রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় সব আসামি খালাস

বনানীর আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ‘অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের’ মামলায় ৫ আসামিকে খালাস দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ আদেশ দিয়েছেন। যাদের খালাস দেয়া হয়েছে তারা হলেন মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু নাইম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, সাদমান শাকিব, গাড়ি চালক বিল্লাল এবং সাফাতের দেহরক্ষী মো. রহমত আলী।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, সাক্ষ্য প্রমাণে কোথাও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরাও কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রীর প্ররোচনায় মামলাটি হয়েছে। ভিকটিমরা সম্মতিতে শারীরিক মেলামেশা করেছে বলে বিশ্লেষণে প্রতিয়মান হয়েছে।

রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, কোন কিছু প্রমাণ না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ মামলাটি চার্জশিট দাখিল করেছে আদালতে। মামলাটি আদালতে চলেছে ৪৬ কার্যদিবস। অর্থাৎ মামলাটি চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ আদালতের পাবলিক সময় নষ্ট করেছে। পুলিশকে বলবো, ৭২ ঘণ্টা পর কেউ যদি ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে যান সেই মামলা না নেয়ার জন্য। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বলা আছে- ধর্ষণের মামলায় আলামত লাগে। ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত থাকে না। পারিপার্শিক ঘটনা এবং আসামিদের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে বুঝা গেছে, আসামি ও ভিকটিমদের মধ্যে সম্মতিতে শারীরিক মেলামেশা হয়েছে। ১৬ বছরের উপরে শারীরিক সম্পর্ক সম্মতিতে হলে সেটিকে ধর্ষণ বলা যায় না। ভিকটিমদের সঙ্গে আসামিদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়েছে। এ মামলায় ভিকটিম আগে থেকে শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত। হোটেলে ভিকটিমরা স্বেচ্ছায় থাকতে গিয়েছেন। তারা ধর্ষণের শিকার হয়নি। এছাড়া, এক নম্বর আসামি (সাফাতের) সদ্য ডিভোর্সি স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় এ মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

বিচারক আরও বলেন, ‘ভিকটিমরা যদি সত্যিকারের ধর্ষণের শিকার হতেন, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের কাজ হতো আগে থানায় যাওয়া। কিšুÍ তারা থানায় না গিয়ে অন্য জায়গায় গিয়েছে। তাই অত্র আদালত মনে করে অত্র মামলায় আসামিরা নির্দোষ। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে মামলা প্রমাণ করতে পারে নাই, তাই আসামিদের খালাস দেয়া হলো।’ ‘রায় ঘোষণা শেষ হলে আসামিরা শুকরিয়া আদায় করে বিচারককে উদ্দেশ্য করে হাত উঠিয়ে সালাম প্রদর্শন করেন’।

‘তবে মামলার পর গ্রেপ্তার হয়ে আসামিদের পুলিশ রিমান্ড হেফাজতে নিলে তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন’।

গতকাল ছিল আলোচিত এ মামলায় রায় ঘোষণার দিন। বেলা ১২টায় রায় ঘোষণার কথা থাকলেও বিচারক রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু করে ১২টার পরে। বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিচারক মামলার এজাহার, সাক্ষীদের জবানবন্দি, মেডিকেল রিপোর্টের প্রতিবেদন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পড়ে শোনার বিচারক। এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ, নাইম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম, সাদমান শাকিব, ড্রাইভার বিল্লাল এবং সাফাতের দেহরক্ষী মো. রহমত আলী।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইট্রি হোটেলের একটি কক্ষে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য দাওয়াত করে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফায়েত আহমেদ ওই দুই ছাত্রীকে মদ পান করিয়ে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ উঠে। প্রথমে থানা পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পরে ঘটনার ৪৫ দিন পর ৬ মে ধর্ষণের শিকার দুই ছাত্রীর একজন বাদী হলে মামলা নেয় পুলিশ। মামলার পর প্রধান আসামিসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে পুলিশ আসামিদের রিমান্ড হেফাজতে নেয়। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিরা ধর্ষণের কথা স্বীকার করে। পরে তাদের রিমান্ড হেফাজতে নিলে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিরা ধর্ষণের কথা স্বীকার করে। আলোচিত এ মামলায় পুলিশ ২০১৭ সালের ৫ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। অভিযোগপত্র গঠন করা হয় ১৩ জুলাই। মামলায় ৪৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। এর মধ্যে সাক্ষী নেয়া হয় ২২ জনের। বাকি আসামিদের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপক্ষের কৌসলিরা আদালতে হাজির করতে পারেননি।

মামলার এজাহার, সাক্ষীদের সাক্ষ, ডিএনএ প্রতিবেদন, ও তদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ পায়নি আদালত

রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেছেন, ‘আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলায় অধিকাংশ সাক্ষী ঘটনাস্থল বনানী রেইনট্রি হোটেলের কর্মচারী। দুজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাদের একজনকে আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। বিচারক বলেছেন, রেইনট্রি হোটেলের কর্মচারীরা তাদের সাক্ষীতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এমন কোন সাক্ষী দেয়নি। অধিকাংশ সাক্ষী ঘটনা দেখেনি। তারা পরে পুলিশের কাছ থেকে ঘটনা শুনেছে বলে আদালতে বলেছে। সাক্ষীরা বলেছে, রেইনট্রি হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। তাই এখানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ধর্ষণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আসামি ও বাদীরা ঘটনার দিন হোটেলের রুট ফ্লোরে সুইমিং করেছিল। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। সেখানে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন পরিধেয় পোশাক পুলিশের কাছে দিয়েছে ভিকটিম। সেটি ডিএনএ পরীক্ষা করেও কোন আলামত পাওয়া যায়নি বলে ডিএনএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আদলত বলেছে, মামলার এজাহারে যে বক্তব্য ভিকটিম দিয়েছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যে চার্জশিট দিয়েছেন তার মধ্যে অনেক জায়গায় অমিল রয়েছে। ডিএন এ নমুনায় আসামিদের কোন সিমেন পাওয়া যায়নি। ডিএনএ প্রতিবেদনে চিকিৎসক বলেছেন, ভিকটিমদের শারীরিক গঠন এমন যে, তারা নিয়মিত শারীরিক মেলামেশায় করে থাকে। অথাৎ এখনও জোরপূর্বক ধর্ষণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভিকটিম শারীরিক পরীক্ষায় কোন আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি। সাক্ষীরা বলেছে, ঘটনার দিন তারা কোন চিৎকার চেচামিচির শব্দ শোনেননি। একজন সাক্ষী বলেছেন, তিনি ওই রাতে কোন নারীকে হোটেলে আটকে রেখে ধর্ষণের কোন ঘটনা দেখেননি।

সাক্ষীদের জবানবন্দি বিচারক আদালতে পড়ে শুনান। এ সময় তিনি প্রথমে রেইনট্রি হোটেলে কর্মরত কর্মচারীদের জবানবন্দি পড়ে শুনান। তিনি বলেন, ‘কোন সাক্ষী ঘটনার দিন ধর্ষণের কোন ঘটনা দেখেননি। এমনকি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তাও দেখেননি। ঘটনার ৩৮ দিন পরে পুলিশ এসে বললে, তারা ঘটনার কথা শুনেন। সাক্ষীদের এমন বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটেনি বা ভিকটিমরা সেখানে গিয়েছিল কি-না তাও স্পষ্ট নয়।’

বিচারক ডাক্তারি রিপোর্টের পর্যালোচনা করেন। এ সময় বিচারক বলেন, ‘ঘটনার ৩৮ দিন পরে মামলা হয়েছে। এত দীর্ঘদিন পর মামলা করার কারণে, মেডিকেলে কোন ধর্ষণের আলামত আসেনি। এছাড়া ভিকটিম শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই মেডিকেল রিপোর্টেও কোন ধর্ষণের প্রমাণ হয়নি। এবার ভিকটিমের ঘটনার দিন পরিহিত লং কামিজ পুলিশ জব্দ করে এবং তা কেমিকেল টেস্ট করানো হয়েছে। সেখানেও কোন ধরনের বীর্য পাওয়া যায়নি। অতএব এতেও স্বীকৃত যে, ধর্ষণ হয়নি।’

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে যা বললেন বিচারক

বিচারক আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে বলেন, আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের আশ্বস্ত করেননি, আসামিরা যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দেন তাহলে তাদের আর রিমান্ড দেয়া হবে না। এতে স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেয়া ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। এছাড়া আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। এছাড়া, ধর্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে কে কীভাবে জড়িত তা আসামিরা ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে সুষ্পষ্টভাবে বলেননি। স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে জোরপূর্বক ধর্ষণ বা প্রতারণামূলকভাবে কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি-না তা পরিষ্কার হয়নি।

রায়ের পর বিচারককে সালাম আসামিদের

রায় শোনার পর আদালতের মধ্যে আসামিরা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন। এরপর তারা বিচারককে হাত উঠিয়ে সালাম দেন। এজলাসেই বলে উঠেন ‘সত্যের জয় হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এটা সাজানো ছিল। আমরা ভিক্টিমাইজড। আদালত সঠিক রায় দিয়েছেন।’ এর পর তারা এজলাসের পাশে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করেন।

আসামি পক্ষের আইনজীবীদের সন্তোষ প্রকাশ

সাফাত আহমেদের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট এবং ২২ জন সাক্ষীর জবানবন্দি- সবকিছুর আলোকে এ ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা টিমের সবাই আনন্দিত। এই মামলায় যারা তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এই মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা কাউকে খুশি করার জন্য এই কাজ করেছিলেন।’

আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “সাক্ষ্যপ্রমাণ এখানে হাজির করার পরও মেডিকেলে রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট, ২২ জনের সাক্ষী, ঘটনাস্থল, ২২ ধারায় বাদীর জবানবন্দি এবং সব কিছুর আলোকে এটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং আদালত চূড়ান্তভাবে খালাস প্রদান করেছেন। আমরা আনন্দিত।”

এ মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ। ‘জোর করে’ ওই জবানবন্দি আদায় করা হয় বলে পরে অভিযোগ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায়ের ‘প্রচলিত নিয়ম’ পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী কাজল। তিনি বলেন, “এই মামলায় যে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হলো, এটা জোর করে নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়মগুলো বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত। পুলিশ যে প্রচলিত নিয়মগুলো ব্যবহার করে সেগুলো বাতিল হয়ে যাওয়া ?উচিত।”

নাঈম আশরাফের আইনজীবী খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ও কতিপয় ব্যবসায়িকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে এই মামলা করেছেন। মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্ট, আসমিদের জবানবন্দি এবং ২২ জন সাক্ষীর জবানবন্দির জেরা পর্যালোচনা করে আসামিদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। মিথ্যা মামলায় ৯৬ কার্যদিবস আদলতের সময় নষ্ট করা হয়েছে।’

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ বলেন, আমরা আদালতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি এ মামলার বিচারে। আদালত ঘটনা এবং নথিপত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মামলার রায় দিয়েছেন। মামলার সত্যায়িত কপি পাওয়ার পরে আমরা কী করব, সেই সিদ্ধান্ত নিব।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত যা বলেছে

অভিযোগপত্র অনুযায়ী কী ঘটেছিল সেদিন?

২০১৭ সালের ৮ জুন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে সাফাতসহ পাঁচ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এ্যানি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার ১৫ দিন আগে গুলশানের পিকাসো হোটেলে সাফাতের সঙ্গে পরিচয় হয় বাদীর। সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে বাদী ও ভিকটিমের মামলার ঘটনায় ১০/১৫ দিন আগে বাদীর পূর্ব পরিচিত বন্ধু সাদমান সাকিফের মাধ্যমে গুলশান থানাধীন পিকাসো হোটেলে পরিচিত হয়।

পরিচয় হওয়ার পর সাফাত আহমেদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে অনেকদিন কথা হয়। কথা হওয়ার মাঝে সাফাত আহমেদ ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ তার জন্মদিনের প্রসঙ্গ তুলে বাদীকে তার বান্ধবীসহ অন্য বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে রেইনট্রি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আসার জন্য দাওয়াত দেন। ঘটনার দিন সাফাত আহমেদ তার নিজের ব্যবহৃত গাড়ি ও ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন এবং গানম্যান রহমতকে পাঠান বাদী ও তার বান্ধবীকে তাদের নিজ বাসা নিকেতন থেকে রাত ৯টায় রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে আসেন এবং ড্রাইভার বিল্লাল তাদের হোটেল রুমে পৌঁছে দিয়ে আসেন। হোটেলে আসার পর ওখানে কোন পার্টির পরিবেশ না দেখে বাদী ও তার বান্ধবী চলে যেতে চাইলে আসামিরা বান্ধবী ও বাদীকে কেক কেটে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেখানে বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও স্নেহা ছিলেন। বাদী তার বন্ধুদের নিয়ে আবার চলে যেতে চাইলে সাফাত ও নাঈম বাদীর বন্ধুদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং বাদীর বন্ধু শাহরিয়ারের গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেন। এরপর শাহরিয়ারকে ৭০৩ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন। পরে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ রেইনট্রি হোটেলের ৭০০ নম্বর সুইট রুমে বাদী ও ভিকটিমকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক মদ পান করিয়ে সাফাত ও নাঈম আশরাফ ধর্ষণ করেন। এ সময় বাদীকে খুব মারধর করেন। বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন। এরপর বাদী ও তার বান্ধবীর বাসায় রহমত আলীকে পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা এতে ভয় পান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে তারা মামলার সিদ্ধান্ত নেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার একদিন আগে সাফাত পার্টির জন্য মদের বোতল রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে আসেন। ধর্ষণের পর সাফাত আহমেদের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন ওষুধের দোকান থেকে আইপিল (জন্মনিরোধ) সংগ্রহ করে আনেন। পরবর্তী সময়ে সাফাত আহমেদ জোর করে বাদীকে আইপিল খাওয়াতে চান। কিন্তু বাদীনি আইপিল খেতে না চাইলে বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও বাদীকে সাফাত ও নাঈম মারধর করে। এ মারধরের ঘটনা নাঈমের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল মোবাইলে রেকর্ড করে রাখেন। পরে সে ভিডিওগুলো তারা ডিলিট করে দেন। পুলিশি তদন্তের সময় মোবাইল থেকে ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সে ভিডিওগুলো উদ্ধার করা হয়।

আসামিদের স্বীকারেক্তি

আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাফাত বলেন, বাদীর সঙ্গে জন্মদিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে তার পরিচয় হয় সাদমান সাকিফের মাধ্যমে। দ্রুততই তারা বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনি দাবি করেন, বাদীর পছন্দে তিনি রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিন উদ্?যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দুটি কক্ষ বুকিং দিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ রাতে তারা মদ খেয়ে বেসামাল ছিলেন।

আসামি নাঈম আশরাফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। নাঈম জবানবন্দিতে বলেন, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে বেশ কিছু মডেলের পরিচয় ছিল। তারা সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো এই নারীদের ব্যবহার করতেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বিকেল থেকে দুজন মডেল ছিলেন। পরে তাদের অনুরোধে আরও একজন বাড্ডা থেকে যোগ দেন। ধর্ষণের শিকার দুই নারী ও তাদের বন্ধুরা হোটেলে আসেন রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে। অতিথিদের একজনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তিনি হোটেলে ফেরেন রাত দেড়টার দিকে।

তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্বলতার কথা বললেন বাদী পক্ষের আইনজীবী

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় সব আসামির খালাস পাওয়ার কারণ হিসেবে ‘তদন্ত প্রতিবেদনের দুর্বলতার’ কথা বলছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। মূলত সঠিক তদন্ত না হওয়ায় আজ দুই ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার বঞ্চিত হলেন। যার কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেছেন আদালত।

ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার গতকাল রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হলো, চিকিৎসক মেডিকেল রিপোটে ধর্ষণের আলামত পাননি মর্মে মতামত দিলেন, ভুক্তভোগীদের পরিধেয় কাপড়ে কোন পুরুষের সিমেন্সের কনা পাওয়া যায়নি। তারপরও তদন্ত চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করেছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেইপ কেসের বিচার ব্যাহত হয়েছে। তিনি অন্য কোন পক্ষকর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এই চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আজকের দিনসহ এই মামলায় ৯৪ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। ৭২ ঘণ্টার পর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, সে কথা তুলে ধরে বিচারক পুলিশকে ওই সময়ের পরে কোন মামলা না নিতে বলেছেন।

বাদীর আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মামলাটি মিথ্যা নয়। মিথ্যা হলে ট্রাইব্যুনাল ভিকটিম বাদীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় প্রসিকিউশন দাখিলের নির্দেশ দিতেন। ঘটনার অনেক দিন পর মেডিকেল পরীক্ষা হওয়ায় সেখানে ধর্ষণের আলামত না আসাই স্বভাবিক ছিল। তাই তারা মামলা চালাতে ভরসা করেছিলেন পারিপার্শ্বিক সাক্ষী ও আসামিদের স্বীকারোক্তির ওপর।

রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বাদীর আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, এ মামলার রায়ের পর একজন ভিকটিমের মায়ের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমি উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।

রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন এ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ। রায়ের কপি পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই মামলায় বিচারে সহযোগিতা করেছি। আদালত চুরচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কী করব ঠিক এখনই বলতে পারছি না।

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১ , ২৭ কার্তিক ১৪২৮ ৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় সব আসামি খালাস

আদালত বার্তা পরিবেশক

image

ধর্ষণ মামলায় খালাসপ্রাপ্তরা আদালত প্রাঙ্গণে -সংবাদ

বনানীর আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে ‘অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের’ মামলায় ৫ আসামিকে খালাস দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ আদেশ দিয়েছেন। যাদের খালাস দেয়া হয়েছে তারা হলেন মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ, তার বন্ধু নাইম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, সাদমান শাকিব, গাড়ি চালক বিল্লাল এবং সাফাতের দেহরক্ষী মো. রহমত আলী।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, সাক্ষ্য প্রমাণে কোথাও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিরাও কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। প্রধান আসামি সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রীর প্ররোচনায় মামলাটি হয়েছে। ভিকটিমরা সম্মতিতে শারীরিক মেলামেশা করেছে বলে বিশ্লেষণে প্রতিয়মান হয়েছে।

রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, কোন কিছু প্রমাণ না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ মামলাটি চার্জশিট দাখিল করেছে আদালতে। মামলাটি আদালতে চলেছে ৪৬ কার্যদিবস। অর্থাৎ মামলাটি চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ আদালতের পাবলিক সময় নষ্ট করেছে। পুলিশকে বলবো, ৭২ ঘণ্টা পর কেউ যদি ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করতে যান সেই মামলা না নেয়ার জন্য। কারণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বলা আছে- ধর্ষণের মামলায় আলামত লাগে। ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত থাকে না। পারিপার্শিক ঘটনা এবং আসামিদের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে বুঝা গেছে, আসামি ও ভিকটিমদের মধ্যে সম্মতিতে শারীরিক মেলামেশা হয়েছে। ১৬ বছরের উপরে শারীরিক সম্পর্ক সম্মতিতে হলে সেটিকে ধর্ষণ বলা যায় না। ভিকটিমদের সঙ্গে আসামিদের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়েছে। এ মামলায় ভিকটিম আগে থেকে শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত। হোটেলে ভিকটিমরা স্বেচ্ছায় থাকতে গিয়েছেন। তারা ধর্ষণের শিকার হয়নি। এছাড়া, এক নম্বর আসামি (সাফাতের) সদ্য ডিভোর্সি স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় এ মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

বিচারক আরও বলেন, ‘ভিকটিমরা যদি সত্যিকারের ধর্ষণের শিকার হতেন, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের কাজ হতো আগে থানায় যাওয়া। কিšুÍ তারা থানায় না গিয়ে অন্য জায়গায় গিয়েছে। তাই অত্র আদালত মনে করে অত্র মামলায় আসামিরা নির্দোষ। আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে মামলা প্রমাণ করতে পারে নাই, তাই আসামিদের খালাস দেয়া হলো।’ ‘রায় ঘোষণা শেষ হলে আসামিরা শুকরিয়া আদায় করে বিচারককে উদ্দেশ্য করে হাত উঠিয়ে সালাম প্রদর্শন করেন’।

‘তবে মামলার পর গ্রেপ্তার হয়ে আসামিদের পুলিশ রিমান্ড হেফাজতে নিলে তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন’।

গতকাল ছিল আলোচিত এ মামলায় রায় ঘোষণার দিন। বেলা ১২টায় রায় ঘোষণার কথা থাকলেও বিচারক রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু করে ১২টার পরে। বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিচারক মামলার এজাহার, সাক্ষীদের জবানবন্দি, মেডিকেল রিপোর্টের প্রতিবেদন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পড়ে শোনার বিচারক। এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন প্রধান আসামি সাফাত আহমেদ, নাইম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম, সাদমান শাকিব, ড্রাইভার বিল্লাল এবং সাফাতের দেহরক্ষী মো. রহমত আলী।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইট্রি হোটেলের একটি কক্ষে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য দাওয়াত করে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফায়েত আহমেদ ওই দুই ছাত্রীকে মদ পান করিয়ে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ উঠে। প্রথমে থানা পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পরে ঘটনার ৪৫ দিন পর ৬ মে ধর্ষণের শিকার দুই ছাত্রীর একজন বাদী হলে মামলা নেয় পুলিশ। মামলার পর প্রধান আসামিসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে পুলিশ আসামিদের রিমান্ড হেফাজতে নেয়। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিরা ধর্ষণের কথা স্বীকার করে। পরে তাদের রিমান্ড হেফাজতে নিলে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিরা ধর্ষণের কথা স্বীকার করে। আলোচিত এ মামলায় পুলিশ ২০১৭ সালের ৫ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। অভিযোগপত্র গঠন করা হয় ১৩ জুলাই। মামলায় ৪৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। এর মধ্যে সাক্ষী নেয়া হয় ২২ জনের। বাকি আসামিদের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপক্ষের কৌসলিরা আদালতে হাজির করতে পারেননি।

মামলার এজাহার, সাক্ষীদের সাক্ষ, ডিএনএ প্রতিবেদন, ও তদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ পায়নি আদালত

রায় ঘোষণার আগে বিচারক বলেছেন, ‘আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলায় অধিকাংশ সাক্ষী ঘটনাস্থল বনানী রেইনট্রি হোটেলের কর্মচারী। দুজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাদের একজনকে আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। বিচারক বলেছেন, রেইনট্রি হোটেলের কর্মচারীরা তাদের সাক্ষীতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এমন কোন সাক্ষী দেয়নি। অধিকাংশ সাক্ষী ঘটনা দেখেনি। তারা পরে পুলিশের কাছ থেকে ঘটনা শুনেছে বলে আদালতে বলেছে। সাক্ষীরা বলেছে, রেইনট্রি হোটেলে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। তাই এখানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ধর্ষণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আসামি ও বাদীরা ঘটনার দিন হোটেলের রুট ফ্লোরে সুইমিং করেছিল। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। সেখানে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন পরিধেয় পোশাক পুলিশের কাছে দিয়েছে ভিকটিম। সেটি ডিএনএ পরীক্ষা করেও কোন আলামত পাওয়া যায়নি বলে ডিএনএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আদলত বলেছে, মামলার এজাহারে যে বক্তব্য ভিকটিম দিয়েছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যে চার্জশিট দিয়েছেন তার মধ্যে অনেক জায়গায় অমিল রয়েছে। ডিএন এ নমুনায় আসামিদের কোন সিমেন পাওয়া যায়নি। ডিএনএ প্রতিবেদনে চিকিৎসক বলেছেন, ভিকটিমদের শারীরিক গঠন এমন যে, তারা নিয়মিত শারীরিক মেলামেশায় করে থাকে। অথাৎ এখনও জোরপূর্বক ধর্ষণের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভিকটিম শারীরিক পরীক্ষায় কোন আঘাতের চিহ্নও পাওয়া যায়নি। সাক্ষীরা বলেছে, ঘটনার দিন তারা কোন চিৎকার চেচামিচির শব্দ শোনেননি। একজন সাক্ষী বলেছেন, তিনি ওই রাতে কোন নারীকে হোটেলে আটকে রেখে ধর্ষণের কোন ঘটনা দেখেননি।

সাক্ষীদের জবানবন্দি বিচারক আদালতে পড়ে শুনান। এ সময় তিনি প্রথমে রেইনট্রি হোটেলে কর্মরত কর্মচারীদের জবানবন্দি পড়ে শুনান। তিনি বলেন, ‘কোন সাক্ষী ঘটনার দিন ধর্ষণের কোন ঘটনা দেখেননি। এমনকি কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, তাও দেখেননি। ঘটনার ৩৮ দিন পরে পুলিশ এসে বললে, তারা ঘটনার কথা শুনেন। সাক্ষীদের এমন বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটেনি বা ভিকটিমরা সেখানে গিয়েছিল কি-না তাও স্পষ্ট নয়।’

বিচারক ডাক্তারি রিপোর্টের পর্যালোচনা করেন। এ সময় বিচারক বলেন, ‘ঘটনার ৩৮ দিন পরে মামলা হয়েছে। এত দীর্ঘদিন পর মামলা করার কারণে, মেডিকেলে কোন ধর্ষণের আলামত আসেনি। এছাড়া ভিকটিম শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই মেডিকেল রিপোর্টেও কোন ধর্ষণের প্রমাণ হয়নি। এবার ভিকটিমের ঘটনার দিন পরিহিত লং কামিজ পুলিশ জব্দ করে এবং তা কেমিকেল টেস্ট করানো হয়েছে। সেখানেও কোন ধরনের বীর্য পাওয়া যায়নি। অতএব এতেও স্বীকৃত যে, ধর্ষণ হয়নি।’

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে যা বললেন বিচারক

বিচারক আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে বলেন, আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের আশ্বস্ত করেননি, আসামিরা যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দেন তাহলে তাদের আর রিমান্ড দেয়া হবে না। এতে স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় দেয়া ছিল বলে প্রতীয়মান হয় না। এছাড়া আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। এছাড়া, ধর্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে কে কীভাবে জড়িত তা আসামিরা ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে সুষ্পষ্টভাবে বলেননি। স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে জোরপূর্বক ধর্ষণ বা প্রতারণামূলকভাবে কোন শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি-না তা পরিষ্কার হয়নি।

রায়ের পর বিচারককে সালাম আসামিদের

রায় শোনার পর আদালতের মধ্যে আসামিরা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন। এরপর তারা বিচারককে হাত উঠিয়ে সালাম দেন। এজলাসেই বলে উঠেন ‘সত্যের জয় হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। এটা সাজানো ছিল। আমরা ভিক্টিমাইজড। আদালত সঠিক রায় দিয়েছেন।’ এর পর তারা এজলাসের পাশে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করেন।

আসামি পক্ষের আইনজীবীদের সন্তোষ প্রকাশ

সাফাত আহমেদের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট এবং ২২ জন সাক্ষীর জবানবন্দি- সবকিছুর আলোকে এ ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা টিমের সবাই আনন্দিত। এই মামলায় যারা তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এই মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তারা কাউকে খুশি করার জন্য এই কাজ করেছিলেন।’

আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “সাক্ষ্যপ্রমাণ এখানে হাজির করার পরও মেডিকেলে রিপোর্ট, ডিএনএ রিপোর্ট, ২২ জনের সাক্ষী, ঘটনাস্থল, ২২ ধারায় বাদীর জবানবন্দি এবং সব কিছুর আলোকে এটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং আদালত চূড়ান্তভাবে খালাস প্রদান করেছেন। আমরা আনন্দিত।”

এ মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ। ‘জোর করে’ ওই জবানবন্দি আদায় করা হয় বলে পরে অভিযোগ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায়ের ‘প্রচলিত নিয়ম’ পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী কাজল। তিনি বলেন, “এই মামলায় যে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হলো, এটা জোর করে নেয়া হয়েছে। আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়মগুলো বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত। পুলিশ যে প্রচলিত নিয়মগুলো ব্যবহার করে সেগুলো বাতিল হয়ে যাওয়া ?উচিত।”

নাঈম আশরাফের আইনজীবী খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ও কতিপয় ব্যবসায়িকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করে এই মামলা করেছেন। মেডিকেল রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্ট, আসমিদের জবানবন্দি এবং ২২ জন সাক্ষীর জবানবন্দির জেরা পর্যালোচনা করে আসামিদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। মিথ্যা মামলায় ৯৬ কার্যদিবস আদলতের সময় নষ্ট করা হয়েছে।’

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ বলেন, আমরা আদালতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি এ মামলার বিচারে। আদালত ঘটনা এবং নথিপত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মামলার রায় দিয়েছেন। মামলার সত্যায়িত কপি পাওয়ার পরে আমরা কী করব, সেই সিদ্ধান্ত নিব।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত যা বলেছে

অভিযোগপত্র অনুযায়ী কী ঘটেছিল সেদিন?

২০১৭ সালের ৮ জুন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে সাফাতসহ পাঁচ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এ্যানি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার ১৫ দিন আগে গুলশানের পিকাসো হোটেলে সাফাতের সঙ্গে পরিচয় হয় বাদীর। সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে বাদী ও ভিকটিমের মামলার ঘটনায় ১০/১৫ দিন আগে বাদীর পূর্ব পরিচিত বন্ধু সাদমান সাকিফের মাধ্যমে গুলশান থানাধীন পিকাসো হোটেলে পরিচিত হয়।

পরিচয় হওয়ার পর সাফাত আহমেদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে অনেকদিন কথা হয়। কথা হওয়ার মাঝে সাফাত আহমেদ ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ তার জন্মদিনের প্রসঙ্গ তুলে বাদীকে তার বান্ধবীসহ অন্য বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে রেইনট্রি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আসার জন্য দাওয়াত দেন। ঘটনার দিন সাফাত আহমেদ তার নিজের ব্যবহৃত গাড়ি ও ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন এবং গানম্যান রহমতকে পাঠান বাদী ও তার বান্ধবীকে তাদের নিজ বাসা নিকেতন থেকে রাত ৯টায় রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে আসেন এবং ড্রাইভার বিল্লাল তাদের হোটেল রুমে পৌঁছে দিয়ে আসেন। হোটেলে আসার পর ওখানে কোন পার্টির পরিবেশ না দেখে বাদী ও তার বান্ধবী চলে যেতে চাইলে আসামিরা বান্ধবী ও বাদীকে কেক কেটে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেখানে বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও স্নেহা ছিলেন। বাদী তার বন্ধুদের নিয়ে আবার চলে যেতে চাইলে সাফাত ও নাঈম বাদীর বন্ধুদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং বাদীর বন্ধু শাহরিয়ারের গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেন। এরপর শাহরিয়ারকে ৭০৩ নম্বর কক্ষে আটকে রাখেন। পরে সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ রেইনট্রি হোটেলের ৭০০ নম্বর সুইট রুমে বাদী ও ভিকটিমকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক মদ পান করিয়ে সাফাত ও নাঈম আশরাফ ধর্ষণ করেন। এ সময় বাদীকে খুব মারধর করেন। বাদীকে সাফাত আহমেদ ও তার বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন। এরপর বাদী ও তার বান্ধবীর বাসায় রহমত আলীকে পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা এতে ভয় পান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠার পরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে তারা মামলার সিদ্ধান্ত নেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার একদিন আগে সাফাত পার্টির জন্য মদের বোতল রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে আসেন। ধর্ষণের পর সাফাত আহমেদের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন ওষুধের দোকান থেকে আইপিল (জন্মনিরোধ) সংগ্রহ করে আনেন। পরবর্তী সময়ে সাফাত আহমেদ জোর করে বাদীকে আইপিল খাওয়াতে চান। কিন্তু বাদীনি আইপিল খেতে না চাইলে বাদীর বন্ধু শাহরিয়ার ও বাদীকে সাফাত ও নাঈম মারধর করে। এ মারধরের ঘটনা নাঈমের নির্দেশে ড্রাইভার বিল্লাল মোবাইলে রেকর্ড করে রাখেন। পরে সে ভিডিওগুলো তারা ডিলিট করে দেন। পুলিশি তদন্তের সময় মোবাইল থেকে ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সে ভিডিওগুলো উদ্ধার করা হয়।

আসামিদের স্বীকারেক্তি

আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাফাত বলেন, বাদীর সঙ্গে জন্মদিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে তার পরিচয় হয় সাদমান সাকিফের মাধ্যমে। দ্রুততই তারা বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনি দাবি করেন, বাদীর পছন্দে তিনি রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিন উদ্?যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দুটি কক্ষ বুকিং দিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ রাতে তারা মদ খেয়ে বেসামাল ছিলেন।

আসামি নাঈম আশরাফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। নাঈম জবানবন্দিতে বলেন, তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে বেশ কিছু মডেলের পরিচয় ছিল। তারা সুযোগ পেলে ইচ্ছেমতো এই নারীদের ব্যবহার করতেন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও বিকেল থেকে দুজন মডেল ছিলেন। পরে তাদের অনুরোধে আরও একজন বাড্ডা থেকে যোগ দেন। ধর্ষণের শিকার দুই নারী ও তাদের বন্ধুরা হোটেলে আসেন রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে। অতিথিদের একজনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তিনি হোটেলে ফেরেন রাত দেড়টার দিকে।

তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্বলতার কথা বললেন বাদী পক্ষের আইনজীবী

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় সব আসামির খালাস পাওয়ার কারণ হিসেবে ‘তদন্ত প্রতিবেদনের দুর্বলতার’ কথা বলছেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। মূলত সঠিক তদন্ত না হওয়ায় আজ দুই ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার বঞ্চিত হলেন। যার কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেছেন আদালত।

ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার গতকাল রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হলো, চিকিৎসক মেডিকেল রিপোটে ধর্ষণের আলামত পাননি মর্মে মতামত দিলেন, ভুক্তভোগীদের পরিধেয় কাপড়ে কোন পুরুষের সিমেন্সের কনা পাওয়া যায়নি। তারপরও তদন্ত চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করেছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেইপ কেসের বিচার ব্যাহত হয়েছে। তিনি অন্য কোন পক্ষকর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এই চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আজকের দিনসহ এই মামলায় ৯৪ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। ৭২ ঘণ্টার পর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, সে কথা তুলে ধরে বিচারক পুলিশকে ওই সময়ের পরে কোন মামলা না নিতে বলেছেন।

বাদীর আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মামলাটি মিথ্যা নয়। মিথ্যা হলে ট্রাইব্যুনাল ভিকটিম বাদীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় প্রসিকিউশন দাখিলের নির্দেশ দিতেন। ঘটনার অনেক দিন পর মেডিকেল পরীক্ষা হওয়ায় সেখানে ধর্ষণের আলামত না আসাই স্বভাবিক ছিল। তাই তারা মামলা চালাতে ভরসা করেছিলেন পারিপার্শ্বিক সাক্ষী ও আসামিদের স্বীকারোক্তির ওপর।

রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বাদীর আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, এ মামলার রায়ের পর একজন ভিকটিমের মায়ের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। আমি উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি।

রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা পরিচালনা করেন এ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ। রায়ের কপি পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই মামলায় বিচারে সহযোগিতা করেছি। আদালত চুরচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কী করব ঠিক এখনই বলতে পারছি না।