ফিরদৌসী কাদরী
সংবাদ : দেশে করোনার সংক্রমণ এখন কম, আগামিতে কি আবারও বাড়ার আশঙ্কা আছে?
ফিরদৌসী কাদরী : ‘covid is any where, covid is everywhere’। করোনা যে কোনো সময় বাড়তে পারে। অনেকেই এখন মাস্ক পরছেন না। মাস্ক না পরাটাই সংক্রমণ বাড়াতে পারে। কারণ টিকা নেয়া ব্যক্তিটি করোনা বহনকারী হতে পারেন।
সংবাদ : করোনা মহামারী এখন কী অবস্থায় আছে, কতটা শক্তিশালী বলে মনে করছেন?
ফিরদৌসী : করোনার ভাইরাসটা এখন দুর্বল হচ্ছে। অনেক ভ্যাকসিনেটেড মানুষ থাকলে তারা কেরিয়ার পায় না তখন হার্ড ইমিউনিটি আসে। কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিলেই এই অবস্থা তৈরি হবে। তবে আমাদের দেশে প্রকৃতিগতভাবে আমাদের এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষেরই এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে।
তবে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বলতে চাই এটা ভেবে আমাদের উদাসীন হলে চলবে না। কারণ আমরা জেনে গেছি করোনা তার ধরন পাল্টে আসে। এ জন্য সামনের আরও দু’বছর আমাদের আরো দেখতে হবে। করোনার অবস্থা, করোনার সংক্রমণ ইত্যাদি নিয়ে এখনই প্রতিষ্ঠিত কোনো মতামত দেয়া যাবে না।
আমরা যে টিকা নিচ্ছি তা করোনা রোধ করবে না, ইমিউনিটি তৈরি করবে। তাই বলা যায়, যে টিকা এখন দেয়া হচ্ছে সেটা একধরনের করোনার প্রতিষেধক। করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং দেখে সাইনোফাম, সাইনো ভ্যাকের ভ্যাকসিন জীবাণুকে নিয়ে অকেজো করে দেয়া হচ্ছে এই টিকার মাধ্যমে। তবে যে টিকা দিলে আর করোনা হবে না সেই টিকা আবিষ্কারের লক্ষ্যে গবেষণা চলছে।
সংবাদ : টিকা নেয়ার পরও মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকে মারাও যাচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
ফিরদৌসী : করোনা সংক্রমণের একবছরের মধ্যে বিশ্ববাসী টিকা পেয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি কোনো রোগের ওষুধ নিয়ে আসা জটিল তাও আবার করোনার মতো ছোঁয়াচে ভাইরাসের। টিকা করোনা ঠেকাতে কোন বয়সীদের জন্য কতটুকু কার্যকর তার পরীক্ষা চলছে। এমনকি কোন রোগ থাকলে এর কার্যকারিতা কতটুকু হবে তাও দেখা হচ্ছে। কিছুদিন তো সময় লাগবে।
সংবাদ : কোভিড নিয়ে কি কোনো গবেষণা হচ্ছে দেশে, হলে তা কি ধরনের গবেষণা?
ফিরদৌসী : আইসিসিডিআরবির নেতৃত্বে একটা বড়ো কাজ চলছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা হাসপাতাল- এই ৪ হাসপাতালে আসা রোগীদের থেকে নমুনা নেয়া হচ্ছে। দেশে যে ৪টা টিকা দেয়া হয়েছে তার কার্যকারিতা কত। একই রোগে আক্রান্তদেরকে কোন টিকা নিলো বা কে টিকাই নেয়নি এমন রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এই টিকা কতদিন পর্যন্ত ইমিউনিটি দিতে পারবে এমন অনেক কাজই করছি আমরা। টিকা কোন বয়সীদের মধ্যে কতটুকু কাজ করে, কীভাবে কাজ করে এসব দেখা হচ্ছে। এটাকে বলে করোনার টেস্ট নেগেটিভ ডিজাইন।
সংবাদ : একটু আগে বলেছেন, সামনে আরও বড় মহামারী আসতে পারে। সেই মহামারী কি করোনার চেয়েও শক্তিশালী হবে? এ জন্য কি ধরনের প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন?
ফিরদৌসী : বিভিন্ন রোগজীবাণুর বিস্তার নিয়ে গবেষণাই বলছে সামনে আরও বড় মহামারী আসতে পারে। উদ্বেগজনকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত নগরায়ণের কারণে বিশ্বব্যাপী পুরোনো ও নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে শুরু করেছে। আমাদের চারপাশের পরিবেশ যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে মহামারী কমে যাবে না, আমার মনে হয় বাড়বে। আবার নতুন জীবাণুর মাধ্যমে যে মহামারি আসবে তাও কিন্তু না।
সংবাদ : এ থেকে রক্ষার উপায় কি?
ফিরদৌসী : ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরগুলোতে মানুষের চাপ কমাতে হবে। অফিস আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঘন বসতির জন্য শহরগুলোর পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ সুস্থ রাখতে হবে। মহামারী ঠেকাতে হলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি গবেষণা বাড়াতে হবে।
সংবাদ : করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে বিশ্বে যে অসম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নাকি ধনী রাষ্ট্রগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের নমুনা?
ফিরদৌসী : কিছু ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভ্যাকসিন মজুত করেছে। উন্নত দেশগুলো ভ্যাকসিন শেয়ার করছে না। ২য় ডোজ দেওয়ার পর তারা বুস্টার দিচ্ছে। উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। কিন্তু যদি তার আশেপাশের দেশের মানুষ এই টিকা না পায় তবে তারা তো নিরাপদ থাকতে পারবে না। মানুষ সারাক্ষণ ট্রাভেল করছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করছে। এই শেয়ারিংটা না করলে আসলে তারাই বিপদে পড়বে।
দেশে এখন তিনভাবে টিকা আসছে। এক. দেশ কিনে নিচ্ছে, দুই. কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিজ থেকে আসছে এবং তিন. কো-ফান্ডিং-এ আসছে। তবে কারো দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশেকে ভ্যাকসিন বানাতে হবে। আমার দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ন হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
সংবাদ : বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগি পূর্বের তুলনায় বাড়ছে এবং মারাও যাচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ে কি দেশে কোনো গবেষণা হচ্ছে? এ বিষয়ে কি নিকট সময়ে কোনো সুখবর পাওয়া যাবে?
ফিরদৌসী : ডেঙ্গু নিয়ে অনেক কাজ চলছে। প্যারাসাইটোলজি ল্যাবে, ড. রাশিদুল হক বিদেশী একটা সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। আমি ওনার সঙ্গে কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে আছি। এ কাজটা হলে খুব বড়ো একটা সাফল্য আসবে। এটার ফার্স্ট ট্রায়াল বাংলাদেশেই হয়েছে। খুবই পজিটিভ। এখন আরো কাজ চলছে। ভ্যাকসিন দিয়ে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে তো খুবই ভালো। ডেঙ্গু অনেক কম্পিøকেটেডে একটা রোগ। একটা স্ট্রেন থেকে আরেকটা স্ট্রেন আসে যখন তখন কমপ্লিকেশন বেশী হয়। তাই খুব দ্রুত এই গবেষণার কাজ শেষ করে আনতে চাচ্ছি।
সংবাদ : দেশে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
ফিরদৌসী : গবেষণা সীমাবদ্ধ মানুষের জন্য। কিন্তু ধনী-দরিদ্র সবার জন্য স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য খাতে টাকা বাড়াতে হবে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইডিবি সব জায়গা থেকে ফান্ড আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার।
সংবাদ : গবেষণা খাতে সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ কেমন?
ফিরদৌসী : গবেষণা খাত নিয়ে আমি একদম সন্তুষ্ট না। কারণ গবেষণা খাতে প্রচুর টাকা লাগে। যতো গবেষণা হবে ততো আমরা এগিয়ে যাবো। কিন্তু এই খাতে বরাদ্দ নেই বল্লেই চলে। সরকারী ক্ষেত্রে আমাদের ফান্ডিং বাড়াতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজগুলোতে যা পাই তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তা যদি ২০ জন শিক্ষকের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে কতো করে পড়ে। এটা দিয়ে তারা কি কাজ করবে। তারা রি-এজেন্ট আনবে না ইকুয়েপমেন্ট ঠিক করবে। আধা সরকারী, বেসরকারী, সরকারী প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋন দেয় রিসার্চ করার জন্য। এই সুযোগটা আরো বাড়াতে হবে।
সংবাদ : দেশের কয়টা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে? তাদের ভ্যাকসিনকে অনুমোদন না দেওয়ার কারণ কি বলে আপনি মনে করেন ?
ফিরদৌসী : যে ভ্যাক্সিনই হোক নিয়ম মেনে আসতে হবে। ল্যাবরেটরি রিপোর্ট ভালো থাকতে হবে। এনিমেল রিপোর্ট ভালো থাকতে হবে। এনিমেল রিপোর্টের মধ্যে ছোট জন্তু যেমন মাইস, গিনিপিগ যেটাই হোক এবং এই ভ্যাকসিনগুলো সব সময় নন হিউম্যান প্রাইমেটে যতে হয় যেমন, বানর, শিম্পাঞ্জি। আর দরকার হয় প্রি-ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট। এরপর ফেজ-১, ফেজ -২, ফেজ -৩ এরপর ফেজ -৪। এমন বেশ কয়েকটা ধাপ পার করে তবেই একটা ভ্যাকসিন অনুমোদন পায়।
বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) এথিকস কমিটি খুবই সচেতন। সকল নিয়ম রক্ষা করে তবেই একটা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়। আমাদের ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনকে প্রচুর তথ্য দিতে হয়। শুধু তথ্য তৈরি করলাম, দিয়ে দিলাম তা কিন্তু হবে না। প্রকাশিত তথ্য দিতে হয়। বাংলাদেশ অন্তত এ ধরণের কর্মকান্ডে নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করে না।
সংবাদ : যে কোনো পুরস্কার দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়ে সেই দায়িত্বের জায়গাটা কি আরো প্রসারিত হয়েছে?
ফিরদৌসী : দায়িত্ব তো অনেক বেড়ে গেছে। আমার দেশের জন্য দায়িত্বশীল হওয়া এখন আমার কর্তব্য। আসলে আমি পুরস্কারের জন্য কিছু করি না। সত্যি কথা বলতে এই পুরস্কার সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। কাজে এতো ব্যস্ত থাকি পুরস্কারের পিছনে ঘুরবো কখন। ম্যাগসেসে পুরস্কার পাওয়ার দিন আমার স্বামী মারা যান। এটা ছিলো আমার জীবনে সবচেয় কঠিনতম দিন। পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ আমি পাইনি। আমার কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
সংবাদ : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফিরদৌসী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
(সংক্ষেপিত। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি সংবাদ-এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।)
রবিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২১ , ২৯ কার্তিক ১৪২৮ ৮ রবিউস সানি ১৪৪৩
ফিরদৌসী কাদরী
সংবাদ : দেশে করোনার সংক্রমণ এখন কম, আগামিতে কি আবারও বাড়ার আশঙ্কা আছে?
ফিরদৌসী কাদরী : ‘covid is any where, covid is everywhere’। করোনা যে কোনো সময় বাড়তে পারে। অনেকেই এখন মাস্ক পরছেন না। মাস্ক না পরাটাই সংক্রমণ বাড়াতে পারে। কারণ টিকা নেয়া ব্যক্তিটি করোনা বহনকারী হতে পারেন।
সংবাদ : করোনা মহামারী এখন কী অবস্থায় আছে, কতটা শক্তিশালী বলে মনে করছেন?
ফিরদৌসী : করোনার ভাইরাসটা এখন দুর্বল হচ্ছে। অনেক ভ্যাকসিনেটেড মানুষ থাকলে তারা কেরিয়ার পায় না তখন হার্ড ইমিউনিটি আসে। কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিলেই এই অবস্থা তৈরি হবে। তবে আমাদের দেশে প্রকৃতিগতভাবে আমাদের এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের প্রায় ৬০ ভাগ মানুষেরই এন্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে।
তবে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বলতে চাই এটা ভেবে আমাদের উদাসীন হলে চলবে না। কারণ আমরা জেনে গেছি করোনা তার ধরন পাল্টে আসে। এ জন্য সামনের আরও দু’বছর আমাদের আরো দেখতে হবে। করোনার অবস্থা, করোনার সংক্রমণ ইত্যাদি নিয়ে এখনই প্রতিষ্ঠিত কোনো মতামত দেয়া যাবে না।
আমরা যে টিকা নিচ্ছি তা করোনা রোধ করবে না, ইমিউনিটি তৈরি করবে। তাই বলা যায়, যে টিকা এখন দেয়া হচ্ছে সেটা একধরনের করোনার প্রতিষেধক। করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং দেখে সাইনোফাম, সাইনো ভ্যাকের ভ্যাকসিন জীবাণুকে নিয়ে অকেজো করে দেয়া হচ্ছে এই টিকার মাধ্যমে। তবে যে টিকা দিলে আর করোনা হবে না সেই টিকা আবিষ্কারের লক্ষ্যে গবেষণা চলছে।
সংবাদ : টিকা নেয়ার পরও মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকে মারাও যাচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
ফিরদৌসী : করোনা সংক্রমণের একবছরের মধ্যে বিশ্ববাসী টিকা পেয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি কোনো রোগের ওষুধ নিয়ে আসা জটিল তাও আবার করোনার মতো ছোঁয়াচে ভাইরাসের। টিকা করোনা ঠেকাতে কোন বয়সীদের জন্য কতটুকু কার্যকর তার পরীক্ষা চলছে। এমনকি কোন রোগ থাকলে এর কার্যকারিতা কতটুকু হবে তাও দেখা হচ্ছে। কিছুদিন তো সময় লাগবে।
সংবাদ : কোভিড নিয়ে কি কোনো গবেষণা হচ্ছে দেশে, হলে তা কি ধরনের গবেষণা?
ফিরদৌসী : আইসিসিডিআরবির নেতৃত্বে একটা বড়ো কাজ চলছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা হাসপাতাল- এই ৪ হাসপাতালে আসা রোগীদের থেকে নমুনা নেয়া হচ্ছে। দেশে যে ৪টা টিকা দেয়া হয়েছে তার কার্যকারিতা কত। একই রোগে আক্রান্তদেরকে কোন টিকা নিলো বা কে টিকাই নেয়নি এমন রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এই টিকা কতদিন পর্যন্ত ইমিউনিটি দিতে পারবে এমন অনেক কাজই করছি আমরা। টিকা কোন বয়সীদের মধ্যে কতটুকু কাজ করে, কীভাবে কাজ করে এসব দেখা হচ্ছে। এটাকে বলে করোনার টেস্ট নেগেটিভ ডিজাইন।
সংবাদ : একটু আগে বলেছেন, সামনে আরও বড় মহামারী আসতে পারে। সেই মহামারী কি করোনার চেয়েও শক্তিশালী হবে? এ জন্য কি ধরনের প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন?
ফিরদৌসী : বিভিন্ন রোগজীবাণুর বিস্তার নিয়ে গবেষণাই বলছে সামনে আরও বড় মহামারী আসতে পারে। উদ্বেগজনকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত নগরায়ণের কারণে বিশ্বব্যাপী পুরোনো ও নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে শুরু করেছে। আমাদের চারপাশের পরিবেশ যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে মহামারী কমে যাবে না, আমার মনে হয় বাড়বে। আবার নতুন জীবাণুর মাধ্যমে যে মহামারি আসবে তাও কিন্তু না।
সংবাদ : এ থেকে রক্ষার উপায় কি?
ফিরদৌসী : ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরগুলোতে মানুষের চাপ কমাতে হবে। অফিস আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ঘন বসতির জন্য শহরগুলোর পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ সুস্থ রাখতে হবে। মহামারী ঠেকাতে হলে পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি গবেষণা বাড়াতে হবে।
সংবাদ : করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে বিশ্বে যে অসম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নাকি ধনী রাষ্ট্রগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের নমুনা?
ফিরদৌসী : কিছু ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভ্যাকসিন মজুত করেছে। উন্নত দেশগুলো ভ্যাকসিন শেয়ার করছে না। ২য় ডোজ দেওয়ার পর তারা বুস্টার দিচ্ছে। উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। কিন্তু যদি তার আশেপাশের দেশের মানুষ এই টিকা না পায় তবে তারা তো নিরাপদ থাকতে পারবে না। মানুষ সারাক্ষণ ট্রাভেল করছে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করছে। এই শেয়ারিংটা না করলে আসলে তারাই বিপদে পড়বে।
দেশে এখন তিনভাবে টিকা আসছে। এক. দেশ কিনে নিচ্ছে, দুই. কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিজ থেকে আসছে এবং তিন. কো-ফান্ডিং-এ আসছে। তবে কারো দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশেকে ভ্যাকসিন বানাতে হবে। আমার দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ন হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
সংবাদ : বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগি পূর্বের তুলনায় বাড়ছে এবং মারাও যাচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ে কি দেশে কোনো গবেষণা হচ্ছে? এ বিষয়ে কি নিকট সময়ে কোনো সুখবর পাওয়া যাবে?
ফিরদৌসী : ডেঙ্গু নিয়ে অনেক কাজ চলছে। প্যারাসাইটোলজি ল্যাবে, ড. রাশিদুল হক বিদেশী একটা সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন। আমি ওনার সঙ্গে কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে আছি। এ কাজটা হলে খুব বড়ো একটা সাফল্য আসবে। এটার ফার্স্ট ট্রায়াল বাংলাদেশেই হয়েছে। খুবই পজিটিভ। এখন আরো কাজ চলছে। ভ্যাকসিন দিয়ে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে তো খুবই ভালো। ডেঙ্গু অনেক কম্পিøকেটেডে একটা রোগ। একটা স্ট্রেন থেকে আরেকটা স্ট্রেন আসে যখন তখন কমপ্লিকেশন বেশী হয়। তাই খুব দ্রুত এই গবেষণার কাজ শেষ করে আনতে চাচ্ছি।
সংবাদ : দেশে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
ফিরদৌসী : গবেষণা সীমাবদ্ধ মানুষের জন্য। কিন্তু ধনী-দরিদ্র সবার জন্য স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য খাতে টাকা বাড়াতে হবে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইডিবি সব জায়গা থেকে ফান্ড আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার।
সংবাদ : গবেষণা খাতে সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ কেমন?
ফিরদৌসী : গবেষণা খাত নিয়ে আমি একদম সন্তুষ্ট না। কারণ গবেষণা খাতে প্রচুর টাকা লাগে। যতো গবেষণা হবে ততো আমরা এগিয়ে যাবো। কিন্তু এই খাতে বরাদ্দ নেই বল্লেই চলে। সরকারী ক্ষেত্রে আমাদের ফান্ডিং বাড়াতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজগুলোতে যা পাই তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তা যদি ২০ জন শিক্ষকের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে কতো করে পড়ে। এটা দিয়ে তারা কি কাজ করবে। তারা রি-এজেন্ট আনবে না ইকুয়েপমেন্ট ঠিক করবে। আধা সরকারী, বেসরকারী, সরকারী প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋন দেয় রিসার্চ করার জন্য। এই সুযোগটা আরো বাড়াতে হবে।
সংবাদ : দেশের কয়টা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনের অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে? তাদের ভ্যাকসিনকে অনুমোদন না দেওয়ার কারণ কি বলে আপনি মনে করেন ?
ফিরদৌসী : যে ভ্যাক্সিনই হোক নিয়ম মেনে আসতে হবে। ল্যাবরেটরি রিপোর্ট ভালো থাকতে হবে। এনিমেল রিপোর্ট ভালো থাকতে হবে। এনিমেল রিপোর্টের মধ্যে ছোট জন্তু যেমন মাইস, গিনিপিগ যেটাই হোক এবং এই ভ্যাকসিনগুলো সব সময় নন হিউম্যান প্রাইমেটে যতে হয় যেমন, বানর, শিম্পাঞ্জি। আর দরকার হয় প্রি-ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট। এরপর ফেজ-১, ফেজ -২, ফেজ -৩ এরপর ফেজ -৪। এমন বেশ কয়েকটা ধাপ পার করে তবেই একটা ভ্যাকসিন অনুমোদন পায়।
বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) এথিকস কমিটি খুবই সচেতন। সকল নিয়ম রক্ষা করে তবেই একটা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়। আমাদের ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনকে প্রচুর তথ্য দিতে হয়। শুধু তথ্য তৈরি করলাম, দিয়ে দিলাম তা কিন্তু হবে না। প্রকাশিত তথ্য দিতে হয়। বাংলাদেশ অন্তত এ ধরণের কর্মকান্ডে নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করে না।
সংবাদ : যে কোনো পুরস্কার দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়ে সেই দায়িত্বের জায়গাটা কি আরো প্রসারিত হয়েছে?
ফিরদৌসী : দায়িত্ব তো অনেক বেড়ে গেছে। আমার দেশের জন্য দায়িত্বশীল হওয়া এখন আমার কর্তব্য। আসলে আমি পুরস্কারের জন্য কিছু করি না। সত্যি কথা বলতে এই পুরস্কার সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। কাজে এতো ব্যস্ত থাকি পুরস্কারের পিছনে ঘুরবো কখন। ম্যাগসেসে পুরস্কার পাওয়ার দিন আমার স্বামী মারা যান। এটা ছিলো আমার জীবনে সবচেয় কঠিনতম দিন। পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ আমি পাইনি। আমার কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
সংবাদ : সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফিরদৌসী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
(সংক্ষেপিত। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি সংবাদ-এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।)