শেরপুর সীমান্তে বন্যহাতির তাণ্ডবে কৃষকরা অতিষ্ঠ

শেরপুর সীমান্তে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বন্যহাতির তাণ্ডবে কৃষকরা অতিষ্ঠ। শত শত একর জমির পাকা ধান, সব্জি ক্ষেত ও মৌসুমি ফসল নিয়ে বিপাকে স্থানীয় কৃষকরা। তারা সীমান্ত থেকে আসা হাতির পাল থেকে ফসল ও নিজেদের রক্ষা করতে রাত জেগে মশাল জ্বালিয়ে ও ঘণ্টা বাজিয়ে পালাক্রমে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন। এরপরও তাণ্ডব ঠেকানো যাচ্ছে না।

কৃষকরা কোন উপায় না পেয়ে ফসল রক্ষায় ও নিজেদের বাঁচতে সীমান্তে বৈদ্যুতিক তার লাগিয়ে আলো দিয়ে হাতি থেকে রক্ষার কৌশলগত চেষ্টা করছেন। কিন্তু বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে সম্প্রতি একটি হাতি মারা গেছে।

অপর দিকে স্থানীয়দের মতে, গত ২৫ বছরে শেরপুর সীমান্তে বন্যহাতির আক্রমণে কৃষকসহ নানা বয়সের ৭০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ১শ’র বেশি মানুষ।

সরেজমিনে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৫ দিন ধরে বন্যহাতির তাণ্ডবে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের গ্রামগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাহাড়ের গ্রামীণ জীবন। হাতি সারাদিন পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে থাকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পাহাড় থেকে দলে দলে ধান ক্ষেতে নেমে তাণ্ডব চালাচ্ছে বন্যহাতির দল। এছাড়া বন্যহাতির তাণ্ডবে সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিবছরই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত একর জমির পাকা ধান, সবজি ক্ষেত ও মৌসুমি ফসল। লণ্ডভণ্ড হচ্ছে ঘরবাড়ি। তছনছ করছে বন বাগানের বিপুল পরিমাণে গাছপালা। পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করছে বিস্তৃর্ণ আবাদী জমির ফসল। এলাকার লোকজন রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছে নিজেদের ফসল বাঁচানোর জন্য। প্রতিনিয়ত হাতির আক্রমণে তাদের জীবন এখন হুমকির মুখে।

স্থানীয় নেয়াবাড়ির টিলা ও পার্শ্ববর্তী মালাকোচা গ্রামের কৃষক লাল চান, রহুল আমীন, মজনু মিয়া, আলাল মিয়া, আবদুর বারিক, সাদা মিয়া, মনিরুল ইসলামসহ গারো পাহাড়ের অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, হাতির আক্রমণে আমাদের ধান ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে কাঁচা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে গেছি। এছাড়াও অসংখ্য কৃষকের সবজি ক্ষেত নষ্ট করে ফেলেছে।

জানা গেছে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত জনপদ শ্রীবরদীর রাজার পাহাড়, নেওয়াবাড়ি টিলা, ঝোঁলগাঁও, বালিজুড়ি, কোচপাড়া, রাঙ্গাজান, কাড়ামারা, কর্ণজোড়া, বাবলাকোনা, হারিয়েকোনা, পাঁচমেঘাদল, গারোপাড়াসহ ১২-১৫টি গ্রামে বাঙালি ও হিন্দু গারো, কোচ হাজংসহ বিভিন্ন গোত্র মিলে প্রায় ২০-৩০ হাজার মানুষ বসবাস করছে।

ওই সব এলাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে বিশাল বনভূমি। বাংলাদেশের বনাঞ্চল অপেক্ষাকৃত সমতল। ভারতের গহীন বনাঞ্চলে রয়েছে অগণিত বুনো হাতি। হাতি দল বেঁধে সমতল ভূমিতে চলাফেরা ও আহার করতে সহজ মনে করে থাকে। তাই সময় অসময়ে বুনো হাতির পাল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওইসব সমতল বনাঞ্চলের আবাসিক ও কৃষিপ্রধান এলাকায় চলে আসে। পাহাড়ে বসবাসরত বাড়িঘর, ফসলাদি জমি ও বিভিন্ন বাগানে বন্যহাতি ঢুকে ধ্বংসলীলা চালায়। আবার ফিরেও যায় হাতির পাল।

গত ২০-২৫ বছর ধরে এসব বুনোহাতি তাণ্ডবলীলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কয়েকশ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার একর জমির ধান শাক-সবজি ফসল খেয়ে এবং বাগানের গাছপালা দুমড়ে মুচড়ে সাবাড় করে চলেছে। বুনোহাতির আক্রমণে এ পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বালিজুরি গ্রামের হামির উদ্দিন, বাবুল মিয়া, খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের স্টারসন, ঝুলগাঁও গ্রামের মজিবর, সিরাজ, হাতিবর গ্রামের বৃন্দাবন দাস, মাখনেরচর গ্রামের হাসান হাবিব বাঘারচর গ্রামের আবু তালেবসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কয়েকশত মানুষ আহত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন পঙ্গুত্ব বরণ করে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে।

ঝুলগাঁও গ্রামের আবদুর রাজ্জাক, শাহজাহান, বালিজুড়ি গ্রামের আমিনুল, খাড়ামোড়া গ্রামের রফিকুল মিয়াসহ অনেকে জানায়, বুনোহাতি ঢাকঢোল ফটকা ও আগুনকে ভয় করে থাকে। তাই এলাকাবাসী মশাল ও বন থেকে কুড়িয়ে আনা আবর্জনা জ্বালিয়ে, হৈ হুল্লোড় করে বাঁশ দিয়ে ফটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানো চেষ্টা করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ওইসব কৌশলও করতে পারছে না পাহাড়িরা। ফলে হাতির পাল বিনা প্রতিরোধে গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের ক্ষতিসাধন করে থাকে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সীমন্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মানুষ পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে এবং পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদ করে কোনরকম জীবিকা নির্বাহ করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গী। এর ওপর প্রায় বন্যহাতির আক্রমণে দিশেহারা করে দিয়েছে তাদের। হাতির আতঙ্কে এমনিতেই অনেক জমি পতিত থাকছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবাদ করলেও সে ফসল ঘরে তুলতে পারছে না অনেকেই।

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে দলবেধে নেমে আসছে ধান ক্ষেতের জমিতে। খেয়ে সাবাড় করছে ধানক্ষেত। ফলে পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলো হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বন্যহাতির সমস্যা স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সীমন্তবাসী।

আদিবাসী নেতা শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, গ্রামবাসীরা হাতির উপদ্রপ থেকে বাঁচতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। তবে এখনও স্থায়ী কোন সমাধান হয়নি। এজন্য দিনদিন বন্যহাতির তাণ্ডবে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।

বন বিভাগের স্থানীয় রেঞ্জার রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছি, যেন হাতির কেউ ক্ষতি করতে না পারে। হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে নিয়ম অনুযায়ী সহায়তা প্রদান করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বন্যহাতির হামলায় নিহত, আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছি। এছাড়াও স্থায়ীভাবে বন্যহাতির কবল থেকে রক্ষা পেতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

শ্রীবরদী উপজেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. কোহিনুর হোসেন জানান, একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির আক্রমণ চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শত শত। ক্ষতি হয়েছে বিস্তীর্ণ আবাদি জমির ফসল।

গত ৯ নভেম্বর শেরপুরের শেরপুর বন বিভাগের কর্মকর্তারা স্থানীয় শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ি বনাঞ্চল বালিঝুড়ি রেঞ্জের মালাকোচা এলাকায় একটি বন্যহাতির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। কয়েক দিন ধরেই সীমান্তে ব্যাপক হাতির উপদ্রপ বেড়েছে। প্রতক্ষদর্শীরা জানায়, হাতিটি আনুমানিক রাত তিনটার দিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশ করে সবজির বাগান ধ্বংস করছিল। বন বিভাগের ধারণা সবজির বাগান রক্ষায় বাগানের চারদিক বিদ্যুতায়িত করা তারে বৈদুতিক শকে হাতিটি মারা যেতে পারে। মৃত ওই পুরুষ হাতিটির বয়স ২৫/৩০ বছর হতে পারে।

বালিঝুড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) ওই মৃত হাতি উদ্ধার করা হয়েছে। বাগান রক্ষার জন্য স্থাপিত বৈদ্যুতিক জিআই তারে জড়িয়ে হাতি মারা যেতে পারে। হাতির মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হবে এবং মৃত্যুর আসল ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১ , ২৭ কার্তিক ১৪২৮ ৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

শেরপুর সীমান্তে বন্যহাতির তাণ্ডবে কৃষকরা অতিষ্ঠ

বাকী বিল্লাহ, ঢাকা, শরিফুর রহমান, শেরপুর

image

শেরপুর সীমান্তে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বন্যহাতির তাণ্ডবে কৃষকরা অতিষ্ঠ। শত শত একর জমির পাকা ধান, সব্জি ক্ষেত ও মৌসুমি ফসল নিয়ে বিপাকে স্থানীয় কৃষকরা। তারা সীমান্ত থেকে আসা হাতির পাল থেকে ফসল ও নিজেদের রক্ষা করতে রাত জেগে মশাল জ্বালিয়ে ও ঘণ্টা বাজিয়ে পালাক্রমে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন। এরপরও তাণ্ডব ঠেকানো যাচ্ছে না।

কৃষকরা কোন উপায় না পেয়ে ফসল রক্ষায় ও নিজেদের বাঁচতে সীমান্তে বৈদ্যুতিক তার লাগিয়ে আলো দিয়ে হাতি থেকে রক্ষার কৌশলগত চেষ্টা করছেন। কিন্তু বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে সম্প্রতি একটি হাতি মারা গেছে।

অপর দিকে স্থানীয়দের মতে, গত ২৫ বছরে শেরপুর সীমান্তে বন্যহাতির আক্রমণে কৃষকসহ নানা বয়সের ৭০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ১শ’র বেশি মানুষ।

সরেজমিনে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৫ দিন ধরে বন্যহাতির তাণ্ডবে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের গ্রামগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাহাড়ের গ্রামীণ জীবন। হাতি সারাদিন পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে থাকে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে পাহাড় থেকে দলে দলে ধান ক্ষেতে নেমে তাণ্ডব চালাচ্ছে বন্যহাতির দল। এছাড়া বন্যহাতির তাণ্ডবে সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রতিবছরই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত একর জমির পাকা ধান, সবজি ক্ষেত ও মৌসুমি ফসল। লণ্ডভণ্ড হচ্ছে ঘরবাড়ি। তছনছ করছে বন বাগানের বিপুল পরিমাণে গাছপালা। পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করছে বিস্তৃর্ণ আবাদী জমির ফসল। এলাকার লোকজন রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছে নিজেদের ফসল বাঁচানোর জন্য। প্রতিনিয়ত হাতির আক্রমণে তাদের জীবন এখন হুমকির মুখে।

স্থানীয় নেয়াবাড়ির টিলা ও পার্শ্ববর্তী মালাকোচা গ্রামের কৃষক লাল চান, রহুল আমীন, মজনু মিয়া, আলাল মিয়া, আবদুর বারিক, সাদা মিয়া, মনিরুল ইসলামসহ গারো পাহাড়ের অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, হাতির আক্রমণে আমাদের ধান ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে কাঁচা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে গেছি। এছাড়াও অসংখ্য কৃষকের সবজি ক্ষেত নষ্ট করে ফেলেছে।

জানা গেছে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত জনপদ শ্রীবরদীর রাজার পাহাড়, নেওয়াবাড়ি টিলা, ঝোঁলগাঁও, বালিজুড়ি, কোচপাড়া, রাঙ্গাজান, কাড়ামারা, কর্ণজোড়া, বাবলাকোনা, হারিয়েকোনা, পাঁচমেঘাদল, গারোপাড়াসহ ১২-১৫টি গ্রামে বাঙালি ও হিন্দু গারো, কোচ হাজংসহ বিভিন্ন গোত্র মিলে প্রায় ২০-৩০ হাজার মানুষ বসবাস করছে।

ওই সব এলাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখণ্ডে রয়েছে বিশাল বনভূমি। বাংলাদেশের বনাঞ্চল অপেক্ষাকৃত সমতল। ভারতের গহীন বনাঞ্চলে রয়েছে অগণিত বুনো হাতি। হাতি দল বেঁধে সমতল ভূমিতে চলাফেরা ও আহার করতে সহজ মনে করে থাকে। তাই সময় অসময়ে বুনো হাতির পাল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওইসব সমতল বনাঞ্চলের আবাসিক ও কৃষিপ্রধান এলাকায় চলে আসে। পাহাড়ে বসবাসরত বাড়িঘর, ফসলাদি জমি ও বিভিন্ন বাগানে বন্যহাতি ঢুকে ধ্বংসলীলা চালায়। আবার ফিরেও যায় হাতির পাল।

গত ২০-২৫ বছর ধরে এসব বুনোহাতি তাণ্ডবলীলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কয়েকশ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার একর জমির ধান শাক-সবজি ফসল খেয়ে এবং বাগানের গাছপালা দুমড়ে মুচড়ে সাবাড় করে চলেছে। বুনোহাতির আক্রমণে এ পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বালিজুরি গ্রামের হামির উদ্দিন, বাবুল মিয়া, খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের স্টারসন, ঝুলগাঁও গ্রামের মজিবর, সিরাজ, হাতিবর গ্রামের বৃন্দাবন দাস, মাখনেরচর গ্রামের হাসান হাবিব বাঘারচর গ্রামের আবু তালেবসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কয়েকশত মানুষ আহত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন পঙ্গুত্ব বরণ করে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে।

ঝুলগাঁও গ্রামের আবদুর রাজ্জাক, শাহজাহান, বালিজুড়ি গ্রামের আমিনুল, খাড়ামোড়া গ্রামের রফিকুল মিয়াসহ অনেকে জানায়, বুনোহাতি ঢাকঢোল ফটকা ও আগুনকে ভয় করে থাকে। তাই এলাকাবাসী মশাল ও বন থেকে কুড়িয়ে আনা আবর্জনা জ্বালিয়ে, হৈ হুল্লোড় করে বাঁশ দিয়ে ফটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানো চেষ্টা করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ওইসব কৌশলও করতে পারছে না পাহাড়িরা। ফলে হাতির পাল বিনা প্রতিরোধে গ্রামে প্রবেশ করে জানমালের ক্ষতিসাধন করে থাকে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সীমন্তবর্তী পাহাড়ি এলাকার মানুষ পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে এবং পাহাড়ের পাদদেশে চাষাবাদ করে কোনরকম জীবিকা নির্বাহ করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গী। এর ওপর প্রায় বন্যহাতির আক্রমণে দিশেহারা করে দিয়েছে তাদের। হাতির আতঙ্কে এমনিতেই অনেক জমি পতিত থাকছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবাদ করলেও সে ফসল ঘরে তুলতে পারছে না অনেকেই।

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে দলবেধে নেমে আসছে ধান ক্ষেতের জমিতে। খেয়ে সাবাড় করছে ধানক্ষেত। ফলে পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলো হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বন্যহাতির সমস্যা স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সীমন্তবাসী।

আদিবাসী নেতা শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, গ্রামবাসীরা হাতির উপদ্রপ থেকে বাঁচতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। তবে এখনও স্থায়ী কোন সমাধান হয়নি। এজন্য দিনদিন বন্যহাতির তাণ্ডবে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।

বন বিভাগের স্থানীয় রেঞ্জার রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছি, যেন হাতির কেউ ক্ষতি করতে না পারে। হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে নিয়ম অনুযায়ী সহায়তা প্রদান করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বন্যহাতির হামলায় নিহত, আহত, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছি। এছাড়াও স্থায়ীভাবে বন্যহাতির কবল থেকে রক্ষা পেতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

শ্রীবরদী উপজেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. কোহিনুর হোসেন জানান, একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির আক্রমণ চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শত শত। ক্ষতি হয়েছে বিস্তীর্ণ আবাদি জমির ফসল।

গত ৯ নভেম্বর শেরপুরের শেরপুর বন বিভাগের কর্মকর্তারা স্থানীয় শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ি বনাঞ্চল বালিঝুড়ি রেঞ্জের মালাকোচা এলাকায় একটি বন্যহাতির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। কয়েক দিন ধরেই সীমান্তে ব্যাপক হাতির উপদ্রপ বেড়েছে। প্রতক্ষদর্শীরা জানায়, হাতিটি আনুমানিক রাত তিনটার দিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশ করে সবজির বাগান ধ্বংস করছিল। বন বিভাগের ধারণা সবজির বাগান রক্ষায় বাগানের চারদিক বিদ্যুতায়িত করা তারে বৈদুতিক শকে হাতিটি মারা যেতে পারে। মৃত ওই পুরুষ হাতিটির বয়স ২৫/৩০ বছর হতে পারে।

বালিঝুড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) ওই মৃত হাতি উদ্ধার করা হয়েছে। বাগান রক্ষার জন্য স্থাপিত বৈদ্যুতিক জিআই তারে জড়িয়ে হাতি মারা যেতে পারে। হাতির মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হবে এবং মৃত্যুর আসল ঘটনা জানার চেষ্টা চলছে।