নতুন ধানের উৎসব

আবদুর রহমান

নবান্ন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্য উৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন নবান্ন। এদেশের কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সয আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। হেমন্তে নতুন আমন ধান ঘরে তোলার সময় এ উৎসব পালন করা হয়। এ সময় আমন ধান কাটা হয়। এ নতুন ধানের চাল দিয়ে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে।

সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ মাস। এথেকে সহজেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। হাজার বছরের পুরোনো এ উৎসব সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম যা বাঙালির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত।

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাস তথা হেমন্ত ঋতু আসে নতুন ফসলের সওগাত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালি দিন। তাদের মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালি ধানের সম্ভার স্বগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলাদেশ।

কৃষক রাশি রাশি সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। কৃষকের মুখে থাকে অনাবিল জীবন জাগানিয়া হাসি। কৃষাণ-কৃষাণির প্রাণমন ভরে ওঠে এক অলৌকিক আনন্দে। এ সময় নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষাণ-কৃষাণিরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ সময় কৃষাণিরা নতুন ধানের চাল থেকে ফিরনি, পায়েশ, পিঠা-পুলিসহ রকমারি খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তা পরমানন্দে ভোগ করে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। কৃষাণ বধূরা নজরকাড়া এবং নকশা সমৃদ্ধ পিঠা তৈরি করে এবং এর মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের অলিখিত দুঃখ, যাতনা-বেদনার গল্প তৈরি হয়। কৃষাণির পরণে নতুন শাড়ি, ঝলমলে থাকে হাসিমুখ। ছেলেমেয়েদের জন্য কেনা হয় নতুন জামাকাপড়।

নতুন ধান বিক্রির টাকায় ঘরে ঘরে বিয়ে-শাদির ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। ধান মাড়াই আর ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢেঁকি ছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে।

দেশের কোন কোন অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম। মুসলিম কৃষক সমাজে নতুন ফসল ঘরে ওঠার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বাড়ি বাড়ি কোরানখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং মসজিদ ও দরগায় শিরনির আয়োজন করা হয়। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অন্ন লক্ষ্মীতুল্য। তাই তারা এ দেবীর উদ্দেশ্যে পূজা-অর্চনার আয়োজন করে। এতে গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে ...।’ নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক মেলবন্ধনের, গড়ে ওঠে পারস্পরিক সৌহার্য্য।

নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলার ঐতিহ্যগুলো ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। আজকের গ্রামবাংলার শিশুরা যেন স্বপ্নের মধ্যে নবান্নের উৎসবের ইতিকথা বাবা-মা, কিংবা দাদা-দাদির মুখে মুখে শোনে। অন্যদিকে খেলার মাঠের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ডিজিটাল যুগে খেলার জায়গা বলতে এক চিলতে বারান্দা। শিশুদের খেলার মাঠের জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্যাব, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটর। দূরন্ত শৈশবটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের।

[লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা]

সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১ , ৭ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৩

নতুন ধানের উৎসব

আবদুর রহমান

নবান্ন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্য উৎসব। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন নবান্ন। এদেশের কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সয আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। হেমন্তে নতুন আমন ধান ঘরে তোলার সময় এ উৎসব পালন করা হয়। এ সময় আমন ধান কাটা হয়। এ নতুন ধানের চাল দিয়ে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে।

সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ মাস। এথেকে সহজেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। হাজার বছরের পুরোনো এ উৎসব সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম যা বাঙালির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত।

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাস তথা হেমন্ত ঋতু আসে নতুন ফসলের সওগাত নিয়ে। কৃষককে উপহার দেয় সোনালি দিন। তাদের মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সোনালি ধানের সম্ভার স্বগৌরবে বুকে ধারণ করে হেসে ওঠে বাংলাদেশ।

কৃষক রাশি রাশি সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। কৃষকের মুখে থাকে অনাবিল জীবন জাগানিয়া হাসি। কৃষাণ-কৃষাণির প্রাণমন ভরে ওঠে এক অলৌকিক আনন্দে। এ সময় নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষাণ-কৃষাণিরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এ সময় কৃষাণিরা নতুন ধানের চাল থেকে ফিরনি, পায়েশ, পিঠা-পুলিসহ রকমারি খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তা পরমানন্দে ভোগ করে এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। কৃষাণ বধূরা নজরকাড়া এবং নকশা সমৃদ্ধ পিঠা তৈরি করে এবং এর মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের অলিখিত দুঃখ, যাতনা-বেদনার গল্প তৈরি হয়। কৃষাণির পরণে নতুন শাড়ি, ঝলমলে থাকে হাসিমুখ। ছেলেমেয়েদের জন্য কেনা হয় নতুন জামাকাপড়।

নতুন ধান বিক্রির টাকায় ঘরে ঘরে বিয়ে-শাদির ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। ধান মাড়াই আর ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা শোনা যায় না। অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢেঁকি ছাঁটা চাল দিয়েই হতো ভাত খাওয়া। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে।

দেশের কোন কোন অঞ্চলে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া দাওয়ার ধুম। মুসলিম কৃষক সমাজে নতুন ফসল ঘরে ওঠার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বাড়ি বাড়ি কোরানখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং মসজিদ ও দরগায় শিরনির আয়োজন করা হয়। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী অন্ন লক্ষ্মীতুল্য। তাই তারা এ দেবীর উদ্দেশ্যে পূজা-অর্চনার আয়োজন করে। এতে গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে ...।’ নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক মেলবন্ধনের, গড়ে ওঠে পারস্পরিক সৌহার্য্য।

নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলার ঐতিহ্যগুলো ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। আজকের গ্রামবাংলার শিশুরা যেন স্বপ্নের মধ্যে নবান্নের উৎসবের ইতিকথা বাবা-মা, কিংবা দাদা-দাদির মুখে মুখে শোনে। অন্যদিকে খেলার মাঠের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ডিজিটাল যুগে খেলার জায়গা বলতে এক চিলতে বারান্দা। শিশুদের খেলার মাঠের জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্যাব, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটর। দূরন্ত শৈশবটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের।

[লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা]