মাতৃভাষা নিয়ে হেলাফেলা

এমএ কবীর

পাঠশালার এক ছাত্র শিক্ষকের কাছে জানতে চাইল, স্যার, একটি কবিতার লাইন ‘কপোল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে’। কপোল শব্দের অর্থ কী?

শিক্ষক টেবিলের ওপরে দুই পা উঠিয়ে সুখনিদ্রায় ছিলেন। ছাত্রের প্রশ্নে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মেজাজ একটু বিগড়ে গেল। তিনি ছাত্রের কথা ভালো করে শোনেননি। তাই চোখ রগড়ে বললেন, কী প্রশ্ন করলি? ছাত্র আবার প্রশ্নটি করল। এবার একটু ভেবে শিক্ষক বললেন, ওটা কপোল নয়, কপাল হবে, কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে। এবার বিস্মিত ছাত্রের প্রশ্ন, স্যার কপাল কীভাবে নয়নের জলে ভিজল? শিক্ষক আবারও একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, পা দুটো বাঁধা ছিল তমালের ডালে!

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ভালোইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা সাবলীলভাবে ইংরেজি পড়তে পারে না। বিষয়টি নজরে আসে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ মো. আক্তারুজ্জামানের। তাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক নার্গিস সুলতানা ছবিকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা চিঠির ২২ জায়গায় ভুল করেন তিনি। সেই চিঠি ফেসবুকে ছড়িয়ে নানা মন্তব্যে সরগরম হয়ে উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনেকে ফেসবুকে লেখেনÑ ‘বিচারপতির বিচার করবে কে?’

প্রাথমিক শিক্ষায় জাতীয় পদকপ্রাপ্ত একজন জেলা প্রশাসকের এক চিঠিতে পাওয়া যায় ২৪টি ভুল। ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘মৃত’ শব্দটির বানান ‘মৃতঃ’, ‘মো.’ শব্দের বানানে শব্দের শুরুতে মাত্রাযুক্ত এ-কার। ‘জনাব’ লেখার পর (,) কমা ব্যবহার করা হয়নি। ‘পূর্বপরিচয়’ শব্দটি আলাদাভাবে ‘পূর্ব’ ও ‘পরিচয়’ হিসেবে লেখা হয়েছে। ‘কোনও’ শব্দটিকে লেখা হয়েছে ‘কোন’ বানানে। সরকারি শব্দের বানান লেখা হয়েছে ‘সরকারী’। নরসিংদী জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি চিঠিতে ভুল পাওয়া গেছে ১৭টি। উপ-পরিচালক ড. এটিএম মাহাবুব-উল করিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে ‘পুনর্বিবেচনা’ শব্দটির বানান আলাদাভাবে দুই শব্দে ‘পুন: বিবেচনা’ লেখা হয়েছে। ‘আবেদনপত্র’ লেখা হয়েছে ‘আবেদন পত্র’ দুই শব্দে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত অফিস আদেশের মূল অংশে ২৭টি ভুল পাওয়া যায়। চিঠিতে ‘ডিগ্রি’ লেখা হয়েছে ‘ডিগ্রী’, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ‘অশিক্ষক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কর্মচারীদের শব্দের জায়াগায় লেখা হয়েছে ‘কর্মচারীদেরকে’। এছাড়া, ৫০টির বেশি শব্দে একটি জটিল বাক্যে আদেশের পুরো বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন চিঠিতেও একই ধরনের অনেক ভুল পাওয়া যায় অহরহ। আর প্রায় সব চিঠিই লেখা হয় দুর্বোধ্য ভাষায়।

সরকারি এসব চিঠি যারা লেখেন, তারা যেমন বানান সচেতন নন, তেমনি আগের তৈরি করা ফরমেটেই নতুন বিষয়টি উপস্থাপন করে চিঠি, নোটিশ বা প্রজ্ঞাপন ফাইলে উপস্থাপন করেন। আর কর্মকর্তারাও কাজের চাপে অথবা বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিয়েই স্বাক্ষর করেন। সরকারি দপ্তরগুলোর বিষয়ে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক কর্মকর্তা বানান বা ভাষাগত বিষয়ে ভালো জানেন না। চর্চাও করেন না।’

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ইংরেজি মূল পাঠ্যবই ENGLISH FOR TODAY এর Unit-1, Lesson-1 এ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে সন্নিবেশন করা হয়েছে। মূল ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভাষণটির সমাপনী টানেন। কিন্তু পাঠ্যসূচিতে ‘জয় বাংলা’র ইংরেজি অনুবাদে লেখা হয়েছে Long live Bengal যার বাংলা অনুবাদ হয় বাংলা দীর্ঘজীবী হোক। এটি বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত মূল উক্তিটির সঙ্গে কখনোই মেলে না। মূলত জয় বাংলার ইংরেজি অনুবাদ হবে Victor Bengal তবে জয় বাংলা কে ‘Joy Bangla’ রূপে উল্লেখ করা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। এতে ভাষণটির মূল ঐতিহ্য সুরক্ষিত থাকে। উচ্চ আদালত জয় বাংলাকে একটি জাতীয় স্লে­াগান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাছাড়া ভাষণটি জাতিসংঘ কর্তৃক ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ বা বিশ^ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই এটি জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

অনার্স চতুর্থবর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ের একটি গাইডে লেখা হয়েছে ‘চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মদ’। ব্যতিক্রম প্রকাশনী প্রকাশিত ‘অনার্স চতুর্থবর্ষ উদ্ভিদবিজ্ঞান ইজি প্লাস ১ম খ-’ বইয়ের ২৫৫ পৃষ্ঠায় এমনটাই বলা হয়েছে। রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা শ্যামল সরদার বইটি লিখেছেন।

কিছুদিন আগে একই প্রকাশনীর একটি গাইড বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে দুজন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। তাদের শোকজ করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন, মাগুরার সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ও কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে প্রভাষক মো. আবু বকর সিদ্দিক। তারা যৌথভাবে ব্যতিক্রম পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি’ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় পত্র) বিষয়ের গাইড বইয়ের লেখক।

ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্টার দপ্তরের একের পর এক প্রজ্ঞাপনে ভুল ধরা পড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির যে কোন প্রজ্ঞাপনে কোন না কোন ভুল যেন থাকবেই। সম্প্রতি বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বিজ্ঞপ্তিতেও বিশ^বিদ্যালয়ের লোগো, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নাম কিংবা সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের এমন কা-কে কেন্দ্র করে গত ২৭ এপ্রিল এক সহকারী প্রক্টরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২৮ এপ্রিল ছুটি বৃদ্ধি নিয়ে জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনে জোড়াতালি চোখে পড়ে। এছাড়া ১৪ জুলাই করপোরেট লোনধারী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে রেজিস্টার দপ্তর এক অফিস আদেশ জারি করে। সেখানে ‘Covid’ এর পরিবর্তে ‘Covit’ এবং ‘আগস্ট’ এর জায়গায় ‘আগষ্ট’ লেখা হয়।

অল্প কিছুদিন আগে ফেসবুকজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এক আশ্চর্য বিজ্ঞপ্তি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সেই বিজ্ঞপ্তিটি লেখা হয় বাংলা ভাষায়। সেখানে ছিল ভুলের পরে ভুল বানান। ৬ লাইনের বিজ্ঞপ্তিতে ভুল ছিল ২২টি।

সবাই বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লিখবেন, এত বড় আশা করা অন্যায় হবে। অনেকেই আছেন, যারা একবর্ণ বাংলা লিখতে পারেন না। আমরা আসলে তাদের নিয়ে কথা বলছি না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যিনি এ বিজ্ঞপ্তিটি লিখেছেন, তিনি যে অক্ষরজ্ঞানহীন নন, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে না পারলে আমরা হাসাহাসি করি। কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলা বলা বা লেখা হয়তোবা আমাদের মনে সে রকম রেখাপাত করে না। নিজ ভাষার প্রতি এই অবহেলা ঔপনিবেশিক আমলের দাস্য মনোভাব কিনা, কে জানে।

একটি বৃহৎ বিদ্যাপীঠে বাংলা লেখার এহেন অবস্থা নিজেদের দৈন্যকেই উলঙ্গভাবে প্রকাশ করে। নিজ ভাষার প্রতি দায়িত্ব, মমত্ব, ভালোবাসা কিছুই যে হালে পানি পাচ্ছে না, অর্থাৎ ধীরে ধীরে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় হারিয়েও দিব্যি সুখে রয়েছি, সেটাই মূর্ত হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে থাকলে ধীরে ধীরে এ পতনটি টের পাওয়া যায়, তার আগে নয়।

শিক্ষা নিয়ে গর্ব করার মতো অতীত নিশ্চয়ই আমাদের আছে। কিন্তু চর্চার অভাবে তাতে জং ধরেছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা আর সুষ্ঠুভাবে জ্ঞানচর্চার সুযোগ কমে গেছে। বিভিন্ন প্রকল্প, ক্লাসের বাইরেই অর্থ উপার্জনের নানা পথ খুলে যাওয়ায় বিশ^বিদ্যালয়ের আসল কাজটাই শিথিল হয়ে পড়ছে। আর এর ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ছে এ ধরনের শিক্ষাহীন চর্চা। যারা ‘স্বশরীরে’, ‘ক্লাশে’, ‘অংশগ্রহন’ শব্দগুলো লিখতে পারেন না, তারা কীভাবে চাকরি পেলেন, সেটাই তো প্রশ্ন। যারা তাদের মনোনীত করেছেন, তাদের কি কোনো দায় নেই?

কে না জানে, মাতৃভাষার শক্তি অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে প্রবল। শুধু আত্মবিস্মৃত জাতি সে কথা স্বীকার করতে চায় না। তারা গ্রহণ-বর্জন বলতে বোঝে নিজেরটা বর্জন, অন্যেরটা গ্রহণ। ফলে গ্রহণে-বর্জনে সংস্কৃতি আর চাঙা হয়ে ওঠে না।

যিনি এ রকম এক অসাধারণ বাংলা লিখেছেন, তাকে তার ভুল ধরিয়ে দেয়া কি হয়েছে? তাকে কি বোঝানো হয়েছে, বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে মাতৃভাষা নিয়ে এ রকম হেলাফেলা করতে নেই? মাতৃভাষা কোন পর্যায়ে আছে, তা জানতে হলে টেলিভিশনে চোখ রাখুন, করপোরেট সংস্কৃতির ভেতরে ঢুকে যান। দেখবেন, বাংলা ছাড়াই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি মানার নির্দেশনা থাকলেও প্রায় নয় বছরেও প্রশাসনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর সরকারি কাজে প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের নির্দেশ দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

[লেখক : সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১ , ৩০ কার্তিক ১৪২৮ ৯ রবিউস সানি ১৪৪৩

মাতৃভাষা নিয়ে হেলাফেলা

এমএ কবীর

পাঠশালার এক ছাত্র শিক্ষকের কাছে জানতে চাইল, স্যার, একটি কবিতার লাইন ‘কপোল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে’। কপোল শব্দের অর্থ কী?

শিক্ষক টেবিলের ওপরে দুই পা উঠিয়ে সুখনিদ্রায় ছিলেন। ছাত্রের প্রশ্নে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মেজাজ একটু বিগড়ে গেল। তিনি ছাত্রের কথা ভালো করে শোনেননি। তাই চোখ রগড়ে বললেন, কী প্রশ্ন করলি? ছাত্র আবার প্রশ্নটি করল। এবার একটু ভেবে শিক্ষক বললেন, ওটা কপোল নয়, কপাল হবে, কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে। এবার বিস্মিত ছাত্রের প্রশ্ন, স্যার কপাল কীভাবে নয়নের জলে ভিজল? শিক্ষক আবারও একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, পা দুটো বাঁধা ছিল তমালের ডালে!

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ভালোইপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা সাবলীলভাবে ইংরেজি পড়তে পারে না। বিষয়টি নজরে আসে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ মো. আক্তারুজ্জামানের। তাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক নার্গিস সুলতানা ছবিকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা চিঠির ২২ জায়গায় ভুল করেন তিনি। সেই চিঠি ফেসবুকে ছড়িয়ে নানা মন্তব্যে সরগরম হয়ে উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনেকে ফেসবুকে লেখেনÑ ‘বিচারপতির বিচার করবে কে?’

প্রাথমিক শিক্ষায় জাতীয় পদকপ্রাপ্ত একজন জেলা প্রশাসকের এক চিঠিতে পাওয়া যায় ২৪টি ভুল। ভুলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘মৃত’ শব্দটির বানান ‘মৃতঃ’, ‘মো.’ শব্দের বানানে শব্দের শুরুতে মাত্রাযুক্ত এ-কার। ‘জনাব’ লেখার পর (,) কমা ব্যবহার করা হয়নি। ‘পূর্বপরিচয়’ শব্দটি আলাদাভাবে ‘পূর্ব’ ও ‘পরিচয়’ হিসেবে লেখা হয়েছে। ‘কোনও’ শব্দটিকে লেখা হয়েছে ‘কোন’ বানানে। সরকারি শব্দের বানান লেখা হয়েছে ‘সরকারী’। নরসিংদী জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি চিঠিতে ভুল পাওয়া গেছে ১৭টি। উপ-পরিচালক ড. এটিএম মাহাবুব-উল করিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে ‘পুনর্বিবেচনা’ শব্দটির বানান আলাদাভাবে দুই শব্দে ‘পুন: বিবেচনা’ লেখা হয়েছে। ‘আবেদনপত্র’ লেখা হয়েছে ‘আবেদন পত্র’ দুই শব্দে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক স্বাক্ষরিত অফিস আদেশের মূল অংশে ২৭টি ভুল পাওয়া যায়। চিঠিতে ‘ডিগ্রি’ লেখা হয়েছে ‘ডিগ্রী’, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ‘অশিক্ষক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কর্মচারীদের শব্দের জায়াগায় লেখা হয়েছে ‘কর্মচারীদেরকে’। এছাড়া, ৫০টির বেশি শব্দে একটি জটিল বাক্যে আদেশের পুরো বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন চিঠিতেও একই ধরনের অনেক ভুল পাওয়া যায় অহরহ। আর প্রায় সব চিঠিই লেখা হয় দুর্বোধ্য ভাষায়।

সরকারি এসব চিঠি যারা লেখেন, তারা যেমন বানান সচেতন নন, তেমনি আগের তৈরি করা ফরমেটেই নতুন বিষয়টি উপস্থাপন করে চিঠি, নোটিশ বা প্রজ্ঞাপন ফাইলে উপস্থাপন করেন। আর কর্মকর্তারাও কাজের চাপে অথবা বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিয়েই স্বাক্ষর করেন। সরকারি দপ্তরগুলোর বিষয়ে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক কর্মকর্তা বানান বা ভাষাগত বিষয়ে ভালো জানেন না। চর্চাও করেন না।’

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ইংরেজি মূল পাঠ্যবই ENGLISH FOR TODAY এর Unit-1, Lesson-1 এ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে সন্নিবেশন করা হয়েছে। মূল ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভাষণটির সমাপনী টানেন। কিন্তু পাঠ্যসূচিতে ‘জয় বাংলা’র ইংরেজি অনুবাদে লেখা হয়েছে Long live Bengal যার বাংলা অনুবাদ হয় বাংলা দীর্ঘজীবী হোক। এটি বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত মূল উক্তিটির সঙ্গে কখনোই মেলে না। মূলত জয় বাংলার ইংরেজি অনুবাদ হবে Victor Bengal তবে জয় বাংলা কে ‘Joy Bangla’ রূপে উল্লেখ করা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। এতে ভাষণটির মূল ঐতিহ্য সুরক্ষিত থাকে। উচ্চ আদালত জয় বাংলাকে একটি জাতীয় স্লে­াগান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাছাড়া ভাষণটি জাতিসংঘ কর্তৃক ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ বা বিশ^ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই এটি জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

অনার্স চতুর্থবর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ের একটি গাইডে লেখা হয়েছে ‘চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মদ’। ব্যতিক্রম প্রকাশনী প্রকাশিত ‘অনার্স চতুর্থবর্ষ উদ্ভিদবিজ্ঞান ইজি প্লাস ১ম খ-’ বইয়ের ২৫৫ পৃষ্ঠায় এমনটাই বলা হয়েছে। রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা শ্যামল সরদার বইটি লিখেছেন।

কিছুদিন আগে একই প্রকাশনীর একটি গাইড বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে দুজন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। তাদের শোকজ করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন, মাগুরার সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ও কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে প্রভাষক মো. আবু বকর সিদ্দিক। তারা যৌথভাবে ব্যতিক্রম পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি’ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় পত্র) বিষয়ের গাইড বইয়ের লেখক।

ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের রেজিস্টার দপ্তরের একের পর এক প্রজ্ঞাপনে ভুল ধরা পড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির যে কোন প্রজ্ঞাপনে কোন না কোন ভুল যেন থাকবেই। সম্প্রতি বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বিজ্ঞপ্তিতেও বিশ^বিদ্যালয়ের লোগো, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নাম কিংবা সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের এমন কা-কে কেন্দ্র করে গত ২৭ এপ্রিল এক সহকারী প্রক্টরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ২৮ এপ্রিল ছুটি বৃদ্ধি নিয়ে জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনে জোড়াতালি চোখে পড়ে। এছাড়া ১৪ জুলাই করপোরেট লোনধারী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে রেজিস্টার দপ্তর এক অফিস আদেশ জারি করে। সেখানে ‘Covid’ এর পরিবর্তে ‘Covit’ এবং ‘আগস্ট’ এর জায়গায় ‘আগষ্ট’ লেখা হয়।

অল্প কিছুদিন আগে ফেসবুকজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এক আশ্চর্য বিজ্ঞপ্তি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সেই বিজ্ঞপ্তিটি লেখা হয় বাংলা ভাষায়। সেখানে ছিল ভুলের পরে ভুল বানান। ৬ লাইনের বিজ্ঞপ্তিতে ভুল ছিল ২২টি।

সবাই বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লিখবেন, এত বড় আশা করা অন্যায় হবে। অনেকেই আছেন, যারা একবর্ণ বাংলা লিখতে পারেন না। আমরা আসলে তাদের নিয়ে কথা বলছি না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যিনি এ বিজ্ঞপ্তিটি লিখেছেন, তিনি যে অক্ষরজ্ঞানহীন নন, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে না পারলে আমরা হাসাহাসি করি। কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলা বলা বা লেখা হয়তোবা আমাদের মনে সে রকম রেখাপাত করে না। নিজ ভাষার প্রতি এই অবহেলা ঔপনিবেশিক আমলের দাস্য মনোভাব কিনা, কে জানে।

একটি বৃহৎ বিদ্যাপীঠে বাংলা লেখার এহেন অবস্থা নিজেদের দৈন্যকেই উলঙ্গভাবে প্রকাশ করে। নিজ ভাষার প্রতি দায়িত্ব, মমত্ব, ভালোবাসা কিছুই যে হালে পানি পাচ্ছে না, অর্থাৎ ধীরে ধীরে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় হারিয়েও দিব্যি সুখে রয়েছি, সেটাই মূর্ত হয়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়তে থাকলে ধীরে ধীরে এ পতনটি টের পাওয়া যায়, তার আগে নয়।

শিক্ষা নিয়ে গর্ব করার মতো অতীত নিশ্চয়ই আমাদের আছে। কিন্তু চর্চার অভাবে তাতে জং ধরেছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা আর সুষ্ঠুভাবে জ্ঞানচর্চার সুযোগ কমে গেছে। বিভিন্ন প্রকল্প, ক্লাসের বাইরেই অর্থ উপার্জনের নানা পথ খুলে যাওয়ায় বিশ^বিদ্যালয়ের আসল কাজটাই শিথিল হয়ে পড়ছে। আর এর ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ছে এ ধরনের শিক্ষাহীন চর্চা। যারা ‘স্বশরীরে’, ‘ক্লাশে’, ‘অংশগ্রহন’ শব্দগুলো লিখতে পারেন না, তারা কীভাবে চাকরি পেলেন, সেটাই তো প্রশ্ন। যারা তাদের মনোনীত করেছেন, তাদের কি কোনো দায় নেই?

কে না জানে, মাতৃভাষার শক্তি অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে প্রবল। শুধু আত্মবিস্মৃত জাতি সে কথা স্বীকার করতে চায় না। তারা গ্রহণ-বর্জন বলতে বোঝে নিজেরটা বর্জন, অন্যেরটা গ্রহণ। ফলে গ্রহণে-বর্জনে সংস্কৃতি আর চাঙা হয়ে ওঠে না।

যিনি এ রকম এক অসাধারণ বাংলা লিখেছেন, তাকে তার ভুল ধরিয়ে দেয়া কি হয়েছে? তাকে কি বোঝানো হয়েছে, বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে মাতৃভাষা নিয়ে এ রকম হেলাফেলা করতে নেই? মাতৃভাষা কোন পর্যায়ে আছে, তা জানতে হলে টেলিভিশনে চোখ রাখুন, করপোরেট সংস্কৃতির ভেতরে ঢুকে যান। দেখবেন, বাংলা ছাড়াই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি মানার নির্দেশনা থাকলেও প্রায় নয় বছরেও প্রশাসনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর সরকারি কাজে প্রমিত বানানরীতি অনুসরণের নির্দেশ দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

[লেখক : সভাপতি,

ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]