‘৭২ ঘণ্টা কেন ৭২ দিন পরে এলেও ধর্ষণের মামলা পুলিশ নিতে বাধ্য’

ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর অভিযোগে কোন মামলা যেন পুলিশ না নেয় সেই নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এমন নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি ব্লাষ্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না সংবাদকে বলেন, ‘৭২ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষণের শিকার নারী মামলা করতে পারবে না এমন জুরিডকশনই নাই, একজন বিজ্ঞ বিচারপতি একথা বলতেই পারেন না। ৭২ ঘণ্টা কেন ৭২ দিন পরে এলেও ধর্ষণের শিকার নারীর মামলা পুলিশ নিতে বাধ্য।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে এই আইনজীবী আরও বলেন, এই রায়ের মাধ্যেমে ধর্ষণকে আরও উৎসাহিত করা হলো। কারণ, ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা আটকে রেখে যখন ধর্ষণের শিকার কাউকে ছেড়ে দেবে সে তো আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না। তখন কি হবে, পুলিশ আর মামলা নেবে না।’

‘মামলার দুই ভুক্তভোগী আগে থেকেই সেক্সুয়াল (যৌন) কর্মে অভ্যস্ত’ অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন- আদালতের এমন পর্যবেক্ষণেও প্রবীণ এই আইনজীবী তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলেন, এমন কথা তিনি বলতেই পারেন না। একজন নারী দেহব্যবসায়ীকে কেউ জোরপূর্বক ধর্ষণ করতে পারে না। তিনি যেসব ভাষা ব্যবহার করেছেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি সার্টিফাইড কপি পাইনি। পেলে মামলা করবো।’

দেশব্যাপী তুমুল আলোচিত রেইনট্রি মামলায় পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারক।

আদালত বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন।

ভুক্তভোগীদের ডাক্তারি প্রতিবেদনে কোন সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের (যৌন সহিংসতা) বিবরণ নেই। ভুক্তভোগীর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলেনি। ৩৮ দিন পর এসে তারা (দুই ছাত্রী) বললো ‘রেপড হয়েছি’, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল।

তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন বলে পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।

বিচারক রায় পড়ার সময় আরও বলেন, আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ।

এই মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোন প্রমাণ দিতে পারেননি।

গত ১২ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক অসুস্থ থাকায় রায় ঘোষণা পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ধার্য করা হয়। কিন্তু ওইদিন সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার মারা যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়।

মামলার আসামিরা হলেনÑ সাফাত আহমেদ, সাফাতের দুই বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম ও সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী।

আসামিদের মধ্যে শুধু রহমত আলী ছাড়া বাকি সবাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ওই দুই তরুণীকে নিয়ে আসা হয়। মদ খাওয়ানোর পর ওই দুই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়।

প্রথম দিকে মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই বছরের ৬ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

মামলায় ওই পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে ওই বছরের ৮ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের পুলিশ পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন।

একই বছরের ১৩ জুলাই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলায় চার্জগঠন করেন আদালত। এর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে তা শেষ হয় ২২ আগস্ট।

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১ , ২৭ কার্তিক ১৪২৮ ৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেয়ার নির্দেশনা আদালতের

‘৭২ ঘণ্টা কেন ৭২ দিন পরে এলেও ধর্ষণের মামলা পুলিশ নিতে বাধ্য’

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর অভিযোগে কোন মামলা যেন পুলিশ না নেয় সেই নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এমন নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি ব্লাষ্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না সংবাদকে বলেন, ‘৭২ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষণের শিকার নারী মামলা করতে পারবে না এমন জুরিডকশনই নাই, একজন বিজ্ঞ বিচারপতি একথা বলতেই পারেন না। ৭২ ঘণ্টা কেন ৭২ দিন পরে এলেও ধর্ষণের শিকার নারীর মামলা পুলিশ নিতে বাধ্য।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে এই আইনজীবী আরও বলেন, এই রায়ের মাধ্যেমে ধর্ষণকে আরও উৎসাহিত করা হলো। কারণ, ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা আটকে রেখে যখন ধর্ষণের শিকার কাউকে ছেড়ে দেবে সে তো আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না। তখন কি হবে, পুলিশ আর মামলা নেবে না।’

‘মামলার দুই ভুক্তভোগী আগে থেকেই সেক্সুয়াল (যৌন) কর্মে অভ্যস্ত’ অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন- আদালতের এমন পর্যবেক্ষণেও প্রবীণ এই আইনজীবী তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলেন, এমন কথা তিনি বলতেই পারেন না। একজন নারী দেহব্যবসায়ীকে কেউ জোরপূর্বক ধর্ষণ করতে পারে না। তিনি যেসব ভাষা ব্যবহার করেছেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি সার্টিফাইড কপি পাইনি। পেলে মামলা করবো।’

দেশব্যাপী তুমুল আলোচিত রেইনট্রি মামলায় পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারক।

আদালত বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন।

ভুক্তভোগীদের ডাক্তারি প্রতিবেদনে কোন সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের (যৌন সহিংসতা) বিবরণ নেই। ভুক্তভোগীর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলেনি। ৩৮ দিন পর এসে তারা (দুই ছাত্রী) বললো ‘রেপড হয়েছি’, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল।

তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন বলে পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।

বিচারক রায় পড়ার সময় আরও বলেন, আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ।

এই মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোন প্রমাণ দিতে পারেননি।

গত ১২ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক অসুস্থ থাকায় রায় ঘোষণা পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ধার্য করা হয়। কিন্তু ওইদিন সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার মারা যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করা হয়।

মামলার আসামিরা হলেনÑ সাফাত আহমেদ, সাফাতের দুই বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম ও সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী।

আসামিদের মধ্যে শুধু রহমত আলী ছাড়া বাকি সবাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ওই দুই তরুণীকে নিয়ে আসা হয়। মদ খাওয়ানোর পর ওই দুই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়।

প্রথম দিকে মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই বছরের ৬ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

মামলায় ওই পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে ওই বছরের ৮ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের পুলিশ পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন।

একই বছরের ১৩ জুলাই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলায় চার্জগঠন করেন আদালত। এর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে তা শেষ হয় ২২ আগস্ট।