রংপুরের বদরগঞ্জে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে হাত-পা ও রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে ধর্ষণের অভিযোগে শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম মিঠুকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা সেই সঙ্গে জরিমানার অর্থ ধষিতা স্কুলছাত্রীকে প্রদানের আদেশ দিয়েছেন। রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত-২ এর বিচারক রোকনুজ্জামান গতকাল দুপুরে এ রায় প্রদান করেছেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে ২০২০ ইং সালের ৩০ জুন তারিখে বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সকাল সোয়া ১০টার দিকে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার পথে একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম মিঠু অনলাইনে ফরম করানোর মিথ্যা কথা বলে তাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু স্কুলে গিয়ে অন্য শিক্ষার্থীকে দেখতে না পেয়ে চলে আসার সময় আসামি স্কুল শিক্ষক মিঠু তাকে জড়িয়ে ধরে জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে সুতলি দিয়ে দুই হাত এবং রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে তাকে জোর করে ধর্ষণ করে।
এ সময় ধষিতা স্কুলছাত্রী কান্নাকাটি করলে তাকে ভয় ভীতি দেখিয়ে স্কুলের পিছনের দিক দিয়ে বের করে দেয়। এরপর স্কুলের কাছেই ইউসুফ আলী নামে এক ব্যক্তিকে ঘটনাটি জানালে তিনি একটি রিকশা ভ্যানে করে তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। এ ঘটনায় ধর্ষিতা স্কুলছাত্রী নিজেই বাদী হয়ে বদরগঞ্জ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ৭ জুলাই মামলা দায়ের করে।
মামলাটি দায়ের করার পর পুলিশ তদন্ত শেষে আসামি স্কুল শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম মিঠুর বিরুদ্ধে ৩ আগস্ট ২০২০ ইং তারিখে অভিযোগ প্রদান করেন। মামলাটি বিচারের জন্য রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত-২ এ আসার পর গত ১২ নভেম্বর ২০২০ ইং তারিখে আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বাদী পক্ষের ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামি পক্ষ তাদের পক্ষে ৫ জন সাক্ষীকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে আদালতে আসামির পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে।
বিঞ্জ বিচারক রায় ঘোষণার সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, একজন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর সম্পর্ক হবে বাবা মেয়ের মতো সেখানে শিক্ষক যদি তার ছাত্রীকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে তাকে শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্কের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে যা সমাজ ব্যবস্থার উপর খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এই মামলায় আসামি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তার পক্ষে সাফাই সাক্ষী দেবার জন্য আদালতে ৫ জন সাফাই সাক্ষী দেয় কিন্তু আসামি পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে সাফাই সাক্ষীরাই পরোক্ষভাবে আসামি যে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তা স্বীকার করে। তা ছাড়া ৭ দিন পর মামলা দায়ের করা প্রসঙ্গে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ফৌজদারি মামলায় কোন লিমিটেশন নেই যে, এত দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।
তবে আলোচ্য মামলাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হবার পর অসুস্থ ছিল তার উপর আসামির মামলা না করার ব্যাপারে চাপ ছিল, তা ছাড়া গ্রামের মানুষ আইন সম্পর্কে অতটা জ্ঞাত না থাকায় মামলা করতে দেরি হয়েছে। তবে তারা মৌখিকভাবে থানাকে অবহিত করেছিল, সে কারণে ৭ দিন বিলম্ব হবার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে আদালতের কাছে। অন্যদিকে মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করা না হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়, ফলে মেডিকেল পরীক্ষা দেরিতে করার কারণ হিসেবে মেয়েটি মামলা করার পর শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় পরীক্ষা করা যায়নি আর গ্রামের মানুষ আলামত হিসেবে পড়নের কাপড় ধুয়ে ফেলার ব্যাপারে তাদের জ্ঞান না থাকায় তারা পড়নের কাপড় ধুয়ে ফেলায় ডিএনএ টেস্ট করা যায়নি। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২০২০ অনুযায়ী মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট বাধ্যতামূলক নয়।
তদুপরি পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার মতো প্রয়োজনীয় সব উপাদান থাকায় আসামি মনোয়ারুল ইসলাম মিঠুকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করার আদেশ প্রদান করেন বিচারক।
বাদী পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত-২ এর বিশেষ পিপি জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন অ্যাডভোকেট মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, আদালত বিলম্বে মামলা দায়েরসহ সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছেন। এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা ন্যায্য বিচার পেয়েছি। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী রইছ উদ্দিন বাদশা বলেন, আমরা ন্যায্য বিচার পাইনি এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ২০২১ , ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৩
লিয়াকত আলী বাদল, রংপুর
রংপুরের বদরগঞ্জে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে হাত-পা ও রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে ধর্ষণের অভিযোগে শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম মিঠুকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা সেই সঙ্গে জরিমানার অর্থ ধষিতা স্কুলছাত্রীকে প্রদানের আদেশ দিয়েছেন। রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত-২ এর বিচারক রোকনুজ্জামান গতকাল দুপুরে এ রায় প্রদান করেছেন।
মামলার বিবরণে জানা গেছে ২০২০ ইং সালের ৩০ জুন তারিখে বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সকাল সোয়া ১০টার দিকে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফেরার পথে একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম মিঠু অনলাইনে ফরম করানোর মিথ্যা কথা বলে তাকে স্কুলে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু স্কুলে গিয়ে অন্য শিক্ষার্থীকে দেখতে না পেয়ে চলে আসার সময় আসামি স্কুল শিক্ষক মিঠু তাকে জড়িয়ে ধরে জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে সুতলি দিয়ে দুই হাত এবং রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে তাকে জোর করে ধর্ষণ করে।
এ সময় ধষিতা স্কুলছাত্রী কান্নাকাটি করলে তাকে ভয় ভীতি দেখিয়ে স্কুলের পিছনের দিক দিয়ে বের করে দেয়। এরপর স্কুলের কাছেই ইউসুফ আলী নামে এক ব্যক্তিকে ঘটনাটি জানালে তিনি একটি রিকশা ভ্যানে করে তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। এ ঘটনায় ধর্ষিতা স্কুলছাত্রী নিজেই বাদী হয়ে বদরগঞ্জ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ৭ জুলাই মামলা দায়ের করে।
মামলাটি দায়ের করার পর পুলিশ তদন্ত শেষে আসামি স্কুল শিক্ষক মনোয়ারুল ইসলাম মিঠুর বিরুদ্ধে ৩ আগস্ট ২০২০ ইং তারিখে অভিযোগ প্রদান করেন। মামলাটি বিচারের জন্য রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত-২ এ আসার পর গত ১২ নভেম্বর ২০২০ ইং তারিখে আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বাদী পক্ষের ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আসামি পক্ষ তাদের পক্ষে ৫ জন সাক্ষীকে সাফাই সাক্ষী হিসেবে আদালতে আসামির পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে।
বিঞ্জ বিচারক রায় ঘোষণার সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, একজন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর সম্পর্ক হবে বাবা মেয়ের মতো সেখানে শিক্ষক যদি তার ছাত্রীকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে তাকে শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্কের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে যা সমাজ ব্যবস্থার উপর খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, এই মামলায় আসামি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য তার পক্ষে সাফাই সাক্ষী দেবার জন্য আদালতে ৫ জন সাফাই সাক্ষী দেয় কিন্তু আসামি পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে সাফাই সাক্ষীরাই পরোক্ষভাবে আসামি যে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তা স্বীকার করে। তা ছাড়া ৭ দিন পর মামলা দায়ের করা প্রসঙ্গে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ফৌজদারি মামলায় কোন লিমিটেশন নেই যে, এত দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।
তবে আলোচ্য মামলাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায় স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হবার পর অসুস্থ ছিল তার উপর আসামির মামলা না করার ব্যাপারে চাপ ছিল, তা ছাড়া গ্রামের মানুষ আইন সম্পর্কে অতটা জ্ঞাত না থাকায় মামলা করতে দেরি হয়েছে। তবে তারা মৌখিকভাবে থানাকে অবহিত করেছিল, সে কারণে ৭ দিন বিলম্ব হবার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে আদালতের কাছে। অন্যদিকে মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করা না হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়, ফলে মেডিকেল পরীক্ষা দেরিতে করার কারণ হিসেবে মেয়েটি মামলা করার পর শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় পরীক্ষা করা যায়নি আর গ্রামের মানুষ আলামত হিসেবে পড়নের কাপড় ধুয়ে ফেলার ব্যাপারে তাদের জ্ঞান না থাকায় তারা পড়নের কাপড় ধুয়ে ফেলায় ডিএনএ টেস্ট করা যায়নি। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২০২০ অনুযায়ী মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্ট বাধ্যতামূলক নয়।
তদুপরি পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার মতো প্রয়োজনীয় সব উপাদান থাকায় আসামি মনোয়ারুল ইসলাম মিঠুকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করার আদেশ প্রদান করেন বিচারক।
বাদী পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত-২ এর বিশেষ পিপি জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন অ্যাডভোকেট মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, আদালত বিলম্বে মামলা দায়েরসহ সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছেন। এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা ন্যায্য বিচার পেয়েছি। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী রইছ উদ্দিন বাদশা বলেন, আমরা ন্যায্য বিচার পাইনি এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।