‘ওমিক্রন’ ঝুঁকি, সংক্রমণ বাড়ছে

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ দেশেও বাড়ছে। দেশে গতকাল পর্যন্ত সাতজনের ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রায় পাঁচশর কাছাকাছি মানুষের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ হারও প্রায় আড়াই শতাংশের ঘরে। ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়া দেশগুলো থেকে দেশে ফেরা লোকজনের কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন ব্যবস্থাপনা ‘কঠোর’র পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যক মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। তবে ওমিক্রনের প্রভাবে বাংলাদেশে সংক্রমণ বাড়ছে কি-না সে সর্ম্পকে নিশ্চিত নয় দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আবারও সংক্রমণ হার বাড়ছে, রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপকভাবে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ওইসব দেশ থেকে অবাধে লোকজন বাংলাদেশে আসছে, যাচ্ছে। কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন- কোন কিছুই ঠিকমত হচ্ছে না। কোন পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে না। এতে মনে হচ্ছে, আবারও খারাপ কিছু আসছে।’

ওমিক্রনের ‘ফ্যাটালিটি’ (মারণক্ষমতা) কম বলে এটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই মন্তব্য করে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ফ্যাটালিটি কম, এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন কারণ নেই। ব্যাপকভাবে মানুষ আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে যারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে। এতে স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালের ওপর চাপ পড়বে।’

পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেও সংক্রমণ বাড়ছে। দেশটিতে করোনার আরেকটি নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে-আশঙ্কা করে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, প্রতিদিন দুই দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ নানা প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করছে।

ওমিক্রনের প্রভাবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ভারতে করোনার নতুন ঢেউ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল কাট্রুমান। তবে তিনি মনে করেন, মহামারীর আরেকটি ঢেউ আসলেও সেটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

অধ্যাপক পল কাট্রুমান বলেন, ‘আর কয়েক দিন, বড় জোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করবে। দৈনিক বহু মানুষ আক্রান্ত হবেন।’

কোভিড ইন্ডিয়া ট্র্যাকার তৈরি করেছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতে করোনা সংক্রমণের ওপর নজর রাখছেন কেমব্রিজের বিশেষজ্ঞরা।

ওমিক্রনের ঝুঁকি ‘খুব বেশি’

করোনার অধিক সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ঝুঁকি এখনও ‘খুব বেশি’ বলে জানিয়েছে বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি জানিয়েছে, ওমিক্রনের প্রভাবে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বেড়েছে। এর প্রভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাড়তি চাপ পড়তে পারে। গত সপ্তাহে বিশ^ব্যাপী করোনা সংক্রমণ ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

ডব্লিউএইচওর করোনা সংক্রান্ত সাপ্তাহিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে যেসব দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের (ধরন) আধিপত্য দেখা গেছে সেগুলোসহ বিভিন্ন দেশে এখন দ্রুত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটছে।

কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, ওমিক্রন দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

গত মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এক সপ্তাহে ইউরোপে করোনা সংক্রমণ ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

ওমিক্রন দেশেও বাড়ছে

২৮ ডিসেম্বর দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত আরও তিনজন ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এই চারজনসহ দেশে গতকাল পর্যন্ত সাতজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্তের খবর পাওয়া গেল। নতুন শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে দুজন নারী ও একজন পুরুষ। তারা সবাই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা বলে জিআইএসএআইডি জানিয়েছে।

গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রথম ওমিক্রন শনাক্তের কথা জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। শনাক্ত হওয়া প্রথম দু’জন হলেন জিম্বাবুয়ে ফেরত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সদস্য।

ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং ঠিকমত হচ্ছে না। এ কারণে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র আমাদের অজানা।’

একদিনে প্রায় পাঁচশ’ রোগী শনাক্ত

একদিনে ফের দেশে পাঁচশর কাছাকাছি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণ হারও বেড়েছে।

গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯৫ জনের শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এদিন করোনায় একজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এক দিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা গত ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ১৩ অক্টোবর এর চেয়ে বেশি মানুষের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। ওইদিন ৫১১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচশ’র নিচে ছিল।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের হার ছিল দুই দশমিক ৩৭ শতাংশ; যা গত আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১১ অক্টোবর এর চেয়ে বেশি সংক্রমণ হার ছিল। ওইদিন পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণ হার ছিল দুই দশমিক ৫৮ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, একদিনে শনাক্ত নতুন রোগীদের নিয়ে এ পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৮ জনে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ২৮ হাজার ৬৩ জন মারা গেছেন।

শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩৭২ জন। এ নিয়ে মোট ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪১৬ জন সুস্থ হয়েছেন। একদিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৪২৫ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা যা মোট শনাক্তের প্রায় ৮৬ শতাংশ। এদিন দেশের ৩১টি জেলায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়নি। এদিন মৃত্যু হওয়া একজন (পুরুষ) ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ২০ হাজার ৯১৪টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট এক কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার ১৪৮টি নমুনা পরীক্ষা হলো। পরীক্ষা বিবেচনায় একদিনে শনাক্তের হার দুই দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা আগের দিন ছিল দুই দশমিক ১০ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী করোনা শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, মৃত্যুর হার এক দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।

বিশ^ব্যাপী সংক্রমণের রেকর্ড

বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের তথ্য সংগ্রহকারী ওয়েবসাইট ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার্সের’ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী গত সাত দিনে করোনা শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। এক সপ্তাহে বিশে^ ৬৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। গত ২২ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৯ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। ওমিক্রনের দাপটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক করোনা শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে বিশ^জুড়ে শনাক্ত ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে সংক্রমণ শনাক্তের রেকর্ড হয়েছিল গত ২৩ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল। ওই এক সপ্তাহে দৈনিক গড়ে আট লাখ ১৭ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে চার লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। যদিও দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বড় দিনের ছুটির সময় রিপোর্ট প্রদানে বিলম্ব হয়; এতে নমুনা পরীক্ষার জট লাগে; এ কারণে শনাক্ত বেশি হয়ে থাকতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) মুখপাত্র জানিয়েছেন, সংক্রমণের সর্বশেষ হিসাব অনেক বেশি হতে পারে। কারণ বড় দিনের সময় পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো এবং নমুনা পরীক্ষা বন্ধ ছিল। নববর্ষের পর আক্রান্তের এই সংখ্যা স্থিতিশীল হয়ে আসতে পারে।

মার্কিন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আমেশ আদালজা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শনাক্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ জন্য তিনি অতি ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ফ্রান্সে এক লাখ ৭৯ হাজার ৮০৭ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। যা ইউরোপে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ।

ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অলিভিয়ের ভেরান সতর্ক করে বলেছেন, জানুয়ারির শুরুতে তাদের দেশে দৈনিক আক্রান্তের পরিমাণ আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও মঙ্গলবার দৈনিক সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইতালি, পর্তুগাল ও গ্রিস। যুক্তরাজ্যেও এই সপ্তাহে রেকর্ড সংক্রমণ হয়েছে।

ইউরোপে গত সপ্তাহে ৩৫ লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দৈনিক গড়ে পাঁচ লাখ ১০ হাজার কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে।

এর আগের ঢেউয়ের সময় ইউরোপে দৈনিক গড়ে সর্বোচ্চ তিন লাখের মতো মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। মঙ্গলবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক দিনেই ছয় লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়।

বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ , ২০ পৌষ ১৪২৮ ২৫ জমাদিউল আউয়াল

‘ওমিক্রন’ ঝুঁকি, সংক্রমণ বাড়ছে

রাকিব উদ্দিন

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ দেশেও বাড়ছে। দেশে গতকাল পর্যন্ত সাতজনের ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রায় পাঁচশর কাছাকাছি মানুষের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ হারও প্রায় আড়াই শতাংশের ঘরে। ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়া দেশগুলো থেকে দেশে ফেরা লোকজনের কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন ব্যবস্থাপনা ‘কঠোর’র পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যক মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। তবে ওমিক্রনের প্রভাবে বাংলাদেশে সংক্রমণ বাড়ছে কি-না সে সর্ম্পকে নিশ্চিত নয় দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আবারও সংক্রমণ হার বাড়ছে, রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপকভাবে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ওইসব দেশ থেকে অবাধে লোকজন বাংলাদেশে আসছে, যাচ্ছে। কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন- কোন কিছুই ঠিকমত হচ্ছে না। কোন পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে না। এতে মনে হচ্ছে, আবারও খারাপ কিছু আসছে।’

ওমিক্রনের ‘ফ্যাটালিটি’ (মারণক্ষমতা) কম বলে এটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই মন্তব্য করে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ফ্যাটালিটি কম, এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন কারণ নেই। ব্যাপকভাবে মানুষ আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে যারা উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে। এতে স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালের ওপর চাপ পড়বে।’

পাশর্^বর্তী দেশ ভারতেও সংক্রমণ বাড়ছে। দেশটিতে করোনার আরেকটি নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে-আশঙ্কা করে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, প্রতিদিন দুই দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ নানা প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করছে।

ওমিক্রনের প্রভাবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ভারতে করোনার নতুন ঢেউ শুরু হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল কাট্রুমান। তবে তিনি মনে করেন, মহামারীর আরেকটি ঢেউ আসলেও সেটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

অধ্যাপক পল কাট্রুমান বলেন, ‘আর কয়েক দিন, বড় জোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করবে। দৈনিক বহু মানুষ আক্রান্ত হবেন।’

কোভিড ইন্ডিয়া ট্র্যাকার তৈরি করেছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতে করোনা সংক্রমণের ওপর নজর রাখছেন কেমব্রিজের বিশেষজ্ঞরা।

ওমিক্রনের ঝুঁকি ‘খুব বেশি’

করোনার অধিক সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ঝুঁকি এখনও ‘খুব বেশি’ বলে জানিয়েছে বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি জানিয়েছে, ওমিক্রনের প্রভাবে সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বেড়েছে। এর প্রভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাড়তি চাপ পড়তে পারে। গত সপ্তাহে বিশ^ব্যাপী করোনা সংক্রমণ ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

ডব্লিউএইচওর করোনা সংক্রান্ত সাপ্তাহিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে যেসব দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের (ধরন) আধিপত্য দেখা গেছে সেগুলোসহ বিভিন্ন দেশে এখন দ্রুত ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটছে।

কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, ওমিক্রন দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

গত মঙ্গলবার বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এক সপ্তাহে ইউরোপে করোনা সংক্রমণ ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

ওমিক্রন দেশেও বাড়ছে

২৮ ডিসেম্বর দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত আরও তিনজন ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি) ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এই চারজনসহ দেশে গতকাল পর্যন্ত সাতজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্তের খবর পাওয়া গেল। নতুন শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে দুজন নারী ও একজন পুরুষ। তারা সবাই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা বলে জিআইএসএআইডি জানিয়েছে।

গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রথম ওমিক্রন শনাক্তের কথা জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। শনাক্ত হওয়া প্রথম দু’জন হলেন জিম্বাবুয়ে ফেরত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সদস্য।

ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং ঠিকমত হচ্ছে না। এ কারণে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র আমাদের অজানা।’

একদিনে প্রায় পাঁচশ’ রোগী শনাক্ত

একদিনে ফের দেশে পাঁচশর কাছাকাছি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে সংক্রমণ হারও বেড়েছে।

গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯৫ জনের শরীরে করোনার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এদিন করোনায় একজনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এক দিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা গত ১১ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ১৩ অক্টোবর এর চেয়ে বেশি মানুষের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। ওইদিন ৫১১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচশ’র নিচে ছিল।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে করোনা শনাক্তের হার ছিল দুই দশমিক ৩৭ শতাংশ; যা গত আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১১ অক্টোবর এর চেয়ে বেশি সংক্রমণ হার ছিল। ওইদিন পরীক্ষা বিবেচনায় সংক্রমণ হার ছিল দুই দশমিক ৫৮ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, একদিনে শনাক্ত নতুন রোগীদের নিয়ে এ পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫১৮ জনে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ২৮ হাজার ৬৩ জন মারা গেছেন।

শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩৭২ জন। এ নিয়ে মোট ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪১৬ জন সুস্থ হয়েছেন। একদিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৪২৫ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা যা মোট শনাক্তের প্রায় ৮৬ শতাংশ। এদিন দেশের ৩১টি জেলায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়নি। এদিন মৃত্যু হওয়া একজন (পুরুষ) ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ২০ হাজার ৯১৪টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট এক কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার ১৪৮টি নমুনা পরীক্ষা হলো। পরীক্ষা বিবেচনায় একদিনে শনাক্তের হার দুই দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা আগের দিন ছিল দুই দশমিক ১০ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী করোনা শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ, মৃত্যুর হার এক দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং সুস্থতার হার ৯৭ দশমিক ৭২ শতাংশ।

বিশ^ব্যাপী সংক্রমণের রেকর্ড

বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসের তথ্য সংগ্রহকারী ওয়েবসাইট ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার্সের’ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী গত সাত দিনে করোনা শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। এক সপ্তাহে বিশে^ ৬৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। গত ২২ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৯ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। ওমিক্রনের দাপটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক করোনা শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগের সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে বিশ^জুড়ে শনাক্ত ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে সংক্রমণ শনাক্তের রেকর্ড হয়েছিল গত ২৩ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল। ওই এক সপ্তাহে দৈনিক গড়ে আট লাখ ১৭ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে চার লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষের শরীরে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। যদিও দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বড় দিনের ছুটির সময় রিপোর্ট প্রদানে বিলম্ব হয়; এতে নমুনা পরীক্ষার জট লাগে; এ কারণে শনাক্ত বেশি হয়ে থাকতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) মুখপাত্র জানিয়েছেন, সংক্রমণের সর্বশেষ হিসাব অনেক বেশি হতে পারে। কারণ বড় দিনের সময় পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো এবং নমুনা পরীক্ষা বন্ধ ছিল। নববর্ষের পর আক্রান্তের এই সংখ্যা স্থিতিশীল হয়ে আসতে পারে।

মার্কিন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আমেশ আদালজা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শনাক্তের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ জন্য তিনি অতি ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ফ্রান্সে এক লাখ ৭৯ হাজার ৮০৭ জনের দেহে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। যা ইউরোপে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ।

ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অলিভিয়ের ভেরান সতর্ক করে বলেছেন, জানুয়ারির শুরুতে তাদের দেশে দৈনিক আক্রান্তের পরিমাণ আড়াই লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও মঙ্গলবার দৈনিক সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইতালি, পর্তুগাল ও গ্রিস। যুক্তরাজ্যেও এই সপ্তাহে রেকর্ড সংক্রমণ হয়েছে।

ইউরোপে গত সপ্তাহে ৩৫ লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দৈনিক গড়ে পাঁচ লাখ ১০ হাজার কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে।

এর আগের ঢেউয়ের সময় ইউরোপে দৈনিক গড়ে সর্বোচ্চ তিন লাখের মতো মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। মঙ্গলবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক দিনেই ছয় লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়।