জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক

মর্তুজা হাসান সৈকত

মহামারী করোনার প্রভাব কাটিয়ে যখন দেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে ঠিক ওই সময়ে কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ৪ নভেম্বর আকস্মিকভাবে দেশে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাসে যাত্রীভাড়া ২৭% এবং লঞ্চে ৩৫% বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এতে পণ্য পরিবহনের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। হুট করে তাই দাম বৃদ্ধির কারণে করোনাকালে কষ্টের মধ্যে থাকা মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের আকার যে আরও স্ফীত হবে- এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ফলে, এই প্রেক্ষাপটে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তকে সুচিন্তিত বলে মনে হয়নি।

গত সাত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করা বিপিসি গত পাঁচ মাসে এক হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। অন্যদিকে, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো লোকসান কমাতে তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এ যুক্তিতে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে ও তেল চুরি ঠেকাতে তেলের দাম একলাফে ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত, বিপিসি যাতে আর লোকসান না দেয় এবং লাভজনক থাকে- সেই হিসেব থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাসের এই সর্বোচ্চ মূল্য বৃদ্ধি।

তবে জ্বালানির এই মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। কারণ, বিগত কয়েক বছরে চাকরিজীবীদের বেতন এক টাকাও বাড়েনি। শ্রমজীবীদেরও বাড়েনি আয়। তার ওপরে মহামারীকালে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে জানানো হয়েছে, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে দেয়া করোনা বিধিনিষেধের কারণে গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনের প্রৃায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে।

জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়ে তেমনি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপরও এর প্রভাব পড়ে। এমনকি ব্যয় বাড়ে কৃষি পণ্য উৎপাদনেও। কারণ, ডিজেলের ব্যবহার সেখানেও অপরিহার্য। ফলে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির এই প্রভাব কৃষিকাজেও পড়বে। বোরো মৌসুম চলছে। কিছুদিন পরেই সেচের প্রয়োজন হবে জমিতে। দেশে ধান উৎপাদনে মোট সেচের ৯৩ ভাগ সেচই প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। এই সেচের জন্য ব্যবহৃত সেচ যন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেলচালিত। ফলে এবার বোরো চাষের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে অনেক। ফলশ্রুতিতে বাড়বে চালের দাম।

দেশের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের অনেকগুলোতেই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি, কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি খেটে খাওয়া গবির মানুষের জীবনমানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। কারণ, দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষেরাই মূলত কেরোসিন ব্যবহার করে থাকে। এই মূলবৃদ্ধি তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিবে।

তবে এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহন মালিকদের তেমন কোন ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ, তারা তো ঠিকই দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ সমন্বয় করে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাস এবং লঞ্চে রেকর্ড পরিমাণ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির এই মূল্য বৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদের আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটাবে। ফলে নাভিশ্বাস উঠবে তাদের। তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে টানা বেশ কয়েক বছর জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল। একপর্যায়ে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলারেও নেমেছিল। সে সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হলেও আগের লোকসান পুষিয়ে নেয়ার কথা বলে বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে এ দেশের ভোক্তারা। দু’একবার যা-ও কমানো হয়েছিল তাতে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয়, পণ্যের উৎপাদন খরচসহ যেসব খাতে ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল পরবর্তীতে তা আর কমানো যায়নি। তাই, করোনাকালে জনজীবনের এই বিপর্যস্ত অবস্থায় সরকার ভর্তুকিটা অব্যাহত রাখতে পারত। কারণ, যখন সরকারের সক্ষমতা অনেক কম ছিল তখনও বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ভারতে জ্বালানির দাম বেশি বলে পাচার হয়ে যাবে, এটাও কিন্তু শক্তিশালী যুক্তি নয়। পণ্য পাচার ঠেকানোর দায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। তাদের ব্যর্থতার জন্য দেশের পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা ঠিক নয়। তাছাড়া, কিছুদিন গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের এই দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে না। তাই দেশে দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার তেল আমদানির ওপর কর কমিয়ে দেয়া বা প্রত্যাহারের মতো পদক্ষেপ নিতে পারত। সম্প্রতি যেটা ভারত করেছে। এতে যে রাজস্ব ক্ষতি হতো, সেটাকে অর্থনীতির জন্য প্রণোদনা হিসেবে একটি প্যাকেজের আওতায় নিয়ে আসা যেত।

করোনাকালে আমরা হার মানিনি। আমাদের অর্থনীতি ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ হয়েছে। আইএমএফের আউটলুকেও সেটা বলা হয়েছে। জিডিপি ৪০০ বিলিয়নের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অর্থনীতি প্রচ-ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, সেখানকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার পেছনে করোনা পরিস্থিতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। তাই সরকারের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে অন্তত ছয় মাসের জন্য পিছিয়ে দেয়া হোক। এতে অর্থনীতির সব খাত ও সাধারণ মানুষ সুফল পাবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১ , ২৮ কার্তিক ১৪২৮ ৭ রবিউস সানি ১৪৪৩

জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক

মর্তুজা হাসান সৈকত

মহামারী করোনার প্রভাব কাটিয়ে যখন দেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে ঠিক ওই সময়ে কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ৪ নভেম্বর আকস্মিকভাবে দেশে বহুল ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাসে যাত্রীভাড়া ২৭% এবং লঞ্চে ৩৫% বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এতে পণ্য পরিবহনের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। হুট করে তাই দাম বৃদ্ধির কারণে করোনাকালে কষ্টের মধ্যে থাকা মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের আকার যে আরও স্ফীত হবে- এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ফলে, এই প্রেক্ষাপটে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তকে সুচিন্তিত বলে মনে হয়নি।

গত সাত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করা বিপিসি গত পাঁচ মাসে এক হাজার ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। অন্যদিকে, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো লোকসান কমাতে তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এ যুক্তিতে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে ও তেল চুরি ঠেকাতে তেলের দাম একলাফে ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত, বিপিসি যাতে আর লোকসান না দেয় এবং লাভজনক থাকে- সেই হিসেব থেকেই বাংলাদেশের ইতিহাসের এই সর্বোচ্চ মূল্য বৃদ্ধি।

তবে জ্বালানির এই মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। কারণ, বিগত কয়েক বছরে চাকরিজীবীদের বেতন এক টাকাও বাড়েনি। শ্রমজীবীদেরও বাড়েনি আয়। তার ওপরে মহামারীকালে বেড়েছে দারিদ্র্যের হার। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে জানানো হয়েছে, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে দেয়া করোনা বিধিনিষেধের কারণে গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনের প্রৃায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে।

জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়ে তেমনি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপরও এর প্রভাব পড়ে। এমনকি ব্যয় বাড়ে কৃষি পণ্য উৎপাদনেও। কারণ, ডিজেলের ব্যবহার সেখানেও অপরিহার্য। ফলে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির এই প্রভাব কৃষিকাজেও পড়বে। বোরো মৌসুম চলছে। কিছুদিন পরেই সেচের প্রয়োজন হবে জমিতে। দেশে ধান উৎপাদনে মোট সেচের ৯৩ ভাগ সেচই প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। এই সেচের জন্য ব্যবহৃত সেচ যন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেলচালিত। ফলে এবার বোরো চাষের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে অনেক। ফলশ্রুতিতে বাড়বে চালের দাম।

দেশের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের অনেকগুলোতেই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি, কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি খেটে খাওয়া গবির মানুষের জীবনমানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। কারণ, দেশের প্রান্তিক জনপদের গরিব মানুষেরাই মূলত কেরোসিন ব্যবহার করে থাকে। এই মূলবৃদ্ধি তাদের চলমান অভাব ও দুঃখ কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিবে।

তবে এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহন মালিকদের তেমন কোন ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ, তারা তো ঠিকই দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ সমন্বয় করে নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাস এবং লঞ্চে রেকর্ড পরিমাণ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির এই মূল্য বৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদের আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটাবে। ফলে নাভিশ্বাস উঠবে তাদের। তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে টানা বেশ কয়েক বছর জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল। একপর্যায়ে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলারেও নেমেছিল। সে সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হলেও আগের লোকসান পুষিয়ে নেয়ার কথা বলে বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে এ দেশের ভোক্তারা। দু’একবার যা-ও কমানো হয়েছিল তাতে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয়, পণ্যের উৎপাদন খরচসহ যেসব খাতে ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল পরবর্তীতে তা আর কমানো যায়নি। তাই, করোনাকালে জনজীবনের এই বিপর্যস্ত অবস্থায় সরকার ভর্তুকিটা অব্যাহত রাখতে পারত। কারণ, যখন সরকারের সক্ষমতা অনেক কম ছিল তখনও বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ভারতে জ্বালানির দাম বেশি বলে পাচার হয়ে যাবে, এটাও কিন্তু শক্তিশালী যুক্তি নয়। পণ্য পাচার ঠেকানোর দায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। তাদের ব্যর্থতার জন্য দেশের পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা ঠিক নয়। তাছাড়া, কিছুদিন গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের এই দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে না। তাই দেশে দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার তেল আমদানির ওপর কর কমিয়ে দেয়া বা প্রত্যাহারের মতো পদক্ষেপ নিতে পারত। সম্প্রতি যেটা ভারত করেছে। এতে যে রাজস্ব ক্ষতি হতো, সেটাকে অর্থনীতির জন্য প্রণোদনা হিসেবে একটি প্যাকেজের আওতায় নিয়ে আসা যেত।

করোনাকালে আমরা হার মানিনি। আমাদের অর্থনীতি ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ হয়েছে। আইএমএফের আউটলুকেও সেটা বলা হয়েছে। জিডিপি ৪০০ বিলিয়নের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অর্থনীতি প্রচ-ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, সেখানকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার পেছনে করোনা পরিস্থিতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। তাই সরকারের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে অন্তত ছয় মাসের জন্য পিছিয়ে দেয়া হোক। এতে অর্থনীতির সব খাত ও সাধারণ মানুষ সুফল পাবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]