তেরশ্রী গণহত্যা দিবস আজ

একদিনে শহীদ ৪৩ বাঙালি

আজ ভয়াল ২২ নভেম্বর। মানিকগঞ্জের ঘিওরের তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর এবং রাজাকার, আলবদর আলসামস বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বোরচিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরীসহ ৪৩ জন গ্রামবাীকে গুলি করে এবং বেওনেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরীকে হাত, পা বেঁধে শরীরে পেট্রোল ঢেলে জালিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকা-ের কারন জানতে চাওয়াতে ঘাতকরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৫০টি বছর অতিবাহিত হবার পরেও নিহতদের পরিবারের খোঁজ খবর কেউ রাখেনি। এবং কি বিচার হয়নি এই জঘন্যতম হত্যাকা-ের।

জানা গেছে, ঘিওরের তেরশ্রী গ্রামের মানুষগুলো ছিল সাংস্কৃতিক মনা। বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেরশ্রী গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধদের আনাগোনা ছিল জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা টার্গেট করে এই গ্রামটিকে। গোপনে শিক্ষানুরাগী, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবিদের তালিকা করে প্রস্তুত করে দালালেরা। নীল নক্সা করে গ্রামটিকে ধ্বংস করার। ১৯৭১’ সালের ২২ নভেম্বর ভোর কেটে সূর্য ওঠার মুহূর্তেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার ঘিরে ফেলে তেরশ্রী গ্রামের সেন পাড়ার কালি মন্দিরটি।

২১ নভেম্বর রাতে এ দেশীয় দালালদের নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গোপনে একটি মিটিং করে তেরশ্রী গ্রামে সেনপাড়া কালিবাড়ী মাঠ প্রাঙ্গণে। তারা পরিকল্পনা করে ২২ নভেম্বর হত্যাযজ্ঞের। ঘিওর থেকে সিধুঁনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে শতাধিক পাকিস্তানী সেনা এ দেশীয় ঘাতকদের সহযোগিতায় ভারি অস্ত্র নিয়ে তেরশ্রী গ্রামে পৌছে। কনকনে শীতের সকাল অনেকেই ঘুম থেকে উঠেনি। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানী সেনারা অতর্কিত হামলা চালায় গ্রামটিতে। ঘরে ঘরে জ¦ালিয়ে দেয় আগুন। ঘর থেকে বের হবার সুযোগ দেয়নি গ্রামবাসীকে। বৃষ্টিরমতো গুলি ছুড়তে থাকে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর। তাদের চিৎকারে পুরো এলাকা কম্পিত হয়ে উঠে। অপরেশনের সময় এ দেশীয় দালালরা মুখোশ পরে নেয় যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে। মাত্র ৬ ঘণ্টার অপারেশনে ঘাতকরা একের পর এক বেওনেট চার্জ করে এবং গুলি করে ৪৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বেলা ১২টার মধ্যে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা চলে ঘিওর সদরে। এই সময় পুরো এলাকা রক্তে ভেসে য়ায। লাশগুলো কোন রকম দাফন করা হয়। হত্যাযজ্ঞের পরে বহু হিন্দু পরিবার অন্যত্র চলে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পরে বিপন্ন কিছু মানুষ আবার ফিরে আসে তারে বাপ দাদাদের ভিটায়। তবে সে দিনের সেই নৃশংসতা কিছুতেই তারা ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হবার পরেও সেন পাড়া গ্রামের মানুষগুলো এই হত্যাকা-ের বিচার পায়নি। নিহত ৪৩ জনের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরী, তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরী মাখন চন্দ্র সরকার,যাদপ চন্দ্রদত্ত, তার পুত্র মাধব চন্দ্র দত্ত,সাধা চরন দত্ত, শামা লাল সুত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদিশ চন্দ্র দাস, সুধনা চন্দ্র দাশ, সুরেন্দ্র চন্দ্র দাশ, প্রাণ নাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ দাশ, রামচরন সুত্রধর,রাধাবল্লভ, ভোলা নাথ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ সুত্রধর, মো. কফিল উদ্দিন, মো. গেদা মিয়া, মো. একলাছ মিয়া, শ্যামা প্রসাদ নাগ, নারায়ন চন্দ্র সুত্রধর, যোগেন্দ্র নাথ গোস্বামী যোগেশ চন্দ্র, গৌর চন্দ্র দাস, মো. তফিল উদ্দিন, তাজ উদ্দিন, মনিন্দ্র চন্দ্র দাশ।

সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

তেরশ্রী গণহত্যা দিবস আজ

একদিনে শহীদ ৪৩ বাঙালি

রামপ্রসাদ সরকার দীপু, মানিকগঞ্জ

image

মানিকগঞ্জ ঘিওরের তেরশ্রী স্মৃতিস্তম্ভ

আজ ভয়াল ২২ নভেম্বর। মানিকগঞ্জের ঘিওরের তেরশ্রী গণহত্যা দিবস। পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর এবং রাজাকার, আলবদর আলসামস বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বোরচিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরীসহ ৪৩ জন গ্রামবাীকে গুলি করে এবং বেওনেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরীকে হাত, পা বেঁধে শরীরে পেট্রোল ঢেলে জালিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকা-ের কারন জানতে চাওয়াতে ঘাতকরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৫০টি বছর অতিবাহিত হবার পরেও নিহতদের পরিবারের খোঁজ খবর কেউ রাখেনি। এবং কি বিচার হয়নি এই জঘন্যতম হত্যাকা-ের।

জানা গেছে, ঘিওরের তেরশ্রী গ্রামের মানুষগুলো ছিল সাংস্কৃতিক মনা। বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেরশ্রী গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধদের আনাগোনা ছিল জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা টার্গেট করে এই গ্রামটিকে। গোপনে শিক্ষানুরাগী, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবিদের তালিকা করে প্রস্তুত করে দালালেরা। নীল নক্সা করে গ্রামটিকে ধ্বংস করার। ১৯৭১’ সালের ২২ নভেম্বর ভোর কেটে সূর্য ওঠার মুহূর্তেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার ঘিরে ফেলে তেরশ্রী গ্রামের সেন পাড়ার কালি মন্দিরটি।

২১ নভেম্বর রাতে এ দেশীয় দালালদের নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গোপনে একটি মিটিং করে তেরশ্রী গ্রামে সেনপাড়া কালিবাড়ী মাঠ প্রাঙ্গণে। তারা পরিকল্পনা করে ২২ নভেম্বর হত্যাযজ্ঞের। ঘিওর থেকে সিধুঁনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে শতাধিক পাকিস্তানী সেনা এ দেশীয় ঘাতকদের সহযোগিতায় ভারি অস্ত্র নিয়ে তেরশ্রী গ্রামে পৌছে। কনকনে শীতের সকাল অনেকেই ঘুম থেকে উঠেনি। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানী সেনারা অতর্কিত হামলা চালায় গ্রামটিতে। ঘরে ঘরে জ¦ালিয়ে দেয় আগুন। ঘর থেকে বের হবার সুযোগ দেয়নি গ্রামবাসীকে। বৃষ্টিরমতো গুলি ছুড়তে থাকে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর। তাদের চিৎকারে পুরো এলাকা কম্পিত হয়ে উঠে। অপরেশনের সময় এ দেশীয় দালালরা মুখোশ পরে নেয় যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে। মাত্র ৬ ঘণ্টার অপারেশনে ঘাতকরা একের পর এক বেওনেট চার্জ করে এবং গুলি করে ৪৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বেলা ১২টার মধ্যে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা চলে ঘিওর সদরে। এই সময় পুরো এলাকা রক্তে ভেসে য়ায। লাশগুলো কোন রকম দাফন করা হয়। হত্যাযজ্ঞের পরে বহু হিন্দু পরিবার অন্যত্র চলে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পরে বিপন্ন কিছু মানুষ আবার ফিরে আসে তারে বাপ দাদাদের ভিটায়। তবে সে দিনের সেই নৃশংসতা কিছুতেই তারা ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হবার পরেও সেন পাড়া গ্রামের মানুষগুলো এই হত্যাকা-ের বিচার পায়নি। নিহত ৪৩ জনের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশরী প্রসাদ রায় চৌধুরী, তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরী মাখন চন্দ্র সরকার,যাদপ চন্দ্রদত্ত, তার পুত্র মাধব চন্দ্র দত্ত,সাধা চরন দত্ত, শামা লাল সুত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদিশ চন্দ্র দাস, সুধনা চন্দ্র দাশ, সুরেন্দ্র চন্দ্র দাশ, প্রাণ নাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ দাশ, রামচরন সুত্রধর,রাধাবল্লভ, ভোলা নাথ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ সুত্রধর, মো. কফিল উদ্দিন, মো. গেদা মিয়া, মো. একলাছ মিয়া, শ্যামা প্রসাদ নাগ, নারায়ন চন্দ্র সুত্রধর, যোগেন্দ্র নাথ গোস্বামী যোগেশ চন্দ্র, গৌর চন্দ্র দাস, মো. তফিল উদ্দিন, তাজ উদ্দিন, মনিন্দ্র চন্দ্র দাশ।