টি-২০ বিশ্বকাপের সপ্তম আসরের প্রথম সেমিফাইনালে জিমি নিশাম যখন ১১ বলে ২৭ রানের ঝড় তুলে সাজঘরে ফিরছিলেন, তখন কি তার মনে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে সুপার ওভারের শেষ বলটার কথা মনে হচ্ছিল? উত্তর কেউ জানে না, নিশাম নিজেও তা বলেননি। তবে, ইতিহাস বলছে যে, ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীর পক্ষে। টি-২০ বিশ্বকাপের সপ্তম আসরের প্রথম সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের বিজয়টা এখন ইতিহাস। এই ইতিহাস হয়তো কালান্তরে পরিণত হবে রূপকথায়। সে যাই হোক, ২০১৫ সালের ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়ের পর ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে হাত ফসকে যাওয়া শিরোপার দুঃখ কিউইদের বর্তমান প্রজন্মকে অনেকদিন পোড়াবে। দুটো ফাইনালের কষ্টের রেকর্ড সামনে আসার সময়টাতে মরুভূমির বুকে পাওয়া এই জয়টা নিঃসন্দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে।
টস জিতে ইংলিশদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর পর নিউজিল্যান্ড যখন ১৬৭ রানের জয়ের টার্গেট পায়, তখন উপভোগ্য ম্যাচের আভাসই পাওয়া গিয়েছিল। আবার চাপের মুখে রান চেজ করতে গিয়ে ব্যাটিং অর্ডারে ধস নেমে ম্যাচটা একপেশে হয়ে যাবার শঙ্কাও ছিল। সেই শঙ্কাকেই সত্যি পরিণত করতেই যেন ১৩ রানে পতন ঘটে দুটো উইকেটের। পরেরটা ইতিহাস।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তোলা কিউইদেরকে নক-আউট পর্বে কখনোই হাল্কাভাবে দেখা উচিত নয়। ব্ল্যাক ক্যাপসরা শেষ পর্যন্ত লেগে থাকে। ঠিক যেমনভাবে সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুটা কিছুতেই তার মায়ের পা ছাড়তে চায় না, অনেকটা তেমনই স্বভাব কিউইদের। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালে লর্ডসে ভারতকে ঠিক একইভাবে পরাজিত করেছিল তাসমান সাগরপাড়ের ক্রিকেটাররা। কাগজে কলমে চলতি টি-২০ বিশ্বকাপের শিরোপার দাবীদার হয়ে আসরে আসা ইংলিশদেরকেও ঠিক একইভাবে বিদায় করেছে নিউজিল্যান্ড।
প্রথমত : ছক্কা হাঁকাতে সিদ্ধহস্ত ইংলিশ ব্যাটাররা সেভাবে হাত খুলতে পারেননি। ট্রেন্ট বোল্ট ছাড়া বাকি বোলাররা তেমন রানও দেননি। জিমি নিশামের করা ডেথ ওভার বোলিং ছিলো দুর্দান্ত।
কিন্তু ইংলিশরা যেমন হাত খুলতে পারেননি, ঠিক তেমনি শুরু থেকেই চাপের মধ্যে ছিলেন কিউই ব্যাটাররাও। শেষ চার ওভারে জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৫৭ রান। যা কি না, গত বুধবার পর্যন্ত টি-২০ ফরম্যাটে কোন দলই করতে পারেনি। নিউজিল্যান্ডের পক্ষেও তা অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। কেননা, এই পিচে ইংলিশ ব্যাটাররা যেমন চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে পারেননি, তেমনি ১৬তম ওভার পর্যন্ত মনেই হয়নি যে নিউজিল্যান্ড জয় পেতে যাচ্ছে। সেই সময়ে নিশাম হয়তো ভাবছিলেন ডেথ ওভারে ইংলিশ বোলিংয়ের দুর্বলতার বিষয়টা। একপ্রান্ত ধরে রেখে ৪৭ বলে ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলের জয় নিয়ে ড্যারিল মিচেল মাঠ ছাড়লেও ক্রিস জর্ডানের করা ১৭তম ওভারে নিশামের বেধড়ক পিটুনিতে ওঠা ২৩ রানই আসলে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।
পরের ওভারের শেষ বলে নিশাম যখন আউট হয়ে ফিরছেন, নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন নেমে এসেছে ২ ওভারে ২০ রানে। নিশামের ১১ বলে ২৭ রানের ইনিংসে ৩টি ছক্কাতে শুধু বলই সীমানার বাইরে আঁচড়ে পড়েনি, ইংল্যান্ডও উড়ে গেছে ম্যাচ থেকে। অথচ এই উইকেটেই বল ঠিকমতো ব্যাটে আসছিল না।
ক্রিস ওকসের পর আদিল রশীদ যেভাবে হাফ ভলি দিচ্ছিলেন, তাতে ড্যারিল মিচেলও ততক্ষণে সীমানার বাইরে বল পাঠানো ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। ১৯তম ওভারে ক্রিস ওকসকে মিচেল যে ছক্কাটা হাঁকিয়েছিলেন, তা আবুধাবীর রাতের আকাশে উজ্জ্বল আলোয় অনেকটা সময় উড়ে উড়ে ইংল্যান্ডের বিদায়ের খবর জানিয়ে মাটিতে পড়েছিল। শেষ তিন ওভারেই নিউজিল্যান্ড তুলে নেয় ৫৭ রান- এটাকে বিধ্বংসী ব্যাটিং না বলে ব্যাটারদের নৃশংসতা বলাটাই যথাযথ।
নিশাম-মিচেলের নৃশংসতায় যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ডেভন কনওয়ের নাম। মিচেল-কনওয়ে যুগলবন্দীই তো চতুর্দশ ওভার পর্যন্ত উইকেটে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে ইংলিশ বোলারদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরানোর কাজটা করেছিলেন। কনওয়ের পর গ্লেন ফিলিপসকে চটজলদি তুলে নিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটাররা যখন জয় দেখতে শুরু করেছিলেন, সেই সুযোগেই ম্যাচটা নিজেদের দিকে টেনে নেয় নিউজিল্যান্ড। নিয়েছিলেন। মিচেল-কনওয়ে ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারলে সুযোগ আসতেও পারে। কিউইরা সেই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। পরাজয়ের পর ইংলিশ অধিনায়ক এউইন মরগান স্বীকার করেছেন যে, কিউইরা নাকি সব সময়ই ইংল্যান্ডকে চাপে রেখেছিল। তিনি বলেছেন, কিউইরা সুযোগের অপেক্ষা করেছে, আর সুযোগ পাওয়ামাত্রই আক্রমণ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি।
২০১৯ সালের ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে বাউন্ডারির গোলমেলে হিসাব আর দুই আম্পায়ারে ছক্কা-পাঁচ রানের গন্ডগোলে নিউজিল্যান্ডের শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার প্রতিশোধের কথা বারবার বলা হচ্ছে এই সেমিফাইনালের ফলাফলের পর। কিন্তু, আসল সত্যিটা হলো, কিউইরা এখন তিন ফরম্যাটেই ধারাবাহিকভাবেই ভালো খেলছে। ধৈর্যশীল অথচ আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের সঙ্গে হিসাবের এমন মিশেল দিয়ে পাওয়া এই জয়ের গল্পটা হয়তো রূপকথার মতোই শোনা যাবে তাসমান সাগরপাড়ে।
শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১ , ২৭ কার্তিক ১৪২৮ ৬ রবিউস সানি ১৪৪৩
বিশেষ প্রতিনিধি
টি-২০ বিশ্বকাপের সপ্তম আসরের প্রথম সেমিফাইনালে জিমি নিশাম যখন ১১ বলে ২৭ রানের ঝড় তুলে সাজঘরে ফিরছিলেন, তখন কি তার মনে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে সুপার ওভারের শেষ বলটার কথা মনে হচ্ছিল? উত্তর কেউ জানে না, নিশাম নিজেও তা বলেননি। তবে, ইতিহাস বলছে যে, ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীর পক্ষে। টি-২০ বিশ্বকাপের সপ্তম আসরের প্রথম সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের বিজয়টা এখন ইতিহাস। এই ইতিহাস হয়তো কালান্তরে পরিণত হবে রূপকথায়। সে যাই হোক, ২০১৫ সালের ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজয়ের পর ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে হাত ফসকে যাওয়া শিরোপার দুঃখ কিউইদের বর্তমান প্রজন্মকে অনেকদিন পোড়াবে। দুটো ফাইনালের কষ্টের রেকর্ড সামনে আসার সময়টাতে মরুভূমির বুকে পাওয়া এই জয়টা নিঃসন্দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে।
টস জিতে ইংলিশদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর পর নিউজিল্যান্ড যখন ১৬৭ রানের জয়ের টার্গেট পায়, তখন উপভোগ্য ম্যাচের আভাসই পাওয়া গিয়েছিল। আবার চাপের মুখে রান চেজ করতে গিয়ে ব্যাটিং অর্ডারে ধস নেমে ম্যাচটা একপেশে হয়ে যাবার শঙ্কাও ছিল। সেই শঙ্কাকেই সত্যি পরিণত করতেই যেন ১৩ রানে পতন ঘটে দুটো উইকেটের। পরেরটা ইতিহাস।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তোলা কিউইদেরকে নক-আউট পর্বে কখনোই হাল্কাভাবে দেখা উচিত নয়। ব্ল্যাক ক্যাপসরা শেষ পর্যন্ত লেগে থাকে। ঠিক যেমনভাবে সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুটা কিছুতেই তার মায়ের পা ছাড়তে চায় না, অনেকটা তেমনই স্বভাব কিউইদের। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালে লর্ডসে ভারতকে ঠিক একইভাবে পরাজিত করেছিল তাসমান সাগরপাড়ের ক্রিকেটাররা। কাগজে কলমে চলতি টি-২০ বিশ্বকাপের শিরোপার দাবীদার হয়ে আসরে আসা ইংলিশদেরকেও ঠিক একইভাবে বিদায় করেছে নিউজিল্যান্ড।
প্রথমত : ছক্কা হাঁকাতে সিদ্ধহস্ত ইংলিশ ব্যাটাররা সেভাবে হাত খুলতে পারেননি। ট্রেন্ট বোল্ট ছাড়া বাকি বোলাররা তেমন রানও দেননি। জিমি নিশামের করা ডেথ ওভার বোলিং ছিলো দুর্দান্ত।
কিন্তু ইংলিশরা যেমন হাত খুলতে পারেননি, ঠিক তেমনি শুরু থেকেই চাপের মধ্যে ছিলেন কিউই ব্যাটাররাও। শেষ চার ওভারে জয়ের জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ৫৭ রান। যা কি না, গত বুধবার পর্যন্ত টি-২০ ফরম্যাটে কোন দলই করতে পারেনি। নিউজিল্যান্ডের পক্ষেও তা অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। কেননা, এই পিচে ইংলিশ ব্যাটাররা যেমন চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে পারেননি, তেমনি ১৬তম ওভার পর্যন্ত মনেই হয়নি যে নিউজিল্যান্ড জয় পেতে যাচ্ছে। সেই সময়ে নিশাম হয়তো ভাবছিলেন ডেথ ওভারে ইংলিশ বোলিংয়ের দুর্বলতার বিষয়টা। একপ্রান্ত ধরে রেখে ৪৭ বলে ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলের জয় নিয়ে ড্যারিল মিচেল মাঠ ছাড়লেও ক্রিস জর্ডানের করা ১৭তম ওভারে নিশামের বেধড়ক পিটুনিতে ওঠা ২৩ রানই আসলে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।
পরের ওভারের শেষ বলে নিশাম যখন আউট হয়ে ফিরছেন, নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন নেমে এসেছে ২ ওভারে ২০ রানে। নিশামের ১১ বলে ২৭ রানের ইনিংসে ৩টি ছক্কাতে শুধু বলই সীমানার বাইরে আঁচড়ে পড়েনি, ইংল্যান্ডও উড়ে গেছে ম্যাচ থেকে। অথচ এই উইকেটেই বল ঠিকমতো ব্যাটে আসছিল না।
ক্রিস ওকসের পর আদিল রশীদ যেভাবে হাফ ভলি দিচ্ছিলেন, তাতে ড্যারিল মিচেলও ততক্ষণে সীমানার বাইরে বল পাঠানো ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। ১৯তম ওভারে ক্রিস ওকসকে মিচেল যে ছক্কাটা হাঁকিয়েছিলেন, তা আবুধাবীর রাতের আকাশে উজ্জ্বল আলোয় অনেকটা সময় উড়ে উড়ে ইংল্যান্ডের বিদায়ের খবর জানিয়ে মাটিতে পড়েছিল। শেষ তিন ওভারেই নিউজিল্যান্ড তুলে নেয় ৫৭ রান- এটাকে বিধ্বংসী ব্যাটিং না বলে ব্যাটারদের নৃশংসতা বলাটাই যথাযথ।
নিশাম-মিচেলের নৃশংসতায় যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ডেভন কনওয়ের নাম। মিচেল-কনওয়ে যুগলবন্দীই তো চতুর্দশ ওভার পর্যন্ত উইকেটে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে ইংলিশ বোলারদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরানোর কাজটা করেছিলেন। কনওয়ের পর গ্লেন ফিলিপসকে চটজলদি তুলে নিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটাররা যখন জয় দেখতে শুরু করেছিলেন, সেই সুযোগেই ম্যাচটা নিজেদের দিকে টেনে নেয় নিউজিল্যান্ড। নিয়েছিলেন। মিচেল-কনওয়ে ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারলে সুযোগ আসতেও পারে। কিউইরা সেই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। পরাজয়ের পর ইংলিশ অধিনায়ক এউইন মরগান স্বীকার করেছেন যে, কিউইরা নাকি সব সময়ই ইংল্যান্ডকে চাপে রেখেছিল। তিনি বলেছেন, কিউইরা সুযোগের অপেক্ষা করেছে, আর সুযোগ পাওয়ামাত্রই আক্রমণ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি।
২০১৯ সালের ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে বাউন্ডারির গোলমেলে হিসাব আর দুই আম্পায়ারে ছক্কা-পাঁচ রানের গন্ডগোলে নিউজিল্যান্ডের শিরোপা হাতছাড়া হওয়ার প্রতিশোধের কথা বারবার বলা হচ্ছে এই সেমিফাইনালের ফলাফলের পর। কিন্তু, আসল সত্যিটা হলো, কিউইরা এখন তিন ফরম্যাটেই ধারাবাহিকভাবেই ভালো খেলছে। ধৈর্যশীল অথচ আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের সঙ্গে হিসাবের এমন মিশেল দিয়ে পাওয়া এই জয়ের গল্পটা হয়তো রূপকথার মতোই শোনা যাবে তাসমান সাগরপাড়ে।