মুক্তিযুদ্ধের মোড়  ঘোরালো ‘অপারেশন জ্যাকপট’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডো বাহিনীর পরিচালিত প্রথম অভিযান ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে দেশের দুইটি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, এবং দুইটি নদী বন্দর চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে একই নামে পরিচালিত অপারেশনগুলো চালানো হয়েছিল।

অপারেশন জ্যাকপট ছিল একটি আত্মঘাতী অভিযান। এই অভিযানকে মুক্তিযোদ্ধারা সফল অভিযান বলে বর্ণনা করেন, কারণ এই অপারেশনে পাকিস্তান ও আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা অস্ত্র, খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ অভিযানে অংশগ্রহণকারী কোন গেরিলা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়েননি।

১৯৭১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখ রাতে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এর পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল মে মাসে। ২৩শে মে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর সহায়তায় ভাগিরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়।

এর সাংকেতিক নাম দেয়া হয়ে হয়েছিল ‘সি-টু-পি’। জুন মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা স্বাস্থ্যবান ও ভালো সাঁতার জানেন এমন ৩০০ জনের একটি দল ‘সি-টু-পি’ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। দীর্ঘ সময় ঢেউ ও স্রোতের মধ্যে নদীতে অবস্থান করতে ও সাঁতার কাটতে পারার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় শরীরে লিমপেট মাইন বেঁধে পানিতে চলাচল এবং সহজে বহনযোগ্য কার্যকর বিস্ফোরক বহন ও ব্যবহারের প্রশিক্ষণ বিষয়ে।

অপারেশন সফল করতে প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে ছবিসহ একটি ফরমে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণের শুরুতে গেরিলা যোদ্ধাদের জানানো হয়েছিল যে এটি একটি আত্মঘাতী অপারেশন হবে। জুলাই মাসের শেষদিকে প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এরপর দিনক্ষণ নির্ধারণসহ হামলার পরিকল্পনা করা হয়।

পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে একই দিনে একই সময়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের নদীবন্দরে হামলা চালানো হবে। চারটি বন্দরে হামলা পরিচালনার জন্য চারটি ছোট দল গঠন করা হয়, যাদেরকে বাছাই করা হয়েছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে।

এসব দলের কমান্ডারদের জানানো হয়েছিল, রেডিওতে আকাশবানী কলকাতা স্টেশন থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে দুটি বাংলা গানকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাদের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিও জানিয়ে দেয়া হয়।

গান দুটির প্রথমটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’- এর অর্থ ছিল, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।

দ্বিতীয় গান ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’- এই সংকেতের মানে ছিল আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর।

জুলাই মাসের ২৮ তারিখে ভারতীয় বাহিনীর ‘ডেলটা’ সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। এজন্য চট্টগ্রাম বন্দররে কর্মকা- এবং কর্ণফুলী নদীতে জাহাজ চলাচল সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। সেই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে চন্দ্রতিথি, আবহাওয়ার অবস্থা, বাতাসের বেগ, জোয়ার-ভাটার সময়, স্রোতের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি তথ্য যুক্ত করা হয়। চট্টগ্রামে বন্দরে অপারেশন চালানোর জন্য বাছাই করা হয়েছিল ৬০ জনের একটি দল।

এ সময় প্রতিজন নৌ-কমান্ডোকে একটি করে ‘লিমপেট মাইন’, একটি ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার দেয়া হয়। প্রতি তিনজনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং এই দলের নেতা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর জন্য ছিল একটি রেডিও।

রেডিওতে প্রথম গান বাজানোর মাধ্যমে সংকেত দেয়া হয় ১৪ই আগস্ট, আর নির্ধারিত দ্বিতীয় গানটি বাজানো হয় ১৫ই আগস্ট। চট্টগ্রাম বন্দরে সেই সময়ে ‘এম.ভি হরমুজ’ এবং ‘এম.ভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি জাহাজ নোঙর করা ছিল, যেগুলো বহন করছিল পাকিস্তানিবাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র। প্রথমটিতে ৯,৯১০ টন এবং দ্বিতীয়টিতে ১০,৪১৮ টন সমর-সম্ভার ছিল।

অপারেশনে সরাসরি অংশ নেন ৩১ জন কমান্ডো। ১৬ই আগস্ট রাত একটায় নৌ-কমান্ডোরা যাত্রা শুরু করেন। রাত সোয়া একটায় জাহাজের উদ্দেশ্যে সাঁতরানো শুরু করেন তারা, এবং দ্রুততার সঙ্গে টার্গেট জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে সাঁতার কেটে সরে পরেন। রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সবগুলো মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সফল অপারেশনের ফলে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ পানিতে তলিয়ে যায়।

অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় নৌ-কমান্ডোরা একযোগে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে আক্রমণ করে পাকিস্তানিবাহিনীর মোট ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানিবাহিনীর মধ্যে একযোগে চালানো এসব হামলার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক।

বৃহস্পতিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ , ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ৪ জমাদিউল আউয়াল

বীরগাথা

মুক্তিযুদ্ধের মোড়  ঘোরালো ‘অপারেশন জ্যাকপট’

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডো বাহিনীর পরিচালিত প্রথম অভিযান ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে দেশের দুইটি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, এবং দুইটি নদী বন্দর চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে একই নামে পরিচালিত অপারেশনগুলো চালানো হয়েছিল।

অপারেশন জ্যাকপট ছিল একটি আত্মঘাতী অভিযান। এই অভিযানকে মুক্তিযোদ্ধারা সফল অভিযান বলে বর্ণনা করেন, কারণ এই অপারেশনে পাকিস্তান ও আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা অস্ত্র, খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ অভিযানে অংশগ্রহণকারী কোন গেরিলা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়েননি।

১৯৭১ সালের আগস্টের ১৫ তারিখ রাতে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে এর পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল মে মাসে। ২৩শে মে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর সহায়তায় ভাগিরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়।

এর সাংকেতিক নাম দেয়া হয়ে হয়েছিল ‘সি-টু-পি’। জুন মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা স্বাস্থ্যবান ও ভালো সাঁতার জানেন এমন ৩০০ জনের একটি দল ‘সি-টু-পি’ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। দীর্ঘ সময় ঢেউ ও স্রোতের মধ্যে নদীতে অবস্থান করতে ও সাঁতার কাটতে পারার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় শরীরে লিমপেট মাইন বেঁধে পানিতে চলাচল এবং সহজে বহনযোগ্য কার্যকর বিস্ফোরক বহন ও ব্যবহারের প্রশিক্ষণ বিষয়ে।

অপারেশন সফল করতে প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে ছবিসহ একটি ফরমে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল। প্রশিক্ষণের শুরুতে গেরিলা যোদ্ধাদের জানানো হয়েছিল যে এটি একটি আত্মঘাতী অপারেশন হবে। জুলাই মাসের শেষদিকে প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এরপর দিনক্ষণ নির্ধারণসহ হামলার পরিকল্পনা করা হয়।

পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে একই দিনে একই সময়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের নদীবন্দরে হামলা চালানো হবে। চারটি বন্দরে হামলা পরিচালনার জন্য চারটি ছোট দল গঠন করা হয়, যাদেরকে বাছাই করা হয়েছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে।

এসব দলের কমান্ডারদের জানানো হয়েছিল, রেডিওতে আকাশবানী কলকাতা স্টেশন থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে দুটি বাংলা গানকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাদের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিও জানিয়ে দেয়া হয়।

গান দুটির প্রথমটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান’- এর অর্থ ছিল, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।

দ্বিতীয় গান ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’- এই সংকেতের মানে ছিল আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর।

জুলাই মাসের ২৮ তারিখে ভারতীয় বাহিনীর ‘ডেলটা’ সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং-এর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। এজন্য চট্টগ্রাম বন্দররে কর্মকা- এবং কর্ণফুলী নদীতে জাহাজ চলাচল সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। সেই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে চন্দ্রতিথি, আবহাওয়ার অবস্থা, বাতাসের বেগ, জোয়ার-ভাটার সময়, স্রোতের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি তথ্য যুক্ত করা হয়। চট্টগ্রামে বন্দরে অপারেশন চালানোর জন্য বাছাই করা হয়েছিল ৬০ জনের একটি দল।

এ সময় প্রতিজন নৌ-কমান্ডোকে একটি করে ‘লিমপেট মাইন’, একটি ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার দেয়া হয়। প্রতি তিনজনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং এই দলের নেতা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর জন্য ছিল একটি রেডিও।

রেডিওতে প্রথম গান বাজানোর মাধ্যমে সংকেত দেয়া হয় ১৪ই আগস্ট, আর নির্ধারিত দ্বিতীয় গানটি বাজানো হয় ১৫ই আগস্ট। চট্টগ্রাম বন্দরে সেই সময়ে ‘এম.ভি হরমুজ’ এবং ‘এম.ভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি জাহাজ নোঙর করা ছিল, যেগুলো বহন করছিল পাকিস্তানিবাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র। প্রথমটিতে ৯,৯১০ টন এবং দ্বিতীয়টিতে ১০,৪১৮ টন সমর-সম্ভার ছিল।

অপারেশনে সরাসরি অংশ নেন ৩১ জন কমান্ডো। ১৬ই আগস্ট রাত একটায় নৌ-কমান্ডোরা যাত্রা শুরু করেন। রাত সোয়া একটায় জাহাজের উদ্দেশ্যে সাঁতরানো শুরু করেন তারা, এবং দ্রুততার সঙ্গে টার্গেট জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে সাঁতার কেটে সরে পরেন। রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সবগুলো মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সফল অপারেশনের ফলে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ পানিতে তলিয়ে যায়।

অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় নৌ-কমান্ডোরা একযোগে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে আক্রমণ করে পাকিস্তানিবাহিনীর মোট ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানিবাহিনীর মধ্যে একযোগে চালানো এসব হামলার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক।