বাগদা ফার্ম, সাঁওতাল হত্যা দিবস এবং অনড় সরকার

মিথুশিলাক মুরমু

২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল অধ্যুষিত বাগদা ফার্ম এলাকায় নেমে এসেছিল নরক যন্ত্রণা। ঘটনার কয়েকদিন পরই আমরা সরজমিন পরিদর্শনে উপস্থিত হয়েছিলাম গোবিন্দগঞ্জের জয়পুর-মাদারপুর সাঁওতাল পল্লিতে। সেদিন অসুস্থ প্রবীণ উইলিয়াম টুডু ঘটনার বর্ণনা করছিলেন, ’৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেরূপ আগুনের লেলিহান দেখেছিলাম, অস্ত্রের ঝনঝনানি, বৃহত্তর সম্প্রদায়ের লোভী ব্যক্তিদের সম্পদ দখলের উম্মত্ততা; সবই যেন স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে ফিরে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ দোসরা ছিলো রাজাকার, আলবদর, আলসামসরা। আর এখন স্বাধীন দেশের পুলিশ, র‌্যাব সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।’

উইলিয়াম টুডু দাবি করেছিলেন, যারা শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ হত্যকা-ের সঙ্গে যুক্ত, যারা আদিবাসী সাঁওতালদের সহায়-সম্পদ লুটপাট করেছে; প্রত্যেককেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।’ মি. টুডু দেখে যেতে পারেননি কোনটাই, দেহত্যাগ করেছেন ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। সাঁওতালদের দুরবস্থার, বিচারহীনতা এবং ইপিজেড নির্মাণে সরকারের অনড় অবস্থান আদিবাসী সাঁওতালদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। কেউ কেউ ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছেন, সরকার এত এত উন্নয়ন কার্যসূচি, মেগা প্রকল্প গ্রহণ করছেন; তারপরও কেন দেশের নিরীহ শান্তিপ্রিয় আদিবাসী সাঁওতালদের জমির ওপর চোখ পড়েছে! কেন এই জমিতেই ইপিজেড! নিশ্চয়ই মানবতাবাদী নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভিন্ন কিছু বোঝানো হয়েছে। ইপিজেড কার্যসূচি সাঁওতালদের দেশত্যাগের পথকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।

এ দিন পুলিশের গুলিতে আত্মহুতি দিয়েছেন শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি এবং রমেশ টুডু। গোবিন্দগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন ঘটনার পরেই আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ দুটি মামলায় ৪২ গ্রামবাসী এবং অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। খোঁজ করার চেষ্টা করছিলাম অধিকার আদায় সংগ্রামের শহীদ পরিবারের। মঙ্গল মার্ডীর স্ত্রী শান্তিনা টুডু ঘটনার পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন, কাউকে ঠিক মতো চিনতে পারেন না। এখন প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ বাজারের পাশর্^বর্তী গ্রাম দামাদোরপুরে। মঙ্গল মার্ডীর পূর্বপুরুষের পৈত্রিক ভিটা এখানেই; দুই মেয়ের মধ্যে কস্তান্তিনার বিয়ে হয়েছে একই গ্রামেই, আর আগাথা মার্ডী ভারসাম্যহীন। মঙ্গলের পুত্র সন্তান ছিল, সেও দূরারোগ্যব্যাধিতে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যায়। পুরো পরিবার এখন অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছে।

রমেশ টুডু স্ত্রী জোসনা প্রায় এক বছর পূর্বে মারা গেছে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তীতে জোসনাও স্থানচ্যুত হয়েছিল, জোসনা চলে গিয়েছিলেন ঘোড়াঘাটের তেঘরা গ্রামে। জোসনা সম্পর্কে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা ২৭ নভেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন, “পুলিশের গুলিতে নিহত রমেশ টুডুর লাশ তখন লাশ কাটা ঘরে। চারদিকে গিজগিজ করছে পুলিশÑ কেউ পোশাকে কেউ বা সাদায়। কে যেন দেখিয়ে দিল এটা রমেশের বেটি। বাপের লাশের জন্য লাশ কাটা ঘরের সামনে দুদিনের না খাওয়া মেয়ের মুখ আরও কতবার দেখতে হবে কে জানে? তবে জোসনার সে মুখ ভোলার নয়। তাই গত বছর (২০১৮) বগুড়ার কাহালুর ইটভাটায় জোসনা টুডুকে এক ঝলক দেখে চিনতে কোন কষ্ট হয়নি। জোসনা টুডু বলে, ‘ইমন তো হবার লয়’। ইটভাটায় গিয়ে সরেজমিন মালিকের সঙ্গে কথা বলার বাইরে আর কোন কাজ ছিল না। ভুলে যাওয়া জোসনা আর গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের মার খাওয়ার ঘটনার এখন আর কোন সংবাদমূল্য নেই। জোসনা এখন আমাদের সাবজেক্ট নয়Ñ সে এখন দূরের কোনো ঝাঁপসা ছবি। তবুও জোসনা টুডুকে পাশ কাটিয়ে শুধু ইটভাটার স্টোরি করা গেল না।’ সেদিন ইটভাটার অবৈধ কাঠ পোড়ানো, মজুরি বৈষম্য ইত্যাদি জোসনার কাহিনীর কাছে গুরুত্বহীন হয়েছিল। আর এখন জোসনারা আলোয় বিলিন হয়ে যায়, নিরবে-নিভৃতে। জোসনা টুডু’রা মনে হয় অভিমান করেই ইহজগতের দিকে ধাবিত হয়েছেন। একটি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পরিবার, সন্তান-সন্ততি এমনকি গোটা সাঁওতাল সমাজ প্রভাবিত হয়েছে, হয়েছে অভিভাবকহীন এবং নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করছে।

শ্যামল হেমব্রমের স্ত্রী সোনামনি কিসপট্টা। সোনার সংসারে জন্ম নেয় সাগর ও সনাতন হেমব্রম। বাপ-দাদার সম্পত্তিকে উদ্ধার করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। জীবনের বিনিময়ে পেয়েছে তার পরিবার অবহেলা, অযতœ আর দয়া-পরবশ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হয়ে বেঁচে থাকা। সোনামনি স্বামীর শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়িতে কাজ করে এবং জীবন ধারণ করেন। সন্তানেরা পোশাক শিল্পের শ্রমিক হিসেবে ঢাকার কোনো গার্মেন্টে কর্মরত। দিন-ক্ষণ, সময়, মাস পেরিয়ে এখন পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু আদিবাসীদের স্বপ্ন অধরায় থেকে গেছে।

৬ নভেম্বর শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি এবং রমেশ টুডুকে হত্যার প্রতিবাদে ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’-এ সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। হত্যার বিচার ও ইপিজেড অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবিতে বাঙালি-আদিবাসীরা পুরো এলাকায় মৌন মিছিল করেছেন। এক সময় জাতীয় পতাকা হাতে নিয়েই শান্তিপূর্ণভাবেই উচ্চারিত হয়েছে, ‘শ্যামল-রমেশের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, মঙ্গল-রমেশের রক্ত শান্তিপূর্ণ সমাধান’, ‘রক্তভেজা জমিতে ইপিজেড হবে না’ ইত্যাদি। এইদিনের সভায় বারবারই উত্থিত হয়েছে, পলাশবাড়ি উপজেলার সাকোয়া এলাকার জনগণ তাদের এলাকায় ইপিজেড স্থাপন করার জন্য আবেদন করেছে। সরকার ওই জমি ছেড়ে কেন এখানেই ইপিজেড তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। নিশ্চয়ই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হওয়া আবশ্যিক, নিশ্চয়ই জনস্বার্থকে গুরুত্বারোপ করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ‘তিন ফসলি জমিতে শিল্পকারখানা হবে না।’ জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তিনি বরাংবার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশব্যাপী ফসলি জমিতে পুকুর খননে প্রশাসন ভূমিকা নিয়েছিল, যাতে কারে কেউ-ই তিন ফসলি জমিকে অন্য কাজে ব্যবহার না করে। বাগদা ফার্মেও তিনটি ফসল উৎপাদিত হয়, তাহলে কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে!

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বাগদা ফার্মের ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি আখ চাষের জন্য অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। অধিগ্রহণ চুক্তির সাতটি শর্তের একটি ছিল, ‘যদি চিনিকল বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চিনি শিল্প করপোরেশন সরকারের মাধ্যমে জমি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবে।’ সে শর্ত অনুযায়ী, ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে আদিবাসী সাঁওতালদের জমি ফেরত পাওয়ার কথা কিন্তু আজ তারা জমি বুঝে পায়নি। জমির তথ্য-উপাত্ত ও নিয়মানুযায়ী জমির মূল মালিক আদিবাসীরা, ইপিজেড নির্মাণে তাদের কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। তাদের সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে প্রশাসনের এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ নিঃসন্দেহে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার সাদৃশ্য।

প্রশাসনের অভ্যন্তরে থাকা সরকারবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গরাই ছলে-বলে কৌশলে আদিবাসী সাঁওতালদের জমিকে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের সুযোগ খুঁজে চলেছেন। হয়তো এ সুযোগেই সুযোগসন্ধানীরা ছক্কা হাঁকানোর শেষ চেষ্টাও চালাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের আরজ, আদিবাসীদের কথা শ্রবণ করুন, দুঃখ বোঝার চেষ্টা করুন; চোখের নোনা জল শুকানোর পূর্বেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

[লেখক : কলামিস্ট]

বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২১ , ৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১২ রবিউস সানি ১৪৪৩

বাগদা ফার্ম, সাঁওতাল হত্যা দিবস এবং অনড় সরকার

মিথুশিলাক মুরমু

২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর সাঁওতাল অধ্যুষিত বাগদা ফার্ম এলাকায় নেমে এসেছিল নরক যন্ত্রণা। ঘটনার কয়েকদিন পরই আমরা সরজমিন পরিদর্শনে উপস্থিত হয়েছিলাম গোবিন্দগঞ্জের জয়পুর-মাদারপুর সাঁওতাল পল্লিতে। সেদিন অসুস্থ প্রবীণ উইলিয়াম টুডু ঘটনার বর্ণনা করছিলেন, ’৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেরূপ আগুনের লেলিহান দেখেছিলাম, অস্ত্রের ঝনঝনানি, বৃহত্তর সম্প্রদায়ের লোভী ব্যক্তিদের সম্পদ দখলের উম্মত্ততা; সবই যেন স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে ফিরে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ দোসরা ছিলো রাজাকার, আলবদর, আলসামসরা। আর এখন স্বাধীন দেশের পুলিশ, র‌্যাব সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।’

উইলিয়াম টুডু দাবি করেছিলেন, যারা শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ হত্যকা-ের সঙ্গে যুক্ত, যারা আদিবাসী সাঁওতালদের সহায়-সম্পদ লুটপাট করেছে; প্রত্যেককেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো।’ মি. টুডু দেখে যেতে পারেননি কোনটাই, দেহত্যাগ করেছেন ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। সাঁওতালদের দুরবস্থার, বিচারহীনতা এবং ইপিজেড নির্মাণে সরকারের অনড় অবস্থান আদিবাসী সাঁওতালদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। কেউ কেউ ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছেন, সরকার এত এত উন্নয়ন কার্যসূচি, মেগা প্রকল্প গ্রহণ করছেন; তারপরও কেন দেশের নিরীহ শান্তিপ্রিয় আদিবাসী সাঁওতালদের জমির ওপর চোখ পড়েছে! কেন এই জমিতেই ইপিজেড! নিশ্চয়ই মানবতাবাদী নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভিন্ন কিছু বোঝানো হয়েছে। ইপিজেড কার্যসূচি সাঁওতালদের দেশত্যাগের পথকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।

এ দিন পুলিশের গুলিতে আত্মহুতি দিয়েছেন শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি এবং রমেশ টুডু। গোবিন্দগঞ্জ পুলিশ প্রশাসন ঘটনার পরেই আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ দুটি মামলায় ৪২ গ্রামবাসী এবং অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। খোঁজ করার চেষ্টা করছিলাম অধিকার আদায় সংগ্রামের শহীদ পরিবারের। মঙ্গল মার্ডীর স্ত্রী শান্তিনা টুডু ঘটনার পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন, কাউকে ঠিক মতো চিনতে পারেন না। এখন প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ বাজারের পাশর্^বর্তী গ্রাম দামাদোরপুরে। মঙ্গল মার্ডীর পূর্বপুরুষের পৈত্রিক ভিটা এখানেই; দুই মেয়ের মধ্যে কস্তান্তিনার বিয়ে হয়েছে একই গ্রামেই, আর আগাথা মার্ডী ভারসাম্যহীন। মঙ্গলের পুত্র সন্তান ছিল, সেও দূরারোগ্যব্যাধিতে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যায়। পুরো পরিবার এখন অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছে।

রমেশ টুডু স্ত্রী জোসনা প্রায় এক বছর পূর্বে মারা গেছে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তীতে জোসনাও স্থানচ্যুত হয়েছিল, জোসনা চলে গিয়েছিলেন ঘোড়াঘাটের তেঘরা গ্রামে। জোসনা সম্পর্কে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা ২৭ নভেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে লিখেছিলেন, “পুলিশের গুলিতে নিহত রমেশ টুডুর লাশ তখন লাশ কাটা ঘরে। চারদিকে গিজগিজ করছে পুলিশÑ কেউ পোশাকে কেউ বা সাদায়। কে যেন দেখিয়ে দিল এটা রমেশের বেটি। বাপের লাশের জন্য লাশ কাটা ঘরের সামনে দুদিনের না খাওয়া মেয়ের মুখ আরও কতবার দেখতে হবে কে জানে? তবে জোসনার সে মুখ ভোলার নয়। তাই গত বছর (২০১৮) বগুড়ার কাহালুর ইটভাটায় জোসনা টুডুকে এক ঝলক দেখে চিনতে কোন কষ্ট হয়নি। জোসনা টুডু বলে, ‘ইমন তো হবার লয়’। ইটভাটায় গিয়ে সরেজমিন মালিকের সঙ্গে কথা বলার বাইরে আর কোন কাজ ছিল না। ভুলে যাওয়া জোসনা আর গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের মার খাওয়ার ঘটনার এখন আর কোন সংবাদমূল্য নেই। জোসনা এখন আমাদের সাবজেক্ট নয়Ñ সে এখন দূরের কোনো ঝাঁপসা ছবি। তবুও জোসনা টুডুকে পাশ কাটিয়ে শুধু ইটভাটার স্টোরি করা গেল না।’ সেদিন ইটভাটার অবৈধ কাঠ পোড়ানো, মজুরি বৈষম্য ইত্যাদি জোসনার কাহিনীর কাছে গুরুত্বহীন হয়েছিল। আর এখন জোসনারা আলোয় বিলিন হয়ে যায়, নিরবে-নিভৃতে। জোসনা টুডু’রা মনে হয় অভিমান করেই ইহজগতের দিকে ধাবিত হয়েছেন। একটি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পরিবার, সন্তান-সন্ততি এমনকি গোটা সাঁওতাল সমাজ প্রভাবিত হয়েছে, হয়েছে অভিভাবকহীন এবং নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করছে।

শ্যামল হেমব্রমের স্ত্রী সোনামনি কিসপট্টা। সোনার সংসারে জন্ম নেয় সাগর ও সনাতন হেমব্রম। বাপ-দাদার সম্পত্তিকে উদ্ধার করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন। জীবনের বিনিময়ে পেয়েছে তার পরিবার অবহেলা, অযতœ আর দয়া-পরবশ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হয়ে বেঁচে থাকা। সোনামনি স্বামীর শোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়িতে কাজ করে এবং জীবন ধারণ করেন। সন্তানেরা পোশাক শিল্পের শ্রমিক হিসেবে ঢাকার কোনো গার্মেন্টে কর্মরত। দিন-ক্ষণ, সময়, মাস পেরিয়ে এখন পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু আদিবাসীদের স্বপ্ন অধরায় থেকে গেছে।

৬ নভেম্বর শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি এবং রমেশ টুডুকে হত্যার প্রতিবাদে ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’-এ সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। হত্যার বিচার ও ইপিজেড অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবিতে বাঙালি-আদিবাসীরা পুরো এলাকায় মৌন মিছিল করেছেন। এক সময় জাতীয় পতাকা হাতে নিয়েই শান্তিপূর্ণভাবেই উচ্চারিত হয়েছে, ‘শ্যামল-রমেশের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, মঙ্গল-রমেশের রক্ত শান্তিপূর্ণ সমাধান’, ‘রক্তভেজা জমিতে ইপিজেড হবে না’ ইত্যাদি। এইদিনের সভায় বারবারই উত্থিত হয়েছে, পলাশবাড়ি উপজেলার সাকোয়া এলাকার জনগণ তাদের এলাকায় ইপিজেড স্থাপন করার জন্য আবেদন করেছে। সরকার ওই জমি ছেড়ে কেন এখানেই ইপিজেড তৈরি করতে উঠে পড়ে লেগেছে। নিশ্চয়ই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হওয়া আবশ্যিক, নিশ্চয়ই জনস্বার্থকে গুরুত্বারোপ করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ‘তিন ফসলি জমিতে শিল্পকারখানা হবে না।’ জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তিনি বরাংবার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশব্যাপী ফসলি জমিতে পুকুর খননে প্রশাসন ভূমিকা নিয়েছিল, যাতে কারে কেউ-ই তিন ফসলি জমিকে অন্য কাজে ব্যবহার না করে। বাগদা ফার্মেও তিনটি ফসল উৎপাদিত হয়, তাহলে কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে!

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বাগদা ফার্মের ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি আখ চাষের জন্য অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। অধিগ্রহণ চুক্তির সাতটি শর্তের একটি ছিল, ‘যদি চিনিকল বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চিনি শিল্প করপোরেশন সরকারের মাধ্যমে জমি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেবে।’ সে শর্ত অনুযায়ী, ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে আদিবাসী সাঁওতালদের জমি ফেরত পাওয়ার কথা কিন্তু আজ তারা জমি বুঝে পায়নি। জমির তথ্য-উপাত্ত ও নিয়মানুযায়ী জমির মূল মালিক আদিবাসীরা, ইপিজেড নির্মাণে তাদের কোনো মতামত গ্রহণ করা হয়নি। তাদের সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে প্রশাসনের এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ নিঃসন্দেহে ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার সাদৃশ্য।

প্রশাসনের অভ্যন্তরে থাকা সরকারবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গরাই ছলে-বলে কৌশলে আদিবাসী সাঁওতালদের জমিকে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের সুযোগ খুঁজে চলেছেন। হয়তো এ সুযোগেই সুযোগসন্ধানীরা ছক্কা হাঁকানোর শেষ চেষ্টাও চালাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের আরজ, আদিবাসীদের কথা শ্রবণ করুন, দুঃখ বোঝার চেষ্টা করুন; চোখের নোনা জল শুকানোর পূর্বেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

[লেখক : কলামিস্ট]