মতিউর রহমান
সাম্প্রতিক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দিয়ে শুরু করি। যার কয়েকটি সুখবর ও বেশিরভাগই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জাগানো খারাপ খবর। দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারীর প্রকোপ আমাদের দেশে কিছুটা কমে এসেছে। দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুহার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। অন্তত সরকারি পরিসংখ্যান তাই বলে। বিশ^ব্যাপীও এ ভাইরাস এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে আমেরিকা, রাশিয়া ও ইউরোপে সংক্রমণ হার বেড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর হারও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব দেশে সব জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের দ্রুত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে ২০২২ সালের মধ্যে বিশে^ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আাসবে। এটা একটা সুখবর।
এ মুহূর্তে বিশে^ সবচেয়ে বড় যে ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা হলো জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) অধীনে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস (সিওপি২৬)। যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে এ সম্মেলনটি গত ১ নভেম্বরে শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে ১২ নভেম্বর। জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত সিওপির প্রথম সম্মেলন অর্থাৎ সিওপি-১ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। আজ থেকে ২৭ বছর আগে। এ ২৭ বছরে পৃথিবী নামক গ্রহটির জলবায়ু প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং এজন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী বলে প্রমাণ, জোর যুক্তি ও দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এবার হচ্ছে ২৬তম সম্মেলন। সারাবিশে^র ছোট-বড়, গরিব ও ধনী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা (১২০টি) এখানে একত্রিত হয়েছেন। সেইসাথে আছেন বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, পরিবেশকর্মী এবং সংবাদকর্মী। সাধারণ মানুষ ও তরুণ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য।
বিশে^ যত ধরনের গণমাধ্যম আছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই উপস্থিত হয়েছেন ওই সম্মেলনের খবর কভার করতে এবং খুবই গুরুত্বসহকারে তা প্রচার করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ২০১৯ সালের শেষে শুরু হওয়া ও অদ্যাবধি চলমান করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলনটি খুবই তাৎপর্যবাহী। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির যে বারোটা বাজার পথে তা এখন সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন করোনাভাইরাসের মতো মহামারীর আবির্ভাব থেকে। জাতিসংঘ মহাসচিব মি. অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আমরাই নিজেদের কবর খুঁড়ছি এবং প্রকৃতিকে একটা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছি।’ কাজেই প্রকৃতিকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ও এই গ্রহটিকে বাঁচিয়ে রাখা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করা সবারই জন্য একান্ত বাধ্যবাধকতা হয়ে দেখা দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম বিশ^নেতাদের প্রতি এ সম্মেলনে অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে তাদের দাবি তুলে ধরছেন।
সুতরাং এ বিষয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা, সংলাপ, তর্ক-বিতর্ক, পরামর্শ, ভূমিকা, করণীয়, পরিকল্পনা, দেন-দরবার, ক্ষতিপূরণ ও অর্থায়ন নিয়ে নিয়ে গভীর বিচার-বিশ্লেষণ। অত্যন্ত আনন্দের কথা এ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সক্রিয় এবং এ সম্মেলনে যে পাঁচজন বিশ^নেতা জলবায়ু ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তাদের মধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম। বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সেসব দেশের সমন্বয়ে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ফোরামের কণ্ঠস্বর। তিনি দুর্গত মানুষের কণ্ঠস্বর। এটা আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত সুখবর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। নতুন হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে আরও ৩২৭ ডলার। ২০১৫-২০১৬ ভিত্তিবছর ধরে এখন থেকে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, মাথাপিছু আয় গণনা করা শুরু হয়েছে। এতদিন ২০০৫-২০০৬ ভিত্তিবছর ধরে এসব গণনা করা হতো। নতুন ভিত্তিবছরের হিসাবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা। মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিটেন্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়। এদিকে গতবারের মতো এবারও মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত অক্টোবরে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ ডলার। আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। এটা একটা সুখবর হিসেবে ধরে নেয়া যেতেই পারে।
গত কয়েক দিন যাবত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ প্রচুর চাপের মধ্যে পড়েছেন। আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসেব মেলাতে না পারায় তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বাজার করতে যাওয়া মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই তা বোঝা যাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছেÑ বিশ^বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশেও তার প্রভাব পড়েছে। তবে সাধারণ মানুষ এ তথ্যে খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছেন না। এটা একটা খারাপ খবর। সুতরাং সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতে এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে গত বুধবার (৩ নভেম্বর) মধ্যরাত থেকে ডিজেল-কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ডিজেল-কেরোসিন বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে প্রতি লিটার ৮০ টাকা করে। বেড়েছে এলপিজি গ্যাসের দামও। হঠাৎ করে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় ভাড়া সমন্বয় বা বাড়ানোর দাবিতে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয় পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ চলাচলও। এতে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। বিপাকে পড়েছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গমনকারী যাত্রী, অফিসগামী ও পরীক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে বাংলাদেশ সড়ক পরিহন কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনা করে সকল প্রকার পরিবহনে যাতায়াত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছেÑ বিশ^বাজারের সাথে সমন্বয়, লোকসান কমানো এবং পাচার রোধ করতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তবে সাধারণ মানুষ এতে আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। এটাও একটা খারাপ খবর। কাজেই সরকারিভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।
করোনাকালীন গত ছয় মাসে আরও ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এই নতুন দরিদ্র্রের সংখ্যা যোগ করে দেশে মোট দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। এ বছর এপ্রিল মাস থেকে দেয়া করোনা বিধিনিষেধের পর দরিদ্রের এ সংখ্যা বেড়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য সরকারিভাবে এই পরিসংখ্যান কখনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ, সরকারের নিজস্ব গবেষণা বিভাগ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ বিষয়ে গবেষণা করে ফলাফল দিলে তবেই তা গ্রহণযোগ্য হবে। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণে আমরা ঘরে-বাইরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখতে পাই। এটা খারাপ খবর বৈকি।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই)-২০২১’। প্রতিবেদন মতে, গত দেড় বছর ধরে করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্তের হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশে সরকারিভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান-সংস্থার গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দারিদ্র্য হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। নিঃসন্দেহে এটি খারাপ খবর। এসব দরিদ্র মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা। সুতরাং বিশেষজ্ঞরা করোনা মহামারী পরবর্তী যে ক্ষুধা মহামারীর আশঙ্কা উল্লেখ করেছিলেন সেটি কি সত্য হতে যাচ্ছে?
[লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা]
শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১ , ২৭ কার্তিক ১৪২৮ ৬ রবিউস সানি ১৪৪৩
মতিউর রহমান
সাম্প্রতিক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দিয়ে শুরু করি। যার কয়েকটি সুখবর ও বেশিরভাগই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জাগানো খারাপ খবর। দীর্ঘ প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারীর প্রকোপ আমাদের দেশে কিছুটা কমে এসেছে। দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুহার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। অন্তত সরকারি পরিসংখ্যান তাই বলে। বিশ^ব্যাপীও এ ভাইরাস এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে আমেরিকা, রাশিয়া ও ইউরোপে সংক্রমণ হার বেড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর হারও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব দেশে সব জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের দ্রুত প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে ২০২২ সালের মধ্যে বিশে^ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আাসবে। এটা একটা সুখবর।
এ মুহূর্তে বিশে^ সবচেয়ে বড় যে ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা হলো জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) অধীনে কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস (সিওপি২৬)। যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে এ সম্মেলনটি গত ১ নভেম্বরে শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে ১২ নভেম্বর। জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত সিওপির প্রথম সম্মেলন অর্থাৎ সিওপি-১ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। আজ থেকে ২৭ বছর আগে। এ ২৭ বছরে পৃথিবী নামক গ্রহটির জলবায়ু প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং এজন্য উন্নত দেশগুলো দায়ী বলে প্রমাণ, জোর যুক্তি ও দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এবার হচ্ছে ২৬তম সম্মেলন। সারাবিশে^র ছোট-বড়, গরিব ও ধনী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা (১২০টি) এখানে একত্রিত হয়েছেন। সেইসাথে আছেন বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, পরিবেশকর্মী এবং সংবাদকর্মী। সাধারণ মানুষ ও তরুণ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য।
বিশে^ যত ধরনের গণমাধ্যম আছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই উপস্থিত হয়েছেন ওই সম্মেলনের খবর কভার করতে এবং খুবই গুরুত্বসহকারে তা প্রচার করা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ২০১৯ সালের শেষে শুরু হওয়া ও অদ্যাবধি চলমান করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলনটি খুবই তাৎপর্যবাহী। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির যে বারোটা বাজার পথে তা এখন সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন করোনাভাইরাসের মতো মহামারীর আবির্ভাব থেকে। জাতিসংঘ মহাসচিব মি. অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘আমরাই নিজেদের কবর খুঁড়ছি এবং প্রকৃতিকে একটা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করছি।’ কাজেই প্রকৃতিকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ও এই গ্রহটিকে বাঁচিয়ে রাখা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করা সবারই জন্য একান্ত বাধ্যবাধকতা হয়ে দেখা দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম বিশ^নেতাদের প্রতি এ সম্মেলনে অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে তাদের দাবি তুলে ধরছেন।
সুতরাং এ বিষয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা, সংলাপ, তর্ক-বিতর্ক, পরামর্শ, ভূমিকা, করণীয়, পরিকল্পনা, দেন-দরবার, ক্ষতিপূরণ ও অর্থায়ন নিয়ে নিয়ে গভীর বিচার-বিশ্লেষণ। অত্যন্ত আনন্দের কথা এ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সক্রিয় এবং এ সম্মেলনে যে পাঁচজন বিশ^নেতা জলবায়ু ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তাদের মধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম। বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সেসব দেশের সমন্বয়ে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ফোরামের কণ্ঠস্বর। তিনি দুর্গত মানুষের কণ্ঠস্বর। এটা আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত সুখবর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। নতুন হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে আরও ৩২৭ ডলার। ২০১৫-২০১৬ ভিত্তিবছর ধরে এখন থেকে জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, মাথাপিছু আয় গণনা করা শুরু হয়েছে। এতদিন ২০০৫-২০০৬ ভিত্তিবছর ধরে এসব গণনা করা হতো। নতুন ভিত্তিবছরের হিসাবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার। ডলারের বর্তমান বাজার অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে ২৯ হাজার ৪৩০ টাকা। মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি রেমিটেন্সসহ যত আয় হয়, তা দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়। এদিকে গতবারের মতো এবারও মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত অক্টোবরে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ ডলার। আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ ডলার। এটা একটা সুখবর হিসেবে ধরে নেয়া যেতেই পারে।
গত কয়েক দিন যাবত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ প্রচুর চাপের মধ্যে পড়েছেন। আয়ের সাথে ব্যয়ের হিসেব মেলাতে না পারায় তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বাজার করতে যাওয়া মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই তা বোঝা যাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছেÑ বিশ^বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশেও তার প্রভাব পড়েছে। তবে সাধারণ মানুষ এ তথ্যে খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছেন না। এটা একটা খারাপ খবর। সুতরাং সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতে এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে গত বুধবার (৩ নভেম্বর) মধ্যরাত থেকে ডিজেল-কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ডিজেল-কেরোসিন বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে প্রতি লিটার ৮০ টাকা করে। বেড়েছে এলপিজি গ্যাসের দামও। হঠাৎ করে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় ভাড়া সমন্বয় বা বাড়ানোর দাবিতে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয় পরিবহন মালিক কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হয়ে যায় লঞ্চ চলাচলও। এতে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। বিপাকে পড়েছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গমনকারী যাত্রী, অফিসগামী ও পরীক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে বাংলাদেশ সড়ক পরিহন কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনা করে সকল প্রকার পরিবহনে যাতায়াত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হচ্ছেÑ বিশ^বাজারের সাথে সমন্বয়, লোকসান কমানো এবং পাচার রোধ করতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তবে সাধারণ মানুষ এতে আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। এটাও একটা খারাপ খবর। কাজেই সরকারিভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হলে সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।
করোনাকালীন গত ছয় মাসে আরও ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এই নতুন দরিদ্র্রের সংখ্যা যোগ করে দেশে মোট দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। এ বছর এপ্রিল মাস থেকে দেয়া করোনা বিধিনিষেধের পর দরিদ্রের এ সংখ্যা বেড়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য সরকারিভাবে এই পরিসংখ্যান কখনই গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ, সরকারের নিজস্ব গবেষণা বিভাগ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ বিষয়ে গবেষণা করে ফলাফল দিলে তবেই তা গ্রহণযোগ্য হবে। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণে আমরা ঘরে-বাইরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখতে পাই। এটা খারাপ খবর বৈকি।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই)-২০২১’। প্রতিবেদন মতে, গত দেড় বছর ধরে করোনা মহামারীর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্তের হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশে সরকারিভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করা না হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান-সংস্থার গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে দারিদ্র্য হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। এ হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে। নিঃসন্দেহে এটি খারাপ খবর। এসব দরিদ্র মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা। সুতরাং বিশেষজ্ঞরা করোনা মহামারী পরবর্তী যে ক্ষুধা মহামারীর আশঙ্কা উল্লেখ করেছিলেন সেটি কি সত্য হতে যাচ্ছে?
[লেখক : গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা]