তারক দাস ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা

মিথুশিলাক মুরমু

৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখ সরেজমিন গিয়েছিলাম সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী হরিণখোলা গ্রামে। উদ্দেশ্য খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর মি. তারক দাসের সাথে সাক্ষাৎ করতে। ন্যাশনাল খ্রিস্টিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশের (এনসিএফবি) সাধারণ সম্পাদক রেভারেন্ড মার্থা দাস, বাংলাদেশ ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চেসের (বিএফবিসি) রেভারেন্ড প্রদ্যুৎ সরকার এবং পাস্টর থিওফিল গাজী, ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চেস অব বাংলাদেশের (এফসিসিবি) রেভারেন্ড রঘুনাথ সরকারের সাথে আমিও সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। সূর্য ডুবু-ডুবু মুহূর্তে আমরা পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছতেই মি. তারক দাস দৌড়িয়ে বেরিয়ে আসেন এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো, লুটপাটের স্থানগুলো, কোন কোন স্থানে পরিবারের সদস্যদের অপদস্ত করা হয়েছে ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাচ্ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও পরিবারের কর্তা মি. তারক দাসের সাথে চোখের জল ফেলেছেন; তাদের চোখের চাহনি, হৃদয়ের ব্যাকুলতা, অবিচারের আশঙ্কা, প্রশাসনের নীরবতা সত্যিই একজন নাগরিককে উদ্বিগ্ন করে তোলে। একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর এহেন হতাশা কিংবা আতঙ্ক অমূলক নয়। আমরা তার মনোব্যথাগুলো উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলাম।

বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মি. তারক দাসের বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। প্রতিদিনের মতোই মি. তারক দাস পারিবারিক কাজে ঘরের বাইরে ছিলেন, তার পুত্রসন্তান সঞ্জয় দাসও (ঝালমুড়ি বিক্রেতা) ঘরে পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল। এমনই সময়ে সুযোগ বুঝে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীরা মি. তারক দাসের পরিবারের সদস্য তার স্ত্রী বীণা দাসী, বৌমা অঞ্জলী দাসী এবং নাতি সুজিত কুমার দাসের ওপর চড়াও হয়। ঘরের আসবাবপত্র, ঘরের টিনগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে। পরিবারের সচ্ছলতা আনয়নে ছাগলের খামার গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৯টি ছাগল সংগ্রহ করেছিলেন; ৯টির মধ্যে ৫টি পাঁঠা (বিদেশি জাতের) এবং ৪টি মাদী ছাগল নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। পাঁঠা দিয়ে ছাগলের প্রজনন কেন্দ্র গড়তে চেয়েছিলেন। ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা রাতের অন্ধকারে পরিবারের সহায় সম্বল সমস্ত কিছুই হাতিয়ে নিয়েছে। পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে সোলার লাগিয়ে ছিলেন, সেটিও ছিনিয়ে নিয়েছে। ঘটনার ৮ দিন পর তালা থানা পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেছে।

খ্রিস্ট বিশ^াসী মি. তারক দাসের সাথে দীর্ঘ সময় আলাপে আরও যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে; সেগুলো খুবই ভয়াবহ। আশপাশের মধ্যে তার পরিবারই একমাত্র খ্রিস্টিয়ান পরিবার। নির্মিত ঘরের ওপর একটি ক্রুশ দ-ায়মান এবং রাস্তার সাথেই ঘরটি থাকায় রাস্তা দিয়ে গমনাগমনকারীদের দৃষ্টি সহজেই আকর্ষিত হতো। তার প্রতিবেশী কিংবা অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা বিষয়টি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। খ্রিস্টিয়ানবিদ্দেষী মনোভাব এবং তাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইতোপূর্বেও বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করা হয়েছে। দ্বিতীয়তÑ মি. তারক দাসের পুত্র সঞ্জয় দাস ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করে থাকেন। তিনি ঝালমুড়ি বিক্রির পাশাপাশি খ্রিস্টিয়ান ধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব যিশুখ্রিস্টের ছবিও প্রদর্শন করে থাকেন, যারা ছবি দেখে আগ্রহী ও উৎসাহী হয়ে থাকেন; তাদের যিশুখ্রিস্টের সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে অবহিত করে থাকেন। কখনই কাউকে প্ররোচিত করেননি, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতেই দুই-একটি শেয়ার করে থাকেন। তৃতীয়তÑমি. তারক দাসের প্রজনন কেন্দ্র সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত সচ্ছলভাবে জীবনযাপন সত্যিই চোখের শূলে পরিণত হয়েছেন। চতুর্থতÑ তিনি রাস্তার পাশের্^ যে জায়গাটির ওপর ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন, সেটি তিনি নগদ অর্থে ক্রয় করেছেন। অনেক অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো জায়গা নেই, সেখানে তারক দাসের বসতভিটা ক্রয় অন্যদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে। পঞ্চমতÑ প্রতিবেশীদের পূজা-পার্বণ কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে চাঁদা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে কিন্তু মি. তারক দাস বিনয়ের সাথে জানিয়েছেন যেÑ আমি খ্রিস্টিয়ান ধর্মাবলম্বী; অন্য ধর্মের ধর্মীয় পুজোতে চাঁদা দেওয়া বিধেয় নয় কিন্তু সামাজিক বিষয়াদিতে আগ্রহী হয়েছেন।

জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করতে গড়িমসি করেছেন? তিনি জানান, ঘটনার পরপরই তালা থানাধীন বালিয়া ক্যাম্পে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়। বালিয়া ক্যাম্পের এসআই মোসতাক অভিযোগ তদন্ত করেন এবং লুট হয়ে যাওয়া ৯টি ছাগলের মধ্যে ৩টি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তারই প্রচেষ্টায় ২৫ সেপ্টেম্বর সালিশি বৈঠক আহবান করলে মি. তারক দাস তার পক্ষের লোকদের নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে উপস্থিত হলেও অভিযুক্তরা তোয়াক্কা করেনি। নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্র্তীতে মোসতাক ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে অভিযুক্তরা সরাসরি নাকচ করে দেন। তারা বিষয়টির কোনো আমলই নেননি। ফলশ্রুতিতে সেদিন সন্ধ্যায় তালা থানায় অভিযোগ দাখিল করা হয়। এখানেও চলেছে লুকোচুরি খেলা। ২৫ তারিখ দাখিল হওয়া অভিযোগপত্র এন্ট্রি হয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। এ অভিযোগের পুনঃতদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এসআই পিযূষকে। কয়েক দিনের মধ্যেই এসআই পিযূষ র‌্যাবে ট্রান্সফার হয়ে চলে যান, সেক্ষেত্রে বর্তমানে এসআই কাউসার নতুনভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। খ্রিস্ট বিশ^াসী মি. তারক দাস ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের গড়িমসি সত্যিই সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করেছে।

বিগত ৫ নভেম্বর তালা থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে সন্ধ্যায় টিমের সদস্যরা সাক্ষাৎ করি। বর্তমান ওসি আমাদের সময় দিলেন এবং আমাদের বক্তব্যগুলো শুনলেন। ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগকালের ওসি মেহেদি হাসানও অন্যত্র বদলি হয়েছেন। ওসি মহোদয় জানালেন, তারক দাসের বিষয়টি তিনি অবগত আছেন, খ্রিস্টিয়ান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে উত্তেজনা রয়েছে, সেটি অবশ্যই আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান তালিকায় রয়েছে। যেহেতু মামলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে তদন্তসাপেক্ষে চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করার জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। দোষী যেই হোক না কেন, কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বোধ করি, তিনি গুরুত্বারোপের কথা বললেও এতদিনে কোনো সামান্যতম উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এখন পর্যন্ত কয়েক লক্ষাধিক টাকার জানমাল উদ্ধারে তৎপরতা দেখা যায়নি। মি. তারক দাস অভিযোগে উল্লেখ করেছিলেন, ‘...৫টি পুরুষ ও ৪টি নারী ছাগল চুরি করিয়া নিয়া যায়; যার আনুমানিক মূল্য ৩,০০,০০০/-(তিন লক্ষ) টাকা’। জানতে চেয়েছিলাম, পাঁঠা ছাগলের দাম এবং কোথায় থেকে ক্রয় করেছেন? তিনি ফেরত পাওয়া পাঁঠা দেখিয়ে জানাচ্ছিলেন, এটি আমি ঝিকরগাছা থেকে ক্রয় করে নিয়ে এসেছি ৪০ হাজার টাকায়। লুট হয়ে যাওয়া পাঁঠার মধ্যে একটির দাম ৮০ হাজার টাকা। ওসি মহোদয় মি. তারক দাসের মতো নগন্য লোকদের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনাকে তালিকার তলানিতেই রেখেছেন।

হরিণখোলার খোলা বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, একটি প্রভাবশালী মহল খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মি. তারক দাসের উচ্ছেদ, হুমকি প্রদানকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। এই হুকুমদাতারাই আড়ালে থেকে শান্তিপূর্ণ সম্প্রীতিমূলক সালিশি বৈঠক প- করে দিয়েছিলেন। কী তাদের উদ্দেশ্য, কী তাদের মনোবাসনা! হয়তো এরূপ আশঙ্কা থেকেই সঞ্জয় দাস উচ্চারণ করেছেনÑ ‘আমাদের আর হরিণখোলায় থাকা হবে না। স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করাও সম্ভব হবে না।’ একজন নাগরিকের কাছ থেকে এমন হতাশা, অসহায়ত্বের কথা কেউ-ই প্রত্যাশা করে না; তালা থানার কর্তৃপক্ষ একটু সুনজর দিলেই মি. তারক দাসের পরিবার শান্তিতে বসবাস করতে পারে। নিষ্ক্রিয় স্থানীয় প্রশাসনগুলো সক্রিয় হলেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনসাধারণ শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, ভ্রাতৃত্ববোধের সাথে বসবাস করতে সক্ষম হবেন।

বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১ , ২৬ কার্তিক ১৪২৮ ৫ রবিউস সানি ১৪৪৩

তারক দাস ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা

মিথুশিলাক মুরমু

৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখ সরেজমিন গিয়েছিলাম সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী হরিণখোলা গ্রামে। উদ্দেশ্য খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর মি. তারক দাসের সাথে সাক্ষাৎ করতে। ন্যাশনাল খ্রিস্টিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশের (এনসিএফবি) সাধারণ সম্পাদক রেভারেন্ড মার্থা দাস, বাংলাদেশ ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চেসের (বিএফবিসি) রেভারেন্ড প্রদ্যুৎ সরকার এবং পাস্টর থিওফিল গাজী, ফ্রি খ্রিস্টিয়ান চার্চেস অব বাংলাদেশের (এফসিসিবি) রেভারেন্ড রঘুনাথ সরকারের সাথে আমিও সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। সূর্য ডুবু-ডুবু মুহূর্তে আমরা পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছতেই মি. তারক দাস দৌড়িয়ে বেরিয়ে আসেন এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো, লুটপাটের স্থানগুলো, কোন কোন স্থানে পরিবারের সদস্যদের অপদস্ত করা হয়েছে ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাচ্ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও পরিবারের কর্তা মি. তারক দাসের সাথে চোখের জল ফেলেছেন; তাদের চোখের চাহনি, হৃদয়ের ব্যাকুলতা, অবিচারের আশঙ্কা, প্রশাসনের নীরবতা সত্যিই একজন নাগরিককে উদ্বিগ্ন করে তোলে। একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর এহেন হতাশা কিংবা আতঙ্ক অমূলক নয়। আমরা তার মনোব্যথাগুলো উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলাম।

বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মি. তারক দাসের বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। প্রতিদিনের মতোই মি. তারক দাস পারিবারিক কাজে ঘরের বাইরে ছিলেন, তার পুত্রসন্তান সঞ্জয় দাসও (ঝালমুড়ি বিক্রেতা) ঘরে পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল। এমনই সময়ে সুযোগ বুঝে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদীরা মি. তারক দাসের পরিবারের সদস্য তার স্ত্রী বীণা দাসী, বৌমা অঞ্জলী দাসী এবং নাতি সুজিত কুমার দাসের ওপর চড়াও হয়। ঘরের আসবাবপত্র, ঘরের টিনগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে। পরিবারের সচ্ছলতা আনয়নে ছাগলের খামার গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৯টি ছাগল সংগ্রহ করেছিলেন; ৯টির মধ্যে ৫টি পাঁঠা (বিদেশি জাতের) এবং ৪টি মাদী ছাগল নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। পাঁঠা দিয়ে ছাগলের প্রজনন কেন্দ্র গড়তে চেয়েছিলেন। ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা রাতের অন্ধকারে পরিবারের সহায় সম্বল সমস্ত কিছুই হাতিয়ে নিয়েছে। পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে সোলার লাগিয়ে ছিলেন, সেটিও ছিনিয়ে নিয়েছে। ঘটনার ৮ দিন পর তালা থানা পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেছে।

খ্রিস্ট বিশ^াসী মি. তারক দাসের সাথে দীর্ঘ সময় আলাপে আরও যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে; সেগুলো খুবই ভয়াবহ। আশপাশের মধ্যে তার পরিবারই একমাত্র খ্রিস্টিয়ান পরিবার। নির্মিত ঘরের ওপর একটি ক্রুশ দ-ায়মান এবং রাস্তার সাথেই ঘরটি থাকায় রাস্তা দিয়ে গমনাগমনকারীদের দৃষ্টি সহজেই আকর্ষিত হতো। তার প্রতিবেশী কিংবা অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা বিষয়টি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। খ্রিস্টিয়ানবিদ্দেষী মনোভাব এবং তাদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইতোপূর্বেও বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করা হয়েছে। দ্বিতীয়তÑ মি. তারক দাসের পুত্র সঞ্জয় দাস ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করে থাকেন। তিনি ঝালমুড়ি বিক্রির পাশাপাশি খ্রিস্টিয়ান ধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব যিশুখ্রিস্টের ছবিও প্রদর্শন করে থাকেন, যারা ছবি দেখে আগ্রহী ও উৎসাহী হয়ে থাকেন; তাদের যিশুখ্রিস্টের সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে অবহিত করে থাকেন। কখনই কাউকে প্ররোচিত করেননি, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতেই দুই-একটি শেয়ার করে থাকেন। তৃতীয়তÑমি. তারক দাসের প্রজনন কেন্দ্র সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত সচ্ছলভাবে জীবনযাপন সত্যিই চোখের শূলে পরিণত হয়েছেন। চতুর্থতÑ তিনি রাস্তার পাশের্^ যে জায়গাটির ওপর ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন, সেটি তিনি নগদ অর্থে ক্রয় করেছেন। অনেক অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো জায়গা নেই, সেখানে তারক দাসের বসতভিটা ক্রয় অন্যদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে। পঞ্চমতÑ প্রতিবেশীদের পূজা-পার্বণ কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে চাঁদা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকে কিন্তু মি. তারক দাস বিনয়ের সাথে জানিয়েছেন যেÑ আমি খ্রিস্টিয়ান ধর্মাবলম্বী; অন্য ধর্মের ধর্মীয় পুজোতে চাঁদা দেওয়া বিধেয় নয় কিন্তু সামাজিক বিষয়াদিতে আগ্রহী হয়েছেন।

জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করতে গড়িমসি করেছেন? তিনি জানান, ঘটনার পরপরই তালা থানাধীন বালিয়া ক্যাম্পে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়। বালিয়া ক্যাম্পের এসআই মোসতাক অভিযোগ তদন্ত করেন এবং লুট হয়ে যাওয়া ৯টি ছাগলের মধ্যে ৩টি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তারই প্রচেষ্টায় ২৫ সেপ্টেম্বর সালিশি বৈঠক আহবান করলে মি. তারক দাস তার পক্ষের লোকদের নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে উপস্থিত হলেও অভিযুক্তরা তোয়াক্কা করেনি। নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্র্তীতে মোসতাক ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে অভিযুক্তরা সরাসরি নাকচ করে দেন। তারা বিষয়টির কোনো আমলই নেননি। ফলশ্রুতিতে সেদিন সন্ধ্যায় তালা থানায় অভিযোগ দাখিল করা হয়। এখানেও চলেছে লুকোচুরি খেলা। ২৫ তারিখ দাখিল হওয়া অভিযোগপত্র এন্ট্রি হয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দে। এ অভিযোগের পুনঃতদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এসআই পিযূষকে। কয়েক দিনের মধ্যেই এসআই পিযূষ র‌্যাবে ট্রান্সফার হয়ে চলে যান, সেক্ষেত্রে বর্তমানে এসআই কাউসার নতুনভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। খ্রিস্ট বিশ^াসী মি. তারক দাস ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের গড়িমসি সত্যিই সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি করেছে।

বিগত ৫ নভেম্বর তালা থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে সন্ধ্যায় টিমের সদস্যরা সাক্ষাৎ করি। বর্তমান ওসি আমাদের সময় দিলেন এবং আমাদের বক্তব্যগুলো শুনলেন। ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগকালের ওসি মেহেদি হাসানও অন্যত্র বদলি হয়েছেন। ওসি মহোদয় জানালেন, তারক দাসের বিষয়টি তিনি অবগত আছেন, খ্রিস্টিয়ান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে উত্তেজনা রয়েছে, সেটি অবশ্যই আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান তালিকায় রয়েছে। যেহেতু মামলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে তদন্তসাপেক্ষে চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করার জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। দোষী যেই হোক না কেন, কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বোধ করি, তিনি গুরুত্বারোপের কথা বললেও এতদিনে কোনো সামান্যতম উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এখন পর্যন্ত কয়েক লক্ষাধিক টাকার জানমাল উদ্ধারে তৎপরতা দেখা যায়নি। মি. তারক দাস অভিযোগে উল্লেখ করেছিলেন, ‘...৫টি পুরুষ ও ৪টি নারী ছাগল চুরি করিয়া নিয়া যায়; যার আনুমানিক মূল্য ৩,০০,০০০/-(তিন লক্ষ) টাকা’। জানতে চেয়েছিলাম, পাঁঠা ছাগলের দাম এবং কোথায় থেকে ক্রয় করেছেন? তিনি ফেরত পাওয়া পাঁঠা দেখিয়ে জানাচ্ছিলেন, এটি আমি ঝিকরগাছা থেকে ক্রয় করে নিয়ে এসেছি ৪০ হাজার টাকায়। লুট হয়ে যাওয়া পাঁঠার মধ্যে একটির দাম ৮০ হাজার টাকা। ওসি মহোদয় মি. তারক দাসের মতো নগন্য লোকদের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনাকে তালিকার তলানিতেই রেখেছেন।

হরিণখোলার খোলা বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, একটি প্রভাবশালী মহল খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মি. তারক দাসের উচ্ছেদ, হুমকি প্রদানকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। এই হুকুমদাতারাই আড়ালে থেকে শান্তিপূর্ণ সম্প্রীতিমূলক সালিশি বৈঠক প- করে দিয়েছিলেন। কী তাদের উদ্দেশ্য, কী তাদের মনোবাসনা! হয়তো এরূপ আশঙ্কা থেকেই সঞ্জয় দাস উচ্চারণ করেছেনÑ ‘আমাদের আর হরিণখোলায় থাকা হবে না। স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করাও সম্ভব হবে না।’ একজন নাগরিকের কাছ থেকে এমন হতাশা, অসহায়ত্বের কথা কেউ-ই প্রত্যাশা করে না; তালা থানার কর্তৃপক্ষ একটু সুনজর দিলেই মি. তারক দাসের পরিবার শান্তিতে বসবাস করতে পারে। নিষ্ক্রিয় স্থানীয় প্রশাসনগুলো সক্রিয় হলেই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনসাধারণ শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, ভ্রাতৃত্ববোধের সাথে বসবাস করতে সক্ষম হবেন।