নিরুত্তাপ রাজনীতির আলোচনায় ইউপি ভোট, নির্বাচন কমিশন

করোনা মহামারীর কারণে এবছর মাঠের রাজনীতির অনেকটই ছিল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। হরতাল, ভাঙচুর, সহিংসতা থেকে অনেকটা সরে এসেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। সেই অর্থে রাজনীতিতে উত্তাপ ছিল না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। আন্দোলন আন্দোলন বলছে, তবে কর্মসূচি ছিল সীমিত। রাজনীতিতে প্রধান চরিত্র হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। সেটাই বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল।

রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকেও আলোচনায় ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার চিকিৎসা ইস্যুতে বছরজুড়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ চলেছে। বছর শেষে বড় আলোচনা প্রাধান্য পায় পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন।

নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও রাজনীতির আলোচনায় ছিল হেফাজতে ইসলাম; যার অধিকাংশ নেতাই বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সদস্য।

এ বছরেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করল। জাতির জন্য এটা অনেক বড় গর্বের। আর এ বছরেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। জাতীয়ভাবে উৎসবের আমেজে এসব অর্জন স্মরণীয় করে রাখতে ব্যাপক কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ।

তবে বছরের শুরুতেই মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপনে সরকারি কর্মসূচির বিরোধিতা করে আলোচনায় আসে ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন হেফাজত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর বাতিলের দাবিতে মাঠে নামেন তারা। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় চালানো হয় নাশকতা। মামুনুল হকসহ হেফাজতের অনেক শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতায়ও সক্রিয় ছিল দলটি। তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ব্যাপক চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ে হেফাজত।

দলীয় নেতাকর্মীদের নানা ধরনের বিতর্কিত কাজে বিব্রত ছিল আওয়ামী লীগ। শিষ্টাচারের অভাব দেখা গেছে রাজনীতিকদের বক্তব্যে। বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশে সরকারি ও বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন, অযাচিত ভাষা ব্যবহার করে।

কুরুচিপূর্ণ কথা ও আচরণের জন্য মন্ত্রিত্ব হারানো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মুরাদ হাসান দলে ও দলের বাইরে আলোচিত হয়েছেন। দেশ ছেড়ে যেতে চাইলেও তাকে ঢুকতে দেয়নি কানাডা, ফেরত এসেছেন।

প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও আলোচনায় ছিলেন, তবে পরে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। বেফাঁস কথার জন্য বরখাস্ত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ছাত্রলীগও নানা বিতর্কিত কাজের জন্য আলোচনায় ছিল। দল ও সরকারের সমালোচনা করে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরর ছোট ভাই বসুরহাটের পৌরমেয়র মির্জা আবদুল কাদের। যদিও তার সমালোচনা প্রতিক্রিয়ায় এক প্রকার নীরব ছিল আওয়ামী লীগ।

কাগজে-কলমে সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও বাস্তবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপি এখনও নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপির মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং উদ্বেগ চলছে। দুটো বিষয় নিয়ে সারা বছরই সরব থেকেছে বিএনপি।

বছরের শেষ দিকে বিএনপি বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়েছে। দীর্ঘদিন পর রাজনীতির মাঠে দেশের প্রধান বিরোধী দলকে সক্রিয় দেখা গেছে, তবে দাবি আদায়ে সফল হয়নি। নতুন বছরে তারা নতুন আন্দোলনের কথা বলে রাজনীতিতে উত্তাপের আভাস দিচ্ছে।

অন্যদিকে বছরজুড়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিভক্তি নিয়েই হিমশিম খেয়েছে আওয়ামী লীগ। চলমান ইউপি নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে তৃণমূলে এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। বিএনপি এই নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে (দলীয়ভাবে) অংশ নেয়নি। এরপরও নির্বাচনে সন্ত্রাস, সহিংসতা বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি যেমন ছিল, বিনাভোটে নৌকার চেয়ারম্যান হওয়ার রেকর্ডও হয়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তৃণমূলে ক্ষমতাসীনদের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়েছে। আগামী দিনগুলোতে তৃণমূল সংগঠিত করতে কি করা যায়, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তা আলোচনা হচ্ছে।

এদিকে গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশও রাজনীতিতে আলোচনায় এসেছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও এই দলে থাকবেন বলে আলোচনা ছিল। তিনি দলকে সমর্থন দিয়েছেন, তবে সদস্য হননি।

বছর শেষে বড় আলোচনা পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন ইসি গঠনে বিভিন্ন দলের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির করণীয় নিয়ে রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। চলমান সংলাপ জানুয়ারিতে শেষ হবে। আমন্ত্রণ পেয়েও সংলাপে যায়নি বাসদ ও সিপিবি। বিএনপিও সংলাপে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এখন নতুন ইসির রূপরেখা কেমন হবে এটাই শেষ সময়ে আলোচনা চলছে।

শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ , ১৬ পৌষ ১৪২৮ ২৬ জমাদিউল আউয়াল

নিরুত্তাপ রাজনীতির আলোচনায় ইউপি ভোট, নির্বাচন কমিশন

ফয়েজ আহমেদ তুষার

করোনা মহামারীর কারণে এবছর মাঠের রাজনীতির অনেকটই ছিল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। হরতাল, ভাঙচুর, সহিংসতা থেকে অনেকটা সরে এসেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। সেই অর্থে রাজনীতিতে উত্তাপ ছিল না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। আন্দোলন আন্দোলন বলছে, তবে কর্মসূচি ছিল সীমিত। রাজনীতিতে প্রধান চরিত্র হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। সেটাই বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল।

রাজনীতিতে সক্রিয় না থেকেও আলোচনায় ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার চিকিৎসা ইস্যুতে বছরজুড়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বাগযুদ্ধ চলেছে। বছর শেষে বড় আলোচনা প্রাধান্য পায় পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন।

নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও রাজনীতির আলোচনায় ছিল হেফাজতে ইসলাম; যার অধিকাংশ নেতাই বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সদস্য।

এ বছরেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করল। জাতির জন্য এটা অনেক বড় গর্বের। আর এ বছরেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। জাতীয়ভাবে উৎসবের আমেজে এসব অর্জন স্মরণীয় করে রাখতে ব্যাপক কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ।

তবে বছরের শুরুতেই মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপনে সরকারি কর্মসূচির বিরোধিতা করে আলোচনায় আসে ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন হেফাজত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফর বাতিলের দাবিতে মাঠে নামেন তারা। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় চালানো হয় নাশকতা। মামুনুল হকসহ হেফাজতের অনেক শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতায়ও সক্রিয় ছিল দলটি। তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ব্যাপক চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ে হেফাজত।

দলীয় নেতাকর্মীদের নানা ধরনের বিতর্কিত কাজে বিব্রত ছিল আওয়ামী লীগ। শিষ্টাচারের অভাব দেখা গেছে রাজনীতিকদের বক্তব্যে। বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশে সরকারি ও বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন, অযাচিত ভাষা ব্যবহার করে।

কুরুচিপূর্ণ কথা ও আচরণের জন্য মন্ত্রিত্ব হারানো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মুরাদ হাসান দলে ও দলের বাইরে আলোচিত হয়েছেন। দেশ ছেড়ে যেতে চাইলেও তাকে ঢুকতে দেয়নি কানাডা, ফেরত এসেছেন।

প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও আলোচনায় ছিলেন, তবে পরে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। বেফাঁস কথার জন্য বরখাস্ত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ছাত্রলীগও নানা বিতর্কিত কাজের জন্য আলোচনায় ছিল। দল ও সরকারের সমালোচনা করে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরর ছোট ভাই বসুরহাটের পৌরমেয়র মির্জা আবদুল কাদের। যদিও তার সমালোচনা প্রতিক্রিয়ায় এক প্রকার নীরব ছিল আওয়ামী লীগ।

কাগজে-কলমে সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও বাস্তবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপি এখনও নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপির মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং উদ্বেগ চলছে। দুটো বিষয় নিয়ে সারা বছরই সরব থেকেছে বিএনপি।

বছরের শেষ দিকে বিএনপি বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়েছে। দীর্ঘদিন পর রাজনীতির মাঠে দেশের প্রধান বিরোধী দলকে সক্রিয় দেখা গেছে, তবে দাবি আদায়ে সফল হয়নি। নতুন বছরে তারা নতুন আন্দোলনের কথা বলে রাজনীতিতে উত্তাপের আভাস দিচ্ছে।

অন্যদিকে বছরজুড়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিভক্তি নিয়েই হিমশিম খেয়েছে আওয়ামী লীগ। চলমান ইউপি নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে তৃণমূলে এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। বিএনপি এই নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে (দলীয়ভাবে) অংশ নেয়নি। এরপরও নির্বাচনে সন্ত্রাস, সহিংসতা বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি যেমন ছিল, বিনাভোটে নৌকার চেয়ারম্যান হওয়ার রেকর্ডও হয়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তৃণমূলে ক্ষমতাসীনদের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়েছে। আগামী দিনগুলোতে তৃণমূল সংগঠিত করতে কি করা যায়, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তা আলোচনা হচ্ছে।

এদিকে গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশও রাজনীতিতে আলোচনায় এসেছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও এই দলে থাকবেন বলে আলোচনা ছিল। তিনি দলকে সমর্থন দিয়েছেন, তবে সদস্য হননি।

বছর শেষে বড় আলোচনা পরবর্তী নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নতুন ইসি গঠনে বিভিন্ন দলের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির করণীয় নিয়ে রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। চলমান সংলাপ জানুয়ারিতে শেষ হবে। আমন্ত্রণ পেয়েও সংলাপে যায়নি বাসদ ও সিপিবি। বিএনপিও সংলাপে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এখন নতুন ইসির রূপরেখা কেমন হবে এটাই শেষ সময়ে আলোচনা চলছে।