দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন আওয়ামী লীগের নতুন চিন্তা

দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা বাড়ছে। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করলেও কিছু ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রতীকে তাদের নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে বেশিরভাগ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থীর কর্মীসমর্থকদের মধ্যেই সংঘাতের ঘটনা বেশি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন ও কোন্দল বাড়ছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু ইউপিতে প্রতীক বরাদ্দ না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সাতজন সংসদ সদস্যের অনুরোধে ৮৮টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করা হয়েছে। শরীয়তপুরে ৫৫টি, মাদারীপুরে ২৬টি ও গোপালগঞ্জে ৭টি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে সব ইউপিতে দলীয় প্রতীক ছাড়া ইউপি নির্বাচনের দাবি জোরদার হচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে।

গত ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাতের বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে উপস্থিত সদস্যদের মতামত জনাতে চান দলীয় প্রধান। বৈঠকে একাধিক সদস্য প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের পক্ষে মত দিলেও নিজের মতামত জানাননি দলের প্রধান শেখ হাসিনা।

তবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর থেকে ফিরে গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনে সংঘাতের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। ‘শুধু প্রতীকের কারণে সংঘাত’- বিষয়টি এমন নয় বলে তার বক্তব্যে উঠে আসে।

বিএনপি কৌশলে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। মারামারি তাদের মধ্যেও হচ্ছে। তারা আবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে উস্কে দিয়ে সংঘাতের সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেম্বার (সদস্য) পদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যেই বেশি মারামারি হচ্ছে। তাদের দলীয় প্রতীক নেই।

দলের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, চলমান নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রতীকে অংশ না নেয়ায় বিদ্রোহীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে দলীয় প্রতীক থাকা না থাকার বিষয়টি নিয়ে জোরেসোরেই আলোচনা হচ্ছে। আগামীকাল গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিষয়টি বিষদভাবে আলোচিত হতে পারে।

তবে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল কেউ নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা যারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়েছেন, তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক উঠিয়ে দেবার কোন চিন্তা এখনও নেই। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভিত্তিতে হচ্ছে এটাই সত্যি। জনগণ কিন্তু প্রতীকের মাধ্যমে নির্বাচনে এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনেও আমি বলতে পারি প্রতীক দিয়েই নির্বাচন হবে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ইউপিতে বিদ্রোহীদের মদদদাতা হিসেবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের জ্যেষ্ঠ নেতা এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নামেও অভিযোগ উঠছে। এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে তালিকা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

প্রথম ধাপে ৩৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বেশিরভাগ নৌকার প্রার্থী জয়লাভ করলেও দলের বিদ্রোহী কিছু প্রার্থীও জয়ী হয়। দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৮৩৬টি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ছিল প্রায় সাতশ বিদ্রোহী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্রোহীদের অনেকের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের মদদ থাকায় তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারে কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টা সফল হয়নি। আবার হাতহতের সংখ্যাও বেড়েছে। তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ১ হাজার ৭টি ইউপির নির্বাচন। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা সহস্রাধিক। জানা গেছে, প্রতীক না থাকলেও এই ধাপে বিএনপির প্রার্থীরা তুলনামুলক বেশি সক্রিয়।

জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দশজনের বেশি নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় নানা সমস্যায় পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ।

একাধিক নেতার অভিযোগ, প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপে অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ও যোগ্য কর্মী মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন। নৌকা পেয়ে ওই প্রার্থী নির্বাচিত হলেও ত্যাগী নেতাকর্মীদের ক্ষোভ বাড়ছে। ফলে তৃণমূলে বিভাজন বাড়ছে। বাড়ছে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা। বিএনপি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ না নেয়ায়, স্থানীয় পর্যায়ে দলটির কিছু নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের উস্কে দিচ্ছে। আবার নৌকার বিদ্রোহীরা মাঠে থাকায় স্বতন্ত্র প্রতীকে বিএনপির প্রার্থীদের জয়লাভের সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে মূল্যায়ন ওই নেতাদের।

স্থানীয় সূত্র বলছে, গত ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে যে ৭ জন মারা গেছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের সম্পাদমন্ডলীর সাবেক এক সদস্য বলেন, যারা দলের চরম দুর্দিনে মাঠ পর্যায়ে দলকে চাঙ্গা রেখেছে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় তাদের মধ্যে ‘বিভাজন’ তৈরি হচ্ছে। তৃণমূলে আওয়ামী লীগের ‘ঐক্য ভেঙে পড়ছে’।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, ইউপি ভোট নিয়ে তৃণমূলে নজর রাখা হচ্ছে। জরিপ হচ্ছে। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায়, আবার বিএনপি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নেই। নৌকা পেলেই পাস। এই ধারণায় অধিকাংশ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেক। একজন মনোনয়ন পেলে একাধিক বিদ্রোহ করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অনেকে জিতেও যাচ্ছে।

এর ফলে তৃণমূলে ঐক্য নষ্ট হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েও বিদ্রোহ দমন করা যাচ্ছে না।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটা আইন করে ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদ দলীয় করা হয়েছে। এখন চাইলেও আর এটা বন্ধ করা যায় না। এর জন্য আইন বদলাতে হবে। দলের সর্বোচ্চ ফোরামের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে।’

নির্বাচনী বিশ্লেষকদের মতে, যে উদ্দেশ্যে ৫ বছর আগে আইন করে ইউপিসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক যিনি পান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন তার পক্ষে কাজ করছে। ফলে ভোটের চেয়ে প্রতীকের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রতীক পাওয়ার প্রতিযোগিতাও চলছে বলে তাদের অভিযোগ। আর এর ফলে স্থানীয় ‘জনপ্রিয় ও সৎ’ ব্যক্তিরা নির্বাচনের আগ্রহ হারাচ্ছে।

দেশে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউপির মধ্যে গত ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপে ৩৬৯টি ইউপিতে এবং ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর ১০০৭টি ইউপিতে ভোট হবে। এছাড়া চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৩ ডিসেম্বর। আগামী ২২ নভেম্বর পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ২০২১ , ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৩

দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন আওয়ামী লীগের নতুন চিন্তা

ফয়েজ আহমেদ তুষার

দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা বাড়ছে। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করলেও কিছু ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রতীকে তাদের নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে বেশিরভাগ ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থীর কর্মীসমর্থকদের মধ্যেই সংঘাতের ঘটনা বেশি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন ও কোন্দল বাড়ছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু ইউপিতে প্রতীক বরাদ্দ না দিয়ে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সাতজন সংসদ সদস্যের অনুরোধে ৮৮টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা উন্মুক্ত করা হয়েছে। শরীয়তপুরে ৫৫টি, মাদারীপুরে ২৬টি ও গোপালগঞ্জে ৭টি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে সব ইউপিতে দলীয় প্রতীক ছাড়া ইউপি নির্বাচনের দাবি জোরদার হচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে।

গত ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাতের বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে উপস্থিত সদস্যদের মতামত জনাতে চান দলীয় প্রধান। বৈঠকে একাধিক সদস্য প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের পক্ষে মত দিলেও নিজের মতামত জানাননি দলের প্রধান শেখ হাসিনা।

তবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর থেকে ফিরে গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনে সংঘাতের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। ‘শুধু প্রতীকের কারণে সংঘাত’- বিষয়টি এমন নয় বলে তার বক্তব্যে উঠে আসে।

বিএনপি কৌশলে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। মারামারি তাদের মধ্যেও হচ্ছে। তারা আবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে উস্কে দিয়ে সংঘাতের সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেম্বার (সদস্য) পদে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যেই বেশি মারামারি হচ্ছে। তাদের দলীয় প্রতীক নেই।

দলের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, চলমান নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রতীকে অংশ না নেয়ায় বিদ্রোহীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে দলীয় প্রতীক থাকা না থাকার বিষয়টি নিয়ে জোরেসোরেই আলোচনা হচ্ছে। আগামীকাল গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিষয়টি বিষদভাবে আলোচিত হতে পারে।

তবে ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল কেউ নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা যারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়েছেন, তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক উঠিয়ে দেবার কোন চিন্তা এখনও নেই। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভিত্তিতে হচ্ছে এটাই সত্যি। জনগণ কিন্তু প্রতীকের মাধ্যমে নির্বাচনে এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনেও আমি বলতে পারি প্রতীক দিয়েই নির্বাচন হবে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ইউপিতে বিদ্রোহীদের মদদদাতা হিসেবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের জ্যেষ্ঠ নেতা এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নামেও অভিযোগ উঠছে। এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে তালিকা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

প্রথম ধাপে ৩৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বেশিরভাগ নৌকার প্রার্থী জয়লাভ করলেও দলের বিদ্রোহী কিছু প্রার্থীও জয়ী হয়। দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৮৩৬টি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ছিল প্রায় সাতশ বিদ্রোহী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্রোহীদের অনেকের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের মদদ থাকায় তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারে কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টা সফল হয়নি। আবার হাতহতের সংখ্যাও বেড়েছে। তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ১ হাজার ৭টি ইউপির নির্বাচন। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা সহস্রাধিক। জানা গেছে, প্রতীক না থাকলেও এই ধাপে বিএনপির প্রার্থীরা তুলনামুলক বেশি সক্রিয়।

জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দশজনের বেশি নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় নানা সমস্যায় পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ।

একাধিক নেতার অভিযোগ, প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপে অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ও যোগ্য কর্মী মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন। নৌকা পেয়ে ওই প্রার্থী নির্বাচিত হলেও ত্যাগী নেতাকর্মীদের ক্ষোভ বাড়ছে। ফলে তৃণমূলে বিভাজন বাড়ছে। বাড়ছে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা। বিএনপি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ না নেয়ায়, স্থানীয় পর্যায়ে দলটির কিছু নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের উস্কে দিচ্ছে। আবার নৌকার বিদ্রোহীরা মাঠে থাকায় স্বতন্ত্র প্রতীকে বিএনপির প্রার্থীদের জয়লাভের সুযোগ তৈরি হচ্ছে বলে মূল্যায়ন ওই নেতাদের।

স্থানীয় সূত্র বলছে, গত ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে যে ৭ জন মারা গেছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের সম্পাদমন্ডলীর সাবেক এক সদস্য বলেন, যারা দলের চরম দুর্দিনে মাঠ পর্যায়ে দলকে চাঙ্গা রেখেছে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় তাদের মধ্যে ‘বিভাজন’ তৈরি হচ্ছে। তৃণমূলে আওয়ামী লীগের ‘ঐক্য ভেঙে পড়ছে’।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, ইউপি ভোট নিয়ে তৃণমূলে নজর রাখা হচ্ছে। জরিপ হচ্ছে। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায়, আবার বিএনপি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নেই। নৌকা পেলেই পাস। এই ধারণায় অধিকাংশ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেক। একজন মনোনয়ন পেলে একাধিক বিদ্রোহ করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অনেকে জিতেও যাচ্ছে।

এর ফলে তৃণমূলে ঐক্য নষ্ট হচ্ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েও বিদ্রোহ দমন করা যাচ্ছে না।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটা আইন করে ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদ দলীয় করা হয়েছে। এখন চাইলেও আর এটা বন্ধ করা যায় না। এর জন্য আইন বদলাতে হবে। দলের সর্বোচ্চ ফোরামের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে।’

নির্বাচনী বিশ্লেষকদের মতে, যে উদ্দেশ্যে ৫ বছর আগে আইন করে ইউপিসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যর্থ হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক যিনি পান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন তার পক্ষে কাজ করছে। ফলে ভোটের চেয়ে প্রতীকের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রতীক পাওয়ার প্রতিযোগিতাও চলছে বলে তাদের অভিযোগ। আর এর ফলে স্থানীয় ‘জনপ্রিয় ও সৎ’ ব্যক্তিরা নির্বাচনের আগ্রহ হারাচ্ছে।

দেশে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউপির মধ্যে গত ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপে ৩৬৯টি ইউপিতে এবং ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর ১০০৭টি ইউপিতে ভোট হবে। এছাড়া চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৩ ডিসেম্বর। আগামী ২২ নভেম্বর পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।