পাবলিক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া

মাছুম বিল্লাহ

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে ১৪ নভেম্বর এবং শেষ হবে ২৩ নভেম্বর। পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নেওয়ার আনন্দ আলাদা, যে আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা গত দুই বছর বঞ্চিত ছিল। সিলেবাস ছোট হোক আর বড় হোক তারা কিছু একটা করে সার্টিফিকেট পেতে যাচ্ছে; যার মূল্যই আলাদা। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শিখণ-শেখানো কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সমস্যা হচ্ছে শিখণ-শেখানো বিষয় নিয়ে আমরা যতটা না ব্যস্ত তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত মূল্যায়ন নিয়ে। এটি অবশ্য হওয়ারই কথা, কারণ একজন শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়ের কতটা জেনেছে তার একটা ডকুমেন্ট থাকা প্রয়োজন; যার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠানের বাইরে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণে, চাকরি পেতে এবং চাকরিতে প্রমোশন পেতে ওই কাগজটিই প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। তাই আমরা এ বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছি। যে কোন প্রকারেই হোকÑ সৎ উপায়ে হোক আর অসৎ উপায়েই হোক ওই কাগজটিতে একটি ভালো গ্রেডিং সবাই পাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ইদানীং ওই কাগজটি তার মূল্য অনেকটাই হারাতে বসেছে; কারণ কেউ একজন যদি বলে আমি এসএসসি ও এইচএসসি দুটো পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেয়েছি। তারপরও তাকে কিন্তু উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিতে হয়। ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে হলে তাকে বাজিয়ে দেখা হয়। এতগুলো কথা যেজন্য বলেছি তার দু’একটি উদ্দেশ্য আছে।

আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লেভেলের (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে যে বিষয়গুলো দেখলাম তাতে মূল্যায়ন নিয়ে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের বাংলা বই, ইংরেজি বই পড়তে দিয়েছি। একটি ক্লাসে এক-দুজন ছাড়া কেউই তাদের শ্রেণীর বাংলা কিংবা ইংরেজি বই ভালোভাবে পড়তে পারছে না। অনেকে যুক্তাক্ষর পড়তেই পারছে না। তাদের জিজ্ঞেস করেছিÑ বাংলাদেশের সুন্দরবন রাজশাহীতে না ঢাকায়? কেউ কেউ বলেছে ঢাকায়, কেউ বলেছে রাজশাহীতে। যখন জিজ্ঞেস করলাম ঢাকায় কোথায়, সাভার না গুলিস্তান? অনেকেই বলেছে, সাভার। আবার অন্য ক্লাসে যখন জিজ্ঞেস করেছিÑ সুন্দরবন কী খুলনায় না বরিশালে। কেউ কেউ বলেছে খুলনায়, কেউ বলেছে বরিশালে। তার মানে সঠিকভাবে কেউই জানে না।

তাদের বই থেকে জিজ্ঞেস করেছিÑ আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি/আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি এর ইংরেজি কী? ধরিয়ে দেওয়ার পর তারা বলতে পেরেছে। নিজে পারার পরে যখন জিজ্ঞেস করেছি আমার ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে/আমার বোন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে তখন আর কেউ পারছে না। তার অর্থ হচ্ছে তারা কিন্তু পঠিত কোন বিষয় নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারছে না অর্থাৎ বাস্তব জীবনে ব্যবহার করতে পারছে না। তাদের মেধা নেই এজন্য পারছে না, বিষয়টি তা নয়। শিক্ষকরা সেভাবে শেখাচ্ছেন না। শিক্ষকরা কেন সেভাবে শেখাচ্ছেন না, কারণ ওইভাবে পরীক্ষায় আসে না।

প্রশ্ন হচ্ছেÑ তাহলে কী ধরনের মূল্যায়নটা হচ্ছে। আমি যখন তাদের শিখিয়ে দিলাম যে, মাই ব্রাদার রিডস ইন ক্লাস সিক্স, কয়েকবার প্র্যাকটিস করার পর তারা পেরেছে। সাধারণ গণিতের ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করলামÑ তোমার কাছে ১২৫০ টাকা আছে। এই টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে একটি বই কিনেছো ২০০ টাকা দিয়ে, একটি ক্যালকুলেটর কিনেছো ২৫০ টাকা দিয়ে, একটি খাতা কিনেছো ৩০ টাকা দিয়ে। এখন কি তোমার কাছে টাকা থাকবে? কেউ বলেছে থাকবে, কেউ বলেছে থাকবে না। জিজ্ঞেস করলামÑ এটি বের করতে কি আমাদের গুণ করতে হবে না ভাগ করতে হবে? কেউ বলেছে গুণ করতে হবে, কেউ বলেছে ভাগ করতে হবে। বিয়োগের কথা প্রথম কেউই বলেনি। বললাম, খাতায় হিসাব করে দেখ। দেখলাম প্রতি ক্লাসে হয়তো একজন কোনরকম বের করেছে কিন্তু বিয়োগ নিয়মানুযায়ী করা হয়নি। সবাই ১২৫০ এর নিচে লিখেছে ২০০ টাকা, ২৫০ টাকা, ৩০ টাকা। এটি বের করার যে নিয়ম সেটিও তারা আয়ত্ত করতে পারেনি। লাভ-ক্ষতির কথা জিজ্ঞেস করেছি কখন লাভ হয়, কখন ক্ষতি হয়। বের করার উপায় কী? কেউ বলতে পারছে না। অর্থাৎ বেসিক ধারণা তাদের দেওয়া হচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণী ও দশম শ্রেণীতে জিজ্ঞেস করেছি আমাদের ক্লাসে ৫৮ জন শিক্ষার্থী আছেÑ এটি ইংরেজিতে কীভাবে বলা যায়। একটি শিক্ষার্থীও পারেনি।

কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যাবে ৯৮-৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালোভাবে পাস করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী মূল্যায়ন হচ্ছে। মূল্যায়ন বিষয়টি তো তার গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। যার বেসিক ধারণা আছে সেও নম্বর পাচ্ছে, যার কোন ধারণা নেই সেও নম্বর পাচ্ছে। এই নম্বর তো তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কথা বলছে না।

২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণী শেষে জেএসসি পরীক্ষা নেই। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো নেওয়া হচ্ছেÑ কোভিডের কারণে গতবার এবং এবার পরীক্ষা দুটো হচ্ছে না। নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো নেওয়া হচ্ছে কেন? পরীক্ষা না হলে, পরীক্ষার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না, পড়তে চায় না, অভিভাবকরাও পড়াশুনার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। তারা চান বাচ্চারা চাপে থাকুক। পরীক্ষা না হলে, পড়ার চাপ না থাকলে বেসরকারি পুস্তক প্রকাশকরা তাদের বই বিক্রি করতে পারেন না। শিক্ষকরাও খুব একটা আগ্রহ পান না। পরীক্ষায় যে কয়টি চ্যাপ্টার, যে কয়টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়, বারবার প্র্যাকটিস করানো হয়। পরীক্ষা না হলে এগুলো করানো হয় না। এটিও বাস্তব চিত্র। তাই সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো টিকিয়ে রেখেছিল। তার মানে পরীক্ষা নেওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু পঠিত বিষয় নিজে ব্যবহার করতে জানছে না কিংবা পারছে না, পরীক্ষা না হলে কোন কিছু পড়তে চায়না, এর সমাধান আসলে কী? শিক্ষার্থীদের আনন্দ দানের মাধ্যমে পড়াতে পারলে এবং পড়ানো বিষয় তারা নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারছে, বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট। শিক্ষক বিষয়টি টের পেলে বা জেনে গেলেই সেটি মূল্যায়ন। একটি শ্রেণীর কোন কোন শিক্ষার্থী নিজের বাক্যে, নিজের লেখায় তাদের পঠিত বিষয় ব্যবহার করতে পারছে। এটিই কিন্তু তাদের আসল মূল্যায়ন।

এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এতে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে নয়টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮০ জন। আর দুই বছর আগে এসব বোর্ডে নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬ জন। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭৬ জনের হদিস নেই। ১১টি বোর্ডের তথ্য যুক্ত হলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮১৪ জন।

রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো শিশুশ্রমে ভিড়ে গেছে কিংবা বিয়ে হয়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রীÑ এ খবর উদ্বেগজনক। এসব ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’

বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এত আলোচনা পর্যালোচনার পরও পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এর মূল কারণ দারিদ্র্য হলেও মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দরিদ্র ও অসহায় পিতামাতা মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে, বখাটেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য, রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পাওয়া উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের হাত থেকে, ইভটিজিংয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাল্যবিয়ের কুফলের কথা জেনেও অনুপযুক্ত পাত্রের হাতে মেয়েকে সমর্পণ করছেন। এ নিয়ে কোন সামাজিক সংগঠন কিংবা কোন বেসরকারি সংস্থা এলাকাভিত্তিক কিছু গবেষণা করে। তার ফল প্রকাশ ও কিছু প্রস্তাবনাও পেশ করে কিন্তু তাতে তো উঠতি বয়সী ছেলেদের বখাটেপনা কমে না। ভুক্তভোগী পিতার পাশে কেউ দাঁড়ায় না, বরং কোন দুর্ঘটনা ঘটলে মেয়ের ওপরই দোষ চাপানো হয়।

রাজনীতির যে দুষ্ট রাহু সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছেÑ এ থেকে উত্তরণের উপায় তো খুব সহজ নয়। তবে শিক্ষকদের হাল ছেড়ে দিলে হবে না।

[লেখক : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন]

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ২০২১ , ২৭ কার্তিক ১৪২৮ ৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

পাবলিক পরীক্ষা ও শিক্ষার্থী ঝরে পড়া

মাছুম বিল্লাহ

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে ১৪ নভেম্বর এবং শেষ হবে ২৩ নভেম্বর। পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নেওয়ার আনন্দ আলাদা, যে আনন্দ থেকে শিক্ষার্থীরা গত দুই বছর বঞ্চিত ছিল। সিলেবাস ছোট হোক আর বড় হোক তারা কিছু একটা করে সার্টিফিকেট পেতে যাচ্ছে; যার মূল্যই আলাদা। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শিখণ-শেখানো কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। সমস্যা হচ্ছে শিখণ-শেখানো বিষয় নিয়ে আমরা যতটা না ব্যস্ত তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত মূল্যায়ন নিয়ে। এটি অবশ্য হওয়ারই কথা, কারণ একজন শিক্ষার্থী তার পঠিত বিষয়ের কতটা জেনেছে তার একটা ডকুমেন্ট থাকা প্রয়োজন; যার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠানের বাইরে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণে, চাকরি পেতে এবং চাকরিতে প্রমোশন পেতে ওই কাগজটিই প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। তাই আমরা এ বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছি। যে কোন প্রকারেই হোকÑ সৎ উপায়ে হোক আর অসৎ উপায়েই হোক ওই কাগজটিতে একটি ভালো গ্রেডিং সবাই পাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ইদানীং ওই কাগজটি তার মূল্য অনেকটাই হারাতে বসেছে; কারণ কেউ একজন যদি বলে আমি এসএসসি ও এইচএসসি দুটো পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেয়েছি। তারপরও তাকে কিন্তু উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিতে হয়। ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে হলে তাকে বাজিয়ে দেখা হয়। এতগুলো কথা যেজন্য বলেছি তার দু’একটি উদ্দেশ্য আছে।

আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লেভেলের (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে যে বিষয়গুলো দেখলাম তাতে মূল্যায়ন নিয়ে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছে। আমি শিক্ষার্থীদের বাংলা বই, ইংরেজি বই পড়তে দিয়েছি। একটি ক্লাসে এক-দুজন ছাড়া কেউই তাদের শ্রেণীর বাংলা কিংবা ইংরেজি বই ভালোভাবে পড়তে পারছে না। অনেকে যুক্তাক্ষর পড়তেই পারছে না। তাদের জিজ্ঞেস করেছিÑ বাংলাদেশের সুন্দরবন রাজশাহীতে না ঢাকায়? কেউ কেউ বলেছে ঢাকায়, কেউ বলেছে রাজশাহীতে। যখন জিজ্ঞেস করলাম ঢাকায় কোথায়, সাভার না গুলিস্তান? অনেকেই বলেছে, সাভার। আবার অন্য ক্লাসে যখন জিজ্ঞেস করেছিÑ সুন্দরবন কী খুলনায় না বরিশালে। কেউ কেউ বলেছে খুলনায়, কেউ বলেছে বরিশালে। তার মানে সঠিকভাবে কেউই জানে না।

তাদের বই থেকে জিজ্ঞেস করেছিÑ আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি/আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি এর ইংরেজি কী? ধরিয়ে দেওয়ার পর তারা বলতে পেরেছে। নিজে পারার পরে যখন জিজ্ঞেস করেছি আমার ভাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে/আমার বোন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে তখন আর কেউ পারছে না। তার অর্থ হচ্ছে তারা কিন্তু পঠিত কোন বিষয় নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারছে না অর্থাৎ বাস্তব জীবনে ব্যবহার করতে পারছে না। তাদের মেধা নেই এজন্য পারছে না, বিষয়টি তা নয়। শিক্ষকরা সেভাবে শেখাচ্ছেন না। শিক্ষকরা কেন সেভাবে শেখাচ্ছেন না, কারণ ওইভাবে পরীক্ষায় আসে না।

প্রশ্ন হচ্ছেÑ তাহলে কী ধরনের মূল্যায়নটা হচ্ছে। আমি যখন তাদের শিখিয়ে দিলাম যে, মাই ব্রাদার রিডস ইন ক্লাস সিক্স, কয়েকবার প্র্যাকটিস করার পর তারা পেরেছে। সাধারণ গণিতের ক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করলামÑ তোমার কাছে ১২৫০ টাকা আছে। এই টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে একটি বই কিনেছো ২০০ টাকা দিয়ে, একটি ক্যালকুলেটর কিনেছো ২৫০ টাকা দিয়ে, একটি খাতা কিনেছো ৩০ টাকা দিয়ে। এখন কি তোমার কাছে টাকা থাকবে? কেউ বলেছে থাকবে, কেউ বলেছে থাকবে না। জিজ্ঞেস করলামÑ এটি বের করতে কি আমাদের গুণ করতে হবে না ভাগ করতে হবে? কেউ বলেছে গুণ করতে হবে, কেউ বলেছে ভাগ করতে হবে। বিয়োগের কথা প্রথম কেউই বলেনি। বললাম, খাতায় হিসাব করে দেখ। দেখলাম প্রতি ক্লাসে হয়তো একজন কোনরকম বের করেছে কিন্তু বিয়োগ নিয়মানুযায়ী করা হয়নি। সবাই ১২৫০ এর নিচে লিখেছে ২০০ টাকা, ২৫০ টাকা, ৩০ টাকা। এটি বের করার যে নিয়ম সেটিও তারা আয়ত্ত করতে পারেনি। লাভ-ক্ষতির কথা জিজ্ঞেস করেছি কখন লাভ হয়, কখন ক্ষতি হয়। বের করার উপায় কী? কেউ বলতে পারছে না। অর্থাৎ বেসিক ধারণা তাদের দেওয়া হচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণী ও দশম শ্রেণীতে জিজ্ঞেস করেছি আমাদের ক্লাসে ৫৮ জন শিক্ষার্থী আছেÑ এটি ইংরেজিতে কীভাবে বলা যায়। একটি শিক্ষার্থীও পারেনি।

কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় দেখা যাবে ৯৮-৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালোভাবে পাস করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী মূল্যায়ন হচ্ছে। মূল্যায়ন বিষয়টি তো তার গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। যার বেসিক ধারণা আছে সেও নম্বর পাচ্ছে, যার কোন ধারণা নেই সেও নম্বর পাচ্ছে। এই নম্বর তো তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার কথা বলছে না।

২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণী শেষে জেএসসি পরীক্ষা নেই। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো নেওয়া হচ্ছেÑ কোভিডের কারণে গতবার এবং এবার পরীক্ষা দুটো হচ্ছে না। নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো নেওয়া হচ্ছে কেন? পরীক্ষা না হলে, পরীক্ষার চাপ না থাকলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চায় না, পড়তে চায় না, অভিভাবকরাও পড়াশুনার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। তারা চান বাচ্চারা চাপে থাকুক। পরীক্ষা না হলে, পড়ার চাপ না থাকলে বেসরকারি পুস্তক প্রকাশকরা তাদের বই বিক্রি করতে পারেন না। শিক্ষকরাও খুব একটা আগ্রহ পান না। পরীক্ষায় যে কয়টি চ্যাপ্টার, যে কয়টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়, বারবার প্র্যাকটিস করানো হয়। পরীক্ষা না হলে এগুলো করানো হয় না। এটিও বাস্তব চিত্র। তাই সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে পরীক্ষা দুটো টিকিয়ে রেখেছিল। তার মানে পরীক্ষা নেওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু পঠিত বিষয় নিজে ব্যবহার করতে জানছে না কিংবা পারছে না, পরীক্ষা না হলে কোন কিছু পড়তে চায়না, এর সমাধান আসলে কী? শিক্ষার্থীদের আনন্দ দানের মাধ্যমে পড়াতে পারলে এবং পড়ানো বিষয় তারা নিজের বাক্যে ব্যবহার করতে পারছে, বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট। শিক্ষক বিষয়টি টের পেলে বা জেনে গেলেই সেটি মূল্যায়ন। একটি শ্রেণীর কোন কোন শিক্ষার্থী নিজের বাক্যে, নিজের লেখায় তাদের পঠিত বিষয় ব্যবহার করতে পারছে। এটিই কিন্তু তাদের আসল মূল্যায়ন।

এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এতে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে নয়টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮০ জন। আর দুই বছর আগে এসব বোর্ডে নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬ জন। বাকি ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭৬ জনের হদিস নেই। ১১টি বোর্ডের তথ্য যুক্ত হলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের ৭২ শতাংশই ছাত্রী। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮১৪ জন।

রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো শিশুশ্রমে ভিড়ে গেছে কিংবা বিয়ে হয়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রীÑ এ খবর উদ্বেগজনক। এসব ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’

বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এত আলোচনা পর্যালোচনার পরও পড়াশুনা বাদ দিয়ে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এর মূল কারণ দারিদ্র্য হলেও মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টিও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। দরিদ্র ও অসহায় পিতামাতা মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে, বখাটেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য, রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পাওয়া উঠতি বয়সের ছেলেপেলেদের হাত থেকে, ইভটিজিংয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাল্যবিয়ের কুফলের কথা জেনেও অনুপযুক্ত পাত্রের হাতে মেয়েকে সমর্পণ করছেন। এ নিয়ে কোন সামাজিক সংগঠন কিংবা কোন বেসরকারি সংস্থা এলাকাভিত্তিক কিছু গবেষণা করে। তার ফল প্রকাশ ও কিছু প্রস্তাবনাও পেশ করে কিন্তু তাতে তো উঠতি বয়সী ছেলেদের বখাটেপনা কমে না। ভুক্তভোগী পিতার পাশে কেউ দাঁড়ায় না, বরং কোন দুর্ঘটনা ঘটলে মেয়ের ওপরই দোষ চাপানো হয়।

রাজনীতির যে দুষ্ট রাহু সমগ্র সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছেÑ এ থেকে উত্তরণের উপায় তো খুব সহজ নয়। তবে শিক্ষকদের হাল ছেড়ে দিলে হবে না।

[লেখক : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন]