প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মানবতার অভিন্ন স্বার্থে দৃঢ় অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে তিনি সংকট কাটিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে ৪টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন ।
গত শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়) ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্যারিসে ইউনেস্কোর সদরদপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে আজুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়্যেল ম্যাক্রোঁসহ ২০টির মতো দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্ব এখন মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের পথে এগিযে চলেছে। বিশ্ব নেতাদের আমি অনুরোধ করবোÑ আসুন এই মুহূর্তকে কাজে লাগাই, বিশ্ব মানবতার কল্যাণে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উত্থাপিত প্রথম প্রস্তাবে বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। ডিজিটাল সরঞ্জাম ও সেবা, ইন্টারনেট সুবিধা, ডিজিটাল বিষয়বস্তু এবং শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শেখানোয় অগ্রাধিকার দিতে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রযুক্তি সহায়ক অর্থবহ শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে অবশ্যই পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারদের অবশ্যই এক হতে হবে।’
তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে অবশ্যই বৈশ্বিক পাবলিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের জন্য।’
চতুর্থ প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের কল্যাণের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইউনেস্কোর অর্জনগুলোকে উদযাপন করতে ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একটি অন্যন্য মুহূর্ত। এছাড়াও শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার পথে পরবর্তী ২৫ বছরে সংস্থার কাযক্রমগুলোকে গভীর থেকে দেখা এবং পুনর্বিবেচনা করার গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মহামারীর বিপদ আমাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং জীবনকে বদলে দিয়েছে। এটি আমাদের উদ্ভাবনী কাজ এবং গতির মাধ্যমে টিকে থাকা শিখিয়েছে।’
বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য ইউনেস্কো অব্যাহত ভূমিকা প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এই সংস্থাটিকে বিশ্ব শান্তি এবং সম্মিলিত সমৃদ্ধি অর্জনে সবচেয়ে কার্যকরী প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণিত শান্তিকেন্দ্রিক বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব সময় বিশ্ব শান্তি উদ্যোগের অগ্রভাগে থাকে।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমরা শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি। উপবৃত্তি, জেন্ডার-সংবেদনশীল পদ্ধতি, স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম, আইসিটি শিক্ষাসহ আমরা শিক্ষার সম্প্রসারণে আমরা প্রচুর বিনিয়োগ করছি।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। রাতে অন্য সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানগণের সঙ্গে অফিসিয়াল ডিনারে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা।
ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনিসহ অনেকে।
ফ্রান্স সরকারের শেখ হাসিনাকে ‘বিরল’ সম্মান
প্যারিস সফরে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বিরল’ সম্মান দেখিয়েছে ফ্রান্স সরকার। যার কারণে সারাবিশ্ব বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবছে। সেই সঙ্গে সহযোগিতার হাত তারা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। গত শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায়) প্যারিসে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে এ অভিমত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফর সবদিক দিয়ে ঐতিহাসিক সফর।’ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা, প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেসসচিব কেএম শাখাওয়াত মুন।
সেসময় মোমেন বলেন, ‘এবার ফ্রান্স সফরে প্রধানমন্ত্রী যে সম্মান পেয়েছেন, তা আগে কখনও বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান পায়নি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফরের বিভিন্ন কর্মসূচি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে সম্মান দেয়া হয় তা তুলে ধরেন। এছাড়া বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে যে আলোচনা হয় তা সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন।
বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমরা যে এখন উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি, আমরা একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছি। আমরা অনেক দেশকে টেকনিক্যাল সহায়তা দেয়া শুরু করেছি।’
অন্য দেশকে সহায়তা করতে একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায় কিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসিসটেন্স প্রোগ্রাম এ রকম কিছু। অন্য অনেক দেশে যেভাবে আছে।’
সেখানকার রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ফ্রান্সে যে পরিমাণ সম্মান দেখানো হয়েছে এটা সত্যিই বিরল। এটা থেকে বোঝা যায় ফ্রান্স আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীরতর করার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সেক্টরে তারা আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে অত্যন্ত আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন, ‘সফরে প্রধানমন্ত্রী অফিসিয়াল কর্মসূচিতে যেখানেই গেছেন সেখানে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধণা দেয়া হয়েছে।’
রাষ্ট্রদূত খন্দকার তালহা বলেন, ‘ইউনেস্কোতেও বাংলাদেশের যে সম্মানজনক অবস্থান ও মর্যদা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে তা আরও অনেক উন্নত হয়েছে।’
বাংলাদেশ সম্পর্কে অন্য দেশের ধারণার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা ছিল যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্যোগপ্রবণ, সেই ইমেজ বাংলাদেশের কেটে গেছে। বাংলাদেশ যে উদীয়মান সম্ভাবনাময় দেশ সে বিষয়ে এখন অনেকের কাছে স্পষ্ট।’
প্যারিস সফরকালে প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন কর্মসূচির বাইরে ইউনেস্কো এবং প্যারিস পিস ফোরামের কর্মসূচিতে অংশ নেন।
গত ৩১ অক্টোবর জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৬) যোগ দিতে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্লাসগো ও লন্ডন সফর শেষে গত মঙ্গলবার প্যারিস আসেন প্রধানমন্ত্রী। সফরের প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্স প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন এলিসি প্রাসাদে যান। এলিসি প্রাসাদ এবং পরে ইনভ্যালিড্স-এ লাল গালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় সফররত প্রধানমন্ত্রীকে।
এছাড়া সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং প্রধানমন্ত্রী জিন ক্যাসট্যাক্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে তার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনা। আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও মধ্যাহ্নভোজের সময়ও দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন দুই নেতা।
প্যারিস সফরকালে ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি, প্যারিস পিস ফোরাম-এ অংশগ্রহণ করেন, ইউনেস্কো সদর দপ্তরে সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ পুরস্কার বিতরণসহ সাইডলাইনে বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নেন শেখ হাসিনা।
সফরে গ্লাসগোতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে ব্রিটেনের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রিন্স চার্লসসহ বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থা প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
গতকাল স্থানীয় সময় বিকেলে প্যারিস থেকে ঢাকার পথে রওনা দেন শেখ হাসিনা। আজ সকালে দেশে ফিরছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানাগেছে।
রবিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২১ , ২৯ কার্তিক ১৪২৮ ৮ রবিউস সানি ১৪৪৩
ফ্রান্সের প্যারিস থেকে সালাম জুবায়ের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মানবতার অভিন্ন স্বার্থে দৃঢ় অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে তিনি সংকট কাটিয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে ৪টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন ।
গত শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়) ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্যারিসে ইউনেস্কোর সদরদপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে আজুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়্যেল ম্যাক্রোঁসহ ২০টির মতো দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্ব এখন মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের পথে এগিযে চলেছে। বিশ্ব নেতাদের আমি অনুরোধ করবোÑ আসুন এই মুহূর্তকে কাজে লাগাই, বিশ্ব মানবতার কল্যাণে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উত্থাপিত প্রথম প্রস্তাবে বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। ডিজিটাল সরঞ্জাম ও সেবা, ইন্টারনেট সুবিধা, ডিজিটাল বিষয়বস্তু এবং শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শেখানোয় অগ্রাধিকার দিতে একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রযুক্তি সহায়ক অর্থবহ শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে অবশ্যই পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারদের অবশ্যই এক হতে হবে।’
তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে অবশ্যই বৈশ্বিক পাবলিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের জন্য।’
চতুর্থ প্রস্তাবে তিনি বলেন, ‘জনগণের কল্যাণের জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইউনেস্কোর অর্জনগুলোকে উদযাপন করতে ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একটি অন্যন্য মুহূর্ত। এছাড়াও শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার পথে পরবর্তী ২৫ বছরে সংস্থার কাযক্রমগুলোকে গভীর থেকে দেখা এবং পুনর্বিবেচনা করার গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মহামারীর বিপদ আমাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং জীবনকে বদলে দিয়েছে। এটি আমাদের উদ্ভাবনী কাজ এবং গতির মাধ্যমে টিকে থাকা শিখিয়েছে।’
বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য ইউনেস্কো অব্যাহত ভূমিকা প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এই সংস্থাটিকে বিশ্ব শান্তি এবং সম্মিলিত সমৃদ্ধি অর্জনে সবচেয়ে কার্যকরী প্লাটফর্ম হিসেবে বিবেচনা করি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণিত শান্তিকেন্দ্রিক বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব সময় বিশ্ব শান্তি উদ্যোগের অগ্রভাগে থাকে।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমরা শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি। উপবৃত্তি, জেন্ডার-সংবেদনশীল পদ্ধতি, স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম, আইসিটি শিক্ষাসহ আমরা শিক্ষার সম্প্রসারণে আমরা প্রচুর বিনিয়োগ করছি।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। রাতে অন্য সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানগণের সঙ্গে অফিসিয়াল ডিনারে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা।
ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনিসহ অনেকে।
ফ্রান্স সরকারের শেখ হাসিনাকে ‘বিরল’ সম্মান
প্যারিস সফরে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘বিরল’ সম্মান দেখিয়েছে ফ্রান্স সরকার। যার কারণে সারাবিশ্ব বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবছে। সেই সঙ্গে সহযোগিতার হাত তারা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। গত শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরে (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায়) প্যারিসে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে এ অভিমত তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফর সবদিক দিয়ে ঐতিহাসিক সফর।’ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা, প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেসসচিব কেএম শাখাওয়াত মুন।
সেসময় মোমেন বলেন, ‘এবার ফ্রান্স সফরে প্রধানমন্ত্রী যে সম্মান পেয়েছেন, তা আগে কখনও বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান পায়নি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফ্রান্স সফরের বিভিন্ন কর্মসূচি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে সম্মান দেয়া হয় তা তুলে ধরেন। এছাড়া বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে যে আলোচনা হয় তা সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন।
বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমরা যে এখন উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি, আমরা একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছি। আমরা অনেক দেশকে টেকনিক্যাল সহায়তা দেয়া শুরু করেছি।’
অন্য দেশকে সহায়তা করতে একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায় কিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসিসটেন্স প্রোগ্রাম এ রকম কিছু। অন্য অনেক দেশে যেভাবে আছে।’
সেখানকার রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ফ্রান্সে যে পরিমাণ সম্মান দেখানো হয়েছে এটা সত্যিই বিরল। এটা থেকে বোঝা যায় ফ্রান্স আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীরতর করার ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সেক্টরে তারা আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে অত্যন্ত আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন, ‘সফরে প্রধানমন্ত্রী অফিসিয়াল কর্মসূচিতে যেখানেই গেছেন সেখানে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধণা দেয়া হয়েছে।’
রাষ্ট্রদূত খন্দকার তালহা বলেন, ‘ইউনেস্কোতেও বাংলাদেশের যে সম্মানজনক অবস্থান ও মর্যদা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে তা আরও অনেক উন্নত হয়েছে।’
বাংলাদেশ সম্পর্কে অন্য দেশের ধারণার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা ছিল যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্যোগপ্রবণ, সেই ইমেজ বাংলাদেশের কেটে গেছে। বাংলাদেশ যে উদীয়মান সম্ভাবনাময় দেশ সে বিষয়ে এখন অনেকের কাছে স্পষ্ট।’
প্যারিস সফরকালে প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন কর্মসূচির বাইরে ইউনেস্কো এবং প্যারিস পিস ফোরামের কর্মসূচিতে অংশ নেন।
গত ৩১ অক্টোবর জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৬) যোগ দিতে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্লাসগো ও লন্ডন সফর শেষে গত মঙ্গলবার প্যারিস আসেন প্রধানমন্ত্রী। সফরের প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্স প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন এলিসি প্রাসাদে যান। এলিসি প্রাসাদ এবং পরে ইনভ্যালিড্স-এ লাল গালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয় সফররত প্রধানমন্ত্রীকে।
এছাড়া সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং প্রধানমন্ত্রী জিন ক্যাসট্যাক্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে তার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন শেখ হাসিনা। আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও মধ্যাহ্নভোজের সময়ও দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন দুই নেতা।
প্যারিস সফরকালে ইউনেস্কোর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি, প্যারিস পিস ফোরাম-এ অংশগ্রহণ করেন, ইউনেস্কো সদর দপ্তরে সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ পুরস্কার বিতরণসহ সাইডলাইনে বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে অংশ নেন শেখ হাসিনা।
সফরে গ্লাসগোতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে ব্রিটেনের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রিন্স চার্লসসহ বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থা প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
গতকাল স্থানীয় সময় বিকেলে প্যারিস থেকে ঢাকার পথে রওনা দেন শেখ হাসিনা। আজ সকালে দেশে ফিরছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানাগেছে।