‘সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’

শেখর ভট্টাচার্য

ধর্ম মানুষকে বিনয় শিক্ষা দেয়। ধার্মিকরা সৃষ্টিকর্তার কাছে বিনয়ে নতজানু হন। রবীন্দ্রনাথের মতো ধার্মিকরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে বলেন, “আমার মাথানত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার পরে, সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।” সব সময় বিনয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চান ধার্মিক মানুষরা। যেমন পৃথিবীতে আগমণের জন্য, ফুল মাটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলে, “ধন্য আমি, ধন্য আমি মাটির পরে”। ধার্মিকরাও প্রতি ক্ষণে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নানাভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। প্রকৃত ধার্মিকরা সতর্ক থাকেন তাদের আচরণে কোন মানুষ যাতে অন্তরে ব্যথা না পায়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে ভালোবেসে পরম দয়াময়কে ভালোবাসার অনুভূতি পান ধার্মিকরা। প্রতিটি ধর্মের নির্দিষ্ট করে দেয়া আচরণের বাইরে এ কথাগুলো সব ধর্ম এবং ধার্মিকের জন্য মৌলবাণী। অন্য ধর্ম অন্য মতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করারও উদাহরণ আছে, আমাদের এই উপমহাদেশে। ধার্মিক মানুষেরা মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চিন্তা করেন তাদের পদ স্পর্শে মাটি যেন আঘাত না পায়। সে রকম মানুষ কি করে হিংস্র হয়ে যায়, ধর্মের নামে? সম্প্রতি বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যারা যুক্ত ছিল, তারা কী প্রকৃত ধার্মিক? ধার্মিক মানুষেরা কি অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, মানুষকে হত্যা করতে পারেন? সব শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ধারণা প্রকৃত ধার্মিকরা এ রকম নিষ্ঠুর সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। যারা এ কাজটি ধর্মের নামে করেছেন তাদের কোন অর্থেই ধার্মিক বলা যায় না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে এ রকম আদেশ, নির্দেশ কোথাও নেই যে মানুষকে নির্যাতন করে কোন ধর্মগ্রন্থ অবমাননার প্রতিশোধ নিতে হবে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমার জানামতে কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হতে হয়েছে। তার হৃদয় ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলবাণী ধারণ করে প্রচুর হামদ, নাত যেমন রচনা করেছেন একইভাবে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত উঁচুমানের শ্যামা সংগীতও রচনা করে গেছেন। ধার্মিকদের জন্য তার হৃদয় ভরা ভালোবাসা ছিল কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ী, ভ-দের জন্য ছিল না। কী আশ্চর্য, তার মৃত্যুর পর তার বাণীকে অধার্মিকেরাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে। তিনি ছিলেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে পরিপূর্ণ “মানুষ”, “ধার্মিক” এবং “বাঙালি”। তার চরিত্রে ভ-ামির লেশ মাত্র ছিল না। নজরুল তার সারাটি জীবন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। নজরুলকে বাঙালি প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হয়েছে। নজরুলকে তার আদর্শের পক্ষে নিজেকেই দাঁড়াতে হয়েছে, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি শুধু হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ সারাজীবন ভেদাভেদের বিপক্ষে তার সমস্ত প্রয়াস, “কা-ারি হুঁশিয়ার” কবিতায় তাই মানুষের পক্ষে তার আন্তরিক উচ্চারণ, “হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কা-ারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”

মানুষ কবিতার প্রতিটি পঙ্্ক্তিতে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার যেমন ভালো-বাসার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে একইভাবে ধর্মের নামে অধর্ম যারা করেন তাদের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা “মানুষ” কবিতার পঙ্্ক্তিগুলো পড়লে আমাদের জাতীয় কবির উচ্চমানের ধর্মীয় বোধের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ি, যে ধর্ম বোধকে ধারণ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। যখন তিনি বলেন, “মানুষেরে ঘৃণা করি’/ও’ কারা কোরআন, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’/ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পূজিছে গ্রন্থ ভ-ের দল! মূর্খরা সব শোনো/মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো। “তার কবিতার এই মর্ম কথা আজও কতো প্রাসঙ্গিক। প্রকৃত বাঙালি, প্রকৃত ধার্মিক, বাংলা সাহিত্যের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। আমরা তাকে মেনে নেই, অনুসরণ করি আমাদের সুবিধা অনুযায়ী। তার রচনাকে সংস্কার করে আমরা “মহাশ্মশান”কে “গোরস্তান”এ রূপান্তরিত করে তাকে উগ্র ধার্মিক বানানোর চেষ্টা করি। তার হামদ, নাত গেয়ে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি কিন্তু তার কাছ থেকে ধর্ম বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা গ্রহণ করি না।

বাঙালির মনুষ্যত্ব বিকাশের কিংবা মানুষ হওয়ার চেষ্টা কিন্তু সমসাময়িক কালের নয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে আমরা বাঙালি কবি চ-ীদাসের কাছ থেকে উদাত্ত আহ্বান শুনতে পাই, “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”, সে কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই রবীন্দ্রনাথ নজরুল হয়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। এই যে চ-ীদাসের মানুষের প্রতি উচ্চমানের ভালোবাসা তা তার সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্য কিংবা অন্য কোন সাহিত্যে শুনতে পাওয়া যায় না। ধর্ম বোধকে অন্তরে ধারণ করে মানুষের প্রতি ভালোবাসাই হলো বাঙালি আদি সংস্কৃতির মর্মকথা। এই মর্মকথাকে ধারণ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বাঙালির আপন সংস্কৃতি আবারও জোরালো হয়ে উঠল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ধ্বনি উঠল, “তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি”। “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা , যমুনা”, পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল সারা পূর্ববাংলা, “বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বুদ্ধ আমারা সবাই বাঙালি। “আত্মপরিচয়ের কোন অস্পষ্টতা নেই। কুয়াশার পর্দা নেই। রাজপথেই মীমাংসিত আমাদের আত্মপরিচয়। এই পরিচয়ে নেই কোন সংকীর্ণতা, নেই কোন আত্মপ্রবঞ্চনা, নেই কোন স্বার্থবোধের ছিটেফোঁটা।

এই পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই আমাদের প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। যাকে আমাদের বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফ বলেছেন “দাম দিয়ে কেনা। “তার সেই বিখ্যাত গানের পঙক্তি উল্লেখ করলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই দাম দেয়ার বিষয়টি অনুভব করতে পারেন। “আমি) দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারোর দানে পাওয়া নয়/আমি) দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/ জানা আছে জগতময়...”। এই দাম দিয়েই রাজপথে বিষয়টি ফয়সালা হয়। এই দাম দিতে গিয়ে তিরিশ লাখ লোক আত্মাহুতি দেয়, দুই লক্ষ মা, বোনের সম্ভ্রম হানি হয়। অগণণ মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন। লক্ষ কোটি মানুষের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে লেখা হয় বাহাত্তরের সংবিধান। সে সংবিধানে শহীদদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উঠে আসে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। মনে রাখতে হবে বাহাত্তরের সংবিধান হলো বাঙালি জাতির সঙ্গে বাংলাদেশের লিখিত চুক্তি। সে চুক্তি থেকে বিচ্যুত হওয়া শহীদদের রক্তের শপথ থেকে দূরে সরে আসা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলনীতি থেকে পথভ্রষ্ট হওয়া। কী আশ্চর্য! গত কয়েক বছর, পথে ঘাটে ধর্মসভার নামে বাহাত্তরের সংবিধানের প্রতি বিষোদ্গার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ রকম কথা বলে, সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এ রকম বিভ্রান্তি ছড়ানোর পরও সংবিধান অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির জন্য রাষ্ট্র তাদের বিচারের সম্মুখীন করেনি। শাল্লাতে আক্রান্ত ঝুমন দাসকে জামিন না দিয়ে মাসের পর মাস কারাগারে থাকতে হয় কিন্তু সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননাকারীদের রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ চ্যালেঞ্জ জানাতে ভয় পায়। নীরবতার সংস্কৃতি গ্রাস করে সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনকে।

আমাদের সবার নাগের ডগায় বেড়ে উঠেছে অসংখ্য বিষাক্ত শ্বাপদ, যে শ্বাপদের বিষ নিঃশ্বাস আমাদের ঘাড়ের ওপরেই পড়ছিল। আমরা সবাই খুব ভালোভাবে তাদের উষ্ণ নিঃশ্বাস সারা শরীরজুড়ে অনুভব করছিলাম। আমরা অনুভব করে, অনুভব না করার ভান করে যাচ্ছিলাম অনেক দিন ধরে। এ রকম করে করে আমরা সর্বনাশের প্রায় শেষ সোপানে এসে পড়েছি। এখনও সময় আছে, আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণদের প্রতি, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাটক মঞ্চায়ন করে এ রকম গ্রহণ বেলায়। আমরা আমাদের দেশের শুভশক্তি সম্পন্ন মানুষদের বিশ্বাস করি যারা সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সারা দেশে সম্প্রীতি সম্মেলন করে বেড়াচ্ছেন। যারা কুমিল্লা, সিলেট, রংপুর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক হামলায় আক্রান্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের ভালোবাসার ঋণ বাংলাদেশ শোধ করতে পারবে না।

বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে, প্রয়োজন রামু থেকে শুরু করে কুমিল্লা পর্যন্ত সংগঠিত সব সাম্প্রদায়িক হামলার, নেপথ্যের কুশীলবদের ধরে এনে সম্পূর্ণ বিচার কার্য সম্পাদন করা। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। যদি আমরা তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে কুমিল্লার পরের ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। এ রকম হামলার পেছনের মানুষদের সাহসের সীমা অতিক্রম করলে ভোটের রাজনীতির হিসাব হয়তো মিলবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আর পাওয়া যাবে না। আমরা নিশ্চয় ৩০ লক্ষ শহীদের জীবনের দামের এবং তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসব না। যদি না আসি, তাহলে এখনই সময়, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা এবং সফলভাবে বিচারের সমাপ্তি ঘটানো।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১ , ৩০ কার্তিক ১৪২৮ ৯ রবিউস সানি ১৪৪৩

‘সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’

শেখর ভট্টাচার্য

ধর্ম মানুষকে বিনয় শিক্ষা দেয়। ধার্মিকরা সৃষ্টিকর্তার কাছে বিনয়ে নতজানু হন। রবীন্দ্রনাথের মতো ধার্মিকরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে বলেন, “আমার মাথানত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার পরে, সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।” সব সময় বিনয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চান ধার্মিক মানুষরা। যেমন পৃথিবীতে আগমণের জন্য, ফুল মাটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলে, “ধন্য আমি, ধন্য আমি মাটির পরে”। ধার্মিকরাও প্রতি ক্ষণে সৃষ্টিকর্তার প্রতি নানাভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। প্রকৃত ধার্মিকরা সতর্ক থাকেন তাদের আচরণে কোন মানুষ যাতে অন্তরে ব্যথা না পায়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে ভালোবেসে পরম দয়াময়কে ভালোবাসার অনুভূতি পান ধার্মিকরা। প্রতিটি ধর্মের নির্দিষ্ট করে দেয়া আচরণের বাইরে এ কথাগুলো সব ধর্ম এবং ধার্মিকের জন্য মৌলবাণী। অন্য ধর্ম অন্য মতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করারও উদাহরণ আছে, আমাদের এই উপমহাদেশে। ধার্মিক মানুষেরা মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চিন্তা করেন তাদের পদ স্পর্শে মাটি যেন আঘাত না পায়। সে রকম মানুষ কি করে হিংস্র হয়ে যায়, ধর্মের নামে? সম্প্রতি বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যারা যুক্ত ছিল, তারা কী প্রকৃত ধার্মিক? ধার্মিক মানুষেরা কি অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, মানুষকে হত্যা করতে পারেন? সব শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের ধারণা প্রকৃত ধার্মিকরা এ রকম নিষ্ঠুর সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। যারা এ কাজটি ধর্মের নামে করেছেন তাদের কোন অর্থেই ধার্মিক বলা যায় না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে এ রকম আদেশ, নির্দেশ কোথাও নেই যে মানুষকে নির্যাতন করে কোন ধর্মগ্রন্থ অবমাননার প্রতিশোধ নিতে হবে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমার জানামতে কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হতে হয়েছে। তার হৃদয় ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলবাণী ধারণ করে প্রচুর হামদ, নাত যেমন রচনা করেছেন একইভাবে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত উঁচুমানের শ্যামা সংগীতও রচনা করে গেছেন। ধার্মিকদের জন্য তার হৃদয় ভরা ভালোবাসা ছিল কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ী, ভ-দের জন্য ছিল না। কী আশ্চর্য, তার মৃত্যুর পর তার বাণীকে অধার্মিকেরাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে। তিনি ছিলেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে পরিপূর্ণ “মানুষ”, “ধার্মিক” এবং “বাঙালি”। তার চরিত্রে ভ-ামির লেশ মাত্র ছিল না। নজরুল তার সারাটি জীবন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। নজরুলকে বাঙালি প্রধান দুটি সম্প্রদায়ের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হয়েছে। নজরুলকে তার আদর্শের পক্ষে নিজেকেই দাঁড়াতে হয়েছে, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি শুধু হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’ সারাজীবন ভেদাভেদের বিপক্ষে তার সমস্ত প্রয়াস, “কা-ারি হুঁশিয়ার” কবিতায় তাই মানুষের পক্ষে তার আন্তরিক উচ্চারণ, “হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কা-ারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”

মানুষ কবিতার প্রতিটি পঙ্্ক্তিতে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার যেমন ভালো-বাসার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে একইভাবে ধর্মের নামে অধর্ম যারা করেন তাদের প্রতি আন্তরিক ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা “মানুষ” কবিতার পঙ্্ক্তিগুলো পড়লে আমাদের জাতীয় কবির উচ্চমানের ধর্মীয় বোধের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ি, যে ধর্ম বোধকে ধারণ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। যখন তিনি বলেন, “মানুষেরে ঘৃণা করি’/ও’ কারা কোরআন, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’/ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পূজিছে গ্রন্থ ভ-ের দল! মূর্খরা সব শোনো/মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো। “তার কবিতার এই মর্ম কথা আজও কতো প্রাসঙ্গিক। প্রকৃত বাঙালি, প্রকৃত ধার্মিক, বাংলা সাহিত্যের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। আমরা তাকে মেনে নেই, অনুসরণ করি আমাদের সুবিধা অনুযায়ী। তার রচনাকে সংস্কার করে আমরা “মহাশ্মশান”কে “গোরস্তান”এ রূপান্তরিত করে তাকে উগ্র ধার্মিক বানানোর চেষ্টা করি। তার হামদ, নাত গেয়ে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি কিন্তু তার কাছ থেকে ধর্ম বোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা গ্রহণ করি না।

বাঙালির মনুষ্যত্ব বিকাশের কিংবা মানুষ হওয়ার চেষ্টা কিন্তু সমসাময়িক কালের নয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে আমরা বাঙালি কবি চ-ীদাসের কাছ থেকে উদাত্ত আহ্বান শুনতে পাই, “শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”, সে কথারই প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই রবীন্দ্রনাথ নজরুল হয়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। এই যে চ-ীদাসের মানুষের প্রতি উচ্চমানের ভালোবাসা তা তার সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্য কিংবা অন্য কোন সাহিত্যে শুনতে পাওয়া যায় না। ধর্ম বোধকে অন্তরে ধারণ করে মানুষের প্রতি ভালোবাসাই হলো বাঙালি আদি সংস্কৃতির মর্মকথা। এই মর্মকথাকে ধারণ করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বাঙালির আপন সংস্কৃতি আবারও জোরালো হয়ে উঠল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ধ্বনি উঠল, “তুমি কে, আমি কে, বাঙালি, বাঙালি”। “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা , যমুনা”, পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেল সারা পূর্ববাংলা, “বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বুদ্ধ আমারা সবাই বাঙালি। “আত্মপরিচয়ের কোন অস্পষ্টতা নেই। কুয়াশার পর্দা নেই। রাজপথেই মীমাংসিত আমাদের আত্মপরিচয়। এই পরিচয়ে নেই কোন সংকীর্ণতা, নেই কোন আত্মপ্রবঞ্চনা, নেই কোন স্বার্থবোধের ছিটেফোঁটা।

এই পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই আমাদের প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। যাকে আমাদের বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফ বলেছেন “দাম দিয়ে কেনা। “তার সেই বিখ্যাত গানের পঙক্তি উল্লেখ করলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই দাম দেয়ার বিষয়টি অনুভব করতে পারেন। “আমি) দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারোর দানে পাওয়া নয়/আমি) দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/ জানা আছে জগতময়...”। এই দাম দিয়েই রাজপথে বিষয়টি ফয়সালা হয়। এই দাম দিতে গিয়ে তিরিশ লাখ লোক আত্মাহুতি দেয়, দুই লক্ষ মা, বোনের সম্ভ্রম হানি হয়। অগণণ মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন। লক্ষ কোটি মানুষের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে লেখা হয় বাহাত্তরের সংবিধান। সে সংবিধানে শহীদদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উঠে আসে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। মনে রাখতে হবে বাহাত্তরের সংবিধান হলো বাঙালি জাতির সঙ্গে বাংলাদেশের লিখিত চুক্তি। সে চুক্তি থেকে বিচ্যুত হওয়া শহীদদের রক্তের শপথ থেকে দূরে সরে আসা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলনীতি থেকে পথভ্রষ্ট হওয়া। কী আশ্চর্য! গত কয়েক বছর, পথে ঘাটে ধর্মসভার নামে বাহাত্তরের সংবিধানের প্রতি বিষোদ্গার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ রকম কথা বলে, সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এ রকম বিভ্রান্তি ছড়ানোর পরও সংবিধান অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির জন্য রাষ্ট্র তাদের বিচারের সম্মুখীন করেনি। শাল্লাতে আক্রান্ত ঝুমন দাসকে জামিন না দিয়ে মাসের পর মাস কারাগারে থাকতে হয় কিন্তু সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননাকারীদের রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ চ্যালেঞ্জ জানাতে ভয় পায়। নীরবতার সংস্কৃতি গ্রাস করে সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনকে।

আমাদের সবার নাগের ডগায় বেড়ে উঠেছে অসংখ্য বিষাক্ত শ্বাপদ, যে শ্বাপদের বিষ নিঃশ্বাস আমাদের ঘাড়ের ওপরেই পড়ছিল। আমরা সবাই খুব ভালোভাবে তাদের উষ্ণ নিঃশ্বাস সারা শরীরজুড়ে অনুভব করছিলাম। আমরা অনুভব করে, অনুভব না করার ভান করে যাচ্ছিলাম অনেক দিন ধরে। এ রকম করে করে আমরা সর্বনাশের প্রায় শেষ সোপানে এসে পড়েছি। এখনও সময় আছে, আমরা আশাবাদী আমাদের তরুণদের প্রতি, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাটক মঞ্চায়ন করে এ রকম গ্রহণ বেলায়। আমরা আমাদের দেশের শুভশক্তি সম্পন্ন মানুষদের বিশ্বাস করি যারা সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সারা দেশে সম্প্রীতি সম্মেলন করে বেড়াচ্ছেন। যারা কুমিল্লা, সিলেট, রংপুর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক হামলায় আক্রান্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের ভালোবাসার ঋণ বাংলাদেশ শোধ করতে পারবে না।

বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে, প্রয়োজন রামু থেকে শুরু করে কুমিল্লা পর্যন্ত সংগঠিত সব সাম্প্রদায়িক হামলার, নেপথ্যের কুশীলবদের ধরে এনে সম্পূর্ণ বিচার কার্য সম্পাদন করা। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। যদি আমরা তা করতে ব্যর্থ হই তাহলে কুমিল্লার পরের ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। এ রকম হামলার পেছনের মানুষদের সাহসের সীমা অতিক্রম করলে ভোটের রাজনীতির হিসাব হয়তো মিলবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আর পাওয়া যাবে না। আমরা নিশ্চয় ৩০ লক্ষ শহীদের জীবনের দামের এবং তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসব না। যদি না আসি, তাহলে এখনই সময়, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা এবং সফলভাবে বিচারের সমাপ্তি ঘটানো।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]