বাঙালির অদম্য দেশপ্রেম

শেখর ভট্টাচার্য

উপমহাদেশে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে “বিজয়-দিবস” নামে কোন জাতীয় দিবস নেই। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আধুনিক এবং প্রশিক্ষিত শত্রু বাহিনীকে মরণপণ লড়াইয়ে পরাভূত করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছিল শুধু বাংলাদেশের বাঙালিরা। ১৯৭১-এর সারাটি বছর ধরেই বাঙালি একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করে ওই বছরের মধ্য-ডিসেম্বর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরে এসে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাঙালি সেদিন যে বিজয় অর্জন করেছিল তার তাৎপর্য ছিল অসীম। আমাদের বিজয় দিবস তাই সর্বার্থে একটি দীর্ঘ যুদ্ধের পরে অর্জিত গৌরবময় একটি দিন।

একাত্তরের ২৬ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে। পোড়ামাটির নীতি অর্থাৎ বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ এমনভাবে পরিচালিত করা যাতে করে এ দেশের সব বাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়ে শুধু দেশটির পোড়ামাটির অস্তিত্ব থাকে। এভাবেই পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা নির্দেশ পালন করতে ভুল করেনি। দেশপ্রেমকে পুঁজি করে একটি জাতি কতটুকু অদম্য হয়ে উঠতে পারে তা ও পাকিস্তানি সেনারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। সবুজ প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা, পলি মাটির মতো কোমল স্বভাবের বাঙালি দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হলে কতটুকু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে সমগ্র বিশ্ব এবং পাকিস্তানিরা অবাক বিস্ময়ে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধকালীন সময়ে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কী একাত্তরের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল? “ভেতো বাঙালি”, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা বলতে তেমন কিছু নেই তাদের, এসব কথা সারা বিশ্বে পাকিস্তানিরা প্রচার করে বেড়াত। সেই ভেতো বাঙালিরা পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাসের মধ্যেই তাদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি ভাষার অধিকার রক্ষার মাধ্যেমে যে বিজয় অর্জন করে সে বিজয় তাদের মানস জগতে এক বিশাল পরিবর্তন সাধন করে। সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে বাঙালির নতুন যাত্রা পথের প্রথম মাইল স্টোনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

বায়ান্ন তাই আমাদের স্বাধীনতার বীজ বপন করার এক অভাবনীয় বছর। বায়ান্ন যদি বীজ বপনের কাল হয়, তাহলে তারই পথ বেঁয়ে ঊনসত্তর হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথনকশা বা রোডম্যাপ রচনার বছর। এই পথনকশা রচিত হয় মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা পেশের মাধ্যমে। ছয় দফা ছিল ইতিহাসের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলস্টোন। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ছয় দফাকে তাই বাঙালির মুক্তি সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলে অভিহিত করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসে ছয় দফার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর এই ছয় দফায় পাকিস্তানি শাসক এবং শাসনের ভিত এতটাই কেঁপে উঠেছিল যে ‘আপত্তিকর বক্তব্য’ দেয়ার অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার না করে পারেনি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দল। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯’র ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন এই সংগ্রামী নেতা। বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই ছিল দীর্ঘ কারাবাস। এই কারাবাস দীর্ঘ হওয়ার কারণ হলো, কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে যে “আসসালামু-আলাইকুম” বা বিদায় সম্ভাসন জানিয়ে ছিলেন, ছয় দফা ছিল সেই বিদায় সম্ভাসনের সুসংগঠিত ব্যাখ্যা। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উত্থাপনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন, সে কথাটি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সহজেই টের পেয়ে যায়।

ছয় দফা অর্জনের জন্য বাঙলাদেশে যে মহা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে সে আন্দোলন অনেকের মতে ফ্রান্স বিপ্লবের সমতুল্য এক গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে। ১৯৬৯-এর এই গণ-অভ্যুত্থান ছয় দফার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী-নারী-পুরুষ, পেশা, শ্রেণী নির্বিশেষে সব স্তরের বাঙালির এক ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। এ ঐক্যের কারণেই ১৯৭০-এর নির্বাচনী রায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল মুক্তি যুদ্ধের পূর্বের সাধারণ মানুষের ব্যাপক আন্দোলনের একটি প্রস্তুতি পর্ব। গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ের ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ, গণ-অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের “ড্রেস রিহার্সেল’ বা মহড়া বলে অভিহিত করেন। গণ-অভ্যুত্থান বাঙালি জাতির মধ্যে যে অভাবনীয় ঐক্য এবং সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিল সেই ঐক্য ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে নিশ্চয়তা এনে দেয়। স্বতঃস্ফূর্ত সেই ঐক্যের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গোটা বিশ্ববাসীর সহমর্মিতা ও সমর্থন আদায় করা খুব সহজ হয়ে পড়ে।

দেশ প্রেমে উদ্বুুদ্ধ বাঙালির মরণপণ লড়াই, যে লড়াই শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে; সে লড়াইয়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে হাজারো শহীদের জীবন ও জাতির অগণন মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের মহাকাক্সিক্ষত বিজয়। বিজয় দিবস তাই বাঙালির ২৩ বছর চার মাসব্যাপী মুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে তাই আবেগ-উল্লাস-আনন্দের মহাস্রোত সৃষ্টি হয়েছিল। একই সঙ্গে হৃদয়ের রক্তক্ষরণও ঘটেছিল সেই বিজয়ের দিনে। মানুষ যখন সংবাদ পাচ্ছিল বধ্যভূমি থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ সম্পর্কে, তখন হৃদয় ভারী হতে থাকে। যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তার নিকটজনদের কান্নার শব্দ সহ্য করার মতো ছিল না। তবুও মানুষ বড় স্বস্তি পেয়েছিল বিজয়ের এই দিনটিতে অন্তত এই কথাটি ভেবে, মানুষ নামের পাকিস্তানি বর্বরগুলো আর কারও ওপর হামলে পড়বে না আর। নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত নতুন দেশের মুখ, স্বাধীন ভূখ-, নাম তার বাংলাদেশ। নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। প্রত্যাশা পূরণ হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালির। কিন্তু এই অর্জনের বিপরীত ধারার মানুষও সেদিন ছিল। আমরা মুদ্রার অপর পিঠের দিকে তাকাইনি। এ কথা ভেবে দেখিনি জামায়াত, নেজামে ইসলাম বা মুসলিম লীগের মতো পাকিস্তানপন্থি দলের সমর্থক বাঙালি তথা রাজাকারের সংখ্যা কি খুব কম ছিল? আজ তারা আরও বেড়েছে। নানা ব্যানারে, নানা নামে তারাই আস্ফালন করছে।

পৃথিবীতে শত, সহস্র বছরেও একটি জাতি স্বতঃস্ফূর্ত ও নিস্বার্থভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করা সব জাতীয় নেতার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বঙ্গবন্ধু সে পরীক্ষায় চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখ হয় বিজয়ের মাসে আমরা যখন দেখি মানুষে মানুষে বৈষম্য দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। শোষক পরিবর্তিত হয়েছে এবং শোষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, মানুষের মধ্যে অনৈক্য শঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শাসক পরিবর্তিত হয়েছে দুঃশাসনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। বঙ্গবন্ধু তো এই বৈষম্য দূর করার জন্যই লড়ে গিয়েছিলেন, তার যত ত্যাগ, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যত আত্মাহুতি সব কিছুই ছিল, আধিপত্যবিহীন স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, তা কি ধরার ধুলায় লীন হবে?” রাত্রির তপস্যা কি দিন আনবে না? বীরের রক্ত, মাতার অশ্রু ধরার ধুলায় লীন হয়নি। জাতির রাত্রির তপস্যাও ব্যর্থ হয়নি। বহু শতকের শোষণ ও বঞ্চনা শেষে যে গঙ্গার তীরে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই গঙ্গার তীরেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে।

এত রক্ত, এত ত্যাগের পর আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি সে বিজয়ের পূর্বে আমাদের অনেক অঙ্গীকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার যেন আমরা ভুলে না যাই। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রয়োজন আত্মোপলব্ধিরও। যেটুকু সরে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার নবপ্রত্যয় চাই। চাই বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র বদলও। তেমন একটি সময়ের অপেক্ষায় আছি। আছি তেমন একটা বিজয় দিবস দেখব বলেও। প্রকৃত দেশপ্রেমী, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে যুথবদ্ধ হয়ে সংকল্প করতেই হবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ-চেতনাবিরোধী কোন কিছুই রক্তস্নাত বাংলাদেশে চলবে না। গত এক যুগে বাংলাদেশের লক্ষণীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছেÑএ কথা অস্বীকার করা যাবে না। দেশি-বিদেশি নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র স্পষ্ট। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করতে চলেছে। এটি অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু এর পাশাপাশি নেতিবাচকতাও কম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা ও রাজনীতির কদর্যতা দূর করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জÑএ কথা মনে রাখতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলোÑমৌলবাদী, উগ্রবাদী, ধর্মান্ধদের আস্ফালন রুখে দিতে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

বাঙালি অদম্য জাতি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বে এই বাংলাতে কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়নি। বাঙালির মানবিকতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমরা দেখতে পাই চ-ীদাস থেকে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ হয়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের মধ্যে। স্বাধীনতার জন্য অদম্য আবেগ দিয়ে যে জাতি তার প্রত্যেকটি মানুষকে একটি মারণাস্ত্রে পরিণত করতে পারে সে জাতির কাছে যে কোন অর্জনই সম্ভব। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তরের পথ বেঁয়ে সর্বশেষ একাত্তরে। ঘোর অন্ধকারেও আমরা আশাবাদী আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতি। দেয়ালে পীঠ ঠেক গেলে তারা বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাই অন্ধকারের কুশীলবরা যতই আস্ফালন করুক না কেন আমাদের সাধারণ মানুষ তাদের অদম্য দেশপ্রেম দিয়ে তা ফিরিয়ে দেবে। এ কথাটি বিশ্বাস করি অত্যন্ত গভীরভাবে, কারণ হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে, এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প আছে অসংখ্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বৃহস্পতিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২১ , ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ ৪ জমাদিউল আউয়াল

বাঙালির অদম্য দেশপ্রেম

শেখর ভট্টাচার্য

উপমহাদেশে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে “বিজয়-দিবস” নামে কোন জাতীয় দিবস নেই। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে আধুনিক এবং প্রশিক্ষিত শত্রু বাহিনীকে মরণপণ লড়াইয়ে পরাভূত করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছিল শুধু বাংলাদেশের বাঙালিরা। ১৯৭১-এর সারাটি বছর ধরেই বাঙালি একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করে ওই বছরের মধ্য-ডিসেম্বর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরে এসে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাঙালি সেদিন যে বিজয় অর্জন করেছিল তার তাৎপর্য ছিল অসীম। আমাদের বিজয় দিবস তাই সর্বার্থে একটি দীর্ঘ যুদ্ধের পরে অর্জিত গৌরবময় একটি দিন।

একাত্তরের ২৬ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে। পোড়ামাটির নীতি অর্থাৎ বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ এমনভাবে পরিচালিত করা যাতে করে এ দেশের সব বাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়ে শুধু দেশটির পোড়ামাটির অস্তিত্ব থাকে। এভাবেই পাকিস্তানি সেনাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা নির্দেশ পালন করতে ভুল করেনি। দেশপ্রেমকে পুঁজি করে একটি জাতি কতটুকু অদম্য হয়ে উঠতে পারে তা ও পাকিস্তানি সেনারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। সবুজ প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা, পলি মাটির মতো কোমল স্বভাবের বাঙালি দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হলে কতটুকু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে সমগ্র বিশ্ব এবং পাকিস্তানিরা অবাক বিস্ময়ে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধকালীন সময়ে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কী একাত্তরের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল? “ভেতো বাঙালি”, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা বলতে তেমন কিছু নেই তাদের, এসব কথা সারা বিশ্বে পাকিস্তানিরা প্রচার করে বেড়াত। সেই ভেতো বাঙালিরা পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাসের মধ্যেই তাদের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি ভাষার অধিকার রক্ষার মাধ্যেমে যে বিজয় অর্জন করে সে বিজয় তাদের মানস জগতে এক বিশাল পরিবর্তন সাধন করে। সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে বাঙালির নতুন যাত্রা পথের প্রথম মাইল স্টোনের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

বায়ান্ন তাই আমাদের স্বাধীনতার বীজ বপন করার এক অভাবনীয় বছর। বায়ান্ন যদি বীজ বপনের কাল হয়, তাহলে তারই পথ বেঁয়ে ঊনসত্তর হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথনকশা বা রোডম্যাপ রচনার বছর। এই পথনকশা রচিত হয় মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা পেশের মাধ্যমে। ছয় দফা ছিল ইতিহাসের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলস্টোন। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ছয় দফাকে তাই বাঙালির মুক্তি সনদ বা ম্যাগনাকার্টা বলে অভিহিত করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসে ছয় দফার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর এই ছয় দফায় পাকিস্তানি শাসক এবং শাসনের ভিত এতটাই কেঁপে উঠেছিল যে ‘আপত্তিকর বক্তব্য’ দেয়ার অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার না করে পারেনি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দল। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯’র ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন এই সংগ্রামী নেতা। বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই ছিল দীর্ঘ কারাবাস। এই কারাবাস দীর্ঘ হওয়ার কারণ হলো, কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে যে “আসসালামু-আলাইকুম” বা বিদায় সম্ভাসন জানিয়ে ছিলেন, ছয় দফা ছিল সেই বিদায় সম্ভাসনের সুসংগঠিত ব্যাখ্যা। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উত্থাপনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন, সে কথাটি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সহজেই টের পেয়ে যায়।

ছয় দফা অর্জনের জন্য বাঙলাদেশে যে মহা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে সে আন্দোলন অনেকের মতে ফ্রান্স বিপ্লবের সমতুল্য এক গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে। ১৯৬৯-এর এই গণ-অভ্যুত্থান ছয় দফার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসী-নারী-পুরুষ, পেশা, শ্রেণী নির্বিশেষে সব স্তরের বাঙালির এক ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। এ ঐক্যের কারণেই ১৯৭০-এর নির্বাচনী রায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল মুক্তি যুদ্ধের পূর্বের সাধারণ মানুষের ব্যাপক আন্দোলনের একটি প্রস্তুতি পর্ব। গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ের ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ, গণ-অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের “ড্রেস রিহার্সেল’ বা মহড়া বলে অভিহিত করেন। গণ-অভ্যুত্থান বাঙালি জাতির মধ্যে যে অভাবনীয় ঐক্য এবং সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিল সেই ঐক্য ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে নিশ্চয়তা এনে দেয়। স্বতঃস্ফূর্ত সেই ঐক্যের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গোটা বিশ্ববাসীর সহমর্মিতা ও সমর্থন আদায় করা খুব সহজ হয়ে পড়ে।

দেশ প্রেমে উদ্বুুদ্ধ বাঙালির মরণপণ লড়াই, যে লড়াই শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে; সে লড়াইয়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে হাজারো শহীদের জীবন ও জাতির অগণন মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের মহাকাক্সিক্ষত বিজয়। বিজয় দিবস তাই বাঙালির ২৩ বছর চার মাসব্যাপী মুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে তাই আবেগ-উল্লাস-আনন্দের মহাস্রোত সৃষ্টি হয়েছিল। একই সঙ্গে হৃদয়ের রক্তক্ষরণও ঘটেছিল সেই বিজয়ের দিনে। মানুষ যখন সংবাদ পাচ্ছিল বধ্যভূমি থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ সম্পর্কে, তখন হৃদয় ভারী হতে থাকে। যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তার নিকটজনদের কান্নার শব্দ সহ্য করার মতো ছিল না। তবুও মানুষ বড় স্বস্তি পেয়েছিল বিজয়ের এই দিনটিতে অন্তত এই কথাটি ভেবে, মানুষ নামের পাকিস্তানি বর্বরগুলো আর কারও ওপর হামলে পড়বে না আর। নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত নতুন দেশের মুখ, স্বাধীন ভূখ-, নাম তার বাংলাদেশ। নতুন পতাকা, নতুন মানচিত্র নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। প্রত্যাশা পূরণ হলো স্বাধীনতাকামী বাঙালির। কিন্তু এই অর্জনের বিপরীত ধারার মানুষও সেদিন ছিল। আমরা মুদ্রার অপর পিঠের দিকে তাকাইনি। এ কথা ভেবে দেখিনি জামায়াত, নেজামে ইসলাম বা মুসলিম লীগের মতো পাকিস্তানপন্থি দলের সমর্থক বাঙালি তথা রাজাকারের সংখ্যা কি খুব কম ছিল? আজ তারা আরও বেড়েছে। নানা ব্যানারে, নানা নামে তারাই আস্ফালন করছে।

পৃথিবীতে শত, সহস্র বছরেও একটি জাতি স্বতঃস্ফূর্ত ও নিস্বার্থভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করা সব জাতীয় নেতার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বঙ্গবন্ধু সে পরীক্ষায় চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখ হয় বিজয়ের মাসে আমরা যখন দেখি মানুষে মানুষে বৈষম্য দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। শোষক পরিবর্তিত হয়েছে এবং শোষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, মানুষের মধ্যে অনৈক্য শঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শাসক পরিবর্তিত হয়েছে দুঃশাসনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। বঙ্গবন্ধু তো এই বৈষম্য দূর করার জন্যই লড়ে গিয়েছিলেন, তার যত ত্যাগ, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যত আত্মাহুতি সব কিছুই ছিল, আধিপত্যবিহীন স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, তা কি ধরার ধুলায় লীন হবে?” রাত্রির তপস্যা কি দিন আনবে না? বীরের রক্ত, মাতার অশ্রু ধরার ধুলায় লীন হয়নি। জাতির রাত্রির তপস্যাও ব্যর্থ হয়নি। বহু শতকের শোষণ ও বঞ্চনা শেষে যে গঙ্গার তীরে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই গঙ্গার তীরেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে।

এত রক্ত, এত ত্যাগের পর আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি সে বিজয়ের পূর্বে আমাদের অনেক অঙ্গীকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার যেন আমরা ভুলে না যাই। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রয়োজন আত্মোপলব্ধিরও। যেটুকু সরে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার নবপ্রত্যয় চাই। চাই বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র বদলও। তেমন একটি সময়ের অপেক্ষায় আছি। আছি তেমন একটা বিজয় দিবস দেখব বলেও। প্রকৃত দেশপ্রেমী, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোকে যুথবদ্ধ হয়ে সংকল্প করতেই হবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ-চেতনাবিরোধী কোন কিছুই রক্তস্নাত বাংলাদেশে চলবে না। গত এক যুগে বাংলাদেশের লক্ষণীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছেÑএ কথা অস্বীকার করা যাবে না। দেশি-বিদেশি নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র স্পষ্ট। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করতে চলেছে। এটি অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু এর পাশাপাশি নেতিবাচকতাও কম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা ও রাজনীতির কদর্যতা দূর করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জÑএ কথা মনে রাখতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলোÑমৌলবাদী, উগ্রবাদী, ধর্মান্ধদের আস্ফালন রুখে দিতে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

বাঙালি অদম্য জাতি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বে এই বাংলাতে কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়নি। বাঙালির মানবিকতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমরা দেখতে পাই চ-ীদাস থেকে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ হয়ে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের মধ্যে। স্বাধীনতার জন্য অদম্য আবেগ দিয়ে যে জাতি তার প্রত্যেকটি মানুষকে একটি মারণাস্ত্রে পরিণত করতে পারে সে জাতির কাছে যে কোন অর্জনই সম্ভব। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তরের পথ বেঁয়ে সর্বশেষ একাত্তরে। ঘোর অন্ধকারেও আমরা আশাবাদী আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতি। দেয়ালে পীঠ ঠেক গেলে তারা বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাই অন্ধকারের কুশীলবরা যতই আস্ফালন করুক না কেন আমাদের সাধারণ মানুষ তাদের অদম্য দেশপ্রেম দিয়ে তা ফিরিয়ে দেবে। এ কথাটি বিশ্বাস করি অত্যন্ত গভীরভাবে, কারণ হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসে, এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প আছে অসংখ্য।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]