আবুল হাসান ও বন্ধু আমার

নির্মলেন্দু গুণ

আমি জানতাম, আবুল হাসান ছিল ওর মা এবং ওর বোনদের প্রতি খুবই দুর্বল। বিশেষ করে বুড়ির প্রতি ওর খুবই দুর্বলতা ছিল। পারিবারিক কথা উঠলে হাসান ওর মা এবং বোনদের কথাই বেশি বলতো, বাবা বা ভাইদের কথা সে খুব একটা বলতো না। ওর শয্যাপাশে গ্রাম থেকে আসা বোন বুড়ি এবং মা সর্বদাই উপস্থিত থাকতো। হাসানের কাছ হাসানের আম্মা জানতো যে, হাসান অনেকবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে। কিন্তু আমি ওদের বাড়িতে কখনও যাইনি। হাসানও নিজের বাড়িতে খুব একটা যেতো না। সুস্থ থাকার সময়ও হাসান আমার চাইতে কমই গ্রামের বাড়িতে যেতো। বার্লিন থেকে ফিরে আসার পর হাসান একবারও গ্রামের বাড়িতে যায়নি। আমি ওকে গ্রামের বাড়িতে যাবার কথা বললে হাসান বলতো যাবো... আরও একটু ভালো হয়ে নিই, পরে যাবো। আমার এখন বড়-ডাক্তারদের কাছাকাছি থাকা দরকার। দীর্ঘদিন হাসান গ্রামের বাড়িতে না যাওয়ার কারণে বুড়ি এবং খালাম্মা আমার কাছে অভিযোগ করলেন। বললেন, এবার হাসান ভালো হয়ে গেলে তুমিও হাসানের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি বললাম, নিশ্চয়ই যাবো।

বুড়ির মাথায় ও হাসানের পায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমি হাসপাতাল থেকে চলে আসি। হাসানের পায়ে হাত বোলাতে গিয়ে লক্ষ্য করি, তার পা বেশ ফুলে উঠেছে। তার মানে জল এসেছে হাসানের পায়ে। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। আমি খুব চিন্তিত বোধ করি।

মহাদেব ও আবুল হাসান আমাকে যৌথভাবে যে চিঠি দুটো লিখেছিল আমি ঐ চিঠি সঙ্গেই রাখতাম। আগেই জানিয়েছি, ভারত এবং আমেরিকান কানেকশন ছিল বলে আমার বড় ভাই ও বন্ধু পূরবীর চিঠি দুটো আমি ভয় পেয়ে পুলিশ কন্ট্রোলরুমের বাথরুমে ঢুকে ছিঁড়ে ফেলে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আবুল হাসান ও মহাদেবের চিঠির খামটি আমার পকেটেই ছিল। রমনা হাজতে যখন ছিলাম, যখন আমার ঘুম আসতো না, তখন সময় কাটাবার জন্য ঐ চিঠি দুটো আমি পড়তাম। বারবার পড়তাম। ভালো লাগতো। হাজতিদের কেউ কেউ ভাবতো আমি বুঝি আমার কোনো প্রেমিকার চিঠি পড়ছি। আসলে ঐ চিঠি দুটোকে আমি প্রেমপত্ররূপেই জ্ঞান করতাম। বন্ধুর উদ্বেগ ও ভালোবাসামাখা ঐ চিঠি দুটো আমাকে জীবনের বিষাদদীর্ণ মুহূর্তে আনন্দ দিত, বাঁচবার সাহস যোগাত।

উন্নতির পরিবর্তে হাসানের অবস্থা যখন ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল, তখন আমার কাছে হাসানের চিঠিটির গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। আমি গভীর রাত্রে আবার হাসানের চিঠিটি খুলে পড়তে বসি। কী বলতে চেয়েছে হাসান চিঠিতে? আমার মতো একজন সামান্য বন্ধুর চিঠি না পাওয়ার জন্য এতো অভিমান হয়েছিল কেন হাসানের? নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকল আমার।

অন্য অনেককে লিখলেও, হাসান বার্লিন থেকে আমাকে চিঠি লেখেনি। ১৫ আগস্টের পর, ঐরূপ একটি নৃশংসতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি যখন মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত, তখন একদিন দুপুরের দিকে আমি আর মোস্তফা মীর হাইকোর্ট মাজার থেকে সিদ্ধি সেবন করে নয়া পল্টনের মেসের দিকে ফিরছিলাম। সুরাইয়ার সঙ্গে একই রিকশায় করে তখন হাসান যাচ্ছিল হাইকোর্টের সামনে দিয়ে। আমি হাসানকে দেখে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হাত উঠাই। হাসান, স্পষ্টই বুঝতে পারি, সুরাইয়ার নির্দেশে তখন চকিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রিকশাটি আমাদের পাশ দিয়েই প্রেসক্লাবের দিকে চলে যায়। থামে না। আমি খুব কষ্ট পাই হাসানের ঐরূপ আচরণে। তার দু’একদিন পরই আমি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই অনির্দিষ্টকালের জন্য।

মহাদেব ওর বাবার শ্রাদ্ধাক্রিয়াদি সম্পন্ন করার জন্য তখন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। মহাদেব নেই, হাসানও আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিজেকে খুবই নির্বান্ধব বলে মনে হলো। আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ঐ অভিমানের কারণেই আমি গ্রাম থেকে ইচ্ছে করেই হাসানকে কোনো চিঠি লিখিনি। আমি চেয়েছিলাম, ওর চিঠি না পাওয়ার কষ্ট আমি যেমন ভোগ করেছি, ওর উপেক্ষা যেমন আমাকে কষ্ট দিয়েছে; আমার উপেক্ষা, আমার চিঠি না পাওয়ার কষ্টও তেমনি হাসান অনুভব করুক।

চিঠি না লিখে আমি যতটা আঘাত করতে চেয়েছিলাম হাসানকে, হাসানের চিঠি পড়ে মনে হলো সে তার

চেয়ে অনেক বেশি আঘাত পেয়েছে। প্রিয়জনের দেয়া আঘাতকে বড় করে গ্রহণ করার ক্ষমতা, আমার তুলনায় হাসানের যে বেশি ছিল, ওর চিঠি থেকে তাই প্রমাণিত হয়। একটি নরম কোমল বন্ধুবৎসল কবিচত্তকে আহত করার জন্য আমি মনে মনে কষ্ট পেতে থাকি। মহাদেবের চিঠিটিও ছিল খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ। কিন্তু পার্থক্য এই যে, মহাদেবের চিঠিটি নিয়ে আমার মনের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। কিন্তু হাসানের চিঠিটি আমার মনের মধ্যে এক ধরনের ‘গিল্টি ফিলিং’ তৈরি করেছিল।

আমি হাসানের চিঠিটি ভালো করে আবার পড়তে শুরু করি।

আবুল হাসান

মহাদেবের বাসা থেকে

প্রিয় গুণ

আজ রাত্রে মহাদেবের সঙ্গে আল মাহমুদের এক তুমুল বাকবিতণ্ডার পর, মহাদেবের বাসায় এসে দেখি তোমার একটি অভিমানী চিঠি মহাদেবের কাছে যা তুমি লিখেছ। চিঠিটা বারবার পড়লুম। অনেকেদিন পর তোমার সান্নিধ্য চিঠির মাধ্যমে পেয়ে একদিকে যেমন ভালো লাগল, অন্যদিকে তেমন আহত হলুম, এই ভেবে যে, তুমি আমার ঠিকানা জানা সত্ত্বেও একটা চিঠিও আমাকে লেখোনি। জানি না কী কারণ; তবে চিঠি না পেলেও তোমার সম্পর্কে অনবরত এরওর কাছ থেকে খবর নিতে চেষ্টা করেছি, মাঝে মাঝে তোমার অনুপস্থিতির নৈঃসঙ্গের তাড়নায়ই হয়তোবা। এছাড়া এর পেছনে আর কোনো মানবিক কারণ নেই। একসময় ছিল, যখন তুমি আমাকে হলুদ পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতে তখন তুমি বাইরে থাকলেও মনে হতো তোমার উপস্থিতি উজ্জ্বলভাবে বর্তমান।

আমি মানুষ হিসেবে কতটুকু সৎ এবং শুভবুদ্ধির সেটা বিচারসাপেক্ষ, তবে বন্ধু হিসেবে একসময় তো আমরা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলাম। আমাদের জীবনযাপন সূত্রগুলি একে একে পরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হলেও সেই প্রবল প্রোচ্ছন্ন দিনগুলির কি কোনো কিছুই আর আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই যা তোমার স্মৃতিকে একবারও নাড়া দিতে পারে? বা পারত? এবং সেই স্মৃতির সুবাদে একটা চিঠি কি আমিও পেতে পারতুম না? মানি, আমার নিজের কিছু কিছু এককেন্দ্রিক দোষত্রুটি এবং মানবিক দুর্বলতা শেষ কালে আমাদের দু’জনকে দু’দিকে সরিয়ে দিয়েছিল- প্রথমদিকে আমি যা ভালোবাসতাম না সেইগুলি তোমার ভালোবাসার জিনিস ছিলো- পরে যখন তুমি সেই মদ নারী গাঁজা চরস পরিত্যাগ করলে এবং সেই সময় যখন আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়ার সময়, কেন জানি না এক অনির্দিষ্ট অদৃষ্টের তাড়নায় আমরা দু’জন পরস্পরে কাছ থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়তোবা আমার দুরারোগ্য ব্যাধির তাড়না।

বার্লিন থেকে আসার পর আমি অন্য মানুষ। ফলে পুরনো যোগসূত্র সংস্থাপনের চেষ্টা করেছি যতবার, ততবার দেখেছি আমার শরীর আমার বৈরী। তুমি যা ভালোবাসো, সেইসব আমার শরীর ভালোবাসে না, তবে অসুস্থতার কারণেই। কিন্তু সত্তায় আমাদের যে গভীর সম্পর্কের সূত্র, কবির সঙ্গে কবির সেই সম্পর্ককে তো আমি কোনোদিন ম্লান করিনি।

১৫ আগস্টের পর; তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে- কিন্তু পরে একদিন হঠাৎ জানলাম তুমি আর ঢাকায় নেই। তোমার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায় দুঃখ পেয়েছিলাম; নৈঃসঙ্গ্যও কম বাজেনি। কিন্তু পরে আবার ভেবেছি, যেভাবে তুমি মাঝে মাঝে বাড়ি যাও, সেভাবেই হয়তো গিয়েছো পরে আবার কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসবে। কিন্তু পরে জানতে পারলুম, তুমি গিয়েছো অনেকদিনের জন্য। বাড়ি গিয়ে তুমি বিভিন্নজনের কাছে চিঠি লিখেছ, সেইসব চিঠিতেই এইসব জানতে পেয়েছি। আমিও অপেক্ষায় ছিলুম, একটা চিঠি পাবো, কিন্তু সবসময় অপেক্ষা যে ফলপ্রসূ হবে, এটার তো কোনো কথা নেই।

মহাদেবের কাছে তোমার চিঠি বারবার পড়েছি। বারবার পড়বার মতোই। কবির চিঠির মধ্যে যে দুঃখবোধ এবং নৈঃসঙ্গ্যবোধ থাকে, তার সবরকম চিৎকার হঠাৎ আমাকেও একা- সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এই একাকিত্বের দরকার ছিলো আমারও। আমি অনেকদিন এরকম সুন্দরভাবে একা হতে পারিনি। বার্লিন থেকে ফেরার পর আমি এই একাকিত্বই বিভিন্ন জনের সান্নিধ্যে খুঁজতে চেষ্টা করেছি। যার জন্য আমি এক রমণীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, এখন সেই শ্রীমতীও আমাকে আর একাকিত্ব দিতে পারেন না। হতে পারে এই একাকিত্ব কেবল তুমিই আমাকে একবার অনেকদিন ধরে দিয়েছিলে। তুমি কি ভুলেই গেলে সেইসব দিনের কথা যখন শীতের কুয়াশায় মধ্যরাত্রির বাতাসকে আমরা সাক্ষী রেখে ঢাকা শহরের অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। আমরা তখন কি সুখী ছিলাম না? সেই সুখের কারণেই কি তুমি আবার ফিরে আসতে পারো না? যতোই ভালোবাসার পিছনে ধাবমান আমাদের ছায়া এর ওর সঙ্গে ঘুরুক, তুমিও জানো আর আমিও জানি- একসময় আমরাই আমাদের প্রেমিক ছিলাম। আর একমাত্র পুরুষ এবং আর একজন পুরুষই ভালোবাসার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে-, কারণ রমণীরা অতি নশ্বর। কিন্তু সেই নশ্বরতার বেদনাবোধ কেবল কবি-পুরুষরাই একমাত্র গ্রহণ করতে পারে। সেই নশ্বরতার অঙ্গীকারে আমরা আমাদের বেঁধেছিলুম একদিন। এখনও সেই বোধ, সেই ভালোবাসা আমার জীবনের একমাত্র স্মৃতি, জানি না তোমার ক্ষেত্রে তার স্পর্শ আর কতদূর মূল্যবান।

ভালোবাসা নিও। ভালো থেকো এবং ফিরে এসো।

ইতি।

চিরশুভাকাক্সক্ষী হাসান।

[সচিত্র সন্ধানী : ১ম বর্ষ ৩১ সংখ্যা, রবিবার ২৬ নভেম্বর ১৯৭৮]

আমি খুবই শক্ত মনের মানুষ। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম। কাঁদিনি। বড় ভাই যখন ভারতে চলে যায়, তখনও আমার কান্না আসেনি। আমি সহজে কাঁদি না। একেবারে কাঁদিই না বলা যায়। কিন্তু হাসানের চিঠি পড়ে আমার প্রায় কান্না চলে আসে। আমি মনে মনে কাঁদি।

হাসানের চিঠিটি আমার হস্তগত হয়েছিল ১৫ অক্টোবর, ১৯৭৫ তারিখে। এর রচনা তারিখ ১২ অক্টোবর রাত। আমাকে অভিমানমুক্ত করার জন্য, চিঠির অন্তিম পঙ্ক্তি ‘এবং ফিরে এসো’ কথাটাকে কী প্রবল ভালোবাসার আর্তি দিয়েই না কাঁচের ওয়েট পেপারের ভিতরের রঙিন ফুলের মতো করে সাজিয়েছে হাসান। ওর চিঠি পড়ে মানতেই হলো, আমি হাসানকে যতটা ভালোবেসেছি, হাসান আমাকে তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। না হলে এমন চিঠি কখনও বানিয়ে লেখা যায় না।

দিনের পর দিন যেতে থাকে। হাসানের অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। তার অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকেই ধাবিতে হতে থাকে। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো ক্রমশ নিভে আসা হাসানের জীবনপ্রদীপের তেলহীন সলতেটিকে উসকে দিয়ে তার মধ্যে আলো ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টায় দিন গুনতে থাকি।

নভেম্বরের ৪ তারিখ হাসান ভর্তি হয়েছিল পিজিতে। ক্রমাগত বাইশ দিন বক্ষব্যাধির (Enlarged Heart) সঙ্গে সংগ্রাম করার পর আসে ২৬ নভেম্বর-এর ভোর। শীতের কুয়াশামাখা ভোর হাসানের প্রিয় ছিল। মৃত্যুর জন্য কোন সময়টা ভালো- এই নিয়ে একদিন আমার সঙ্গে হাসানের কথা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, মৃত্যুর জন্য কোনো সময়ই ভালো নয়। হাসান বলেছিল, এটা হচ্ছে তোমার গায়ের জোরের কথা। একটা সময় তো বেছে নিতেই হবে। হাসান বলেছিল, আমার ভালো লাগে ভোরের দিকটা। শীতের সময়। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে যখন তাকতাম, খুব সকালে উঠতাম ঘুম থেকে, শীতের শেফালি কুড়াবার জন্য। মসজিদে তখন আজান দিত মোয়াজ্জিন। খুব ভালো লাগত। ওর ঐ কথাটাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো। প্রিয় সময়টাতেই শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো হাসান। ২৬ নভেম্বরের কুয়াশাঢাকা ভোরে, ঝরা শেফালির মতোই অভিমানী হাসান নশ্বর দেহকে পরিত্যাগ করে ওর অনশ্বর-অদৃশ্য আত্মায় তুলে নিলো অনন্তের পথ।

হাসান যখন জন্মভূমির এই মায়াময় মাটির পৃথক পালঙ্কে শয়ন করবে- তখন তার উদ্বাস্তু-উন্মুল যৌবনসঙ্গীটি যেন ঘটে-যাওয়া রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতার ঘটনায় অভিমান করে দূরে, গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে না থেকে ঢাকায় ফিরে এসে তার প্রিয় বন্ধুর অন্তিম পালঙ্ক নির্মাণে অংশ নিতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যই কি আবুল হাসান এই আবেগমথিত পত্রটি আমাকে লিখেছিল? ওর অজ্ঞাতসারে? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, হাসান জানত, এটিই হবে ওর শেষ চিঠি।

একবার হাসানের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথাও ভাবা হয়েছিল, কিন্তু পরে পরিবারের সদস্যরা, তাঁর অনুরাগী ভক্ত ও বন্ধুরা বনানী কবরস্থানেই তাঁকে কবর দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে নামাজে জানাজা পড়ার পর, আমরা বিকেলের দিকেই হাসানের মরদেহটিকে একটি পুষ্পশোভিত ট্রাকে তুলে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাই। তাঁর অন্তিম কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’-এর প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন আবুল হাসানের কবরের মাটি ক্রয় করার জন্য তিন হাজার টাকা প্রদান করেন।

আমরা জানতাম, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বরের শহীদরা বনানীর কবরে শায়িত আছেন। ইচ্ছা থাকলেও এতোদিন ঐ শহীদানদের কবর জিয়ারত করার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠেনি। সুযোগ থাকলেও সাহস হয়নি। আবুল হাসান আমাদের সেই সাহস বাড়িয়ে দিয়ে গেল। আবুল হাসানের কবরের জন্য একটি ভালো জায়গা খুঁজতে গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি, রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির পরিবারের সদস্যদের কবরের সামনে থমকে দাঁড়াই। ১৫ আগস্টের নিহতদের কবরের পরে ৩ নভেম্বর জেলে নিহত ৩ জাতীয় নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং তাজউদ্দীনের কবর। তিন নেতার কবর পেরুতেই চোখে পড়ল ৭ নভেম্বরে ‘সিপাহী বিপ্লবে’ নিহত খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বিশ্বস্ত সহযোগী (রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার) কর্নেল হুদার কবর। কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার কবরের পরে আর কারও কবর হয়নি। পাশের জায়গাটা ছিল খালি। কেন খালি ছিল, কে জানে? হয়তো ভয়ে। ভারতের চর হিসেবে কলঙ্কিত করে যারা খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সহযোগীকে হত্যা করেছিল, তারাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাতে, মনে হয় ৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়কের পাশের মাটিতে কেউ তার প্রিয়জনকে কবর দিতে সাহস পাচ্ছিল না, পাছে মৃতের জীবিতরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীদের কুনজরে পড়ে যায়। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নায়করা সত্যি-সত্যিই ভারতের চর ছিলো- ঐরূপ বিশ্বাস থেকেও এমনটি হতে পারে। কিন্তু আমার ঐরূপ ভয় ছিল না। আমি কখনও ঐরূপ অপপ্রচার বিশ্বাস করিনি। খালেদ মোশাররফ-হুদা-হায়দাররা ছিলেন সত্যিকারের বীর ও দেশপ্রেমিক। খালেদ মোশাররফের কবরটি ছিল বাননী কবরস্থান সংলগ্ন আর্মি গ্রেভইয়ার্ডের ভিতরে। কর্নেল হুদার পাশের জায়গাটা খালি পেয়ে আমার খুব ভালো লাগল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি হিসেবে কর্নেল হুদা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন বিশ্বস্ত ভক্ত ছিলেন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম খালেদের পাশেই আবুল হাসানের কবর হবে। সবাই আমার প্রস্তাব মেনে নিল। তখন বনানীর মাটি খুঁড়ে আমরা আবুল হাসানের জন্য একটি গভীর কবর খনন করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের বীর-শহীদদের পাশে নির্মিত হলো ২৬ নভেম্বরের অকালপ্রয়াত এক অভিমানী কবির কবর। জীবদ্দশায় চঞ্চল জীবন যাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলো, নিশ্চল মৃত্যু কী চমৎকারভাবেই না একই মালার ফুলের মতো করে পাশাপাশি গেঁথে দিয়ে গেল তাঁদের।

কবি আবুল হাসানের মরদেহকে মাটির গভীরে প্রোথিত করে, আমরা যখন নগরীর দিকে ফিরছি, তখন আমার বক্ষচাপা-ক্রন্দন উদিত দীর্ঘশ্বাসের মতো মুক্ত হলো একটি ছোট্ট-পঙ্ক্তিতে : ‘ভালোবেসে যাকে ছুঁই সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে...’।

কিছুদিন পর আবুল হাসানকে নিয়ে আমি যে এলিজিটি লিখি, ঐটি তার অন্তিম চরণে পরিণত হয়।

বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১ , ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৩

আবুল হাসান ও বন্ধু আমার

নির্মলেন্দু গুণ

image

আমি জানতাম, আবুল হাসান ছিল ওর মা এবং ওর বোনদের প্রতি খুবই দুর্বল। বিশেষ করে বুড়ির প্রতি ওর খুবই দুর্বলতা ছিল। পারিবারিক কথা উঠলে হাসান ওর মা এবং বোনদের কথাই বেশি বলতো, বাবা বা ভাইদের কথা সে খুব একটা বলতো না। ওর শয্যাপাশে গ্রাম থেকে আসা বোন বুড়ি এবং মা সর্বদাই উপস্থিত থাকতো। হাসানের কাছ হাসানের আম্মা জানতো যে, হাসান অনেকবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে। কিন্তু আমি ওদের বাড়িতে কখনও যাইনি। হাসানও নিজের বাড়িতে খুব একটা যেতো না। সুস্থ থাকার সময়ও হাসান আমার চাইতে কমই গ্রামের বাড়িতে যেতো। বার্লিন থেকে ফিরে আসার পর হাসান একবারও গ্রামের বাড়িতে যায়নি। আমি ওকে গ্রামের বাড়িতে যাবার কথা বললে হাসান বলতো যাবো... আরও একটু ভালো হয়ে নিই, পরে যাবো। আমার এখন বড়-ডাক্তারদের কাছাকাছি থাকা দরকার। দীর্ঘদিন হাসান গ্রামের বাড়িতে না যাওয়ার কারণে বুড়ি এবং খালাম্মা আমার কাছে অভিযোগ করলেন। বললেন, এবার হাসান ভালো হয়ে গেলে তুমিও হাসানের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি বললাম, নিশ্চয়ই যাবো।

বুড়ির মাথায় ও হাসানের পায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমি হাসপাতাল থেকে চলে আসি। হাসানের পায়ে হাত বোলাতে গিয়ে লক্ষ্য করি, তার পা বেশ ফুলে উঠেছে। তার মানে জল এসেছে হাসানের পায়ে। এটা খুবই খারাপ লক্ষণ। আমি খুব চিন্তিত বোধ করি।

মহাদেব ও আবুল হাসান আমাকে যৌথভাবে যে চিঠি দুটো লিখেছিল আমি ঐ চিঠি সঙ্গেই রাখতাম। আগেই জানিয়েছি, ভারত এবং আমেরিকান কানেকশন ছিল বলে আমার বড় ভাই ও বন্ধু পূরবীর চিঠি দুটো আমি ভয় পেয়ে পুলিশ কন্ট্রোলরুমের বাথরুমে ঢুকে ছিঁড়ে ফেলে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আবুল হাসান ও মহাদেবের চিঠির খামটি আমার পকেটেই ছিল। রমনা হাজতে যখন ছিলাম, যখন আমার ঘুম আসতো না, তখন সময় কাটাবার জন্য ঐ চিঠি দুটো আমি পড়তাম। বারবার পড়তাম। ভালো লাগতো। হাজতিদের কেউ কেউ ভাবতো আমি বুঝি আমার কোনো প্রেমিকার চিঠি পড়ছি। আসলে ঐ চিঠি দুটোকে আমি প্রেমপত্ররূপেই জ্ঞান করতাম। বন্ধুর উদ্বেগ ও ভালোবাসামাখা ঐ চিঠি দুটো আমাকে জীবনের বিষাদদীর্ণ মুহূর্তে আনন্দ দিত, বাঁচবার সাহস যোগাত।

উন্নতির পরিবর্তে হাসানের অবস্থা যখন ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল, তখন আমার কাছে হাসানের চিঠিটির গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। আমি গভীর রাত্রে আবার হাসানের চিঠিটি খুলে পড়তে বসি। কী বলতে চেয়েছে হাসান চিঠিতে? আমার মতো একজন সামান্য বন্ধুর চিঠি না পাওয়ার জন্য এতো অভিমান হয়েছিল কেন হাসানের? নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকল আমার।

অন্য অনেককে লিখলেও, হাসান বার্লিন থেকে আমাকে চিঠি লেখেনি। ১৫ আগস্টের পর, ঐরূপ একটি নৃশংসতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমি যখন মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত, তখন একদিন দুপুরের দিকে আমি আর মোস্তফা মীর হাইকোর্ট মাজার থেকে সিদ্ধি সেবন করে নয়া পল্টনের মেসের দিকে ফিরছিলাম। সুরাইয়ার সঙ্গে একই রিকশায় করে তখন হাসান যাচ্ছিল হাইকোর্টের সামনে দিয়ে। আমি হাসানকে দেখে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে হাত উঠাই। হাসান, স্পষ্টই বুঝতে পারি, সুরাইয়ার নির্দেশে তখন চকিতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রিকশাটি আমাদের পাশ দিয়েই প্রেসক্লাবের দিকে চলে যায়। থামে না। আমি খুব কষ্ট পাই হাসানের ঐরূপ আচরণে। তার দু’একদিন পরই আমি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই অনির্দিষ্টকালের জন্য।

মহাদেব ওর বাবার শ্রাদ্ধাক্রিয়াদি সম্পন্ন করার জন্য তখন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। মহাদেব নেই, হাসানও আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিজেকে খুবই নির্বান্ধব বলে মনে হলো। আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ঐ অভিমানের কারণেই আমি গ্রাম থেকে ইচ্ছে করেই হাসানকে কোনো চিঠি লিখিনি। আমি চেয়েছিলাম, ওর চিঠি না পাওয়ার কষ্ট আমি যেমন ভোগ করেছি, ওর উপেক্ষা যেমন আমাকে কষ্ট দিয়েছে; আমার উপেক্ষা, আমার চিঠি না পাওয়ার কষ্টও তেমনি হাসান অনুভব করুক।

চিঠি না লিখে আমি যতটা আঘাত করতে চেয়েছিলাম হাসানকে, হাসানের চিঠি পড়ে মনে হলো সে তার

চেয়ে অনেক বেশি আঘাত পেয়েছে। প্রিয়জনের দেয়া আঘাতকে বড় করে গ্রহণ করার ক্ষমতা, আমার তুলনায় হাসানের যে বেশি ছিল, ওর চিঠি থেকে তাই প্রমাণিত হয়। একটি নরম কোমল বন্ধুবৎসল কবিচত্তকে আহত করার জন্য আমি মনে মনে কষ্ট পেতে থাকি। মহাদেবের চিঠিটিও ছিল খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ। কিন্তু পার্থক্য এই যে, মহাদেবের চিঠিটি নিয়ে আমার মনের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। কিন্তু হাসানের চিঠিটি আমার মনের মধ্যে এক ধরনের ‘গিল্টি ফিলিং’ তৈরি করেছিল।

আমি হাসানের চিঠিটি ভালো করে আবার পড়তে শুরু করি।

আবুল হাসান

মহাদেবের বাসা থেকে

প্রিয় গুণ

আজ রাত্রে মহাদেবের সঙ্গে আল মাহমুদের এক তুমুল বাকবিতণ্ডার পর, মহাদেবের বাসায় এসে দেখি তোমার একটি অভিমানী চিঠি মহাদেবের কাছে যা তুমি লিখেছ। চিঠিটা বারবার পড়লুম। অনেকেদিন পর তোমার সান্নিধ্য চিঠির মাধ্যমে পেয়ে একদিকে যেমন ভালো লাগল, অন্যদিকে তেমন আহত হলুম, এই ভেবে যে, তুমি আমার ঠিকানা জানা সত্ত্বেও একটা চিঠিও আমাকে লেখোনি। জানি না কী কারণ; তবে চিঠি না পেলেও তোমার সম্পর্কে অনবরত এরওর কাছ থেকে খবর নিতে চেষ্টা করেছি, মাঝে মাঝে তোমার অনুপস্থিতির নৈঃসঙ্গের তাড়নায়ই হয়তোবা। এছাড়া এর পেছনে আর কোনো মানবিক কারণ নেই। একসময় ছিল, যখন তুমি আমাকে হলুদ পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতে তখন তুমি বাইরে থাকলেও মনে হতো তোমার উপস্থিতি উজ্জ্বলভাবে বর্তমান।

আমি মানুষ হিসেবে কতটুকু সৎ এবং শুভবুদ্ধির সেটা বিচারসাপেক্ষ, তবে বন্ধু হিসেবে একসময় তো আমরা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলাম। আমাদের জীবনযাপন সূত্রগুলি একে একে পরে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হলেও সেই প্রবল প্রোচ্ছন্ন দিনগুলির কি কোনো কিছুই আর আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই যা তোমার স্মৃতিকে একবারও নাড়া দিতে পারে? বা পারত? এবং সেই স্মৃতির সুবাদে একটা চিঠি কি আমিও পেতে পারতুম না? মানি, আমার নিজের কিছু কিছু এককেন্দ্রিক দোষত্রুটি এবং মানবিক দুর্বলতা শেষ কালে আমাদের দু’জনকে দু’দিকে সরিয়ে দিয়েছিল- প্রথমদিকে আমি যা ভালোবাসতাম না সেইগুলি তোমার ভালোবাসার জিনিস ছিলো- পরে যখন তুমি সেই মদ নারী গাঁজা চরস পরিত্যাগ করলে এবং সেই সময় যখন আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী হওয়ার সময়, কেন জানি না এক অনির্দিষ্ট অদৃষ্টের তাড়নায় আমরা দু’জন পরস্পরে কাছ থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়তোবা আমার দুরারোগ্য ব্যাধির তাড়না।

বার্লিন থেকে আসার পর আমি অন্য মানুষ। ফলে পুরনো যোগসূত্র সংস্থাপনের চেষ্টা করেছি যতবার, ততবার দেখেছি আমার শরীর আমার বৈরী। তুমি যা ভালোবাসো, সেইসব আমার শরীর ভালোবাসে না, তবে অসুস্থতার কারণেই। কিন্তু সত্তায় আমাদের যে গভীর সম্পর্কের সূত্র, কবির সঙ্গে কবির সেই সম্পর্ককে তো আমি কোনোদিন ম্লান করিনি।

১৫ আগস্টের পর; তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে- কিন্তু পরে একদিন হঠাৎ জানলাম তুমি আর ঢাকায় নেই। তোমার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায় দুঃখ পেয়েছিলাম; নৈঃসঙ্গ্যও কম বাজেনি। কিন্তু পরে আবার ভেবেছি, যেভাবে তুমি মাঝে মাঝে বাড়ি যাও, সেভাবেই হয়তো গিয়েছো পরে আবার কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসবে। কিন্তু পরে জানতে পারলুম, তুমি গিয়েছো অনেকদিনের জন্য। বাড়ি গিয়ে তুমি বিভিন্নজনের কাছে চিঠি লিখেছ, সেইসব চিঠিতেই এইসব জানতে পেয়েছি। আমিও অপেক্ষায় ছিলুম, একটা চিঠি পাবো, কিন্তু সবসময় অপেক্ষা যে ফলপ্রসূ হবে, এটার তো কোনো কথা নেই।

মহাদেবের কাছে তোমার চিঠি বারবার পড়েছি। বারবার পড়বার মতোই। কবির চিঠির মধ্যে যে দুঃখবোধ এবং নৈঃসঙ্গ্যবোধ থাকে, তার সবরকম চিৎকার হঠাৎ আমাকেও একা- সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এই একাকিত্বের দরকার ছিলো আমারও। আমি অনেকদিন এরকম সুন্দরভাবে একা হতে পারিনি। বার্লিন থেকে ফেরার পর আমি এই একাকিত্বই বিভিন্ন জনের সান্নিধ্যে খুঁজতে চেষ্টা করেছি। যার জন্য আমি এক রমণীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, এখন সেই শ্রীমতীও আমাকে আর একাকিত্ব দিতে পারেন না। হতে পারে এই একাকিত্ব কেবল তুমিই আমাকে একবার অনেকদিন ধরে দিয়েছিলে। তুমি কি ভুলেই গেলে সেইসব দিনের কথা যখন শীতের কুয়াশায় মধ্যরাত্রির বাতাসকে আমরা সাক্ষী রেখে ঢাকা শহরের অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। আমরা তখন কি সুখী ছিলাম না? সেই সুখের কারণেই কি তুমি আবার ফিরে আসতে পারো না? যতোই ভালোবাসার পিছনে ধাবমান আমাদের ছায়া এর ওর সঙ্গে ঘুরুক, তুমিও জানো আর আমিও জানি- একসময় আমরাই আমাদের প্রেমিক ছিলাম। আর একমাত্র পুরুষ এবং আর একজন পুরুষই ভালোবাসার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে-, কারণ রমণীরা অতি নশ্বর। কিন্তু সেই নশ্বরতার বেদনাবোধ কেবল কবি-পুরুষরাই একমাত্র গ্রহণ করতে পারে। সেই নশ্বরতার অঙ্গীকারে আমরা আমাদের বেঁধেছিলুম একদিন। এখনও সেই বোধ, সেই ভালোবাসা আমার জীবনের একমাত্র স্মৃতি, জানি না তোমার ক্ষেত্রে তার স্পর্শ আর কতদূর মূল্যবান।

ভালোবাসা নিও। ভালো থেকো এবং ফিরে এসো।

ইতি।

চিরশুভাকাক্সক্ষী হাসান।

[সচিত্র সন্ধানী : ১ম বর্ষ ৩১ সংখ্যা, রবিবার ২৬ নভেম্বর ১৯৭৮]

আমি খুবই শক্ত মনের মানুষ। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম। কাঁদিনি। বড় ভাই যখন ভারতে চলে যায়, তখনও আমার কান্না আসেনি। আমি সহজে কাঁদি না। একেবারে কাঁদিই না বলা যায়। কিন্তু হাসানের চিঠি পড়ে আমার প্রায় কান্না চলে আসে। আমি মনে মনে কাঁদি।

হাসানের চিঠিটি আমার হস্তগত হয়েছিল ১৫ অক্টোবর, ১৯৭৫ তারিখে। এর রচনা তারিখ ১২ অক্টোবর রাত। আমাকে অভিমানমুক্ত করার জন্য, চিঠির অন্তিম পঙ্ক্তি ‘এবং ফিরে এসো’ কথাটাকে কী প্রবল ভালোবাসার আর্তি দিয়েই না কাঁচের ওয়েট পেপারের ভিতরের রঙিন ফুলের মতো করে সাজিয়েছে হাসান। ওর চিঠি পড়ে মানতেই হলো, আমি হাসানকে যতটা ভালোবেসেছি, হাসান আমাকে তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছে। না হলে এমন চিঠি কখনও বানিয়ে লেখা যায় না।

দিনের পর দিন যেতে থাকে। হাসানের অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। তার অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকেই ধাবিতে হতে থাকে। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো ক্রমশ নিভে আসা হাসানের জীবনপ্রদীপের তেলহীন সলতেটিকে উসকে দিয়ে তার মধ্যে আলো ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টায় দিন গুনতে থাকি।

নভেম্বরের ৪ তারিখ হাসান ভর্তি হয়েছিল পিজিতে। ক্রমাগত বাইশ দিন বক্ষব্যাধির (Enlarged Heart) সঙ্গে সংগ্রাম করার পর আসে ২৬ নভেম্বর-এর ভোর। শীতের কুয়াশামাখা ভোর হাসানের প্রিয় ছিল। মৃত্যুর জন্য কোন সময়টা ভালো- এই নিয়ে একদিন আমার সঙ্গে হাসানের কথা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, মৃত্যুর জন্য কোনো সময়ই ভালো নয়। হাসান বলেছিল, এটা হচ্ছে তোমার গায়ের জোরের কথা। একটা সময় তো বেছে নিতেই হবে। হাসান বলেছিল, আমার ভালো লাগে ভোরের দিকটা। শীতের সময়। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে যখন তাকতাম, খুব সকালে উঠতাম ঘুম থেকে, শীতের শেফালি কুড়াবার জন্য। মসজিদে তখন আজান দিত মোয়াজ্জিন। খুব ভালো লাগত। ওর ঐ কথাটাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো। প্রিয় সময়টাতেই শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো হাসান। ২৬ নভেম্বরের কুয়াশাঢাকা ভোরে, ঝরা শেফালির মতোই অভিমানী হাসান নশ্বর দেহকে পরিত্যাগ করে ওর অনশ্বর-অদৃশ্য আত্মায় তুলে নিলো অনন্তের পথ।

হাসান যখন জন্মভূমির এই মায়াময় মাটির পৃথক পালঙ্কে শয়ন করবে- তখন তার উদ্বাস্তু-উন্মুল যৌবনসঙ্গীটি যেন ঘটে-যাওয়া রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতার ঘটনায় অভিমান করে দূরে, গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে না থেকে ঢাকায় ফিরে এসে তার প্রিয় বন্ধুর অন্তিম পালঙ্ক নির্মাণে অংশ নিতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যই কি আবুল হাসান এই আবেগমথিত পত্রটি আমাকে লিখেছিল? ওর অজ্ঞাতসারে? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, হাসান জানত, এটিই হবে ওর শেষ চিঠি।

একবার হাসানের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথাও ভাবা হয়েছিল, কিন্তু পরে পরিবারের সদস্যরা, তাঁর অনুরাগী ভক্ত ও বন্ধুরা বনানী কবরস্থানেই তাঁকে কবর দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে নামাজে জানাজা পড়ার পর, আমরা বিকেলের দিকেই হাসানের মরদেহটিকে একটি পুষ্পশোভিত ট্রাকে তুলে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাই। তাঁর অন্তিম কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’-এর প্রকাশক গাজী শাহাবুদ্দিন আবুল হাসানের কবরের মাটি ক্রয় করার জন্য তিন হাজার টাকা প্রদান করেন।

আমরা জানতাম, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বরের শহীদরা বনানীর কবরে শায়িত আছেন। ইচ্ছা থাকলেও এতোদিন ঐ শহীদানদের কবর জিয়ারত করার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠেনি। সুযোগ থাকলেও সাহস হয়নি। আবুল হাসান আমাদের সেই সাহস বাড়িয়ে দিয়ে গেল। আবুল হাসানের কবরের জন্য একটি ভালো জায়গা খুঁজতে গিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি, রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির পরিবারের সদস্যদের কবরের সামনে থমকে দাঁড়াই। ১৫ আগস্টের নিহতদের কবরের পরে ৩ নভেম্বর জেলে নিহত ৩ জাতীয় নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং তাজউদ্দীনের কবর। তিন নেতার কবর পেরুতেই চোখে পড়ল ৭ নভেম্বরে ‘সিপাহী বিপ্লবে’ নিহত খালেদ মোশাররফের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বিশ্বস্ত সহযোগী (রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার) কর্নেল হুদার কবর। কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার কবরের পরে আর কারও কবর হয়নি। পাশের জায়গাটা ছিল খালি। কেন খালি ছিল, কে জানে? হয়তো ভয়ে। ভারতের চর হিসেবে কলঙ্কিত করে যারা খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সহযোগীকে হত্যা করেছিল, তারাই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাতে, মনে হয় ৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়কের পাশের মাটিতে কেউ তার প্রিয়জনকে কবর দিতে সাহস পাচ্ছিল না, পাছে মৃতের জীবিতরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীদের কুনজরে পড়ে যায়। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নায়করা সত্যি-সত্যিই ভারতের চর ছিলো- ঐরূপ বিশ্বাস থেকেও এমনটি হতে পারে। কিন্তু আমার ঐরূপ ভয় ছিল না। আমি কখনও ঐরূপ অপপ্রচার বিশ্বাস করিনি। খালেদ মোশাররফ-হুদা-হায়দাররা ছিলেন সত্যিকারের বীর ও দেশপ্রেমিক। খালেদ মোশাররফের কবরটি ছিল বাননী কবরস্থান সংলগ্ন আর্মি গ্রেভইয়ার্ডের ভিতরে। কর্নেল হুদার পাশের জায়গাটা খালি পেয়ে আমার খুব ভালো লাগল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি হিসেবে কর্নেল হুদা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন বিশ্বস্ত ভক্ত ছিলেন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম খালেদের পাশেই আবুল হাসানের কবর হবে। সবাই আমার প্রস্তাব মেনে নিল। তখন বনানীর মাটি খুঁড়ে আমরা আবুল হাসানের জন্য একটি গভীর কবর খনন করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের বীর-শহীদদের পাশে নির্মিত হলো ২৬ নভেম্বরের অকালপ্রয়াত এক অভিমানী কবির কবর। জীবদ্দশায় চঞ্চল জীবন যাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলো, নিশ্চল মৃত্যু কী চমৎকারভাবেই না একই মালার ফুলের মতো করে পাশাপাশি গেঁথে দিয়ে গেল তাঁদের।

কবি আবুল হাসানের মরদেহকে মাটির গভীরে প্রোথিত করে, আমরা যখন নগরীর দিকে ফিরছি, তখন আমার বক্ষচাপা-ক্রন্দন উদিত দীর্ঘশ্বাসের মতো মুক্ত হলো একটি ছোট্ট-পঙ্ক্তিতে : ‘ভালোবেসে যাকে ছুঁই সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে...’।

কিছুদিন পর আবুল হাসানকে নিয়ে আমি যে এলিজিটি লিখি, ঐটি তার অন্তিম চরণে পরিণত হয়।