ক্ষমতা হারালেন সেই বিচারক

প্রধান বিচারপতির নির্দেশ : আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত

রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায়ে বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ দেয়া বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন প্রধান বিচারপতি।

গতকাল সকাল থেকেই ওই বিচারককে এজলাসে না বসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। এরপর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারকে সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে আদালতে না বসার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।’

আরও বলা হয়, ‘তার ফৌজদারী বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে বর্তমান কর্মস্থল হতে প্রত্যাহার করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে আইন মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।’

ঘটনার ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার নির্দেশনা কেন দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, ওই বিচারক আইন ও সংবিধান দুটোই লঙ্ঘন করেছেন। সে কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলোও গ্রহণ করা হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের বক্তব্য ‘অসাংবিধানিক ও বেআইনি’। ‘বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রধান বিচারপতি এ শোকজ পাঠাবেন। এ শোকজ যখন আমাদের কাছে পাঠানো হবে, আমরা তার (বিচারক) কাছে পাঠিয়ে দেব।’ বলেন আইনমন্ত্রী। গতকাল দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সকাল বেলা শুনলাম প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, তিনি বিজ্ঞ বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করছেন। আপনারা লিখেছেন ???‘বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে’। কেড়ে নেয়া কথাটার মানে হচ্ছে জোর করে কেড়ে নেয়া। এটা কেড়ে নেয়া হচ্ছে না। এ রকম যদি ঘটনা ঘটে প্রধান বিচারপতির এই ক্ষমতা আছে তাকে বিচারিক ক্ষমতা থেকে কিছুদিন সরিয়ে রাখার।’

তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে আমি কিছু বলিনি। এটি (শাস্তিমূলক ব্যবস্থা) উনার (প্রধান বিচারপতি) সিদ্ধান্ত। উনি স্বপ্রণোদিত হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেয় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। ওইদিন আদালত তিনি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোন ধর্ষণের মামলা না নেয় সে আদেশও দেয় এই বিচারক।

আনিসুল হক বলেন, ‘এখন কথা হচ্ছে এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? বিজ্ঞ বিচারকরা প্রতিদিনই কিন্তু রায় দেন। রায়ে কেউ সন্তুষ্ট হয়, কেউ অসন্তুষ্ট হয়। যারা অসন্তুষ্ট হন, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, সংবিধান অনুযায়ী, তারা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে আপিল বিভাগ। সেই আপিল বিভাগের সাংবিধানিক কিছু বাড়তি ক্ষমতাও আছে। সেগুলো তারা প্রয়োগ করেন। রায় দিলেই যে কোন বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা নয়। তারা মেরিটের উপরে, আইনের উপরে, রায় দেয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এখানে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে একজন বিজ্ঞ বিচারক তিনি ওপেন কোর্টে রায় দেয়ার সময় তার পর্যবেক্ষণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছেন, ৭২ ঘণ্টা পর কেউ যদি কোন ধর্ষণ মামলা করতে আসে, তাহলে সেই মামলাটা গ্রহণ না করতে। এটাই হচ্ছে আপত্তির জায়গা।’

আনিসুল হক বলেন, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কোন ফৌজদারি অপরাধের মামলা তামাদি হয় না। নট বার বাই লিমিটেশন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর কিন্তু মামলা হয়নি। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর এই মামলার প্রথম এফআইআর হয়। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, একমাত্র আইন দিয়ে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে বা পক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারকের বক্তব্যটি সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। এই দুটোই তিনি ভায়োলেট (লঙ্ঘন) করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘এই ভায়োলেশনের তাৎপর্যটা কী? অনেক রায় আছে বেআইনি হয়, আপিল বিভাগে গিয়ে বাতিল হয়। এখানে তিনি যে কথাটা বলেছেন, সেটার একটা ইমপ্লিকেশন আছে, একটা কনসিকোয়েন্স আছে। এ কারণেই আজকে বিচার বিভাগের যিনি গার্ডিয়ান, যিনি প্রধান তাকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ঠিক সেই কারণেই আমি আইনমন্ত্রী হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে গতকাল বলেছিলাম, আমি প্রধান বিচারপতির কাছেই বিচার চাইতে পারি। কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয় যে, এটা বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য বিব্রতকর। এটা একটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভুল নির্দেশনা দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, সেজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেটাও সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে কিন্তু এগিয়ে যাবে। আইনে তার যা সুবিধা...তাকে শোকজ করা হবে। তিনি কেন বলেছেন তার ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। সেটা আইনিভাবে যে প্রক্রিয়া দেয়া আছে, সেটাই তার ব্যাপারেও প্রযোজ্য।’

প্রধান বিচারপতি এই শোকজ পাঠাবেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই শোকজ যখন আমাদের কাছে পাঠনো হবে। এটা আমরা তার কাছে পৌঁছে দেব।’

আদালতে এসেও এজলাসে ওঠেননি

গতকাল বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগেই খাসকামড়ায় বসে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পান বিচারক কামরুন্নাহার। এ কারণে আদালতে এলেও এজলাসে বসেননি তিনি। এদিন কোন মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।

ওই ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বিচারক সকাল সাড়ে ৮টার সময় আদালতে আসেন। এরপর তিনি কখন খাস কামরা থেকে চলে গেছেন তা তিনি জানেন না বলে জানান।

বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণের পরই তোলপাড় শুরু হয় সারাদেশে। রায় ঘোষণার দিন মধ্যরাতে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ নামক প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারীরা। এরপর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদালতের এমন পর্যবক্ষণের সমালোচনা করা হয়। গতকালও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণে উদ্বেগ জানিয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়, আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ধর্ষণের বিচার পাওয়া কঠিন করবে।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছিলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের ডাক্তারি প্রতিবেদনে কোন সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের (যৌন সহিংসতা) বিবরণ নেই। ভুক্তভোগীর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মেলেনি। ৩৮ দিন পর এসে তারা (দুই ছাত্রী) বললো ‘রেপড হয়েছি’, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন বলে পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।

বিচারক রায় পড়ার সময় আরও বলেছিলেন, আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোন প্রমাণ দিতে পারেননি।

১১ নভেম্বর রায় ঘোষণার আগে ২ দফায় তারিখ পিছিয়েছে আদালত। গত ১২ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক ‘অসুস্থ’ থাকায় রায় ঘোষণা পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ধার্য করা হয়। কিন্তু ওইদিন সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার মারা যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে রায় ঘোষণার জন্য ১১ নভেম্বর দিন ধার্য করা হয়।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ওই দুই তরুণীকে নিয়ে আসা হয়। মদ খাওয়ানোর পর ওই দুই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। প্রথম দিকে মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই বছরের ৬ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

মামলায় ওই পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামিরা হলেন- আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, সাফাতের দুই বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম ও সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী। তবে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল শুধু সাফাত ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফের বিরুদ্ধে। বাকিদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। আসামিদের মধ্যে শুধু রহমত আলী ছাড়া বাকি সবাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

তদন্ত শেষে ওই বছরের ৮ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের পুলিশ পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। একই বছরের ১৩ জুলাই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলায় চার্জগঠন করেন আদালত। এর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে তা শেষ হয় ২২ আগস্ট।

সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১ , ৩০ কার্তিক ১৪২৮ ৯ রবিউস সানি ১৪৪৩

ক্ষমতা হারালেন সেই বিচারক

প্রধান বিচারপতির নির্দেশ : আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত

আদালত বার্তা পরিবেশক

রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায়ে বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ দেয়া বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন প্রধান বিচারপতি।

গতকাল সকাল থেকেই ওই বিচারককে এজলাসে না বসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। এরপর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারকে সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে আদালতে না বসার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।’

আরও বলা হয়, ‘তার ফৌজদারী বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে বর্তমান কর্মস্থল হতে প্রত্যাহার করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে আইন মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।’

ঘটনার ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার নির্দেশনা কেন দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, ওই বিচারক আইন ও সংবিধান দুটোই লঙ্ঘন করেছেন। সে কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলোও গ্রহণ করা হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের বক্তব্য ‘অসাংবিধানিক ও বেআইনি’। ‘বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রধান বিচারপতি এ শোকজ পাঠাবেন। এ শোকজ যখন আমাদের কাছে পাঠানো হবে, আমরা তার (বিচারক) কাছে পাঠিয়ে দেব।’ বলেন আইনমন্ত্রী। গতকাল দুপুরে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সকাল বেলা শুনলাম প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, তিনি বিজ্ঞ বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করছেন। আপনারা লিখেছেন ???‘বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে’। কেড়ে নেয়া কথাটার মানে হচ্ছে জোর করে কেড়ে নেয়া। এটা কেড়ে নেয়া হচ্ছে না। এ রকম যদি ঘটনা ঘটে প্রধান বিচারপতির এই ক্ষমতা আছে তাকে বিচারিক ক্ষমতা থেকে কিছুদিন সরিয়ে রাখার।’

তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে আমি কিছু বলিনি। এটি (শাস্তিমূলক ব্যবস্থা) উনার (প্রধান বিচারপতি) সিদ্ধান্ত। উনি স্বপ্রণোদিত হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেয় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। ওইদিন আদালত তিনি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোন ধর্ষণের মামলা না নেয় সে আদেশও দেয় এই বিচারক।

আনিসুল হক বলেন, ‘এখন কথা হচ্ছে এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? বিজ্ঞ বিচারকরা প্রতিদিনই কিন্তু রায় দেন। রায়ে কেউ সন্তুষ্ট হয়, কেউ অসন্তুষ্ট হয়। যারা অসন্তুষ্ট হন, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, সংবিধান অনুযায়ী, তারা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে আপিল বিভাগ। সেই আপিল বিভাগের সাংবিধানিক কিছু বাড়তি ক্ষমতাও আছে। সেগুলো তারা প্রয়োগ করেন। রায় দিলেই যে কোন বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা নয়। তারা মেরিটের উপরে, আইনের উপরে, রায় দেয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এখানে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে একজন বিজ্ঞ বিচারক তিনি ওপেন কোর্টে রায় দেয়ার সময় তার পর্যবেক্ষণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছেন, ৭২ ঘণ্টা পর কেউ যদি কোন ধর্ষণ মামলা করতে আসে, তাহলে সেই মামলাটা গ্রহণ না করতে। এটাই হচ্ছে আপত্তির জায়গা।’

আনিসুল হক বলেন, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কোন ফৌজদারি অপরাধের মামলা তামাদি হয় না। নট বার বাই লিমিটেশন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর কিন্তু মামলা হয়নি। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর এই মামলার প্রথম এফআইআর হয়। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, একমাত্র আইন দিয়ে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে বা পক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারকের বক্তব্যটি সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। এই দুটোই তিনি ভায়োলেট (লঙ্ঘন) করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘এই ভায়োলেশনের তাৎপর্যটা কী? অনেক রায় আছে বেআইনি হয়, আপিল বিভাগে গিয়ে বাতিল হয়। এখানে তিনি যে কথাটা বলেছেন, সেটার একটা ইমপ্লিকেশন আছে, একটা কনসিকোয়েন্স আছে। এ কারণেই আজকে বিচার বিভাগের যিনি গার্ডিয়ান, যিনি প্রধান তাকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ঠিক সেই কারণেই আমি আইনমন্ত্রী হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে গতকাল বলেছিলাম, আমি প্রধান বিচারপতির কাছেই বিচার চাইতে পারি। কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনে হয় যে, এটা বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য বিব্রতকর। এটা একটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভুল নির্দেশনা দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, সেজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেটাও সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে কিন্তু এগিয়ে যাবে। আইনে তার যা সুবিধা...তাকে শোকজ করা হবে। তিনি কেন বলেছেন তার ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। সেটা আইনিভাবে যে প্রক্রিয়া দেয়া আছে, সেটাই তার ব্যাপারেও প্রযোজ্য।’

প্রধান বিচারপতি এই শোকজ পাঠাবেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই শোকজ যখন আমাদের কাছে পাঠনো হবে। এটা আমরা তার কাছে পৌঁছে দেব।’

আদালতে এসেও এজলাসে ওঠেননি

গতকাল বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগেই খাসকামড়ায় বসে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পান বিচারক কামরুন্নাহার। এ কারণে আদালতে এলেও এজলাসে বসেননি তিনি। এদিন কোন মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।

ওই ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বিচারক সকাল সাড়ে ৮টার সময় আদালতে আসেন। এরপর তিনি কখন খাস কামরা থেকে চলে গেছেন তা তিনি জানেন না বলে জানান।

বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণের পরই তোলপাড় শুরু হয় সারাদেশে। রায় ঘোষণার দিন মধ্যরাতে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ নামক প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারীরা। এরপর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদালতের এমন পর্যবক্ষণের সমালোচনা করা হয়। গতকালও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণে উদ্বেগ জানিয়েছে। জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়, আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ধর্ষণের বিচার পাওয়া কঠিন করবে।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছিলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের ডাক্তারি প্রতিবেদনে কোন সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের (যৌন সহিংসতা) বিবরণ নেই। ভুক্তভোগীর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মেলেনি। ৩৮ দিন পর এসে তারা (দুই ছাত্রী) বললো ‘রেপড হয়েছি’, বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন বলে পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।

বিচারক রায় পড়ার সময় আরও বলেছিলেন, আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোন প্রমাণ দিতে পারেননি।

১১ নভেম্বর রায় ঘোষণার আগে ২ দফায় তারিখ পিছিয়েছে আদালত। গত ১২ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বিচারক ‘অসুস্থ’ থাকায় রায় ঘোষণা পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ধার্য করা হয়। কিন্তু ওইদিন সিনিয়র আইনজীবী বাসেত মজুমদার মারা যাওয়ায় আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে রায় ঘোষণার জন্য ১১ নভেম্বর দিন ধার্য করা হয়।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ওই দুই তরুণীকে নিয়ে আসা হয়। মদ খাওয়ানোর পর ওই দুই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। প্রথম দিকে মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই বছরের ৬ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

মামলায় ওই পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামিরা হলেন- আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, সাফাতের দুই বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম ও সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী। তবে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল শুধু সাফাত ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফের বিরুদ্ধে। বাকিদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। আসামিদের মধ্যে শুধু রহমত আলী ছাড়া বাকি সবাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

তদন্ত শেষে ওই বছরের ৮ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের পুলিশ পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। একই বছরের ১৩ জুলাই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলায় চার্জগঠন করেন আদালত। এর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে তা শেষ হয় ২২ আগস্ট।