সিআরবি রক্ষা আন্দোলন

জাহিদ অয়ন

সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যার অধীনে চট্টগ্রামে একটি মেডিকেল কলেজ, একটি ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রকল্পের জন্য যে জমি প্রস্তাবিত হয়েছে, সেটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) এলাকায়। চুক্তিটি গৃহীত হবার পর থেকেই চট্টগ্রাম নগরবাসী বিভিন্ন আপত্তি জানিয়ে আসছেন। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য- এ সমস্ত বিভিন্ন দিক থেকে রয়েছে সিআরবি এলাকার তাৎপর্য। প্রকল্পটি সংলগ্ন এলাকার পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যেখানে বেশ কিছু শতবর্ষী বৃক্ষ তো রয়েছেই, তা ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির গাছগাছালি। যদিও বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হচ্ছে, যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়।

কিন্তু হাসপাতাল বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর অধীনে চিহ্নিত রেড ক্যাটাগরির একটি স্থাপনা। পরিবেশের ওপর যে ধরনের স্থাপনাগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি, আইনের রেড ক্যাটাগরিতে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাস্তবে পরিবেশ কতটা রক্ষা করে হাসপাতাল পরিচালনা সম্ভব, তা নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যায় না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সমস্ত আলোচনায় সবচেয়ে কম উঠে এসেছে, তা হলো পাবলিক স্পেস হিসেবে এলাকাটির গুরুত্ব। সিআরবি এলাকাটি চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান পাবলিক স্পেস বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান। একটি আদর্শ নগরী গঠনে এবং নাগরিকদের মানসম্নন্ন নগরজীবন নিশ্চিত করতে পাবলিক স্পেসের গুরুত্ব অপরিহার্য।

UN-Habitat-এর গবেষণা অনুযায়ী, একটি আদর্শ নগরীর প্রায় ৫০ শতাংশ ভূমি পাবলিক স্পেস হিসেবে উন্মুক্ত থাকা উচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিলাসিতাই মনে হবে, যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় হাজারখানেক মানুষের বসবাস; নগর এলাকায় সেই সংখ্যাটি আরো বেশি। তবে UN-Habitat-এর ব্যাখ্যা লক্ষ্য করলে এর তাৎপর্য অনুধাবন করা সহজ হবে। উৎকৃষ্ট পাবলিক স্পেসের অভাব নাগরিক জীবনের মান কমিয়ে দেয়, যার ফলে নগরে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যেতে পারে, সামাজিক সংহতি লোপ পেতে পারে, নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্যেই এর লক্ষ্যণীয় প্রভাব পড়তে পারে এবং সর্বোপরি নগরজীবনে একধরনের আবদ্ধতা (congestion) সৃষ্টি হতে পারে। অপরপক্ষে, উৎকৃষ্ট পাবলিক স্পেস নিরাপদ ও সংহতিপূর্ণ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় এবং সহাবস্থানের সুযোগ করে দেওয়ায়, সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকেও এ ধরনের স্থানগুলো কমিয়ে আনতে পারে বলে UN-Habitat মনে করে। স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এটি একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়। সর্বোপরি নগরীর প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নে উন্মুক্ত স্থানগুলো ভূমিকা রাখে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উল্লিখিত সব বৈশিষ্ট্যই চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকাটি ধারণ করে আছে। প্রতিদিন সেখানে হাজারও মানুষ প্রাতঃভ্রমণ এবং সান্ধ্যভ্রমণে আসেন। শিশুরা যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্ত হয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পায়। তরুণ-কিশোর বয়সীরা প্রতিদিনই সংলগ্ন এলাকায় খেলাধুলা করে। বলাই বাহুল্য, একটি হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় এমন কোলাহলের সুযোগ আর থাকবে না। এছাড়াও সিআরবির শতবর্ষী বৃক্ষগুলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অংশ। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রও এই এলাকা। রমনার বটমূল ছাড়া যেমন ঢাকায় পহেলা বৈশাখ ভাবা যায় না, তেমনি সিআরবির শিরীষতলা চট্টগ্রামের পহেলা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার মাস্টারপ্ল্যানে এলাকাটি সংরক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানেও উক্ত এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নগরের অন্য বিভিন্ন স্থানেও রেলওয়ের যে জায়গা রয়েছে, তার বদলে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে এরকম একটি তাৎপর্যপূর্ণ এলাকায় পরিবেশ আইনে রেড ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত একটি স্থাপনার সিদ্ধান্ত কেন গৃহীত হলো তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের।

যদিও আশার বিষয়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সিআরবির মতো ঐতিহ্যবাহী স্থানে এ ধরনের স্থাপনার অনুমোদন দেবে না। চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু বাদী হয়ে চট্টগ্রাম আদালতে সিআরবি সংরক্ষণের আবেদন করেছেন। আদালত তার আবেদন আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সমন জারি করেছেন। মামলার বিবাদীরা হলেন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, রেলওয়ের জিএম ও স্টেট অফিসার, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চসিক ও ওয়াসার সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী, স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ স¤পাদক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক প্রমুখ। এদিকে চট্টগ্রাম সুশীল সমাজ সিআরবি সংরক্ষণের দাবিতে গণস্বাক্ষর কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম সিভিল সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. অনুপম সেন কার্যক্রমটি উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশে পাবলিক স্পেস বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানের ধারণাটি কতটা উপেক্ষিত, তা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্তটি দিয়ে আরো একবার স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে নাগরিক জীবনের মান যে বিশ্বের অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় তলানির দিকে, তার অন্যতম কারণ উন্মুক্ত স্থানের অভাব। মাইলের পর মাইল কেবল গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা কনক্রিটের ব্লক। তাতেও কোনো শিল্পবোধ নেই, বেশির ভাগ স্থাপনায় জমির সমস্তটার বাণিজ্যিক মূল্য উসুলের প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বিবেচনা করে নিরাপদে বহির্গমনের পথটুকুও রাখা হয় না। এমন শহরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পর্যাপ্ত স্থানের আশা করা বস্তুত খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ঢাকা শহরে হাঁটতে বের হলে একমাত্র রেস্তোরাঁ ছাড়া ন্যূনতম আর কোনো বসার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চট্টগ্রামও ক্রমেই ঢাকার পথে হাঁটছে। এখনকার স্কুলগুলোতেও লক্ষ্য করা যায়, বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

স্কুলের বাইরেও উন্মুক্ত খেলাধুলার জায়গা কমছে ক্রমাগত। প্রাকৃতিক পরিবেশের মানও এর ফলে কমে যাচ্ছে বহুগুণ। দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা উঠেছে শীর্ষে। পরিবেশের বিবেচনা বাদ দিলেও শিল্পবোধ, মননের চর্চাতেও পাবলিক স্পেসের গুরুত্ব অত্যধিক। বাংলাদেশের নগরজীবনে পাবলিক স্পেস উপেক্ষিত হতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মানসম্পন্ন স্বকীয় শিল্পবোধ, সৃজনশীলতা গড়ে তোলা দুরূহ হয়ে পড়বে। ক্রমাগত বাড়বে নাগরিক হতাশা। বস্তুত নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ব্যাহত হলেই বিদেশি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ সহজ হয়। পাবলিক স্পেসগুলো শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার মিলনমেলা হিসেবে কাজ করে। নাগরিকরা একত্রিত হন, একে অপরকে সচেতন করেন, যার একটি রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক গুরুত্বও রয়েছে। সিআরবির সিদ্ধান্তটির পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে পাবলিক স্পেসের গুরুত্বের বিষয়টিতে বিশেষভাবে আলোকপাত করা প্রয়োজন। তা না হলে যে পরিণতি অপেক্ষা করছে তার উপযুক্ত চিত্রায়ণ পাওয়া যায় কবি আল মাহমুদের পঙ্ক্তিতে। বাংলাদেশের নান্দনিকতার প্রতি উদাসীন অগ্রযাত্রার সমালোচনা করে কবি আল মাহমুদ অনেক আগেই লিখেছেন-

এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উত্থান রহিত/নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না।/নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়/কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্য কোন শ্যামলতা নেই।/বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের/বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।/গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে/পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই...।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)

শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ২০২১ , ৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৩

সিআরবি রক্ষা আন্দোলন

জাহিদ অয়ন

সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যার অধীনে চট্টগ্রামে একটি মেডিকেল কলেজ, একটি ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রকল্পের জন্য যে জমি প্রস্তাবিত হয়েছে, সেটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) এলাকায়। চুক্তিটি গৃহীত হবার পর থেকেই চট্টগ্রাম নগরবাসী বিভিন্ন আপত্তি জানিয়ে আসছেন। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য- এ সমস্ত বিভিন্ন দিক থেকে রয়েছে সিআরবি এলাকার তাৎপর্য। প্রকল্পটি সংলগ্ন এলাকার পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যেখানে বেশ কিছু শতবর্ষী বৃক্ষ তো রয়েছেই, তা ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির গাছগাছালি। যদিও বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হচ্ছে, যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়।

কিন্তু হাসপাতাল বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর অধীনে চিহ্নিত রেড ক্যাটাগরির একটি স্থাপনা। পরিবেশের ওপর যে ধরনের স্থাপনাগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি, আইনের রেড ক্যাটাগরিতে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাস্তবে পরিবেশ কতটা রক্ষা করে হাসপাতাল পরিচালনা সম্ভব, তা নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যায় না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সমস্ত আলোচনায় সবচেয়ে কম উঠে এসেছে, তা হলো পাবলিক স্পেস হিসেবে এলাকাটির গুরুত্ব। সিআরবি এলাকাটি চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান পাবলিক স্পেস বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান। একটি আদর্শ নগরী গঠনে এবং নাগরিকদের মানসম্নন্ন নগরজীবন নিশ্চিত করতে পাবলিক স্পেসের গুরুত্ব অপরিহার্য।

UN-Habitat-এর গবেষণা অনুযায়ী, একটি আদর্শ নগরীর প্রায় ৫০ শতাংশ ভূমি পাবলিক স্পেস হিসেবে উন্মুক্ত থাকা উচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিলাসিতাই মনে হবে, যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় হাজারখানেক মানুষের বসবাস; নগর এলাকায় সেই সংখ্যাটি আরো বেশি। তবে UN-Habitat-এর ব্যাখ্যা লক্ষ্য করলে এর তাৎপর্য অনুধাবন করা সহজ হবে। উৎকৃষ্ট পাবলিক স্পেসের অভাব নাগরিক জীবনের মান কমিয়ে দেয়, যার ফলে নগরে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যেতে পারে, সামাজিক সংহতি লোপ পেতে পারে, নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্যেই এর লক্ষ্যণীয় প্রভাব পড়তে পারে এবং সর্বোপরি নগরজীবনে একধরনের আবদ্ধতা (congestion) সৃষ্টি হতে পারে। অপরপক্ষে, উৎকৃষ্ট পাবলিক স্পেস নিরাপদ ও সংহতিপূর্ণ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় এবং সহাবস্থানের সুযোগ করে দেওয়ায়, সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকেও এ ধরনের স্থানগুলো কমিয়ে আনতে পারে বলে UN-Habitat মনে করে। স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এটি একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়। সর্বোপরি নগরীর প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নে উন্মুক্ত স্থানগুলো ভূমিকা রাখে।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, উল্লিখিত সব বৈশিষ্ট্যই চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকাটি ধারণ করে আছে। প্রতিদিন সেখানে হাজারও মানুষ প্রাতঃভ্রমণ এবং সান্ধ্যভ্রমণে আসেন। শিশুরা যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্ত হয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পায়। তরুণ-কিশোর বয়সীরা প্রতিদিনই সংলগ্ন এলাকায় খেলাধুলা করে। বলাই বাহুল্য, একটি হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় এমন কোলাহলের সুযোগ আর থাকবে না। এছাড়াও সিআরবির শতবর্ষী বৃক্ষগুলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অংশ। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রও এই এলাকা। রমনার বটমূল ছাড়া যেমন ঢাকায় পহেলা বৈশাখ ভাবা যায় না, তেমনি সিআরবির শিরীষতলা চট্টগ্রামের পহেলা বৈশাখ উৎসবের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার মাস্টারপ্ল্যানে এলাকাটি সংরক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানেও উক্ত এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নগরের অন্য বিভিন্ন স্থানেও রেলওয়ের যে জায়গা রয়েছে, তার বদলে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে এরকম একটি তাৎপর্যপূর্ণ এলাকায় পরিবেশ আইনে রেড ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত একটি স্থাপনার সিদ্ধান্ত কেন গৃহীত হলো তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের।

যদিও আশার বিষয়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সিআরবির মতো ঐতিহ্যবাহী স্থানে এ ধরনের স্থাপনার অনুমোদন দেবে না। চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু বাদী হয়ে চট্টগ্রাম আদালতে সিআরবি সংরক্ষণের আবেদন করেছেন। আদালত তার আবেদন আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সমন জারি করেছেন। মামলার বিবাদীরা হলেন- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, রেলওয়ের জিএম ও স্টেট অফিসার, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চসিক ও ওয়াসার সচিব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী, স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ স¤পাদক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক প্রমুখ। এদিকে চট্টগ্রাম সুশীল সমাজ সিআরবি সংরক্ষণের দাবিতে গণস্বাক্ষর কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম সিভিল সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. অনুপম সেন কার্যক্রমটি উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশে পাবলিক স্পেস বা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থানের ধারণাটি কতটা উপেক্ষিত, তা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্তটি দিয়ে আরো একবার স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে নাগরিক জীবনের মান যে বিশ্বের অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় তলানির দিকে, তার অন্যতম কারণ উন্মুক্ত স্থানের অভাব। মাইলের পর মাইল কেবল গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা কনক্রিটের ব্লক। তাতেও কোনো শিল্পবোধ নেই, বেশির ভাগ স্থাপনায় জমির সমস্তটার বাণিজ্যিক মূল্য উসুলের প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বিবেচনা করে নিরাপদে বহির্গমনের পথটুকুও রাখা হয় না। এমন শহরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পর্যাপ্ত স্থানের আশা করা বস্তুত খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ঢাকা শহরে হাঁটতে বের হলে একমাত্র রেস্তোরাঁ ছাড়া ন্যূনতম আর কোনো বসার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চট্টগ্রামও ক্রমেই ঢাকার পথে হাঁটছে। এখনকার স্কুলগুলোতেও লক্ষ্য করা যায়, বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

স্কুলের বাইরেও উন্মুক্ত খেলাধুলার জায়গা কমছে ক্রমাগত। প্রাকৃতিক পরিবেশের মানও এর ফলে কমে যাচ্ছে বহুগুণ। দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা উঠেছে শীর্ষে। পরিবেশের বিবেচনা বাদ দিলেও শিল্পবোধ, মননের চর্চাতেও পাবলিক স্পেসের গুরুত্ব অত্যধিক। বাংলাদেশের নগরজীবনে পাবলিক স্পেস উপেক্ষিত হতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মানসম্পন্ন স্বকীয় শিল্পবোধ, সৃজনশীলতা গড়ে তোলা দুরূহ হয়ে পড়বে। ক্রমাগত বাড়বে নাগরিক হতাশা। বস্তুত নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ব্যাহত হলেই বিদেশি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ সহজ হয়। পাবলিক স্পেসগুলো শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার মিলনমেলা হিসেবে কাজ করে। নাগরিকরা একত্রিত হন, একে অপরকে সচেতন করেন, যার একটি রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক গুরুত্বও রয়েছে। সিআরবির সিদ্ধান্তটির পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে পাবলিক স্পেসের গুরুত্বের বিষয়টিতে বিশেষভাবে আলোকপাত করা প্রয়োজন। তা না হলে যে পরিণতি অপেক্ষা করছে তার উপযুক্ত চিত্রায়ণ পাওয়া যায় কবি আল মাহমুদের পঙ্ক্তিতে। বাংলাদেশের নান্দনিকতার প্রতি উদাসীন অগ্রযাত্রার সমালোচনা করে কবি আল মাহমুদ অনেক আগেই লিখেছেন-

এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উত্থান রহিত/নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না।/নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়/কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্য কোন শ্যামলতা নেই।/বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের/বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।/গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে/পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই...।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]

সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)