৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেয়ার পরামর্শে নারী নেত্রীদের উদ্বেগ

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে ‘৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেয়ার জন্য আদালতের পরামর্শে’ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক পৃথক বিবৃতিতে এই উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থাগুলো।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিবৃতিতে জানায়, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার জন্য পুলিশকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মামলা রুজু করার জন্য বিধিনিষেধ বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত করবে, যা মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।

মহিলা পরিষদ এই রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিবৃতিতে আরও বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ এই ধর্ষণ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, মেডিকেল রিপোর্ট ও ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ আনা হলেও এটিকে ধর্ষণ বলা যাবে না। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টই ধর্ষণ মামলার একমাত্র প্রমাণ (এভিডেন্স) না। আরও অনেকগুলো পারিপার্শ্বিক এভিডেন্স থাকে, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার বিচার কাজ এগিয়ে চলে। বিচারিক আদালতের এ ধরনের বিধিনিষেধ তৈরি করার মতো মন্তব্য ভবিষ্যতে ধর্ষণের ঘটনায় ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

অপরদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে, বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় কোন অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অপরাধ সংঘটনের অনেক বছর পরও মামলা ও বিচার কাজ সম্পাদিত হওয়ার নজির রয়েছে। যেখানে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার ওপর বার বার জোর দেয়া হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে উচ্চ আদালত বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সেখানে এ মামলার ক্ষেত্রে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা আমাদের হতাশ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সাংঘর্ষিক।

প্রগতিশলী নারী সংগঠন

ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয় আদালতের এমন পরামর্শে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছেন দেশের কয়েকটি প্রগতিশীল নারী সংগঠনের নেতারা। গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ প্রতিক্রিয়া জানান তারা।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একশটি ঘটনার মধ্যে গড়ে মাত্র ২৩টিতে মামলা হয়। প্রভাবশালীদের দাপটে মামলা ও বিচার অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়। ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়, আদালতের এমন পরামর্শে অর্থ ও ক্ষমতাধারী অপরাধীরা অসহায়-দরিদ্র ভিক্টিমদের ৭২ ঘণ্টা মামলা করতে না দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। এই নির্দেশনা প্রভাবশালী অপরাধীদের-ই সহযোগিতা করতে পারে।

তারা বলেন, ‘বাংলাদেশে আইন-আদালতও ক্ষমতা ও অর্থের দাপটে প্রভাবিত হয়। এর আগে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলায় প্রধান আসামি হওয়া এবং নানা ধরনের সংশ্লিষ্টতা সংবাদ মাধ্যমে আসার পরও পুলিশের চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।’

নারী সংগঠনগুলোর নেতাদের দাবি, ‘আদালতের এ ধরনের পরামর্শ অর্থ ও ক্ষমতাধারী অপরাধীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করার সুযোগ পাবে।’

তারা ‘অসহায়, দরিদ্র, প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সামগ্রিকভাবে সব নিপীড়িত নারীদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিতে পারেÑ এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এই নির্দেশনা পরিত্যাগ করার অনুরোধ’ জানান বিবৃতিতে।

বিবৃতিতে সংগঠনগুলোর সমন্বয়ক ও সিপিবি নারী সেলের আহ্বায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তী, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি রওশন আরা রুশো, শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নি শিখা জামালি, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, নারী সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার লিমা, বিপ্লবী নারী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক আমেনা আক্তারের নাম উল্লেখ করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন। পরে পর্যবেক্ষণে ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয় এমন পরামর্শ দেন আদালত।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।

শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১ , ২৮ কার্তিক ১৪২৮ ৭ রবিউস সানি ১৪৪৩

৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেয়ার পরামর্শে নারী নেত্রীদের উদ্বেগ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে ‘৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেয়ার জন্য আদালতের পরামর্শে’ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক পৃথক বিবৃতিতে এই উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থাগুলো।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বিবৃতিতে জানায়, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার জন্য পুলিশকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। মামলা রুজু করার জন্য বিধিনিষেধ বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত করবে, যা মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী।

মহিলা পরিষদ এই রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিবৃতিতে আরও বলছে, রাষ্ট্রপক্ষ এই ধর্ষণ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, মেডিকেল রিপোর্ট ও ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ আনা হলেও এটিকে ধর্ষণ বলা যাবে না। কিন্তু মেডিকেল রিপোর্টই ধর্ষণ মামলার একমাত্র প্রমাণ (এভিডেন্স) না। আরও অনেকগুলো পারিপার্শ্বিক এভিডেন্স থাকে, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার বিচার কাজ এগিয়ে চলে। বিচারিক আদালতের এ ধরনের বিধিনিষেধ তৈরি করার মতো মন্তব্য ভবিষ্যতে ধর্ষণের ঘটনায় ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

অপরদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে, বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় কোন অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অপরাধ সংঘটনের অনেক বছর পরও মামলা ও বিচার কাজ সম্পাদিত হওয়ার নজির রয়েছে। যেখানে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার ওপর বার বার জোর দেয়া হচ্ছে এবং এক্ষেত্রে উচ্চ আদালত বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সেখানে এ মামলার ক্ষেত্রে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা আমাদের হতাশ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান আইন ও বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সাংঘর্ষিক।

প্রগতিশলী নারী সংগঠন

ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয় আদালতের এমন পরামর্শে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছেন দেশের কয়েকটি প্রগতিশীল নারী সংগঠনের নেতারা। গতকাল সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ প্রতিক্রিয়া জানান তারা।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একশটি ঘটনার মধ্যে গড়ে মাত্র ২৩টিতে মামলা হয়। প্রভাবশালীদের দাপটে মামলা ও বিচার অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়। ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয়, আদালতের এমন পরামর্শে অর্থ ও ক্ষমতাধারী অপরাধীরা অসহায়-দরিদ্র ভিক্টিমদের ৭২ ঘণ্টা মামলা করতে না দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। এই নির্দেশনা প্রভাবশালী অপরাধীদের-ই সহযোগিতা করতে পারে।

তারা বলেন, ‘বাংলাদেশে আইন-আদালতও ক্ষমতা ও অর্থের দাপটে প্রভাবিত হয়। এর আগে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলায় প্রধান আসামি হওয়া এবং নানা ধরনের সংশ্লিষ্টতা সংবাদ মাধ্যমে আসার পরও পুলিশের চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।’

নারী সংগঠনগুলোর নেতাদের দাবি, ‘আদালতের এ ধরনের পরামর্শ অর্থ ও ক্ষমতাধারী অপরাধীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করার সুযোগ পাবে।’

তারা ‘অসহায়, দরিদ্র, প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সামগ্রিকভাবে সব নিপীড়িত নারীদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিতে পারেÑ এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এই নির্দেশনা পরিত্যাগ করার অনুরোধ’ জানান বিবৃতিতে।

বিবৃতিতে সংগঠনগুলোর সমন্বয়ক ও সিপিবি নারী সেলের আহ্বায়ক লক্ষ্মী চক্রবর্তী, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি রওশন আরা রুশো, শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নি শিখা জামালি, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, নারী সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার লিমা, বিপ্লবী নারী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক আমেনা আক্তারের নাম উল্লেখ করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন। পরে পর্যবেক্ষণে ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর পুলিশ যেন মামলা না নেয় এমন পরামর্শ দেন আদালত।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।