গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের নবান্ন মেলা জমজমাট

‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার পদ্মপুকুর নামকস্থানে ৫২ বছর ধরে হয়ে আসছে এই ঐতিহ্যবাহী নবান্নের মেলা। প্রতিবছরের ইংরেজি তারিখের ১৭ নভেম্বর এই মেলা হয় । জানা যায়, নবান্নের এই মেলাকে ঘিরে আশপাশের ১০-১২টি গ্রামের গ্রামীণ মানুষের মধ্য এক অন্য রকম উৎসব কাজ করে।

বাড়িতে বাড়িতে তৈরি করা হয় শীতের পিঠা পুলি, নতুন ধান থেকে পাওয়া চাল দিয়ে রান্না করা হয় পায়েশ। আর এই নবান্ন উপলক্ষে ঘরে নতুন ধান উঠার আগে বেশকিছু প্রস্তুতি নিতে হয় কৃষকদের। ধানচালা কুলা, চালুনি, ডালা ইত্যাদি ক্রয় করতে হয় তাদের। আর এজন্যই এই নবান্নের মেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই জামাই মেয়েসহ বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন আসে, চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম। মাংস পোলাও, পাটিসাপটা, দুধকুসলি, কানমুচরি, পাকোয়ান পিঠা, রস পিঠাসহ নানান পিঠাপুলি মিষ্টি মিঠাই খাওয়ার ধুম। নিতান্ত গরিব হলেও মেলাতে ১ কেজি জিলাপি কিনবেই।

এক দিনের এ মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে দোকানিরা আগেরদিন এসে দোকানে মিষ্টি, বাঁশ, বেত, মাটির তৈরি নকশি পাতিল, মাটির ব্যাংক, পুতুল, কাঠের তৈরি ফার্ণিচার, কসমেটিক, খেলনা, বাঁশি, বেলুন, ঘূর্ণি, লোহার তৈরি হাঁসুয়া বটি, চাকু, কাগজের ফুলসহ নানা রকম মুখরোচক খাবারেরর দোকান দিয়ে নানান জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন।

মেলাতে আসা এক দোকানি শ্রী অজিত কুমার পাল জানান, দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই পদ্মপুকুর নবান্নের মেলাতে মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করে আসছি। শুরুর দিকে আমার দাদু এই মেলাতে মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করতেন। এরপর আমার বাবা অমূল্য চরণ পাল তারপর আমি এসব বিক্রি করছি। এখানে মাটির তৈরি হাড়ি, পাতিল, ঢাকোন, প্রদীপ, দিয়া, ছোট বাটি, ধুপ জালানো ধুপতীসহ নানা রকম মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করি আমরা।

মেলাতে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসা দোকানি রেবেকা পাহান জানান, সারাবছর আমাদের খুব কষ্টে দিন কাটে। নবান্নের এই সময়টাতে আমরা বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করি। মেলাতে আমরা বাঁশের তৈরি কুলা, ঢাকনা, ঝাল ডালা, খইচালা, চালুন, মাছ রাখা খলইসহ বাঁশের তৈরি নানা উপকরণ বিক্রি করি।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল সাত্তার জানান, বছরে এখানে এক দিনের জন্য নবান্নের মেলা হয়। আর এই মেলাতে এই এলাকার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষেরা আসেন। এখানে সারাবছরের সংসারের প্রয়োজনীয় নানা রকম জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মানুষেরা এগুলো কিনে সারাবছরই ব্যবহার করে থাকে।

মেলার এক পাশে চলে ‘বউ মেলা’। বউ মেলায় বিশেষ করে নারীদের কসমেটিক দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শত শত নারীদের বউ মেলায় আগমন ঘটে।

নজিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও মেলা কমিটির সভাপতি শ্রী মনজ কুমার জানান, মূলত নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে আমরা এই মেলার আয়োজন করে থাকি। প্রতিবছর ধান কাটার সময় এখানে এই মেলা বসানো হয়। আশপাশের অনেক এলাকার মানুষ আসে এই মেলায়। তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে থাকেন এই মেলা থেকে। আর প্রতিবছর এই মেলোয় বেচাকেনা ভালো হওয়ায় অনেক দোকান আসে এই মেলাতে।

শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ২০২১ , ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৩

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের নবান্ন মেলা জমজমাট

প্রতিনিধি, বদলগাছী (নওগাঁ)

image

‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার পদ্মপুকুর নামকস্থানে ৫২ বছর ধরে হয়ে আসছে এই ঐতিহ্যবাহী নবান্নের মেলা। প্রতিবছরের ইংরেজি তারিখের ১৭ নভেম্বর এই মেলা হয় । জানা যায়, নবান্নের এই মেলাকে ঘিরে আশপাশের ১০-১২টি গ্রামের গ্রামীণ মানুষের মধ্য এক অন্য রকম উৎসব কাজ করে।

বাড়িতে বাড়িতে তৈরি করা হয় শীতের পিঠা পুলি, নতুন ধান থেকে পাওয়া চাল দিয়ে রান্না করা হয় পায়েশ। আর এই নবান্ন উপলক্ষে ঘরে নতুন ধান উঠার আগে বেশকিছু প্রস্তুতি নিতে হয় কৃষকদের। ধানচালা কুলা, চালুনি, ডালা ইত্যাদি ক্রয় করতে হয় তাদের। আর এজন্যই এই নবান্নের মেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই জামাই মেয়েসহ বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন আসে, চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম। মাংস পোলাও, পাটিসাপটা, দুধকুসলি, কানমুচরি, পাকোয়ান পিঠা, রস পিঠাসহ নানান পিঠাপুলি মিষ্টি মিঠাই খাওয়ার ধুম। নিতান্ত গরিব হলেও মেলাতে ১ কেজি জিলাপি কিনবেই।

এক দিনের এ মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে দোকানিরা আগেরদিন এসে দোকানে মিষ্টি, বাঁশ, বেত, মাটির তৈরি নকশি পাতিল, মাটির ব্যাংক, পুতুল, কাঠের তৈরি ফার্ণিচার, কসমেটিক, খেলনা, বাঁশি, বেলুন, ঘূর্ণি, লোহার তৈরি হাঁসুয়া বটি, চাকু, কাগজের ফুলসহ নানা রকম মুখরোচক খাবারেরর দোকান দিয়ে নানান জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন।

মেলাতে আসা এক দোকানি শ্রী অজিত কুমার পাল জানান, দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই পদ্মপুকুর নবান্নের মেলাতে মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করে আসছি। শুরুর দিকে আমার দাদু এই মেলাতে মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করতেন। এরপর আমার বাবা অমূল্য চরণ পাল তারপর আমি এসব বিক্রি করছি। এখানে মাটির তৈরি হাড়ি, পাতিল, ঢাকোন, প্রদীপ, দিয়া, ছোট বাটি, ধুপ জালানো ধুপতীসহ নানা রকম মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করি আমরা।

মেলাতে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসা দোকানি রেবেকা পাহান জানান, সারাবছর আমাদের খুব কষ্টে দিন কাটে। নবান্নের এই সময়টাতে আমরা বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করি। মেলাতে আমরা বাঁশের তৈরি কুলা, ঢাকনা, ঝাল ডালা, খইচালা, চালুন, মাছ রাখা খলইসহ বাঁশের তৈরি নানা উপকরণ বিক্রি করি।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল সাত্তার জানান, বছরে এখানে এক দিনের জন্য নবান্নের মেলা হয়। আর এই মেলাতে এই এলাকার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষেরা আসেন। এখানে সারাবছরের সংসারের প্রয়োজনীয় নানা রকম জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মানুষেরা এগুলো কিনে সারাবছরই ব্যবহার করে থাকে।

মেলার এক পাশে চলে ‘বউ মেলা’। বউ মেলায় বিশেষ করে নারীদের কসমেটিক দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শত শত নারীদের বউ মেলায় আগমন ঘটে।

নজিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও মেলা কমিটির সভাপতি শ্রী মনজ কুমার জানান, মূলত নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে আমরা এই মেলার আয়োজন করে থাকি। প্রতিবছর ধান কাটার সময় এখানে এই মেলা বসানো হয়। আশপাশের অনেক এলাকার মানুষ আসে এই মেলায়। তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে থাকেন এই মেলা থেকে। আর প্রতিবছর এই মেলোয় বেচাকেনা ভালো হওয়ায় অনেক দোকান আসে এই মেলাতে।