মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
একটি শিশু পৃথিবীতে আগমনের পর সবার প্রত্যাশা প্রাণভরে শিশুটি নেবে তার প্রথম শ্বাস-কেঁদে উঠবে সে- হাসবে সবাই। আর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সবাইকে কাঁদিয়ে নিশ্চিন্তের দেশে ফিরে যান সবাই-এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেকটি শ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ।
সুস্থ দেহে সুস্থ নিঃশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগের জন্য “সুস্থ ফুসফুস” আমাদের কাম্য। কিন্তু এই ফুসফুস বিভিন্ন কারণে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। ফুসফুসের সব অসুখগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান অসুখ “নিউমোনিয়া” বা ফুসফুসের প্রদাহ।
“নিউমোনিয়া” এই নামটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। “ফুসফুসের প্রদাহ বা সংক্রমণের” কারণে এই রোগটি হয়। ফুসফুসের এই প্রদাহ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, অধিকাংশ সময় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এমনকি ফাংগাস ইত্যাদি বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা ফুসফুসের সংক্রমণ হয়ে থাকে। বর্তমানে কোভিড-১৯ অতিমারি রোগটিও এক ধরনের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত নিউমোনিয়া জনিত রোগ-যার সঙ্গে সারাবিশ^ যুদ্ধ করে চলেছে। একইভাবে অন্যান্য আরও কিছু ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া অথবা ক্ষেত্রবিশেষে একই সঙ্গে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে আমাদের ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা “নিউমোনিয়ায়” ভুগতে পারি। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে আমাদের ফুসফুসের বায়ুপূর্ণ ছোট ছোট বায়ু-কুঠুরিগুলো প্রদাহজনিত তরলে পূর্ণ হয়ে উঠে, ফলে আমাদের শরীরের অক্সিজেন আদান প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়।
সাধরণত: স্বল্প মাত্রার প্রদাহ হলে মৃদু বা মাঝারি লক্ষণের মাধ্যমেই রোগটি প্রশমিত হয়। তবে রোগটি তীব্র মাত্রার হলে রোগীর ভোগান্তি অনেক বেশি হয়। বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য রোগটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি এই দুই বয়সীদের মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই নিউমোনিয়া রোগটি, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য।
জ¦র, কাশি, কফ নিষ্কাশন, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, খাদ্যে অরুচি, শ^াসকষ্ট ইত্যাদি নিউমোনিয়ার সাধারণ লক্ষণ। শিশুদের ক্ষেত্রে খেলাধুলা কমে যাওয়া, মায়ের দুধ খেতে অসুবিধা হওয়া, শ^াসের গতির দ্রুততা ইত্যাদি মারাত্মক নিউমোনিয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে। অন্যদিকে যে সব রোগী পূর্বের থেকেই বিভিন্ন ফুসফুসজনিত রোগ যেমন সিত্তপিডি, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগে ভুগছেন, অথবা হৃদরোগ, কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছেন, যাদের নার্ভজনিত দুর্বলতার জন্য গিলে খাবার খেতে সমস্যা হয়, যারা ক্যান্সার চিকিৎসায় থেরাপি গ্রহণ করছেন তাদের জন্য নিউমোনিয়া সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা সাধারণের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
কোভিড-১৯ এর মতো এক ভয়াবহ অতিমারী আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে ফুসফুসের প্রতি যতœবান হওয়া-কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি পারে এই সমস্যা থেকে আমাদের অনেকাংশে মুক্ত রাখতে যেমন : ধূমপান ও মদ্য পান পরিহার করতে হবে, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে, পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করতে হবে, নিউমোনিয়া প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করতে হবে, খাবার গ্রহণের আগে ও শৌচ কাজের পরে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধৌত করতে হবে, পরিমিত মাত্রায় ঘুমাতে হবে, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, হাঁসি-কাশি দেয়ার সময় শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে, রোগের তীব্রতা অনুযায়ী অতিদ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে যথা সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, সব নিউমোনিয়া রোগীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং নবজাতক ও শিশুদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে “বেরিয়ার নার্সিং” অর্থাৎ হাত পরিষ্কার করা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে শিশুদের নিউমোনিয়ার প্রকোপ কমিয়ে রাখা যায়।
[লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়]
সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১ , ৩০ কার্তিক ১৪২৮ ৯ রবিউস সানি ১৪৪৩
মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
একটি শিশু পৃথিবীতে আগমনের পর সবার প্রত্যাশা প্রাণভরে শিশুটি নেবে তার প্রথম শ্বাস-কেঁদে উঠবে সে- হাসবে সবাই। আর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সবাইকে কাঁদিয়ে নিশ্চিন্তের দেশে ফিরে যান সবাই-এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেকটি শ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ।
সুস্থ দেহে সুস্থ নিঃশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগের জন্য “সুস্থ ফুসফুস” আমাদের কাম্য। কিন্তু এই ফুসফুস বিভিন্ন কারণে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। ফুসফুসের সব অসুখগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান অসুখ “নিউমোনিয়া” বা ফুসফুসের প্রদাহ।
“নিউমোনিয়া” এই নামটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। “ফুসফুসের প্রদাহ বা সংক্রমণের” কারণে এই রোগটি হয়। ফুসফুসের এই প্রদাহ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, অধিকাংশ সময় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এমনকি ফাংগাস ইত্যাদি বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা ফুসফুসের সংক্রমণ হয়ে থাকে। বর্তমানে কোভিড-১৯ অতিমারি রোগটিও এক ধরনের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত নিউমোনিয়া জনিত রোগ-যার সঙ্গে সারাবিশ^ যুদ্ধ করে চলেছে। একইভাবে অন্যান্য আরও কিছু ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া অথবা ক্ষেত্রবিশেষে একই সঙ্গে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে আমাদের ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা “নিউমোনিয়ায়” ভুগতে পারি। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে আমাদের ফুসফুসের বায়ুপূর্ণ ছোট ছোট বায়ু-কুঠুরিগুলো প্রদাহজনিত তরলে পূর্ণ হয়ে উঠে, ফলে আমাদের শরীরের অক্সিজেন আদান প্রদান বাধাগ্রস্ত হয়।
সাধরণত: স্বল্প মাত্রার প্রদাহ হলে মৃদু বা মাঝারি লক্ষণের মাধ্যমেই রোগটি প্রশমিত হয়। তবে রোগটি তীব্র মাত্রার হলে রোগীর ভোগান্তি অনেক বেশি হয়। বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য রোগটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি এই দুই বয়সীদের মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই নিউমোনিয়া রোগটি, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য।
জ¦র, কাশি, কফ নিষ্কাশন, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, খাদ্যে অরুচি, শ^াসকষ্ট ইত্যাদি নিউমোনিয়ার সাধারণ লক্ষণ। শিশুদের ক্ষেত্রে খেলাধুলা কমে যাওয়া, মায়ের দুধ খেতে অসুবিধা হওয়া, শ^াসের গতির দ্রুততা ইত্যাদি মারাত্মক নিউমোনিয়ার লক্ষণ প্রকাশ করে। অন্যদিকে যে সব রোগী পূর্বের থেকেই বিভিন্ন ফুসফুসজনিত রোগ যেমন সিত্তপিডি, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগে ভুগছেন, অথবা হৃদরোগ, কিডনির রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছেন, যাদের নার্ভজনিত দুর্বলতার জন্য গিলে খাবার খেতে সমস্যা হয়, যারা ক্যান্সার চিকিৎসায় থেরাপি গ্রহণ করছেন তাদের জন্য নিউমোনিয়া সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা সাধারণের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
কোভিড-১৯ এর মতো এক ভয়াবহ অতিমারী আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে ফুসফুসের প্রতি যতœবান হওয়া-কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি পারে এই সমস্যা থেকে আমাদের অনেকাংশে মুক্ত রাখতে যেমন : ধূমপান ও মদ্য পান পরিহার করতে হবে, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে, পুষ্টিকর খাবার, ফলমূল, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করতে হবে, নিউমোনিয়া প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করতে হবে, খাবার গ্রহণের আগে ও শৌচ কাজের পরে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধৌত করতে হবে, পরিমিত মাত্রায় ঘুমাতে হবে, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, হাঁসি-কাশি দেয়ার সময় শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে, রোগের তীব্রতা অনুযায়ী অতিদ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে যথা সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে, সব নিউমোনিয়া রোগীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং নবজাতক ও শিশুদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে “বেরিয়ার নার্সিং” অর্থাৎ হাত পরিষ্কার করা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মাধ্যমে শিশুদের নিউমোনিয়ার প্রকোপ কমিয়ে রাখা যায়।
[লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়]