে আছে। তাদের হয়ে কথা বলার মতো শক্তিশালী কেউ নেই বলে তাদের সর্বস্বান্ত করা কেন? প্রায় সব সেক্টরেই তো চোর-বাটপারেরা শত শত কোটি টাকা লোপাট করছে। সেসব ঠেকান। সাধারণ মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ঘষা কেন? এই যে পরিবহন খাতে চরম অস্থিরতা শুরু হলো এর ব্যাকফায়ারে অর্থনীতি অস্থির এবং মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। তখন কী হবে? আরও এক দফা জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের দামা বাড়ানো হবে? অবস্থাদৃষ্টে তাই-ই মনে হচ্ছে। লুটেরা পুঁজির আগ্রাসনের নিয়মই তাই। পুঁজিবাদ তার মুনাফার জন্য হেন নিচ কাজ নেই, যা করতে পারে না। আর তারা যেহেতু বিবিধভাবে সরকারের সঙ্গে দহরম-মহরম করে স্টেকহোল্ডার, তাই সরকারও জনগণের ক্ষতির দিক বিবেচনায় আনার কথা ভাবল না।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

এই প্রশ্ন করা যাবে না

মনজুরুল হক

জনসাধারণের মনে যে শঙ্কা আর সন্দেহ ছিল, তাই-ই হলো। অযোগ্য দুর্নীতিগ্রস্ত বিপিসির ‘লোকসান’ সমন্বয় করতে বিপিসি হুট করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১৫% বাড়িয়ে দিল। যদিও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো-কমানোর এক্তিয়ার একমাত্র জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের রেগুলেটরি কমিটির। বিপিসি বা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অথচ তারা রেগুলেটরি কমিটিকে না জানিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়াল। এটাই তো আইনত দ-নীয়! কে দেবে দ-? যে কোম্পানি ব্যবসা করে তার লাভ-লোকসান থাকবে, এবং তাকে তা মেনে নিতে হবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম থাকার সময় বিপিসি যে ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে তার ভাগ কি জনগণের পকেটে এসেছে? না। তাহলে লোকসানের ভার কেন জনগণকে বইতে হবে?

বিশ্ববাজারের লাগাতার রেকর্ড কম দামের বিপরীতে তেলের দাম ততটা না কমিয়ে শেষ পাঁচ মাস বাদে গত সাত বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তখন দাম কমানোর দাবি উঠেছে বহুবার, কিন্তু বিপিসি বা সরকার কর্ণপাত করেনি। একপর্যায়ে বলেছে-‘আগের বছরগুলোতে বিপিসি কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে’, আর সরকারও বলেছে-‘বিপিসির লোকসান সমন্বয় হলে দাম কমানো হবে। ‘বিপিসির লাভ যখন লিটারপ্রতি ১৫-৪০ টাকা ছিল, তখন বহু সমালোচনার পর এপ্রিল ২০১৬ সালে মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছিল! এরপর ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর সুযোগ না পেয়ে কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা লোকসান দেখিয়ে এক ধাক্কায় ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করা হলো। সাত বছর ধরে গড়ে ২৩ শতাংশের বেশি লাভের বিপরীতে কমানো হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। অথচ পাঁচ মাসের লোকসান দেখিয়ে ডিজেল-কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো কি গ্রহণযোগ্য হলো?

সরকার বিপিসিকে ভর্তুকি দেয়, তবে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক, কর, ভ্যাট বা মূসক বাবদ আয়ও করে। লোকসানের হিসাবটা সরকার যেমন দেখায় তেমন সরল নয়। লিটারপ্রতি ডিজেলে ১১ টাকা ভ্যাটসহ অন্যান্য শুল্ক প্রায় ১৭ টাকার বেশি। এক্ষেত্রে সরকার জনগণের সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে বিপিসির কাছ থেকে শুল্ক করাদি কম করতে পারত। তাতে করে ভর্তুকি দেয়া লাগত না। কিন্তু এসব দিক বিবেচনায় আনেনি সরকার কিংবা বিপিসি।

এই প্রশ্নগুলো শনৈ শনৈ উন্নতি করা ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে করা যাবে না। করলেই মাননীয়দের ভাবমূর্তি চোট খাবে।

এরপর যেটা হলো তার সবই ‘পাতানো খেলা’! আইন উপেক্ষা করে (আইনে আছে যে কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ধর্মঘট ডাকার ১৫ দিন আগে পোষকদের এবং সরকারকে জানাতে হবে। তারা সেসবের ধার ধারেনি। তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন মালিকপক্ষ অনৈতিকভাবে ধর্মঘট ডেকে বসল। তারা ‘সরকার আলোচনা না করে বাড়িয়েছে’ অজুহাত দেখালো। তারা যে আগাম ঘোষণা না দিয়ে ধর্মঘট ডাকল তার জবাবদিহিতা নেয়া হলো না। টানা তিন দিন ধর্মঘট করে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে, তাদের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা বাড়তি শুষে নিয়ে অবশেষে তারা ‘আমরা আমরাই তো’ দুপক্ষ আলোচনায় বসলেন, এবং মালিকপক্ষের অন্যায্য অনৈতিক দাবি মেনে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো অনুমোদন করে দিলেন। শেষে নিষ্ঠুর রসিকতার মতো বললেন-‘কেউ বেঁধে দেয়া ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’! কী সেই ‘কঠোর ব্যবস্থা’? কচু। সরকার জানেও না এই শহরে কত পার্সেন্ট বাস-মিনিবাস ডিজেলে চলে আর কত পার্সেন্ট সিএনজিতে চলে! ভাড়া বাড়ানোর কারণে এখন সিএনজিচালিত, ডিজেলচালিত সব যানবাহনই বেঁধে দেয়া ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করছে। তার কোন মনিটরিং নেই।

বাংলাদেশে এখন সরকারের ‘চোখে চোখ রেখে’ চ্যালেঞ্জ করতে পারে একটি ‘মাফিয়া গোষ্ঠী’-পরিবহন মালিক-শ্রমিক। এখন যে পেট্রোবাংলা বলছে মাসে ২০ কোটির বেশি লোকসান দিচ্ছে, সেটারও ভিত্তি নেই। দেখা যাবে সেই লোকসান হচ্ছে চুরি-ডাকাতি, সিস্টেম লস আর কর্মকর্তাদের বেশুমার ভোগ-বিলাসের কারণে। আরও একটি যুক্তি-‘ভারতে দাম বেশি, তাই ভারতে পাচার ঠেকাতে দাম বাড়ানো হয়েছে’। এটারও ভিত্তি নেই। পাচারই যদি হবে তাহলে বর্ডার গার্ডের মতো বিশাল বাহিনী রয়েছে কী করতে?

এইসব ‘মাফিয়া’ গোষ্ঠী চিকন সূতোর গিট্টু না মেরে যদি সোজাসাপ্টা বলত- “পেট্রোবাংলার লোকসান কমানোর জন্য বাহুল্য খরচ কমান। সিস্টেম লস বন্ধ করুন। দেশ তো এখন প্রায় উন্নত, তাহলে ভর্তুকি দিন, কিংবা কোনভাবেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো চলবে না।”

না। তারা তা বলবেন না। এখানে একটা বহুল প্রচলিত সূত্র আছে। মালিক সিন্ডিকেট ঈদের আগে কসাইদের মতো মাংসের দাম কেজি প্রতি ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেয়। তার পর সরকার রাগান্বিত হয়ে বলে ‘এ কিছুতেই মেনে নেয়া হবে না’। এরপর সরকার ৫০ টাকা অনুমোদন করে দেয়। কসাইরা আসলে যেটা চেয়েছিল। বিপিসি এবং পরিবহন মালিকগং ঠিক সেই কাজটি করেছে। এক ধরনের হ-য-ব-র-ল দশা সৃষ্টি করে ২৭-৩০% ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা আর ৭ টাকার বদলে ১০ টাকা ও ৭ টাকা করেছে। লঞ্চের ভাড়া ৬০% বাড়িয়ে নিয়ে ১০০% আদায় করছে। পুরো পরিবহন ব্যবস্থা এখন যে যার মতো মুনাফা তুলে নিচ্ছে। এতে করে দেশে উৎপাদিত সুঁই থেকে ট্রাক্টর পর্যন্ত উৎপাদন, পরিবহন ব্যয় বেড়ে সাধারণ জনণের চামড়া তুলে লবণ লাগানোর অবস্থায় চলে গেছে।

বিআরটিএ নির্ধারিত প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা ছিল। কেউ কি কখনও দেখেছেন, বাসে এই হারে ভাড়া নিতে? না। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ঢাকার গুলিস্তান থেকে কুড়িল বিশ্বরোড ১২ কিলোমিটার। ভাড়া হয় ১.৭০ী১২ = ২০.৪০ টাকা। লক্কড়ঝক্কড় লোকাল বাসেও ভাড়া নেয়া হয় ৩০ টাকা। এসি বাসে ৬০ টাকা। এ রকম প্রত্যেকটা রুটেই দেড়গুণ ভাড়া নেয়া হয়। এবার ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামহিম ‘কত্তিপক্ক’ ৫০ পয়সা ভাড়া বাড়িয়ে নিতে বলেছে। মানে ২ টাকা ২০ পয়সা প্রতি কিলো। এরপর থেকেই থেকেই দেখা যাচ্ছে কোন বাস, পিকআপ, অটো সিএনজিচালিত নয়! সবই যেন ডিজেলে চলে! এমনকি বাইক নিএনজি অটোরিকশা ও বাইক রাইডারও ভাড়া বাড়িয়ে দেবে, কারণ হিসাবে বলবে-সবকিছুর দাম বেড়েছে। ইতোমধ্যে এককাপ চায়ের দামও বেড়েছে ওই একই অজুহাতে।

দেশের মোট জ্বালানির ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৩২ শতাংশ হচ্ছে তরল জ্বালানি। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশেহারা, তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে তখন জ্বালানির দাম বাড়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, কারণ, মূল্য বৃদ্ধির নতুন এক বিভীষিকাময় চক্র শুরু হয়েছে এতে। অথচ জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় একটা হারে বাড়ানোর সুযোগ ছিল। মহামারীর মন্দা অর্থনীতিকে সচল করতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি নিয়ে বাজারে বাড়তি মুদ্রাপ্রবাহ করা হয়েছে, বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। সেক্ষেত্রে জ্বালানির দাম ৫ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির যুক্তি নেই।

ইতোমধ্যে ২৩ শতাংশের মতো অসহনীয় হারে দাম বাড়ানোয় জনজীবনে অসহনীয় চাপ শুরু হয়ে গেছে। পত্রিকায় শিরোনাম উঠেছে, ‘দামে দিশেহারা ক্রেতা’, ‘এখন সংসার চালানোই দায়’, ‘সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ’, ‘সবকিছুর দাম নাগালের বাইরে’! করোনার পর মানুষের আয়ের ক্রয়ক্ষমতা আরেক দফা কমে গেছে। দেশে এখন অলিখিত প্রায় দেড় কোটি মানুষ সরাসরি করোনায় বেকার কিংবা আধা বেকার। এ অবস্থায় সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধার কষ্টও শুরু হয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে যখন সরকারের কর্তব্য ছিল ভর্তুকি দিয়ে হলেও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করা, সেখানে জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের দাম সহনীয় হারে না বাড়িয়ে ‘অতি উচ্চহারে’র বাড়ানো অযৌক্তিক এবং অবশ্যই গণবিরোধী।

‘বাংলাদেশের প্রকৃত মালিক জনগণ’ সংবিধানের এই বাক্যটি এখন অসার প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকৃত মালিক তারাই যারা অনৈতিক অবৈধ ক্ষমতাবলে জনগণকে জিম্মি করে অনৈতকি অবৈধ সুবিধা আদায় করতে পারে। এই অনৈতিক অবৈধ সুবিধা কোন কোন গোষ্ঠী এবং শ্রেণী আদায় করে, করছে এবং করবেও সেটা সবাই জানে। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারছে না। করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত মানুষের পিঠ-পেট একাকার হয়ে আছে। তাদের হয়ে কথা বলার মতো শক্তিশালী কেউ নেই বলে তাদের সর্বস্বান্ত করা কেন? প্রায় সব সেক্টরেই তো চোর-বাটপারেরা শত শত কোটি টাকা লোপাট করছে। সেসব ঠেকান। সাধারণ মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ঘষা কেন? এই যে পরিবহন খাতে চরম অস্থিরতা শুরু হলো এর ব্যাকফায়ারে অর্থনীতি অস্থির এবং মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। তখন কী হবে? আরও এক দফা জ্বালানি তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের দামা বাড়ানো হবে? অবস্থাদৃষ্টে তাই-ই মনে হচ্ছে। লুটেরা পুঁজির আগ্রাসনের নিয়মই তাই। পুঁজিবাদ তার মুনাফার জন্য হেন নিচ কাজ নেই, যা করতে পারে না। আর তারা যেহেতু বিবিধভাবে সরকারের সঙ্গে দহরম-মহরম করে স্টেকহোল্ডার, তাই সরকারও জনগণের ক্ষতির দিক বিবেচনায় আনার কথা ভাবল না।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]