জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

নিতাই চন্দ্র রায়

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে চলছে বহুপ্রতীক্ষিত ২৬তম বিশ^ জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-২৬। করোনা মহামারীর কারণে এক বছর পর অনুষ্ঠিত হলো এ গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। সম্মেলনে ২০০ দেশের ১২০ জন রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধানসহ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির চার অনুচ্ছেদে ১৯৭টি রাষ্ট্রপ্রতি পাঁচ বছর পরপর আরও উচ্চাকাক্সক্ষী কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার যে বিধান রেখেছিল, এবারের সম্মেলনে সেই লক্ষ্যমাত্রার পুনঃনির্ধারণ করা হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৭ সালে জাপানে স্বাক্ষরিত কিয়াটো প্রটেকলে শিল্পোন্নত ৩৭টি দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনি বাধ্যবাধকতা চুক্তি ও অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতায় জরিমানার বিধান থাকলেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া প্যারিস চুক্তি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা কেবল সময়ই বলতে পারবে।

আমরা জানি, ঐতিহাসিক দূষণকারী দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ। চীন বর্তমানে সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশ (প্রায় ২৮ শতাংশ); মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া ও জাপানের মিলিত নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং ভারত ২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০১৫ সালে ডিসেম্বরে প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই প্যারিসে আবার চুক্তিতে যোগ দেন। এছাড়া বাইডেনের ১ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন বাজেটে ঘুরে ফিরে দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহার, বিদ্যুতচালিত গাড়ির জন্য সহায়তা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার মুক্ত করা এবং জলবায়ু বিষয়ক গবেষণায় বাজেট বাড়ানোর কথা এসেছে বারবার। গত এপ্রিলে জলবায়ু অর্থায়নে বার্ষিক প্রায় ১৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ব্যয় করার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দেন জো বাইডেন এবং ২০২০ সালের মধ্যে এ পরিমাণ দ্বিগুণ করার আশ^াস দেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায়।

সারা বিশে^ দূষণ যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে এ শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, যার বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এর আগে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেও সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দূষণকারী দেশগুলো কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

ইমার্জেন্সি ইভেন্ট ডাটাবেজ ২০২০-এর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়- শুধু ২০২০ সালেই ৫০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বন্যা, খরা ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌসুমি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে চীনেই ২.২ বিলিয়নের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯.৬ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বাংলাদেশ ও ভারত এবং এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে ৩০.৬ মিলিয়ন মানুষ। বৈশি্বক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি ডুবে যাবে আগামী ৩০ বছরে। এভাবে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়তে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় রূপান্তরমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আহবান জানানো হয়। বলা হয়Ñ বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের বিপদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বড় ধরনের সরকারি বিনিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান, সবুজ শিল্পনীতি গ্রহণ এবং শস্য উৎপাদনে সবুজ কৃষিনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে।

গত ২ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে বিশে^র সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) মূল অধিবেশনের ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ’-এর সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ^ নেতাদের সামনে চার দফা দাবি তুলে ধরেন। চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- প্রধান কার্বন নিঃসরণকারীদের অবশ্যই উচ্চাভিলাষী জাতীয় পরিকল্পনা (এনডিসি) দাখিল এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন এবং প্রশমন অর্ধেক ভিত্তিতে ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে স্বল্প খরচে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব নেয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ক্ষতি ও ধ্বংস মোকাবিলা করতে হবে।

জলবায়ু সম্মেলনের মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তির অনুপস্থিতির কঠোর সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সমালোচনায় তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল ও ভয়াবহ সমস্যা থেকে চীন তার মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। একই ঘটনা ঘটিয়েছে রাশিয়া। যদিও দেশ দুটি বৃক্ষ নিধন কমানোর অঙ্গীকারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ইতোপূর্বে। বাইডেনের মতে, শি জিং পিংয়ের অনুপস্থিতি একটি মারাত্মক ভুল। রাশিয়ায় দাবানলে যখন বনভূমি পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট চুপ করে বসে আছেন।

উল্লেখ্য, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের শীর্ষ নেতা শিন জিং পিং কেউই জলবায়ু সম্মেলন-২৬-এ অংশগ্রহণ না করে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত দুই সপ্তাহব্যাপী জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। যদিও বিশে্ব এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ হলো চীন। তার পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান হলো পঞ্চম। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সিভিএফ ও কমনওয়েলথ দেশগুলোর যৌথ পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ কেরন। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি বৈশি^ক ও আন্তঃসীমান্ত সমস্যা এবং এর মারাত্মক পরিণতি থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে জরুরি এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ করে দরিদ্রতম যে ৪৮টি দেশ বেশি পর্যুদস্ত অথচ বিশে^ কার্বন নিঃসরণে যাদের অবদান শতকরা ৫ ভাগ তাদের অর্থায়ন চাহিদার আশু স্বীকৃতি দেয়া উচিত।

জলবায়ু দুর্যোগের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং এসবের প্রভাব নাজুক দেশগুলোকে অপূরণীয় ক্ষতির অগ্রভাগে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; যা বিশ^বাপী খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। তাই এই গ্রহ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে সবাইকে জরুরি এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এক-তৃতীয়াংশের বেশি সিডিএফ সদস্য দেশ কমনওয়েলথের সদস্য এবং এসব দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং অবদানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করে যৌথ প্রচেষ্টা সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ সদস্য দেশগুলো প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার অবশ্যই পালন করতে হবে এবং এ পরিমাণ অর্থায়ন বিদ্যমান ওডিএর অতিরিক্ত ও বিভিন্ন জলবায়ু অর্থায়নের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে জলবায়ু অর্থায়ন বিতরণের মধ্যে ৫০:৫০ অনুপাত থাকা উচিত। উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাশ্রয়ী খাতে সবুজ প্রযুক্তি প্রসারে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে মুজিব জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়।

চরম তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা ও ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদীভাঙন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভূমিক্ষয় বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট জিডিপির ২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নষ্ট হচ্ছে এবং আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। এর আওতায় বাংলাদেশ ৮০০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা প্রধানত অভিযোজন, প্রশমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। বাংলাদেশ একটি নিরাপদ, জলবায়ু সহিষ্ণু এবং সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ অর্জনের জন্য অভিযোজিত ব-দ্বীপের ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক ১০০ বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০’ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে দেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে এবং একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, তাতে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ অভিযোজন উচ্চাক্সক্ষাকে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন]

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

নিতাই চন্দ্র রায়

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে চলছে বহুপ্রতীক্ষিত ২৬তম বিশ^ জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-২৬। করোনা মহামারীর কারণে এক বছর পর অনুষ্ঠিত হলো এ গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। সম্মেলনে ২০০ দেশের ১২০ জন রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধানসহ প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির চার অনুচ্ছেদে ১৯৭টি রাষ্ট্রপ্রতি পাঁচ বছর পরপর আরও উচ্চাকাক্সক্ষী কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার যে বিধান রেখেছিল, এবারের সম্মেলনে সেই লক্ষ্যমাত্রার পুনঃনির্ধারণ করা হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৭ সালে জাপানে স্বাক্ষরিত কিয়াটো প্রটেকলে শিল্পোন্নত ৩৭টি দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনি বাধ্যবাধকতা চুক্তি ও অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতায় জরিমানার বিধান থাকলেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া প্যারিস চুক্তি কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা কেবল সময়ই বলতে পারবে।

আমরা জানি, ঐতিহাসিক দূষণকারী দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশ। চীন বর্তমানে সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশ (প্রায় ২৮ শতাংশ); মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া ও জাপানের মিলিত নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং ভারত ২ দশমিক ৬২ শতাংশ।

২০১৫ সালে ডিসেম্বরে প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই প্যারিসে আবার চুক্তিতে যোগ দেন। এছাড়া বাইডেনের ১ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন বাজেটে ঘুরে ফিরে দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবহার, বিদ্যুতচালিত গাড়ির জন্য সহায়তা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার মুক্ত করা এবং জলবায়ু বিষয়ক গবেষণায় বাজেট বাড়ানোর কথা এসেছে বারবার। গত এপ্রিলে জলবায়ু অর্থায়নে বার্ষিক প্রায় ১৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ব্যয় করার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দেন জো বাইডেন এবং ২০২০ সালের মধ্যে এ পরিমাণ দ্বিগুণ করার আশ^াস দেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায়।

সারা বিশে^ দূষণ যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে এ শতাব্দীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, যার বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এর আগে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেও সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দূষণকারী দেশগুলো কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

ইমার্জেন্সি ইভেন্ট ডাটাবেজ ২০২০-এর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়- শুধু ২০২০ সালেই ৫০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বন্যা, খরা ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌসুমি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে চীনেই ২.২ বিলিয়নের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯.৬ মিলিয়ন মানুষ। এর মধ্যে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বাংলাদেশ ও ভারত এবং এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে ৩০.৬ মিলিয়ন মানুষ। বৈশি্বক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি ডুবে যাবে আগামী ৩০ বছরে। এভাবে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়তে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলায় রূপান্তরমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আহবান জানানো হয়। বলা হয়Ñ বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের বিপদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বড় ধরনের সরকারি বিনিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান, সবুজ শিল্পনীতি গ্রহণ এবং শস্য উৎপাদনে সবুজ কৃষিনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে।

গত ২ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে বিশে^র সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) মূল অধিবেশনের ভাষণে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ’-এর সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ^ নেতাদের সামনে চার দফা দাবি তুলে ধরেন। চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- প্রধান কার্বন নিঃসরণকারীদের অবশ্যই উচ্চাভিলাষী জাতীয় পরিকল্পনা (এনডিসি) দাখিল এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন এবং প্রশমন অর্ধেক ভিত্তিতে ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে স্বল্প খরচে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব নেয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ক্ষতি ও ধ্বংস মোকাবিলা করতে হবে।

জলবায়ু সম্মেলনের মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তির অনুপস্থিতির কঠোর সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সমালোচনায় তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল ও ভয়াবহ সমস্যা থেকে চীন তার মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। একই ঘটনা ঘটিয়েছে রাশিয়া। যদিও দেশ দুটি বৃক্ষ নিধন কমানোর অঙ্গীকারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ইতোপূর্বে। বাইডেনের মতে, শি জিং পিংয়ের অনুপস্থিতি একটি মারাত্মক ভুল। রাশিয়ায় দাবানলে যখন বনভূমি পুড়ে ধ্বংস হচ্ছে তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট চুপ করে বসে আছেন।

উল্লেখ্য, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের শীর্ষ নেতা শিন জিং পিং কেউই জলবায়ু সম্মেলন-২৬-এ অংশগ্রহণ না করে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত দুই সপ্তাহব্যাপী জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। যদিও বিশে্ব এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ হলো চীন। তার পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান হলো পঞ্চম। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সিভিএফ ও কমনওয়েলথ দেশগুলোর যৌথ পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ কেরন। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি বৈশি^ক ও আন্তঃসীমান্ত সমস্যা এবং এর মারাত্মক পরিণতি থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে জরুরি এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ করে দরিদ্রতম যে ৪৮টি দেশ বেশি পর্যুদস্ত অথচ বিশে^ কার্বন নিঃসরণে যাদের অবদান শতকরা ৫ ভাগ তাদের অর্থায়ন চাহিদার আশু স্বীকৃতি দেয়া উচিত।

জলবায়ু দুর্যোগের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং এসবের প্রভাব নাজুক দেশগুলোকে অপূরণীয় ক্ষতির অগ্রভাগে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে; যা বিশ^বাপী খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। তাই এই গ্রহ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে সবাইকে জরুরি এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এক-তৃতীয়াংশের বেশি সিডিএফ সদস্য দেশ কমনওয়েলথের সদস্য এবং এসব দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং অবদানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করে যৌথ প্রচেষ্টা সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ সদস্য দেশগুলো প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।

উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার অবশ্যই পালন করতে হবে এবং এ পরিমাণ অর্থায়ন বিদ্যমান ওডিএর অতিরিক্ত ও বিভিন্ন জলবায়ু অর্থায়নের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে জলবায়ু অর্থায়ন বিতরণের মধ্যে ৫০:৫০ অনুপাত থাকা উচিত। উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাশ্রয়ী খাতে সবুজ প্রযুক্তি প্রসারে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে মুজিব জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়।

চরম তাপমাত্রা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা, খরা ও ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদীভাঙন ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভূমিক্ষয় বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৈশি^ক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট জিডিপির ২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নষ্ট হচ্ছে এবং আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। এর আওতায় বাংলাদেশ ৮০০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা প্রধানত অভিযোজন, প্রশমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। বাংলাদেশ একটি নিরাপদ, জলবায়ু সহিষ্ণু এবং সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ অর্জনের জন্য অভিযোজিত ব-দ্বীপের ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক ১০০ বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০’ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে দেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে এবং একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে, তাতে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ অভিযোজন উচ্চাক্সক্ষাকে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

[লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন]