সেই রাতে যা ঘটেছিল

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর। ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার ফাহাদ রাব্বী। অন্য স্বাভাবিক দিনের মতই বিকেল গড়িয়ে নামে রাতের কালো অন্ধকার। অন্ধকার নেমে আসে আবরারের জীবনেও। ঘটনার একদিন আগে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে ফেসইবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার। ফেইসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ৬ অক্টোবর রাত ৮টায় শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে আবারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নেয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। সঙ্গে নেয়া হয় তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল।

২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়েই আবারারের কাছে ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির সমালোচনা করে স্ট্যাটাস’ দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। উত্তর দেয়ার আগেই শুরু হয় বেধড়ক পিটুনি। নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে বমি করে ফেলেন মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার। প্রশ্রাবও করে ফেলেন। পরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে এনে পোশাক বদলে আবারও মারধর করা হয় তাকে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলা আবরার ইঙ্গিতে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে বারবার মিনতি করলেও তাতে মন নরম হয়নি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। শেষ পর্যন্ত আবরারকে মেরে ফেলে মরদেহ হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখে তারা। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি জানাজানি হলে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠটি। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় বুয়েট শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলনের পর ওই শিক্ষায়তনে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড : আবরার হলের যে কক্ষে থাকতেন, ওই কক্ষ ও আশপাশে কক্ষগুলোর কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার। ওইদিন বিকেলের দিকে শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষে পৌঁছে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথাও বলেন।

শিক্ষার্থীরা জানান, বাড়ি থেকে ফিরে আবরার নিজের কক্ষেই পড়ালেখা করছিলেন। ৬ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আবরারের কক্ষে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের চার নেতা। সেখানে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করে নেতারা। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ। তারা আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেটি যাচাই করেন। এক পর্যায়ে আবরারকে তার ফেইসবুক আইডি খুলতে বলেন। পরে তারা তার ফেইসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে তাকে শিবিরের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। এর পরই ওই দুই নেতার সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন তাকে মারধর শুরু করেন। আবরারকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। ‘শিবির ধরা হয়েছে’- এমন খবর পেয়ে সেখানে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী আরও সাত থেকে আটজন নেতা জড়ো হন। তারাও সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যায় আবরারের দেহ। রাত ২টার পর তাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।

আবরার হত্যা মামলায় ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর আদালতে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন তার হলের ক্যান্টিন বয় জাহিদ হোসেন জনি। জবানবন্দিতে জনি বলেন, তাকে রাত ১টায় হল ক্যান্টিন থেকে (২০১১ নম্বর কক্ষে) ডেকে নিয়ে বমি করা বিছানার চাদর-বালিশ পরিষ্কার করানো হয়। বলে যে, সকালে আমাকে বকশিশ দেয়া হবে। এরপর রাত ৪টায় ঘুম থেকে জেগে ওই বিছানার চাদরে মোড়ানো আবরারের লাশ দেখতে পান জনি।

ঘটনার পর একজন শিক্ষার্থী জানান, ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছিল। তবে ঝামেলা এড়াতে তিনি ওই কক্ষে যাননি। কক্ষটিতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাসহ তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিল। তারাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সকালে বুঝতে পারেন, সেখানে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে।

অন্য দু’জন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, পেটাতে পেটাতে আবরারকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের নেতারা। তিনি তাতে রাজিও হন। এরপরও তাকে ছাড়া হয়নি; নৃশংস ও নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

হলের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা সে সময় দাবি করেন, প্রতি রাতেই শিক্ষার্থীরা নানা বিষয়ে কমবেশি হৈ-হুল্লোড় করেন। কিন্তু রোববার রাতে তিনি কোনো চিৎকার শোনেননি। বিষয়টি গভীর রাতে জানতে পারেন তিনি।

আবরারকে হত্যার ঘটনা জানাজানির পর হলজুড়েই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহত ওই ছাত্রের রুমমেট ও সহপাঠীরাও এ বিষয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবরারের কয়েকজন সহপাঠী জানান, হত্যার পর দীর্ঘক্ষণ আবরারের লাশটি ২০১১ নম্বর কক্ষেই পড়ে ছিল। রাত ২টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তার নিথর দেহ নামিয়ে আনেন। এক পর্যায়ে নিচতলা ও দোতলার মাঝখানের সিঁড়িতে তার লাশটি ফেলে রাখা হয়।

আবরার হত্যার ঘটনায় ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন মামলার পঞ্চম সাক্ষী বুয়েটের চিকিৎসক মাসুক এলাহী। ডা. মাসুক বলেন, রাত ২টা ৪৭ মিনিটে তাকে একজন ছাত্র খবর দিয়ে মেডিকেল সেন্টার থেকে অক্সিজেন নিয়ে যেতে বলে। তখন তিনি বলেন, তিনি আগে রোগী দেখবেন, তারপর সিদ্ধান্ত দেবেন। তখন আমাকে ছাত্ররা উত্তর ব্লকের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। এক এবং দুই তলার মাঝখানে আবরার ফাহাদকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। তার পরনে একটি চেক শার্ট আর কালো রংয়ের ট্রাউজার ছিল। তোশক এবং ট্রাউজার প্রশ্রাবে ভেজা ছিল।

তিনি বলেন, দেখেই আবরারকে মৃত মনে হয়েছিল। এরপর পরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হলে তা সেখানে ঘিরে থাকা ১৫-২০ জন ছাত্রকে আবরারের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন। এটা শোনার পর সকল ছাত্ররা পালিয়ে যায়। সেখানে আমি আর আবরারের লাশ ছাড়া আর কেউ ছিল না।

কিছুক্ষণ পর বুয়েট ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাসেল উপস্থিত হন বলে জানান ডা. মাসুক। ডা. মাসুক বলেন, ‘সে নিজের পরিচয় দেয় সে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। সে আমাকে আবরারকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলে। আমি বলি সে বেঁচে নেই, মারা গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করি।’ তখন রাসেল আমাকে বলে, ‘আবরার মারা যায়নি, সে ঘুমাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেও সে ঘুমাচ্ছিল’। রাসেল অন্য ছাত্রদের দিয়ে লাশ ঢাকা মেডিকেলে পাঠাতে অ্যাম্বুলেন্সেও তুলেছিল বলে জানান ঘটনার সাক্ষী এই চিকিৎসক।

তিনি বলেন, তখন আমি হলের প্রভোস্ট ড. জাফর ইকবাল স্যারকে মোবাইলে ফোন দিয়ে আবরারে মৃত্যু সংবাদ জানাই। উনাকে তাড়াতাড়ি হলে আসতে বলি। তিনি ১০-১৫ মিনিটে হলে চলে আসেন। প্রাধ্যক্ষ আসার পর অ্যাম্বুলেন্স থেকে আবরারের লাশ স্ট্রেচারে করে নামিয়ে আনা হয়।

সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারীদের মুখ : প্রায় দেড় মিনিটের একটি ফুটেজে দেখা যায়, আবরারকে মারধরের পর কক্ষ থেকে বের করা হচ্ছে। প্রথমে একজন বারান্দা দিয়ে কিছুটা দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান। এরপর তিনি একই পথে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর আরও তিনজনকে দেখা যায় যারা আবরারকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। ওই তিনজনের পেছনে আরও একজনকে হাঁটতে দেখা যায়। এরপরই চশমা পরা একজন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বেরিয়ে আসেন। এর পরপরই আরও পাঁচজনকে ওই বারান্দা দিয়ে পেছনে হাঁটতে দেখা যায়। তাদের একজন আবার মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ফুটেজে দেখতে পাওয়া ছাত্রদের মধ্যে নেতা ছাড়াও কর্মী রয়েছে।

ছাত্রলীগের টর্চার সেল ‘২০০৫’ ও ‘২০১১’: শেরেবাংলা হলের ‘২০০৫’ ও ‘২০১১’ রুমকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতো ছাত্রলীগ। রুমগুলোর একটি হলের ‘শ-ব্লক’-এ, অপরটি ‘হাজার-ব্লক’-এ। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আবরার হত্যার পর রুম দুটি থেকে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবি শাখা নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্ট্যাম্প, রড, চাকু ও দড়ি উদ্ধার করেছে। এছাড়া মাদক সেবনের আলামত পেয়েছে। তবে হল প্রশাসন এ বিষয়ে কিছুই জানতো না বলে দাবি করেছে।

২০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন ছাত্রলীগ সহ-সম্পাদক আশিমুল ইসলাম বিটু, উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাউল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার। আবরার ফাহাদকে এই রুমেই ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে এই কক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও চকবাজার থানা পুলিশ স্ট্যাম্প, লাঠি, রড, চাকু উদ্ধার করে।

২০০৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ও মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ইশতিয়াক হাসান মুন্না। এই কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। কক্ষটি টর্চার সেল ছাড়াও পার্টি রুম হিসেবে পরিচিত। এই কক্ষের পাশের একটি কক্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই রুমে নিয়মিত ছাত্রলীগের নেতারা আড্ডা দিতেন। ছাত্রলীগের যেসব নেতা বুয়েট থেকে পাস করে গেছেন, তারাও এখানে এসে আড্ডা দিতেন।’

সেই কক্ষে তখন যারা উপস্থিত ছিলেন

শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০১১ নম্বর কক্ষটিতে থাকেন বুয়েটের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহাসহ ছাত্রলীগের চার নেতা। ওই কক্ষটি বুয়েট ছাত্রলীগের নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহার হতো। নেতারাও আড্ডা দিতেন সেখানে। আবরারের ওপর নির্যাতন চলার সময় ওই কক্ষে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ছাড়াও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপ-দপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ সকাল, উপ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, ক্রীড়া সম্পাদক নেভাল, আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মিফতাউল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অনিক সরকার, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বী তানিম ও মুজাহিদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই অবরারকে নির্যাতনে অংশ নেন।

আরও খবর
শরীয়তপুরে আ’লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ, আহত অর্ধশত
পলাতকদের বিচারের আওতায় আনতে হবে বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবি
‘নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তাই সর্বোচ্চ শাস্তি’
রায় কার্যকর হলেই বুঝবো বিচার পেয়েছি আবরারের বাবা-মা
ফোর্বসের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় শেখ হাসিনা
হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়
নীলফামারীতে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন ভাইবোনের মর্মান্তিক মৃত্যু
রায়ে প্রমাণ হয়েছে দেশে আইনের শাসন আছে : আইনমন্ত্রী
খুলনায় মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ, ডিবির এসআই গ্রেপ্তার
মুরাদের সংসদ সদস্য পদ : কী হতে পারে
হেলিকপ্টার বিধ্বস্তে ভারতের প্রতিরক্ষা প্রধান বিপিন নিহত
নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাইকেল শোভাযাত্রা

বৃহস্পতিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ , ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ৪ জমাদিউল আউয়াল

সেই রাতে যা ঘটেছিল

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর। ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার ফাহাদ রাব্বী। অন্য স্বাভাবিক দিনের মতই বিকেল গড়িয়ে নামে রাতের কালো অন্ধকার। অন্ধকার নেমে আসে আবরারের জীবনেও। ঘটনার একদিন আগে ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে ফেসইবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার। ফেইসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ৬ অক্টোবর রাত ৮টায় শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে আবারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নেয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। সঙ্গে নেয়া হয় তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল।

২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়েই আবারারের কাছে ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির সমালোচনা করে স্ট্যাটাস’ দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। উত্তর দেয়ার আগেই শুরু হয় বেধড়ক পিটুনি। নির্মম নির্যাতনের এক পর্যায়ে বমি করে ফেলেন মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার। প্রশ্রাবও করে ফেলেন। পরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে এনে পোশাক বদলে আবারও মারধর করা হয় তাকে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলা আবরার ইঙ্গিতে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিতে বারবার মিনতি করলেও তাতে মন নরম হয়নি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। শেষ পর্যন্ত আবরারকে মেরে ফেলে মরদেহ হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখে তারা। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি জানাজানি হলে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠটি। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় বুয়েট শিক্ষার্থীরা। টানা আন্দোলনের পর ওই শিক্ষায়তনে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড : আবরার হলের যে কক্ষে থাকতেন, ওই কক্ষ ও আশপাশে কক্ষগুলোর কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটি কাটিয়ে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর বিকেলে নিজের ক্যাম্পাসে ফেরেন আবরার। ওইদিন বিকেলের দিকে শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষে পৌঁছে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথাও বলেন।

শিক্ষার্থীরা জানান, বাড়ি থেকে ফিরে আবরার নিজের কক্ষেই পড়ালেখা করছিলেন। ৬ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আবরারের কক্ষে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ২০১১ নম্বর কক্ষে। এই কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের চার নেতা। সেখানে তার মোবাইল ফোন তল্লাশি করে নেতারা। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ। তারা আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেটি যাচাই করেন। এক পর্যায়ে আবরারকে তার ফেইসবুক আইডি খুলতে বলেন। পরে তারা তার ফেইসবুক ও মেসেঞ্জার ঘেঁটে তাকে শিবিরের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। এর পরই ওই দুই নেতার সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন তাকে মারধর শুরু করেন। আবরারকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটানো হয়। ‘শিবির ধরা হয়েছে’- এমন খবর পেয়ে সেখানে সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের অনুসারী আরও সাত থেকে আটজন নেতা জড়ো হন। তারাও সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এক পর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে যায় আবরারের দেহ। রাত ২টার পর তাকে ওই কক্ষ থেকে বের করে হলের সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।

আবরার হত্যা মামলায় ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর আদালতে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন তার হলের ক্যান্টিন বয় জাহিদ হোসেন জনি। জবানবন্দিতে জনি বলেন, তাকে রাত ১টায় হল ক্যান্টিন থেকে (২০১১ নম্বর কক্ষে) ডেকে নিয়ে বমি করা বিছানার চাদর-বালিশ পরিষ্কার করানো হয়। বলে যে, সকালে আমাকে বকশিশ দেয়া হবে। এরপর রাত ৪টায় ঘুম থেকে জেগে ওই বিছানার চাদরে মোড়ানো আবরারের লাশ দেখতে পান জনি।

ঘটনার পর একজন শিক্ষার্থী জানান, ২০১১ নম্বর কক্ষ থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছিল। তবে ঝামেলা এড়াতে তিনি ওই কক্ষে যাননি। কক্ষটিতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাসহ তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিল। তারাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সকালে বুঝতে পারেন, সেখানে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে।

অন্য দু’জন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, পেটাতে পেটাতে আবরারকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন ছাত্রলীগের নেতারা। তিনি তাতে রাজিও হন। এরপরও তাকে ছাড়া হয়নি; নৃশংস ও নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

হলের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ মোস্তফা সে সময় দাবি করেন, প্রতি রাতেই শিক্ষার্থীরা নানা বিষয়ে কমবেশি হৈ-হুল্লোড় করেন। কিন্তু রোববার রাতে তিনি কোনো চিৎকার শোনেননি। বিষয়টি গভীর রাতে জানতে পারেন তিনি।

আবরারকে হত্যার ঘটনা জানাজানির পর হলজুড়েই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহত ওই ছাত্রের রুমমেট ও সহপাঠীরাও এ বিষয়ে প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবরারের কয়েকজন সহপাঠী জানান, হত্যার পর দীর্ঘক্ষণ আবরারের লাশটি ২০১১ নম্বর কক্ষেই পড়ে ছিল। রাত ২টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তার নিথর দেহ নামিয়ে আনেন। এক পর্যায়ে নিচতলা ও দোতলার মাঝখানের সিঁড়িতে তার লাশটি ফেলে রাখা হয়।

আবরার হত্যার ঘটনায় ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন মামলার পঞ্চম সাক্ষী বুয়েটের চিকিৎসক মাসুক এলাহী। ডা. মাসুক বলেন, রাত ২টা ৪৭ মিনিটে তাকে একজন ছাত্র খবর দিয়ে মেডিকেল সেন্টার থেকে অক্সিজেন নিয়ে যেতে বলে। তখন তিনি বলেন, তিনি আগে রোগী দেখবেন, তারপর সিদ্ধান্ত দেবেন। তখন আমাকে ছাত্ররা উত্তর ব্লকের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। এক এবং দুই তলার মাঝখানে আবরার ফাহাদকে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাই। তার পরনে একটি চেক শার্ট আর কালো রংয়ের ট্রাউজার ছিল। তোশক এবং ট্রাউজার প্রশ্রাবে ভেজা ছিল।

তিনি বলেন, দেখেই আবরারকে মৃত মনে হয়েছিল। এরপর পরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হলে তা সেখানে ঘিরে থাকা ১৫-২০ জন ছাত্রকে আবরারের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন। এটা শোনার পর সকল ছাত্ররা পালিয়ে যায়। সেখানে আমি আর আবরারের লাশ ছাড়া আর কেউ ছিল না।

কিছুক্ষণ পর বুয়েট ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাসেল উপস্থিত হন বলে জানান ডা. মাসুক। ডা. মাসুক বলেন, ‘সে নিজের পরিচয় দেয় সে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। সে আমাকে আবরারকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলে। আমি বলি সে বেঁচে নেই, মারা গেছে। তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করি।’ তখন রাসেল আমাকে বলে, ‘আবরার মারা যায়নি, সে ঘুমাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেও সে ঘুমাচ্ছিল’। রাসেল অন্য ছাত্রদের দিয়ে লাশ ঢাকা মেডিকেলে পাঠাতে অ্যাম্বুলেন্সেও তুলেছিল বলে জানান ঘটনার সাক্ষী এই চিকিৎসক।

তিনি বলেন, তখন আমি হলের প্রভোস্ট ড. জাফর ইকবাল স্যারকে মোবাইলে ফোন দিয়ে আবরারে মৃত্যু সংবাদ জানাই। উনাকে তাড়াতাড়ি হলে আসতে বলি। তিনি ১০-১৫ মিনিটে হলে চলে আসেন। প্রাধ্যক্ষ আসার পর অ্যাম্বুলেন্স থেকে আবরারের লাশ স্ট্রেচারে করে নামিয়ে আনা হয়।

সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারীদের মুখ : প্রায় দেড় মিনিটের একটি ফুটেজে দেখা যায়, আবরারকে মারধরের পর কক্ষ থেকে বের করা হচ্ছে। প্রথমে একজন বারান্দা দিয়ে কিছুটা দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান। এরপর তিনি একই পথে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর আরও তিনজনকে দেখা যায় যারা আবরারকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। ওই তিনজনের পেছনে আরও একজনকে হাঁটতে দেখা যায়। এরপরই চশমা পরা একজন প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বেরিয়ে আসেন। এর পরপরই আরও পাঁচজনকে ওই বারান্দা দিয়ে পেছনে হাঁটতে দেখা যায়। তাদের একজন আবার মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ফুটেজে দেখতে পাওয়া ছাত্রদের মধ্যে নেতা ছাড়াও কর্মী রয়েছে।

ছাত্রলীগের টর্চার সেল ‘২০০৫’ ও ‘২০১১’: শেরেবাংলা হলের ‘২০০৫’ ও ‘২০১১’ রুমকে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করতো ছাত্রলীগ। রুমগুলোর একটি হলের ‘শ-ব্লক’-এ, অপরটি ‘হাজার-ব্লক’-এ। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আবরার হত্যার পর রুম দুটি থেকে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবি শাখা নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্ট্যাম্প, রড, চাকু ও দড়ি উদ্ধার করেছে। এছাড়া মাদক সেবনের আলামত পেয়েছে। তবে হল প্রশাসন এ বিষয়ে কিছুই জানতো না বলে দাবি করেছে।

২০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন ছাত্রলীগ সহ-সম্পাদক আশিমুল ইসলাম বিটু, উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাউল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার। আবরার ফাহাদকে এই রুমেই ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে এই কক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও চকবাজার থানা পুলিশ স্ট্যাম্প, লাঠি, রড, চাকু উদ্ধার করে।

২০০৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ও মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ইশতিয়াক হাসান মুন্না। এই কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। কক্ষটি টর্চার সেল ছাড়াও পার্টি রুম হিসেবে পরিচিত। এই কক্ষের পাশের একটি কক্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই রুমে নিয়মিত ছাত্রলীগের নেতারা আড্ডা দিতেন। ছাত্রলীগের যেসব নেতা বুয়েট থেকে পাস করে গেছেন, তারাও এখানে এসে আড্ডা দিতেন।’

সেই কক্ষে তখন যারা উপস্থিত ছিলেন

শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০১১ নম্বর কক্ষটিতে থাকেন বুয়েটের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহাসহ ছাত্রলীগের চার নেতা। ওই কক্ষটি বুয়েট ছাত্রলীগের নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহার হতো। নেতারাও আড্ডা দিতেন সেখানে। আবরারের ওপর নির্যাতন চলার সময় ওই কক্ষে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ছাড়াও সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপ-দপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ সকাল, উপ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, ক্রীড়া সম্পাদক নেভাল, আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মিফতাউল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অনিক সরকার, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বী তানিম ও মুজাহিদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই অবরারকে নির্যাতনে অংশ নেন।