যে বিষয়গুলো আড়ালেই থেকে যায়

সাঈদ চৌধুরী

গাজীপুরের শ্রীপুরে এএসএম কেমিক্যালের আগুনে দুদিন আগে যে ফুলকি আর ধোঁয়ার দাপট ছিল তাতে বাস্তবিক ভয়াবহতার আড়ালে যা ঘটেছেÑ তা নিয়ে আমরা আমাদের তেমন উদ্বিগ্ন করিনি। আমরা এখনও কেউ আধুনিকভাবে বিজ্ঞানকে চিন্তা করতে পারিনি সে বিষয়টি এরকম অগ্নিকা-, দুর্যোগ বা যে কোন ধরনের বিপর্যয় দেখার পর আরও ¯পষ্ট হয়ে ওঠে!

কেউ কেউ পত্রিকায় তুলে এনেছেন এই কো¤পানির ক্ষতি কত হয়েছে সে বিষয়টি। এএসএম কেমিক্যালের মানব স¤পদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাদের!

কিন্তু পরিবেশের কি ক্ষতি হল, আশপাশে যারা আছে বা ছিল তাদের কি ক্ষতি হলো এবং যারা সং¯পর্শে থেকে কাজ করে যাচ্ছে তাদের কি ক্ষতি হলো?

সাধারণ কাঠের মধ্যে আগুন জ্বললেও সেখান থেকে কার্বন ও অন্যান্য যত উপাদান মিশ্রিত হয় তাতে একজন মানুষের শ্বাসতন্ত্র প্রবলভাবে ক্ষতি হয়। এ নিয়ে গবেষণাও আছে। ইইউ রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন ম্যাগাজিন একটি রিসার্চ তথ্য প্রকাশ করেছিল এ বিষয়ে। সাধারণত বিশ্বে বনে আগুনের ফলে বাতাসে যে পরিবর্তনগুলো হয় তা তারা দেখাতে চেয়েছেন।

সেখানে বলা হয়েছে যেখানে আগুন লাগে তার থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে সে আগুনের প্রভাব বিদ্যমান হয় এবং যত সময় বেশি ক্ষেপণ হয় তত বেশি দূষণের মাত্রা ও ভিন্নতা বাড়তে থাকে। গ্রিসের পাত্রাসের ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সের বায়ুম-লীয় রসায়নবিদ এথানাসিওস নেনেস বলেন, ‘পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আমরা রাশিয়ার বনের আগুন থেকে ধোঁয়া পাই এবং যখন এটি ঘটে তখন সর্বত্র শুধু কুয়াশাযুক্ত ধোঁয়া থাকে।’ এটা বেশ নাটকীয় হতে পারে। তারা পুরো অঞ্চল বা মহাদেশের কিছু অংশে বায়ুর গুণমানকে প্রভাবিত করছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেনেস এবং তার দল বায়ুম-ল, সূর্যালোক এবং অন্ধকারের সংস্পর্শে এলে ধোঁয়ায় কণার রসায়ন কিভাবে পরিবর্তিত হয় তা দেখতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৭ সালে পাঁচ বছরের প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে দলটি যে মূল অনুসন্ধান করেছে, তার মধ্যে একটি হলো, বনভূমিতে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছ থেকে নির্গত কণাগুলো আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

বাতাসে থাকাকালীন ধোঁয়ার কণাগুলো রাসায়নিকভাবে ট্রেস বা র‌্যাডিকেলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে- অযৌক্তিক বা অজানা ইলেকট্রনসহ অণু- একটি প্রক্রিয়া উৎপন্ন করে, যা অক্সিডেশন নামে পরিচিত। এটি ধোঁয়া কণার যৌগগুলোকে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল যৌগগুলোতে রূপান্তরিত করে। যখন তারা শ্বাস নেয়, তখন এই প্রতিক্রিয়াশীল যৌগগুলো- ফ্রি রেডিক্যাল নামে পরিচিত এবং এই ফ্রি রেডিক্যাল শরীরের কোষ এবং টিস্যুকে ক্ষতি করতে পারে।

এখন আসি কেমিক্যাল মিশ্রিত কোন দ্রব্যে আগুন লাগলে কি ধরনের বিপর্যয় বা ক্ষতি হতে পারে। গত দুদিন আগে ব্লিচিং পাউডার প্লান্টে আগুন লাগে গাজীপুরের শ্রীপুরে। ব্লিচিং পাউডারে থাকে এভেইলবেল ক্লোরিন যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর দ্রব্য । এখন ব্লিচিং পাউডারে যখন আগুন ধরে তখন ক্লোরিন বেইজড হওয়ায় সে আগুন আরও বেশি পরিমাণে দাহ্য বৈশিষ্ট্য প্রদর্শণ করে। যার ফলে প্রচুর ধোঁয়া এবং বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় ।

বাতাসে হাইপো ক্লোরাইড বেইজড ধোঁয়া মানুষের ইনহলেশনের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর। আগুন লাগার দূরবর্তী স্থানে এই পার্টিকেলগুলো যেতে শিশির ও রোদের কণার সঙ্গে বিক্রিয়ায় আরও ভয়ানক রিএকশনেবল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে।

এই অঞ্চলে বাতাস পরীক্ষার দাবি অনেক দিনের। প্রচুর গজাড়ি বন আর বৃক্ষ শোভিত হওয়ার কারণে তাৎক্ষণিক ক্ষতি বোঝা না গেলেও এই কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির কারণে মানব স্বাস্থ্যের প্রভাব যে খুব বিরূপ তা ¯পষ্ট হলেও কোন গবেষণা এখন পর্যন্ত হলো না। এখানকার বাতাস যেমনি পরীক্ষা করা প্রয়োজন তেমনি ব্লিচিং পুড়ে যাবার পর এগুলো মাটির সঙ্গে কন্টামিনেশন করে যে ধরনের যৌগ উৎপন্ন করছে তা দেখাও প্রয়োজন।

[লেখক : রসায়নবিদ]

আরও খবর

বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১ , ২ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১১ রবিউস সানি ১৪৪৩

যে বিষয়গুলো আড়ালেই থেকে যায়

সাঈদ চৌধুরী

গাজীপুরের শ্রীপুরে এএসএম কেমিক্যালের আগুনে দুদিন আগে যে ফুলকি আর ধোঁয়ার দাপট ছিল তাতে বাস্তবিক ভয়াবহতার আড়ালে যা ঘটেছেÑ তা নিয়ে আমরা আমাদের তেমন উদ্বিগ্ন করিনি। আমরা এখনও কেউ আধুনিকভাবে বিজ্ঞানকে চিন্তা করতে পারিনি সে বিষয়টি এরকম অগ্নিকা-, দুর্যোগ বা যে কোন ধরনের বিপর্যয় দেখার পর আরও ¯পষ্ট হয়ে ওঠে!

কেউ কেউ পত্রিকায় তুলে এনেছেন এই কো¤পানির ক্ষতি কত হয়েছে সে বিষয়টি। এএসএম কেমিক্যালের মানব স¤পদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তাদের!

কিন্তু পরিবেশের কি ক্ষতি হল, আশপাশে যারা আছে বা ছিল তাদের কি ক্ষতি হলো এবং যারা সং¯পর্শে থেকে কাজ করে যাচ্ছে তাদের কি ক্ষতি হলো?

সাধারণ কাঠের মধ্যে আগুন জ্বললেও সেখান থেকে কার্বন ও অন্যান্য যত উপাদান মিশ্রিত হয় তাতে একজন মানুষের শ্বাসতন্ত্র প্রবলভাবে ক্ষতি হয়। এ নিয়ে গবেষণাও আছে। ইইউ রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন ম্যাগাজিন একটি রিসার্চ তথ্য প্রকাশ করেছিল এ বিষয়ে। সাধারণত বিশ্বে বনে আগুনের ফলে বাতাসে যে পরিবর্তনগুলো হয় তা তারা দেখাতে চেয়েছেন।

সেখানে বলা হয়েছে যেখানে আগুন লাগে তার থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে সে আগুনের প্রভাব বিদ্যমান হয় এবং যত সময় বেশি ক্ষেপণ হয় তত বেশি দূষণের মাত্রা ও ভিন্নতা বাড়তে থাকে। গ্রিসের পাত্রাসের ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সের বায়ুম-লীয় রসায়নবিদ এথানাসিওস নেনেস বলেন, ‘পূর্ব ভূমধ্যসাগরে আমরা রাশিয়ার বনের আগুন থেকে ধোঁয়া পাই এবং যখন এটি ঘটে তখন সর্বত্র শুধু কুয়াশাযুক্ত ধোঁয়া থাকে।’ এটা বেশ নাটকীয় হতে পারে। তারা পুরো অঞ্চল বা মহাদেশের কিছু অংশে বায়ুর গুণমানকে প্রভাবিত করছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেনেস এবং তার দল বায়ুম-ল, সূর্যালোক এবং অন্ধকারের সংস্পর্শে এলে ধোঁয়ায় কণার রসায়ন কিভাবে পরিবর্তিত হয় তা দেখতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৭ সালে পাঁচ বছরের প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে দলটি যে মূল অনুসন্ধান করেছে, তার মধ্যে একটি হলো, বনভূমিতে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছ থেকে নির্গত কণাগুলো আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

বাতাসে থাকাকালীন ধোঁয়ার কণাগুলো রাসায়নিকভাবে ট্রেস বা র‌্যাডিকেলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে- অযৌক্তিক বা অজানা ইলেকট্রনসহ অণু- একটি প্রক্রিয়া উৎপন্ন করে, যা অক্সিডেশন নামে পরিচিত। এটি ধোঁয়া কণার যৌগগুলোকে অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল যৌগগুলোতে রূপান্তরিত করে। যখন তারা শ্বাস নেয়, তখন এই প্রতিক্রিয়াশীল যৌগগুলো- ফ্রি রেডিক্যাল নামে পরিচিত এবং এই ফ্রি রেডিক্যাল শরীরের কোষ এবং টিস্যুকে ক্ষতি করতে পারে।

এখন আসি কেমিক্যাল মিশ্রিত কোন দ্রব্যে আগুন লাগলে কি ধরনের বিপর্যয় বা ক্ষতি হতে পারে। গত দুদিন আগে ব্লিচিং পাউডার প্লান্টে আগুন লাগে গাজীপুরের শ্রীপুরে। ব্লিচিং পাউডারে থাকে এভেইলবেল ক্লোরিন যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর দ্রব্য । এখন ব্লিচিং পাউডারে যখন আগুন ধরে তখন ক্লোরিন বেইজড হওয়ায় সে আগুন আরও বেশি পরিমাণে দাহ্য বৈশিষ্ট্য প্রদর্শণ করে। যার ফলে প্রচুর ধোঁয়া এবং বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় ।

বাতাসে হাইপো ক্লোরাইড বেইজড ধোঁয়া মানুষের ইনহলেশনের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর। আগুন লাগার দূরবর্তী স্থানে এই পার্টিকেলগুলো যেতে শিশির ও রোদের কণার সঙ্গে বিক্রিয়ায় আরও ভয়ানক রিএকশনেবল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে।

এই অঞ্চলে বাতাস পরীক্ষার দাবি অনেক দিনের। প্রচুর গজাড়ি বন আর বৃক্ষ শোভিত হওয়ার কারণে তাৎক্ষণিক ক্ষতি বোঝা না গেলেও এই কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির কারণে মানব স্বাস্থ্যের প্রভাব যে খুব বিরূপ তা ¯পষ্ট হলেও কোন গবেষণা এখন পর্যন্ত হলো না। এখানকার বাতাস যেমনি পরীক্ষা করা প্রয়োজন তেমনি ব্লিচিং পুড়ে যাবার পর এগুলো মাটির সঙ্গে কন্টামিনেশন করে যে ধরনের যৌগ উৎপন্ন করছে তা দেখাও প্রয়োজন।

[লেখক : রসায়নবিদ]