পঞ্চাশের পাওয়া না-পাওয়া

মীজানুর রহমান

পরিসংখ্যানই আপাতত সত্য। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি নাকি বলেছিলেন, ‘মিথ্যা তিন প্রকার: মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান। স্বাধীনতার পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের তো বটেই এমনকি ভারতের চেয়েও মাথাপিছু আয়ে আমরা এগিয়ে। নতুন পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ ডলার। ২০২০-২১ সালে অর্থনীতির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। তবে আমাদের সম্পদ, আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন যে হারে হয়েছে, আমাদের বৈষম্য, দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা, অধিকারহীনতা, পরিবেশ দূষণ এবং বঞ্চনা সে হারে কমেনি বরং আয় উন্নতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বেড়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা গত ৫০ বছরে অনেক কমে আসলেও সব নাগরিকের জীবনে মৌলিক চাহিদা এখনও নিশ্চিত হয়নি। পুষ্টিকর খাবার ও সুপেয় পানি দূরে থাক ন্যূনতম খাবার ও পানির সুবিধাও পাচ্ছে না অনেক নাগরিক। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও এর ফাঁকফোকরগুলো দেখা গেছে গত বছর করোনা দুর্যোগের সময়। বাংলাদেশের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার যতটুকু আছে সেটা শুধু ধনীদের জন্য, সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে।

এখনো দেশের আনাচে-কানাচে বহু মানুষ আধপেটে বা একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকে। আমাদের উত্তরবঙ্গের মঙ্গার অবস্থা এখন আর নেই, কিন্তু তারপরেও মানুষের দুরবস্থা এখনো পুরোপুরি ঘোচেনি, যা কিছু রাষ্ট্রের আয়োজন তার ৮০% ভোগ করছে শহুরে ধনীরা। গ্রামের মানুষ এখনও বঞ্চিত অনেক কিছু থেকে। তাই হয়তো সরকার শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু শহুরে সুবিধাভোগীরা তা কতটা বাস্তবায়ন করবে এ নিয়ে সন্দেহ আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই দেখা গেছে, যে গ্রামের মানুষ শহরের মানুষকে একাত্তরের যুদ্ধের সময় আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল তারাই যখন ১৯৭৪ সালে খাবার না পেয়ে শহরে এলো তাদের আমরা খাবার দেইনি। অনেকেই দুর্ভিক্ষে মারা গেল। যদিও শহরের বাড়িতে এবং দোকানগুলোতে প্রচুর খাবার মজুত ছিল’। ২০২০ সালে করোনার সংকটের সময় দেখা গেল শহরে কাজ হারিয়ে অনেকেই তাদের গ্রামের শেকড়ে ফিরে যাচ্ছেন নিরাপত্তার’ খোঁজে। গ্রাম এবং কৃষিকে অগ্রাহ্য করে এদেশের কোন অর্জনে টেকসই হবে না।

অবকাঠামোগত (ইনপুট) উন্নয়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতা যত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ফলাফল (আউটপুট) বিশ্লেষণ ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের পরেও আমাদের যাতায়াতের গতি বাড়ছে না। ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের পরেও অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের গতি বাড়বে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। সরকারি অর্থায়নে মডেল মসজিদ নির্মাণ করেও প্রকৃত নামাজীর সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। উন্নয়ন এবং স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে গিয়ে আমরা পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছি। পৃথিবীটাকে শুধু আমাদের করতে গিয়ে অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ এবং প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছি। চলমান করোনা সংকটের উৎপত্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলতেই পারে। তবে আমার ধারণা এটাও পরিবেশ বিপর্যয়ের একটা ফল।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী এলাকায় মানুষ হাতির উপদ্রবে ঘুমোতে পারছে না। রাত জেগে ফসল পাহারা দিচ্ছে। গত এক দশকে কমপক্ষে ৭০ জন কৃষক হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জাতিসংঘের অর্থায়নে বৈদ্যুতিক বেড়া দিয়েও হাতিকে ঠেকানো যাচ্ছে না। যেখানে ছিল হাতির আবাস সেখানে মানুষ বসতি গড়েছে বলেই এমনটি হয়েছে। হাতির আবাসে মানুষ ফসল চাষ করেছে তার নিজের খাবারের জন্য, তাই কৃষকের ফসলের ওপর হাতির আক্রমণ। তাছাড়া জেনেটিক কারণেও এই হাতির আগমন রোধ করা যাবে না।

অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক নৈতিকতা ধ্বংসের মুখোমুখি। ব্যাংক বাংলাদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, অথচ বর্তমানে এদেশেই এ খাতে সবচেয়ে বেশি অরাজকতা চলছে। আজ থেকে ১০৭ বছর আগে ১৯১৪ সালে ‘কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ দেশেরই ব্যবসায়ী কুমিল্লার কৃতী সন্তান নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, যে ব্যাংকের শাখা ছিল দিল্লি, লখনৌ, কানপুর, মুম্বাই থেকে শুরু করে সুদূর লন্ডন পর্যন্ত। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা অসাধারণ ঐতিহ্যবাহী এই বাংলাদেশের অসংখ্য ব্যাংক আজ কুণ্ডঋণে জর্জরিত। সঙ্গবদ্ধ প্রতারক গোষ্ঠী এবং উইগির দল কোন কোন ব্যাংকের প্রায় সব টাকাই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকায়, আর সরকারি ব্যাংক চলছে সরকারের মূলধনের ভর্তুকি নিয়ে।

প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, বিশেষ করে ‘আইসিটি’ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, তবে এর ফলে যে ‘cyber poverty gap’ তৈরি হয়েছে তা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইউনেস্কোর ৪১তম অধিবেশনে তুলে ধরেছেন। ইউনেস্কোর মতে স্কুল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্যারিসের ইউনেস্কো সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতায় এই বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা যায়নি বিধায় দূর শিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নতুন বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এ থেকে বাদ যায়নি।

শিক্ষার হার ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু সে হারে কমছে না সমাজের কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতা। কিছুতেই সমাজের অন্ধকার দূর হচ্ছে না বরং আরও ঘনীভূত হচ্ছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নেও কাজ হচ্ছে না। অনেকে বলেন এদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে ধর্মভীরুরা যদি বিজ্ঞানমনস্ক না হয়, শিক্ষিত না হয় তাহলে সে ধর্মান্ধ হতে বাধ্য। বিজ্ঞানের পড়াশোনা বেড়েছে, অনেকগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছি, কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে না।

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে। এই ব্যবস্থাটা কীভাবে আবার দাঁড়াবে এ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আমি আরও গোড়ায় যেতে চাই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে জনপ্রতিনিধিত্ব তৈরি হয় তাদের কয়জন আসলে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ লোকের কাছেই জনপ্রতিনিধিত্ব এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেকে বলেন আমাদের রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে, কিন্তু ব্যবসায় না করেও যারা রাজনীতিতে জড়িয়েছেন তাদের কয়জন জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরে ব্যবসায়ী হননি বা পরিবারের সদস্যদের ব্যবসায়ী বানাননি? সেবা করতে করতে আগের চেয়ে আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে এমন কয়জন জনপ্রতিনিধি আছেন? প্রত্যেকেই মনে করে অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো জনপ্রতিনিধিত্ব একটি লোভনীয় ব্যবসায়। লোভীরা সেখানে ভিড় করছে। জনপ্রতিনিধিত্ব সামাজিক পুঁজির (social capital) বদলে এখন আর্থিক পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। একসময় জনপ্রতিনিধিত্বের মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক পুঁজি। পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এখনও সামাজিক পুঁজিই জনপ্রতিনিধিত্বের মুখ্য বিষয়।

স্থানান্তরিত ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু সব সময়েই হয় নিরীহ ও দুর্বল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান (নারী, শিশু, সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়)। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিক ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো আমজনতার ক্রোধকে স্থানান্তরিত করে ওই সব দুর্বল জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। আক্রান্ত হয় মন্দির, পূজা মণ্ডপ এবং জেলেপাড়া। যদিও মানবিক মূল্যবোধের এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিক্রিয়া (বিলম্বিত) আমাকে আশাবাদী করে।

যারা দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ হিসাবে অবহিত করতে চান, তাদের জন্য রবার্ট কেগন, তার ‘Is Democracy in Decline’ বইয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র একটি নাজুক ফুল, সবসময় এর পরিচর্যা যত্ন-আত্তি লাগে। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। এই ফুল রক্ষা করতে বেড়া লাগে। ভেতর-বাইরের দুইদিকের বিপদ থেকেই একে বাঁচাতে হয়। বেড়া পাকাপোক্ত না হলে এবং আগাছা নিয়মিত সাফ করা না হলে জঙ্গল ও আগাছা ফিরে এসে তা ভূখণ্ড দখল করবেই’।

শাসন ব্যবস্থার কঠোরতা নেতৃত্বের গুণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন (নিকোলাস ম্যাকিয়াভ্যালি, ‘দ্য প্রিন্স’ -১৫১৫)। তবে বিরোধী মতকে কঠোর শাস্তি দিয়ে মোকাবিলা ব্যবস্থাপনার গুণ নয়। ‘রাজতন্ত্রেই কী আর শিক্ষাতন্ত্রেই কী, কঠোর শাসন-নীতি শাসয়িতারই অযোগ্যতার প্রমাণ’ (‘Antonio Giustozzi †hgbwU e‡j‡Qb, Ôthe greatest skill is to keep all of this together despite constant friction and constant argument’।

আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে ‘রাষ্ট্রের সুরে সুর না মেলালেই মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী হয় না, হয় না রাষ্ট্রের দুশমন বা সমাজের শত্রু’(লাস্কি, ১৮৩৯-১৯৫০)। ভিন্ন মত, ভিন্ন পথ থাকবেই; তারপরও সবাইকে নিয়ে পথ চলাই ‘এগিয়ে যাওয়া’।

(সংক্ষেপিত। পূর্ণাঙ্গ লেখাটি সংবাদ-এর অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়েছে)

[লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর ২০২১ , ১০ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৩

পঞ্চাশের পাওয়া না-পাওয়া

মীজানুর রহমান

পরিসংখ্যানই আপাতত সত্য। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি নাকি বলেছিলেন, ‘মিথ্যা তিন প্রকার: মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান। স্বাধীনতার পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের তো বটেই এমনকি ভারতের চেয়েও মাথাপিছু আয়ে আমরা এগিয়ে। নতুন পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ ডলার। ২০২০-২১ সালে অর্থনীতির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। তবে আমাদের সম্পদ, আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন যে হারে হয়েছে, আমাদের বৈষম্য, দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা, অধিকারহীনতা, পরিবেশ দূষণ এবং বঞ্চনা সে হারে কমেনি বরং আয় উন্নতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বেড়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা গত ৫০ বছরে অনেক কমে আসলেও সব নাগরিকের জীবনে মৌলিক চাহিদা এখনও নিশ্চিত হয়নি। পুষ্টিকর খাবার ও সুপেয় পানি দূরে থাক ন্যূনতম খাবার ও পানির সুবিধাও পাচ্ছে না অনেক নাগরিক। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও এর ফাঁকফোকরগুলো দেখা গেছে গত বছর করোনা দুর্যোগের সময়। বাংলাদেশের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার যতটুকু আছে সেটা শুধু ধনীদের জন্য, সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে।

এখনো দেশের আনাচে-কানাচে বহু মানুষ আধপেটে বা একবেলা খেয়ে বেঁচে থাকে। আমাদের উত্তরবঙ্গের মঙ্গার অবস্থা এখন আর নেই, কিন্তু তারপরেও মানুষের দুরবস্থা এখনো পুরোপুরি ঘোচেনি, যা কিছু রাষ্ট্রের আয়োজন তার ৮০% ভোগ করছে শহুরে ধনীরা। গ্রামের মানুষ এখনও বঞ্চিত অনেক কিছু থেকে। তাই হয়তো সরকার শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু শহুরে সুবিধাভোগীরা তা কতটা বাস্তবায়ন করবে এ নিয়ে সন্দেহ আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই দেখা গেছে, যে গ্রামের মানুষ শহরের মানুষকে একাত্তরের যুদ্ধের সময় আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিল তারাই যখন ১৯৭৪ সালে খাবার না পেয়ে শহরে এলো তাদের আমরা খাবার দেইনি। অনেকেই দুর্ভিক্ষে মারা গেল। যদিও শহরের বাড়িতে এবং দোকানগুলোতে প্রচুর খাবার মজুত ছিল’। ২০২০ সালে করোনার সংকটের সময় দেখা গেল শহরে কাজ হারিয়ে অনেকেই তাদের গ্রামের শেকড়ে ফিরে যাচ্ছেন নিরাপত্তার’ খোঁজে। গ্রাম এবং কৃষিকে অগ্রাহ্য করে এদেশের কোন অর্জনে টেকসই হবে না।

অবকাঠামোগত (ইনপুট) উন্নয়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতা যত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ফলাফল (আউটপুট) বিশ্লেষণ ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের পরেও আমাদের যাতায়াতের গতি বাড়ছে না। ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের পরেও অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের গতি বাড়বে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ আছে। সরকারি অর্থায়নে মডেল মসজিদ নির্মাণ করেও প্রকৃত নামাজীর সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। উন্নয়ন এবং স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে গিয়ে আমরা পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনছি। পৃথিবীটাকে শুধু আমাদের করতে গিয়ে অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ এবং প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে যাচ্ছি। চলমান করোনা সংকটের উৎপত্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলতেই পারে। তবে আমার ধারণা এটাও পরিবেশ বিপর্যয়ের একটা ফল।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী এলাকায় মানুষ হাতির উপদ্রবে ঘুমোতে পারছে না। রাত জেগে ফসল পাহারা দিচ্ছে। গত এক দশকে কমপক্ষে ৭০ জন কৃষক হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জাতিসংঘের অর্থায়নে বৈদ্যুতিক বেড়া দিয়েও হাতিকে ঠেকানো যাচ্ছে না। যেখানে ছিল হাতির আবাস সেখানে মানুষ বসতি গড়েছে বলেই এমনটি হয়েছে। হাতির আবাসে মানুষ ফসল চাষ করেছে তার নিজের খাবারের জন্য, তাই কৃষকের ফসলের ওপর হাতির আক্রমণ। তাছাড়া জেনেটিক কারণেও এই হাতির আগমন রোধ করা যাবে না।

অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক নৈতিকতা ধ্বংসের মুখোমুখি। ব্যাংক বাংলাদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, অথচ বর্তমানে এদেশেই এ খাতে সবচেয়ে বেশি অরাজকতা চলছে। আজ থেকে ১০৭ বছর আগে ১৯১৪ সালে ‘কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ দেশেরই ব্যবসায়ী কুমিল্লার কৃতী সন্তান নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, যে ব্যাংকের শাখা ছিল দিল্লি, লখনৌ, কানপুর, মুম্বাই থেকে শুরু করে সুদূর লন্ডন পর্যন্ত। ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা অসাধারণ ঐতিহ্যবাহী এই বাংলাদেশের অসংখ্য ব্যাংক আজ কুণ্ডঋণে জর্জরিত। সঙ্গবদ্ধ প্রতারক গোষ্ঠী এবং উইগির দল কোন কোন ব্যাংকের প্রায় সব টাকাই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকায়, আর সরকারি ব্যাংক চলছে সরকারের মূলধনের ভর্তুকি নিয়ে।

প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, বিশেষ করে ‘আইসিটি’ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, তবে এর ফলে যে ‘cyber poverty gap’ তৈরি হয়েছে তা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইউনেস্কোর ৪১তম অধিবেশনে তুলে ধরেছেন। ইউনেস্কোর মতে স্কুল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্যারিসের ইউনেস্কো সম্মেলনে বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতায় এই বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা যায়নি বিধায় দূর শিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নতুন বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এ থেকে বাদ যায়নি।

শিক্ষার হার ও শিক্ষায়তনের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু সে হারে কমছে না সমাজের কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতা। কিছুতেই সমাজের অন্ধকার দূর হচ্ছে না বরং আরও ঘনীভূত হচ্ছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নেও কাজ হচ্ছে না। অনেকে বলেন এদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে ধর্মভীরুরা যদি বিজ্ঞানমনস্ক না হয়, শিক্ষিত না হয় তাহলে সে ধর্মান্ধ হতে বাধ্য। বিজ্ঞানের পড়াশোনা বেড়েছে, অনেকগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছি, কিন্তু মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে না।

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে। এই ব্যবস্থাটা কীভাবে আবার দাঁড়াবে এ নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আমি আরও গোড়ায় যেতে চাই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে জনপ্রতিনিধিত্ব তৈরি হয় তাদের কয়জন আসলে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ লোকের কাছেই জনপ্রতিনিধিত্ব এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেকে বলেন আমাদের রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে, কিন্তু ব্যবসায় না করেও যারা রাজনীতিতে জড়িয়েছেন তাদের কয়জন জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরে ব্যবসায়ী হননি বা পরিবারের সদস্যদের ব্যবসায়ী বানাননি? সেবা করতে করতে আগের চেয়ে আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে এমন কয়জন জনপ্রতিনিধি আছেন? প্রত্যেকেই মনে করে অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো জনপ্রতিনিধিত্ব একটি লোভনীয় ব্যবসায়। লোভীরা সেখানে ভিড় করছে। জনপ্রতিনিধিত্ব সামাজিক পুঁজির (social capital) বদলে এখন আর্থিক পুঁজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। একসময় জনপ্রতিনিধিত্বের মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক পুঁজি। পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এখনও সামাজিক পুঁজিই জনপ্রতিনিধিত্বের মুখ্য বিষয়।

স্থানান্তরিত ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু সব সময়েই হয় নিরীহ ও দুর্বল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান (নারী, শিশু, সংখ্যালঘু এবং সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়)। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিক ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো আমজনতার ক্রোধকে স্থানান্তরিত করে ওই সব দুর্বল জায়গায় পাঠিয়ে দেয়। আক্রান্ত হয় মন্দির, পূজা মণ্ডপ এবং জেলেপাড়া। যদিও মানবিক মূল্যবোধের এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিক্রিয়া (বিলম্বিত) আমাকে আশাবাদী করে।

যারা দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ হিসাবে অবহিত করতে চান, তাদের জন্য রবার্ট কেগন, তার ‘Is Democracy in Decline’ বইয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র একটি নাজুক ফুল, সবসময় এর পরিচর্যা যত্ন-আত্তি লাগে। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। এই ফুল রক্ষা করতে বেড়া লাগে। ভেতর-বাইরের দুইদিকের বিপদ থেকেই একে বাঁচাতে হয়। বেড়া পাকাপোক্ত না হলে এবং আগাছা নিয়মিত সাফ করা না হলে জঙ্গল ও আগাছা ফিরে এসে তা ভূখণ্ড দখল করবেই’।

শাসন ব্যবস্থার কঠোরতা নেতৃত্বের গুণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন (নিকোলাস ম্যাকিয়াভ্যালি, ‘দ্য প্রিন্স’ -১৫১৫)। তবে বিরোধী মতকে কঠোর শাস্তি দিয়ে মোকাবিলা ব্যবস্থাপনার গুণ নয়। ‘রাজতন্ত্রেই কী আর শিক্ষাতন্ত্রেই কী, কঠোর শাসন-নীতি শাসয়িতারই অযোগ্যতার প্রমাণ’ (‘Antonio Giustozzi †hgbwU e‡j‡Qb, Ôthe greatest skill is to keep all of this together despite constant friction and constant argument’।

আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে ‘রাষ্ট্রের সুরে সুর না মেলালেই মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী হয় না, হয় না রাষ্ট্রের দুশমন বা সমাজের শত্রু’(লাস্কি, ১৮৩৯-১৯৫০)। ভিন্ন মত, ভিন্ন পথ থাকবেই; তারপরও সবাইকে নিয়ে পথ চলাই ‘এগিয়ে যাওয়া’।

(সংক্ষেপিত। পূর্ণাঙ্গ লেখাটি সংবাদ-এর অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়েছে)

[লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]