ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন

বিচারক কামরুন্নাহারকে এর আগে তলব করেছিল সর্বোচ্চ আদালত

রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ দিয়ে ক্ষমতা হারানো বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার আরেকটি মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করেছিলেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসলাম শিকদার নামে ধর্ষণ মামলার এক আসামিকে জামিন দিয়েছিলেন এই বিচারক।

সেই ইস্যুতে তাকে ওই সময় আপিল বিভাগে তলবও করেছিল। সেই ফৌজদারি আবেদনটিই গতকাল ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’ শিরোনামে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১নং ক্রমিকে উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ আদেশ দিয়েছে। তবে কী আদেশ দেয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি।

আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ শুনানি শুরু হলে অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি এই মুহূর্তে নেই বলে জানান।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের কাছে সব আছে।’ এরপর আদালত কিছু সময়ের জন্য বিরতিতে যায়। ফিরে এসে প্রধান বিচরাপতি বলেন, ‘আদেশ দেয়া হয়েছে।’

কী আদেশ হয়েছে- অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানতে চাইলে প্রধান বিচারপতি বলেন, লিখিত আদেশে পাবেন।

আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপিল বিভাগ বলেছেন, আদেশ দেয়া হলো। তবে কী আদেশ দেয়া হয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে জানা যাবে। বিচারক আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কি না, তাও আদেশ পেলে বোঝা যাবে।’

উল্লেখ্য, ধর্ষণের অভিযোগে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার সাবেক অনুষ্ঠান প্রযোজক আসলাম শিকদারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন এক নারী। ওদিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ মামলায় ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাই কোর্ট আসলাম শিকদারকে জামিন দিলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত জামিন স্থগিত করে দেয়। পরে এই স্থগিতাদেশ বাড়ানোর জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

কিন্তু চেম্বার আদালতে জামিন স্থগিত থাকার পরও আসামি আসলামকে জামিন দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক কামরুন্নাহার। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানির সময় নি¤œআদালত থেকে আসলাম শিকদারের জামিন পাওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের নজরে এনেছিলেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তখন আপিল বিভাগ বিশেষ বার্তা বাহকের মাধ্যমে নি¤œআদালত থেকে মামলার নথি আনে। নথি আসার পর তা পর্যালোচনা করেন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এরপর বিচারক কামরুন্নাহারকে তলবের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।

এদিকে গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ে আসলাম শিকদার খালাস পান। সে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ২০ জানুয়ারি সে আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ মামলার নথি তলব করে। সেই সঙ্গে আসলাম শিকদারকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেয় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। ওইদিন আদালত তিনি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোন ধর্ষণের মামলা না নেয় সে আদেশও দেয় এই বিচারক।

বিচারকের এমন পর্যবেক্ষণের পরই তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। রায় ঘোষণার দিন মধ্যরাতে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ নামক প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারীরা। এরপর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার তার ফৌজদারী বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেয় প্রধান বিচারপতি। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও জারি করে মন্ত্রণালয়।

ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার নির্দেশনা কেন দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ওই বিচারক আইন ও সংবিধান দুটোই লঙ্ঘন করেছেন। সে কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলোও গ্রহণ করা হবে।

মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ২০২১ , ৩১ কার্তিক ১৪২৮ ১০ রবিউস সানি ১৪৪৩

ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন

বিচারক কামরুন্নাহারকে এর আগে তলব করেছিল সর্বোচ্চ আদালত

আদালত বার্তা পরিবেশক

image

ধর্ষণ মামলার বিচারপ্রার্থীর চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ও ১৪৬(৩) ধারা বাতিলের দাবিতে গতকাল হাইকোর্টের সামনে নারীমুক্তি কেন্দ্রের মানববন্ধন -সংবাদ

রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ দিয়ে ক্ষমতা হারানো বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার আরেকটি মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করেছিলেন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসলাম শিকদার নামে ধর্ষণ মামলার এক আসামিকে জামিন দিয়েছিলেন এই বিচারক।

সেই ইস্যুতে তাকে ওই সময় আপিল বিভাগে তলবও করেছিল। সেই ফৌজদারি আবেদনটিই গতকাল ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’ শিরোনামে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ১নং ক্রমিকে উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ আদেশ দিয়েছে। তবে কী আদেশ দেয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি।

আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ শুনানি শুরু হলে অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি এই মুহূর্তে নেই বলে জানান।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের কাছে সব আছে।’ এরপর আদালত কিছু সময়ের জন্য বিরতিতে যায়। ফিরে এসে প্রধান বিচরাপতি বলেন, ‘আদেশ দেয়া হয়েছে।’

কী আদেশ হয়েছে- অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানতে চাইলে প্রধান বিচারপতি বলেন, লিখিত আদেশে পাবেন।

আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপিল বিভাগ বলেছেন, আদেশ দেয়া হলো। তবে কী আদেশ দেয়া হয়েছে, তা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে জানা যাবে। বিচারক আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কি না, তাও আদেশ পেলে বোঝা যাবে।’

উল্লেখ্য, ধর্ষণের অভিযোগে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার সাবেক অনুষ্ঠান প্রযোজক আসলাম শিকদারের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন এক নারী। ওদিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ মামলায় ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাই কোর্ট আসলাম শিকদারকে জামিন দিলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত জামিন স্থগিত করে দেয়। পরে এই স্থগিতাদেশ বাড়ানোর জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

কিন্তু চেম্বার আদালতে জামিন স্থগিত থাকার পরও আসামি আসলামকে জামিন দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক কামরুন্নাহার। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানির সময় নি¤œআদালত থেকে আসলাম শিকদারের জামিন পাওয়ার বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের নজরে এনেছিলেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তখন আপিল বিভাগ বিশেষ বার্তা বাহকের মাধ্যমে নি¤œআদালত থেকে মামলার নথি আনে। নথি আসার পর তা পর্যালোচনা করেন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এরপর বিচারক কামরুন্নাহারকে তলবের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ।

এদিকে গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ে আসলাম শিকদার খালাস পান। সে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ২০ জানুয়ারি সে আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ মামলার নথি তলব করে। সেই সঙ্গে আসলাম শিকদারকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেয় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। ওইদিন আদালত তিনি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাই পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোন ধর্ষণের মামলা না নেয় সে আদেশও দেয় এই বিচারক।

বিচারকের এমন পর্যবেক্ষণের পরই তোলপাড় শুরু হয় সারা দেশে। রায় ঘোষণার দিন মধ্যরাতে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ নামক প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজন করেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারীরা। এরপর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার তার ফৌজদারী বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেয় প্রধান বিচারপতি। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও জারি করে মন্ত্রণালয়।

ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণ মামলা না নেয়ার নির্দেশনা কেন দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিচারক মোছা. কামরুন্নাহারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ওই বিচারক আইন ও সংবিধান দুটোই লঙ্ঘন করেছেন। সে কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলোও গ্রহণ করা হবে।